‘ফ্রন্টিয়ার’-এ যাওয়ার আগে, সমর সেন সম্পর্কে, সত্যি বলতে কী, আমি মাত্র দু’টি কথা জানতাম: এক, উনি বাংলা ভাষার এমনই এক বিরলতম কবি, যিনি খ্যাতির শীর্ষে থাকাকালীন কবিতা-জগৎ থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়েছিলেন। এবং দুই, উনি দীনেশচন্দ্র সেনের নাতি। প্রথম প্রথম ভাবতাম, কিন্তু এখন ওঁর এই দশা কেন!
৪৫ বছর হয়ে গেল, প্রথম দিনটার কথা খুঁটিনাটি সমেত আর মনে পড়ে না। প্রথম কথা কি আমি বলেছিলাম, না, সমর সেন? হাসি বিনিময়, সামান্য হলেও, হয়েছিল কি? ঘরে কি আর কেউ ছিল? কিছুই মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে, ‘ফ্রন্টিয়ার’-এ আমার কাজ কী হবে, কাজ শিখব কার কাছ থেকে, ক’টা থেকে ক’টা পর্যন্ত অফিস– এইসব কথাবার্তা হয়েছিল। এবং দিনটা ছিল শনিবার। শনিবার-টা কেন ভুলিনি, তার একটা গল্প আছে। পরে কোনও এক সময়ে সেটা বলা যাবে ’খন।
‘ফ্রন্টিয়ার’-এ যাওয়ার আগে, সমর সেন সম্পর্কে, সত্যি বলতে কী, আমি মাত্র দু’টি কথা জানতাম: এক, উনি বাংলা ভাষার এমনই এক বিরলতম কবি, যিনি খ্যাতির শীর্ষে থাকাকালীন কবিতা-জগৎ থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়েছিলেন। এবং দুই, উনি দীনেশচন্দ্র সেনের নাতি। তা বেশ, ভাল কথা, প্রথম প্রথম ভাবতাম, কিন্তু এখন ওঁর এই দশা কেন! মলিন আসবাব নিয়ে মলিনতর একটা অফিসে বসে এক নকশালপন্থী সাপ্তাহিক সম্পাদনা করা?
আরও পড়ুন: অরুণ মিত্রর একটি কবিতা: অভিশাপ, বিস্মৃতি ও জায়মানতা
প্রথম ধাক্কাটা খেলাম মাসখানেক পর। সোয়া বারোটা নাগাদ এলেন এক বিদেশি ভদ্রলোক। সমরবাবু ডাকলেন। গেলাম। বললেন, ‘ইনি ইয়ান মিরড্যাল।’
মিস্টার মিরড্যাল বললেন, ‘হ্যালোও।’
হাসি ধরে রেখে বললাম, ‘হ্যালো।’
সমরবাবু বললেন, ‘একটু চায়ের বন্দোবস্ত করতে পারেন?’
শত অনুরোধেও সমরবাবু ‘তুমি’ বলবেন না।
কোনওরকমে ঘাড় নেড়ে দ্রুত ওখান থেকে চলে এলাম। সহকর্মী নবীকে বললাম, “চারজনের মতো চা এনো। আর ‘ইন্ডিয়ানা’ থেকে সবচেয়ে ভাল দুটো কেক। জলদি!” ‘ইন্ডিয়ানা’য় অসাধারণ কেক পাওয়া যায়। আর আমাদের অফিস থেকে মাত্র দু’-পা। দৌড়ে গেলাম পাশের ঘরে ‘দর্পণ’ পত্রিকার অফিসে। হিরণদাকে (হিরণ বসু, সম্পাদক) বললাম, ‘গেস্ট এসেছেন। দুটো ভাল কাপ-ডিশ নিচ্ছি।’
সেগুলো ধুতে ধুতে ভাবছি, উরিব্বাস, ইয়ান মিরড্যাল! ওঁর কথা শুনেছি নায়ারদার (বিক্রমন নায়ার, সাংবাদিক) কাছে। চিন বিশেষজ্ঞ বিখ্যাত সুইডিশ লেখক। দুনিয়া জোড়া নাম!
বছর দুয়েক পরের এক ঘটনা। দুপুরবেলা। এক ভদ্রলোক এলেন। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা। মফস্সলের এক কলেজে ইংরেজি পড়ান।
–এটা ফ্রন্টিয়ারের অফিস?
–হ্যাঁ।
–(কুণ্ঠিতভাবে) সমর সেন কোন জায়গায় বসেন?
আমি দেখালাম।
–একটু ওখানটায় যেতে পারি?
–হ্যাঁ, যান না।
সমরবাবুর টেবিলের সামনে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি প্রায় দু’-মিনিট।
সমরবাবুর কাছে মানুষের আসার বিরাম ছিল না। তাঁদের প্রত্যেকের, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক থেকে বাংলার মফস্সলের অখ্যাত অধ্যাপক, অভিব্যক্তিতে ঝরে পড়ত সমর সেনের প্রতি গভীর গভীরতর শ্রদ্ধা।
ততদিনে আমি অনেক কিছু জেনেছি। ‘বাবু বৃত্তান্ত’ পড়েছি। ওঁকে কাছ থেকে দেখেছি। আর নিজের আহাম্মকিতে নিজেই হেসে বলেছি, যে-ঘরে সমর সেন বসেন, সে ঘরের আসবাবের মলিনতা নিয়ে তুই মাথা ঘামাস, মূর্খ!
সমর সেনের জীবনটা একেবারে ‘অন্যরকম’। তরুণ বয়সে মাত্র কিছুকাল কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন। ইন্টারমিডিয়েট থেকে এম.এ.– সবেতেই প্রথম। রুশ থেকে বাংলায় অজস্র অনুবাদের মধ্যে আছে টলস্টয় এবং চেকভ। অথচ এসব কথা আত্মজীবনীতে লিখবেন না।
আরও পড়ুন: চুরি হয়েছিল মোনালিসা, সন্দেহের তালিকায় ছিলেন পিকাসোও! কে ছিলেন আসল চোর?
নানা জায়গায় চাকরি করে কলকাতায় থিতু হয়ে যোগ দিলেন, ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এ। সেখানে সাদা চামড়ার কর্তা আদেশ দিলেন ওঁর স্ত্রীর পুষ্পপ্রদর্শনীর খবর ‘ক্যালকাটা নোটবুক’-এ প্রকাশ করতে। সমরবাবু রাজি হননি। অতএব চাকরি নট। যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’-এ। সংবাদ নির্বাচন নিয়ে মালিকের সঙ্গে মতভেদ ও পদত্যাগ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমায়ুন কবীর নতুন সাপ্তাহিক ‘Now’ বের করলেন, সম্পাদকের দায়িত্ব দিলেন সমরবাবুকে। মাত্র কয়েক মাসে সেটা তুমুল জনপ্রিয়! কিন্তু সমরবাবু বামপন্থী, কবীর সাহেব মূলত কংগ্রেসি। অতএব দ্বন্দ্ব ও ছাঁটাই। সমরবাবু এবারে নিজে বের করলেন ‘ফ্রন্টিয়ার’। বাংলার রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষাপটে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা নিল হয়তো ‘ফ্রন্টিয়ার’, কিন্তু অর্থসংকট নিত্যসঙ্গী। অতঃপর ক্রমাগত অসুস্থতা ও মৃত্যু। কিন্তু ইস্পাতের মতো শিরদাঁড়াটাকে এতটুকু বেঁকানো গেল না।
বাংলায় এমন কিছু শব্দ আছে, যেগুলো সারাজীবনে দু’-একবারের বেশি ব্যবহার করার সুযোগ মেলে না। যেমন, ‘অনাস্বাদিতপূর্ব’। এ শব্দ ব্যবহার করা যায় সমরবাবুর আত্মজীবনী ‘বাবু বৃত্তান্ত’ সম্পর্কে। অন্য একটি শব্দ, ‘কিমাশ্চর্যম’। সমরবাবু-অনুগতপ্রাণ তিমির বসুর অক্লান্ত চেষ্টায় ‘ফ্রন্টিয়ার’ যে এখনও বের হচ্ছে, নিরবচ্ছিন্নভাবে– সেটা কি আশ্চর্য ঘটনা নয়?