নকুড়, ভীম নাগ, চিত্তরঞ্জন, কে সি দাশ, হরিদাস মোদক– বাঙালির সন্দেশি সাম্রাজ্যের অনেকটাই উত্তরমুখী। যদিও পার্ক সার্কাসের ‘মিঠাই’ কিংবা ঢাকুরিয়ার ‘সুরেশ’ কিছুটা মুখ রক্ষা করছে দক্ষিণের, কিন্তু সন্দেশের জাতবিচারে উত্তরকে প্রত্যুত্তর দেওয়ার মতো মিষ্টি দক্ষিণ এখনও বের করতে পারেনি! সন্দেশের আবার কড়াপাক, নরমপাক আছে। আগে তো মনে হত নরমপাকই সর্বোচ্চ– হালে ভীম নাগের রাতাবির নেশা ধরেছে। চিত্তরঞ্জনের কাঁচাগোল্লা, নকুড়ের গুড় ফিলিং দেওয়া সরের রোল– বেঁচে থাক আমার শীতকাল।
‘সন্দেশ’ মানে খবর, শীতকালের খবর। শীতকালে শহরে শীত পড়ে না, তা বলে পেটে সন্দেশ পড়বে না– তা হয় না কি! সারা বছরের সন্দেশ আর শীতের সন্দেশের তফাত আছে ভাইটি! দূর মফস্সল থেকে অমৃতকলস এসে পৌঁছয় মিষ্টিমহল্লায়। জীবনের এই নিগুড় রহস্য যে জন জানে সেইজন প্রকৃত জিবপ্রেমিক।
নতুন গুড়ের সন্দেশের কোনও তুলনা হয় না। পৃথিবীজোড়া এই যে এত রংবাহারি ডেসার্ট– এক গুড়ের সন্দেশের কাছে সব মুহূর্তে ফিকে! সন্দেশের কথা লিখতে গেলেই আমার প্রশান্ত নন্দীর কথা মনে পড়ে যায়। নকুড়চন্দ্র নন্দীর প্রকৃত এক জিনিয়াস উত্তরসাধক। কাঁচা ছানা দিয়ে কাস্টমাইজড গুড়ের পায়েসে একবার একটু শ্যাম্পেন ঢেলে খাইয়েছিলেন। পুরো লা ডলছে ভিটা-মিন। অমৃত আমার না খেলেও চলবে। অসময়ে চলে যান প্রশান্তদা, নকুড়ের দোকানে গেলে এখনও তাঁর স্যান্ডো গেঞ্জি-পাজামা পরা চেহারাটা ভেসে ওঠে। নকুড়ে এখনও পুরনো নিয়ম মেনে ছানা কাটানো হয় মাঝরাতে। বারকোষের উপর জুঁইফুলের মতো সদ্য কাটানো ছানা দেখাটাও কেমন যেন চোখের শান্তি। সিমলেপাড়ার এই ছানাবাজিটা তৈরি হল কোত্থেকে! ওসব পর্তুগিজদের ফিকির। দুধ থেকে ছানা কাটানোর প্রথম শিক্ষেটা ওদের থেকেই পাওয়া। ফলে ছানাসূত্র মেলালে দেখা যাবে, কলকাত্তাইয়া সন্দেশভার্সের সকলেই প্রায় হুগলিবন্ধনে অভিন্ন। গিরিশচন্দ্র ঘোষই হন, কি তাঁর জামাই নকুড় নন্দী বা ভীমচন্দ্র নাগ আর তাঁর নাতি জটাধারী নাগ– সবই হুগলিপ্রেরিত। বাঙালির মণ্ডাপ্রীতি পেরিয়ে যে সন্দেশের কৌলিন্য তৈরি হল– তার একটা কারণ অবশ্য, পুজোআচ্চা। নকুলদানা, বাতাসা না দিয়ে ঠাকুরকে গোল সন্দেশ প্রসাদ। কলকাতার সব বনেদি মিষ্টির দোকানে এখনও পুজোর মিষ্টির আলাদা সাইজ। সাধে কি দেবভোগ্য বস্তু এ জিনিস!
………………………………………
প্রশান্ত নন্দী একবার আক্ষেপ করেছিলেন, ভালো জাতের গরু যে পরিমাণ দুধ দিত আগে, তার চেয়ে কম পাওয়া যায় এখন। কাঁচামাল যদি ঠিক না হয়, সন্দেশ ভুষি হবেই। কোয়ালিটি ধরে রাখতে গেলে দাম বাড়বে ও খদ্দেরও পালাবে। আজ একটি প্রকৃত সঠিক সন্দেশের দাম, বাজারি আইসক্রিমের চেয়ে অনেক বেশি। এই দাম দিয়েও মধ্যবিত্ত বাঙালি আর সন্দেশ খেতে পারছে না। দিনে দিনে আরও বেশি করে সন্দেশের বাজার সামলাবে অ-বাঙালি ভোক্তার দল। ফলে সন্দেশের একটা জিনগত পরিবর্তন তৈরি হয়েছে বেশ কিছুটা সময় ধরেই।
………………………………………
নকুড়, ভীম নাগ, চিত্তরঞ্জন, কে সি দাশ, হরিদাস মোদক– বাঙালির সন্দেশি সাম্রাজ্যের অনেকটাই উত্তরমুখী। যদিও পার্ক সার্কাসের ‘মিঠাই’ কিংবা ঢাকুরিয়ার ‘সুরেশ’ কিছুটা মুখরক্ষা করছে দক্ষিণের, কিন্তু সন্দেশের জাতবিচারে উত্তরকে প্রত্যুত্তর দেওয়ার মতো মিষ্টি দক্ষিণ এখনও বের করতে পারেনি! সন্দেশের আবার কড়াপাক, নরমপাক আছে। আগে তো মনে হত নরমপাকই সর্বোচ্চ– হালে ভীম নাগের রাতাবির নেশা ধরেছে। চিত্তরঞ্জনের কাঁচাগোল্লা, নকুড়ের গুড় ফিলিং দেওয়া সরের রোল– বেঁচে থাক আমার শীতকাল।
প্রশান্ত নন্দী একবার আক্ষেপ করেছিলেন, ভালো জাতের গরু যে পরিমাণ দুধ দিত আগে, তার চেয়ে কম পাওয়া যায় এখন। কাঁচামাল যদি ঠিক না হয়, সন্দেশ ভুষি হবেই। কোয়ালিটি ধরে রাখতে গেলে দাম বাড়বে ও খদ্দেরও পালাবে। আজ একটি প্রকৃত সঠিক সন্দেশের দাম, বাজারি আইসক্রিমের চেয়ে অনেক বেশি। এই দাম দিয়েও মধ্যবিত্ত বাঙালি আর সন্দেশ খেতে পারছে না। দিনে দিনে আরও বেশি করে সন্দেশের বাজার সামলাবে অ-বাঙালি ভোক্তার দল। ফলে সন্দেশের একটা জিনগত পরিবর্তন তৈরি হয়েছে বেশ কিছুটা সময় ধরেই। সন্দেশ কারিগরের ছেলে এখন এমবিএ পড়তে যায়, সে আর ভোলা ময়রার ব্যাটন হাতে তুলে নেবে না। ফলে সন্দেশের যুগ পার হয়ে এখন সময় সন্দেশখালির।
সময় বদলাক বা না-বদলাক, কলকাতাকে এখনও আমি মিষ্টির দোকান দিয়েই ভাগ করি। আমার গুগলম্যাপের মিষ্টান্ন ভাণ্ডার অফুরন্ত। আর একটু ঠান্ডা পড়ুক বাংলায়। মাজদিয়ার পথ বেয়ে গুড়ের নাগরিরা গড়াগড়ি খাক কলকাতার অলিতে গলিতে। ডায়েট ভেঙে আসুন। একভাঁড় সদ্য কাটানো গরম ছানা, সঙ্গে প্রকৃত দু’চামচ গুড়– বেঁচে থাক বাঙালি। এটুকুই তো চেয়েছি আমরা– আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে/ একদলা সন্দেশ মিশিয়ে দিয়ে তাতে।
………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………….