সন্তোষ দত্তর চরিত্রে দুটো দিক ছিল। একদিকে ক্রিমিনাল ল’ইয়ার সন্তোষ দত্ত, অপরদিকে অভিনেতা সন্তোষ দত্ত। কোর্টে কেস থাকলে সন্তোষকাকু আগে থেকে ছুটি নিয়ে রাখতেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একবার শুটিং চলছে, হঠাৎ সত্যজিৎ রায় বললেন, ‘আজ সন্তোষ আসতে পারবে না, কোর্টে ওর কেস আছে।’ এমনও হয়েছে কোর্টে যে কেস নিয়ে ব্যস্ত, তার জন্য নিয়মিত পড়াশোনা করা, সেসব মেকআপ রুমে বসে করতেন সন্তোষকাকু। দেখতাম, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া, মুখে পাইপ, একমনে মোটা মোটা বইগুলোয় দাগিয়ে যাচ্ছেন। সেটা হল ল’ইয়ার সন্তোষ দত্ত। তারপর পোশাক বদলে যেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেন ওমনি হয়ে উঠতেন জটায়ু!
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
সন্তোষ দত্তর নাম উচ্চারণ করলেই যে চরিত্রটা অবিলম্বে ভেসে ওঠে, তা জটায়ু। বাংলা সিনেমায় আরও অনেক চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। তবে ‘জটায়ু’ অর্থাৎ, লালমোহনবাবুর চরিত্রে অসামান্য অভিনয়কেই বেশি মনে রেখেছি। ‘পরশপাথর’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘হীরক রাজার দেশে’-তেও সন্তোষ দত্ত দুরন্ত! বিশেষ করে, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’– বিশেষভাবে ওই দুটো সিনেমার কথা বলতে চাই। সত্যজিৎ রায়ের এই দু’টি সিনেমাতেই আমি তাঁর সহ-অভিনেতা।
পর্দার জটায়ু আর বাস্তবের সন্তোষ দত্তর মধ্যে মিল কতটা? অমিলই বা কি? এ নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই! সবার আগে সে প্রসঙ্গে আসি।
সিরিয়াস টাইপের এক ভদ্রলোক। মুখে পাইপ। গুরুগম্ভীর– স্টুডিও-তে প্রথম দর্শনে সন্তোষ দত্তকে দেখে আমার এমনটাই মনে হয়েছিল। আমরা সিনেমায় জটায়ুকে যেভাবে দেখেছি, সামনাসামনি জটায়ু অর্থাৎ সন্তোষ দত্ত মোটেই তেমন ছিলেন না। সুতরাং, প্রথম দিকে ভাবতাম, এ কেমন ব্যাপার! কিন্তু ক্যামেরা অন হলেই জটায়ু হাজির হত সন্তোষ দত্তর মধ্যে থেকে। সিন চলাকালীনও অনেক সময় হাসি চাপতে পারতাম না। সেসব মুহূর্ত সিনেমাতেও রয়েছে। এমন অনেক দৃশ্য আছে যেখানে জটায়ু কোনও ভুল করেছেন, ফেলুদা শুধরে দিচ্ছে, আমি পাশে দাঁড়িয়ে হাসছি। আসলে ফেলুদার সঙ্গে জটায়ুর সম্পর্কের রসায়নটা দুর্দান্ত! আমার ধারণা, সত্যজিৎ রায় জটায়ু চরিত্রটার মাধ্যমে এটাই হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, বইয়ের কাটতি ভালো মানেই যে সেই বইয়ের কোয়ালিটি খুব ভালো, তা নয়। অনেক ট্র্যাশ লেখাও খুব ভালো বিক্রি হয়। ঘুরিয়ে বাঙালি পাঠকদের বলতে চেয়েছেন যেন, একটু খেয়াল-টেয়াল করে বইপত্তর পড়া উচিত। যে জন্য জটায়ুকে ফেলুদা বলছে– সপ্তম এডিশনে শুধরে নেবেন। মানে ছ’টা এডিশন আপনি ভুল লিখে চালিয়েছেন মশাই। ইনফরমেশনটাই ঠিকঠাক নেই। অথচ বই বিক্রি হচ্ছে, পাঠক গপগপ করে গিলছে! সেই ভুলের সঙ্গে জটায়ু চরিত্রটা মিলে মিশে গিয়েছিল। জটায়ু চরিত্রটাও বারবার স্বীকার করছে বিভিন্ন ডায়লগের মাধ্যমে যে, ভুলটা কোনও ব্যাপার না। গোটাটাই নেহাত মামুলি ব্যাপার। কনফিডেন্টলি নিজের ভুলগুলো জটায়ু জানতেন, সেগুলো শুধরে নেওয়ার ক্ষেত্রে জটায়ুর যে অভিব্যক্তি, সেটা লেখায় হোক কিংবা সিনেমা– আমরা সবাই খুব উপভোগ করেছি।
বাস্তব জীবনে আমরাও তো কত ভুল করি, কত ভুল জানি, অথচ আমাদের শুধরে দেওয়ার জন্য কোনও ফেলুদা সামনে থাকে না। জটায়ু চরিত্রের এই ভুলেভরা অথচ সবজান্তা মিশ্রণটা সন্তোষ দত্তর মতো একজন ক্রিমিনাল ল’ইয়ার, যিনি পেশাগত ভাবে আইনজীবী, তাঁর অভিনয়ে দারুণ মেলে ধরেছেন। সচরাচর এটাই হয়। নাটকের কলাকুশলীরা যখন রুপোলি পর্দায় অভিনয় করেন, তা যে কতটা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে, সেটার বড় প্রমাণ হচ্ছেন সন্তোষ দত্ত।
প্রথম দর্শনে দেখা সেই গুরুগম্ভীর মানুষটাই কিন্তু পরে খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। সম্পর্কটা এমন হয়ে গিয়েছিল যে, নানা প্রশ্ন নির্দ্বিধায় করে বসতাম। এমনকী, আইনের ব্যাপারেও! জিজ্ঞাসা করতাম, ‘তোমরা কেন এত মোটা মোটা বইগুলো পড়ে দাগাও বল তো?’ বাচ্চা ছেলে বলে কিন্তু এড়িয়ে যেতেন না। যত্নসহকারে বোঝাতেন। সেই শেখানো বা বোঝানো, সেটাও করতেন খুব ধৈর্য সহকারে। এসবের মধ্যে দিয়েই সন্তোষ দত্ত কখন আমার কাছে ‘সন্তোষকাকু’ হয়ে উঠলেন, তা ঠিক মনে নেই।
পরবর্তীকালে আমার বাড়িতে, পারিবারিক অনুষ্ঠানে, বিয়েতেও সন্তোষকাকু সপরিবারে এসেছেন। অথচ খেয়াল করলে দেখবেন, আমি তাঁর সঙ্গে অভিনয় করেছি মাত্র দু’টো ছবিতে। একজন কো-অ্যাক্টরের সঙ্গে সম্পর্কে হৃদ্যতা না থাকলে পরিবার নিয়ে তার বিয়ে কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানে আসা যায় নাকি! এমন নয় যে, আমি তখন নিয়মিত অভিনয় করছি। আমার সঙ্গে সন্তোষকাকুর নিয়মিত দেখা হচ্ছে, তাও নয়। অথচ আমার পাশে সবসময় সন্তোষকাকু থাকতেন। এটাই একটা ভালো মানুষের সবচেয়ে বড় দিক। এমনটাই ছিলেন সন্তোষ দত্ত।
এখন, যখন পুরনো ছবিগুলো দেখি, সন্তোষকাকুকে ঘিরে সেই স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। শুধু বিয়ে কেন, আমার উপনয়নের সময়ও সন্তোষকাকু এসেছিলেন। ‘সোনার কেল্লা’ শুটিং-এর শেষ পর্যায়ে আমার পইতে হয়েছিল। তখন শুটিং ইউনিটের অনেকেই এসেছিল। খুব হই হই হয়েছিল। শুধু সন্তোষকাকু নয়, মন্দার বোস মানে কামু মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন। সত্যজিৎ রায় এসেছিলেন। আসলে তখনকার সময়ে অভিনেতা তথা আর্টিস্টদের মধ্যে সম্পর্কটা এমনই ছিল। আজকাল সেটা হয়তো অনেক কম চোখে পড়ে।
সন্তোষ দত্তর চরিত্রে দুটো দিক ছিল। একদিকে ক্রিমিনাল ল’ইয়ার সন্তোষ দত্ত, অপরদিকে অভিনেতা সন্তোষ দত্ত। কোর্টে কেস থাকলে সন্তোষকাকু আগে থেকে ছুটি নিয়ে রাখতেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একবার শুটিং চলছে, হঠাৎ সত্যজিৎ রায় বললেন, ‘আজ সন্তোষ আসতে পারবে না, কোর্টে ওর কেস আছে।’ এমনও হয়েছে কোর্টে যে কেস নিয়ে ব্যস্ত, তার জন্য নিয়মিত পড়াশোনা করা, সেসব মেকআপ রুমে বসে করতেন সন্তোষকাকু। দেখতাম, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া, মুখে পাইপ, একমনে মোটা মোটা বইগুলোয় দাগিয়ে যাচ্ছেন। সেটা হল ল’ইয়ার সন্তোষ দত্ত। তারপর পোশাক বদলে যেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতেন ওমনি হয়ে উঠতেন জটায়ু! এই যে দুটো দিকে ভারসাম্য রেখে চলা, একদিকে উকিল সন্তোষ দত্ত, আরেকজন জটায়ু অর্থাৎ ফিকশন লেখকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া– আমায় খুব অবাক করত। ভাবতাম, একটা মানুষের পক্ষে কী করে সম্ভব! একটু আগে যে মানুষটাকে ভুরু কুঁচকে আইনের মোটা বইয়ে ডুবে থাকতে দেখছিলাম, তার জায়গায় এই মানুষটা কোথা থেকে এল! আসলে সন্তোষ দত্ত এতটাই শক্তিশালী, বলিষ্ঠ অভিনেতা যে, দুটো দিকে তাল মিলিয়ে চলতে পারতেন। অভিনয়টা তাঁর স্বভাবজাত, খুব স্বতঃস্ফূর্ত সেই অভিনয়।
শুটিং চলাকালীন সত্যজিৎ রায় অভিনয় করে খুব যে শট বুঝিয়ে দিতেন সন্তোষকাকুকে, তা নয়। বড়জোর বলতেন, ‘সন্তোষ, এই দেখো, এমন একটা ব্যাপার আছে। দেখে নাও, কী করতে হবে।’ এই যে অভিনেতার ওপর একজন পরিচালকের এই কনফিডেন্স, সেটাই আসল ব্যাপার। আর সেই প্ল্যানিংটা সন্তোষকাকুর হয়তো আগে থেকেই করে রাখতেন। কারণ, যখন ক্যামেরার সামনে শটটা ডেলিভারি করতেন, তা একদম পারফেক্ট হত। সেটাকে কাটাছেঁড়া করা যেত না। এতটাই অতুলনীয় ছিলেন অভিনেতা সন্তোষ দত্ত।
সন্তোষ দত্তর বাড়িতে গিয়েছি বহুবার। সন্তোষকাকুর স্ত্রী অর্থাৎ কাকিমার সঙ্গেও আলাপ ছিল। তবে অভিনয় জগৎ আর পরিবার দুটোকে কখনও মিশিয়ে ফেলেননি। পরিবারের কারও সঙ্গে ফিল্মের কোনও যোগাযোগ বা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়নি কখনও। কিন্তু বরাবর সামাজিক সম্পর্কটা দারুণভাবে বজায় রাখতে জানতেন। খুব ভদ্র এবং মার্জিত একজন মানুষ, ইউনিটের সকলের কাছেই যিনি ‘সন্তোষদা’– কোনও ঝুটঝামেলায় নেই। পরিস্থিতি যেমনই হোক মানিয়ে নিতে জানতেন। মুখে কখনও টুঁ শব্দ করতে দেখিনি। এমন মানসিকতার মানুষ আজকের দিনে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
এ প্রসঙ্গে আরেকজনের কথা না-বললেই নয়। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সবার চোখে তিনি তারকা হতে পারেন, আমার কাছে তিনি সৌমিত্রকাকু। সন্তোষ দত্ত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতারা সহ-অভিনেতাদের যত্ন করতে জানতেন। আন্তরিকতা বজায় রেখে তাঁরা অভিনয় করতেন। সহ-অভিনেতাদের উৎসাহিত করতেন।
অভিনয়ে ডায়লগের টাইমিং, সেই থ্রোয়িং যেমন রবি ঘোষের দুর্দান্ত ছিল, তেমনই দারুণ ছিল সন্তোষ দত্তেরও। সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ কিংবা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ খেয়াল করে দেখবেন, সন্তোষ দত্তের ডায়লগ থ্রোয়িং কতটা অসাধারণ। এগুলো আসলে সন্তোষ দত্তের ন্যাচারাল অভিনয়। আরোপিত নয়। শিখিয়ে-পড়িয়েও নিতে হত না। ‘তং মৎ করো… জাদা হো গিয়া…’ – কীভাবে বলতে হবে, সেটা সত্যজিৎ রায়কে বুঝিয়ে দিতে হয়নি, ওটা সন্তোষ দত্তের ক্রিয়েশন। এমনকী ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ মগনলাল মেঘরাজের ঘরে, ওই নাইফ-থ্রোয়িংয়ের সময় ব্যাপারটা কী রকম হতে পারে, সেটা আমরা দেখেছি, কিন্তু সেখানেও সন্তোষ দত্ত খুব ন্যাচারাল অভিনয় করেছেন। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ তো উৎপল দত্তর মতো অসাধারণ অভিনেতা ছিলেন। আমার তো মনে হয়, মগনলালের ঘরে, ওই সিনে ফেলুদা ডাউন হয়ে গিয়েছিল, সেটা উৎপলজেঠুর অভিনয়ের গুণে। একজন ভিলেন হিরোকে ডাউন করছে, সেটা মারপিট করে নয়, শুধুমাত্র ডায়লগ আর অভিনয়ের ক্ষমতা দিয়ে, জাস্ট ভাবা যায় না। সেখানেও উৎপলজেঠুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে গিয়েছেন সন্তোষকাকু।
………………………………………
আরও পড়ুন সন্তোষ দত্ত-কে নিয়ে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়-এর লেখা: জটায়ু সত্যজিতের, কিন্তু কপিরাইট সন্তোষ দত্তর
………………………………………
তবে ‘সোনার কেল্লা’য় অভিনয়ের সময় নয়, অভিনেতা সন্তোষ দত্তকে প্রথম দেখেছিলাম ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এ। দেখেই মুগ্ধ হয়েছি। সে যখন সামনে এসে পৌঁছল ‘সোনার কেল্লা’য়, তখন মুগ্ধতার বশে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম মানুষটা দিকে। ভাবতাম, শুণ্ডির রাজা কীভাবে জটায়ু হবে, তারপর ক্যামেরা অন হতেই দেখলাম ম্যাজিক! এমনটাই ছিল সন্তোষ দত্তর অভিনয় দক্ষতা। সত্যজিৎ রায় তো নিজেই বলেছেন, ‘সন্তোষ যখন চলে গিয়েছে, আমি আর তিন নম্বর ফেলুদা করতে পারব না।’ এর চেয়ে বড় কমপ্লিমেন্ট আর হয় নাকি! ওই শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়।
সব শেষে একটা কথাই বলার, সন্তোষ দত্ত যে মাপের অভিনেতা, তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন এখনও পর্যন্ত করা সম্ভব হয়েছে বলে আমি মনে করি না। সে সময়েও হয়নি, আজও না। বরাবর প্রচারের আলোর বাইরেই থেকে গিয়েছেন অভিনেতা সন্তোষ দত্ত।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………