Robbar

বর্মের আড়াল থেকে বেরিয়ে আজ নিজের অবশেষটুকু দেখে নিন!

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 23, 2025 8:08 pm
  • Updated:May 24, 2025 10:54 am  

নিজের জন্য তাই একটা বর্ম কেনেন ড্যানি উ। দৈনিক ৩০ ইউয়ান মূল্যে রোজ আট ঘণ্টা করে সপ্তাহে ছ’দিন নিজেকে লুকিয়ে রাখার ‘প্রিটেন্ড টু ওয়ার্ক’ বর্ম। হয়তো ড্যানির অন্যরকম কিছু ভাবা উচিত ছিল, আরও স্মার্ট কিছু, আজকের পৃথিবী যেমন শেখায়। কিন্তু এই ‘স্মার্ট’ ভাবনার যুগে ড্যানির মতো আমরা যারা ‘স্মার্ট’ অর্থে শিশুকালে জানতাম ‘কনফিডেন্ট’, বড়বেলায় জানলাম ‘ইন্টেলিজেন্ট’ আর কোনও দিনই জানলাম না যে ‘ইন্টেলিজেন্ট’কে ‘ইন্টেলিজেন্ট’ এর বদলে স্মার্ট বলে কী সুবিধাটা হল, তারা আরও ঘোল খেয়ে যাই। 

প্রহেলী ধর চৌধুরী

চিনের ব্যস্ত শহর চাংকিং। এ-শহরের আর পাঁচজন চাকরিজীবীর মতোই প্রতিদিন সকালে কাজে বেরন ড্যানি উ। ফেরেন সন্ধে পেরিয়ে। তফাত হল, বাকিদের মতো ড্যানির কোনও চাকরি নেই। সে যায় ‘প্রিটেন্ড টু ওয়ার্ক’ কোম্পানিতে। দৈনিক ৩০ ইউয়ান বা সাড়ে ৩০০ টাকার বিনিময়ে সপ্তাহে ছ’ দিন আট ঘণ্টা সময় কাটিয়ে আসে। মিছিমিছি এই কাজের জায়গায় সত্যিকারের অফিসের মতোই বসার টেবিল, কাজের ডেস্ক, আর কাজ না-করা কম্পিউটার, টেলিফোন আছে। ড্যানির মতো আরও বেশ কিছু মানুষ এখানে আসে। তাস কিংবা ভিডিও গেম খেলে। সত্যি চাকরির দরখাস্তও করে। তারপর সন্ধে হলে বাড়ি ফিরে যায়।

গোটা চিন জুড়ে আজ এমনই ‘প্রিটেন্ড টু ওয়ার্ক’ কোম্পানির ছয়লাপ। আগেও ছিল, কোভিডের পর রমরমা বেড়েছে। ড্যানি উ-র মতো যে বিপুল সংখ্যক মানুষের চাকরি গেল কোভিডে, তাদের অনেকেরই এখনও কাজ জোটেনি। কেউ কেউ অবশ্য জোটানোর চেষ্টাও করেনি। ড্যানিই যেমন। রিটায়ারমেন্টের মাত্র বছর পাঁচেক বাকি। এদিকে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন নেই। একমাত্র ছেলে বিদেশে সেটেলড। নিজেও কোনও দিন নেশা বা অকারণ বিলাসিতা করেননি। গুছিয়ে সঞ্চয়ও করেছেন। উপরন্তু পিতৃপুরুষের বাড়ি, ছোট ভাইয়ের সঙ্গে শরিকি হলেও, আছে। অন্তত লোন নিয়ে বাড়ি বানাতে হয়নি বলে সঞ্চয়ে টান পড়েনি কোনওদিন। অর্থাৎ, মোটের ওপর আতিশয্য না থাকলেও অভাব নেই ড্যানি উ-র। কিন্তু সংসারে অর্থের অভাবই শেষ কথা নয়। আরও অনেকরকম অভাব তাতে থাকে। আর বয়সকালে যে অভাবটা সবচেয়ে বেশি পেয়ে বসে, তা হল সম্মানের অভাব। 

…………………………………………

আজ ২৩ মে দিনটি তাই আমাদের কাছে বিশ্ব কচ্ছপ সংরক্ষণ দিবস নয়, পারসোনিফিকেশনের দিন। নিজেকে খোঁজার দিন। খোলের আড়ালে লুকিয়ে রাখা নিজের ক্ষয়িষ্ণু সত্তাটাকে আরেকবার সামাজিক লেন্সে ঝালিয়ে দেখার দিন– কোথাও আছি কি অবশেষ?

…………………………………………

ড্যানির খুব ইচ্ছে করে গিন্নিকে সবটা খুলে বলেন। তারপরের দিন বেলা করে ঘুম থেকে উঠে আয়েশ করে চা খান, গিন্নির সঙ্গে সংসারের কাজে খানিক হাত লাগান, দুপুরবেলা লাঞ্চ করেন একসঙ্গে, বিকেলবেলা একটু হাঁটা কিংবা একটা সিনেমা। কিন্তু ঠিক কীভাবে ব্যাপারটা বললে যে সব ঠিক থাকবে, তার এই ছাপোষা বোকা বোকা ইচ্ছেগুলো দাম পাবে, ঠাওর করতে পারেন না ড্যানি। স্ত্রী যদি বা মেনে নেয়, ভাই, ভাইয়ের বউ কী বলবে? আত্মীয় আর পাড়া-প্রতিবেশীর কথা তো বাদই দিলাম… কিন্তু ছেলে? এমনিতেই ভালো করে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারেন না ড্যানি, স্মার্ট ঘড়ি পরেন না, স্মার্ট টিভির চ্যানেল বদলাতে সাউন্ড বাড়িয়ে ফেলেন বলে ছেলে দু’-একবার ছুটিতে বাড়ি ফিরে কথা শুনিয়েছে, ‘ও দেশে থাকল, তুমি চলতে কী করে বাপি!’

নিজের জন্য তাই একটা বর্ম কেনেন ড্যানি উ। দৈনিক ৩০ ইউয়ান মূল্যে রোজ আট ঘণ্টা করে সপ্তাহে ছ’দিন নিজেকে লুকিয়ে রাখার ‘প্রিটেন্ড টু ওয়ার্ক’ বর্ম। হয়তো ড্যানির অন্যরকম কিছু ভাবা উচিত ছিল, আরও স্মার্ট কিছু, আজকের পৃথিবী যেমন শেখায়। কিন্তু এই ‘স্মার্ট’ ভাবনার যুগে ড্যানির মতো আমরা যারা ‘স্মার্ট’ অর্থে শিশুকালে জানতাম ‘কনফিডেন্ট’, বড়বেলায় জানলাম ‘ইন্টেলিজেন্ট’ আর কোনও দিনই জানলাম না যে ‘ইন্টেলিজেন্ট’কে ‘ইন্টেলিজেন্ট’ এর বদলে ‘স্মার্ট’ বলে কী সুবিধাটা হল, তারা আরও ঘোল খেয়ে যাই। 

This may contain: a painting of a woman with her back turned to the camera, wearing a yellow necklace
সূত্র: ইন্টারনেট

ঘোল খেয়ে যায় আমাদের সহজাত কল্পনা আর ইচ্ছেগুলো। আমরা যারা মহালয়ার ভোরে সত্যি সত্যিই মেঘের ফাঁকে দুর্গা-অসুরের লড়াই দেখতে পেতাম কিংবা শঙ্খ ঘোষের ‘মিথ্যে কথা’ কবিতার মতো নোনা দেওয়ালে পশুরাজের ঝলমলে কেশর আবিষ্কার করতাম, তারা আজ ক্রমশ গুটিয়ে যাই। নিজের ‘আনস্মার্টনেস’ লোকাতে সিঁধিয়ে যাই নবনির্মিত সামাজিক বর্মের আড়ালে। আমরা যারা নিজের কথা, নিজের গৌরবের কথা, অ্যাচিভমেন্টের কথা নিজের মুখে বলতে শিখিনি কোনও দিন, ‘ব্লো ইয়োর ওন ট্রাম্পেট’ শুনে পশ্চিমি দেখনদারি বলে নাক সিঁটকিয়ে হরিশচন্দ্র মিত্র আওড়ে বলেছি– ‘আপনারে বড় বলে বড় সে তো নয়/ লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়’; এই কল্পনাহীন, ফেক স্মার্ট-ওয়ার্ল্ডে তাদের জায়গা নেই। আজ ২৩ মে দিনটি তাই আমাদের কাছে বিশ্ব কচ্ছপ সংরক্ষণ দিবস নয়, পারসোনিফিকেশনের দিন। নিজেকে খোঁজার দিন। খোলের আড়ালে লুকিয়ে রাখা নিজের ক্ষয়িষ্ণু সত্তাটাকে আরেকবার সামাজিক লেন্সে ঝালিয়ে দেখার দিন– কোথাও আছি কি অবশেষ?

এ-প্রশ্নের উত্তর চ্যাটজিপিটি দেবে কি না জানি না, কিন্তু আমাদের নিত্যদিনের বোকা বোকা গল্পগুলো যে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে, সহজে প্রকাশ করা যাচ্ছে না কিছুই, সবকিছুই ক্রমাগত অস্থির, প্রতিযোগী আর ঘোর বস্তুবাদী হয়ে উঠছে, তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছি।  

এই তো কয়েকবছর আগের কথা। জন্মদিনের পার্টিতে আলাপ হল ক্লাস থ্রি-এর এক খুদের সঙ্গে। কথায় কথায় জিগ্যেস করলাম:

– কোথায় থাকো?

– সাউথ সিটি।

আমি স্বাভাবিক মৃদু হেসে তার গাল টিপে আদর করে উঠে আসছি, পাশের আরেক খুদে বলে উঠল:

– দিদি উয়ো সাউথ সিটি নেহি রহতা হ্যায়। বস অ্যায়সা বোলতা হ্যায় তা কি আপ উসকো কুছ বড়া সমঝো।

জীবনের হাতেগোনা কিছু হতবাক হওয়ার স্মৃতিতে আজীবন রয়ে যাবে সেই মুহূর্তটি– ‘ও সাউথ সিটিতে থাকে না, কিন্তু অমনটা বলে– যাতে সবাই ওকে খুব বড় কিছু একটা ভাবে।’

This may contain: a man is looking into a mirror with his face in the mirror and holding a cup
সূত্র: ইন্টারনেট

আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কী বলব, কোথা থেকে বলা শুরু করব, ভেবে পাচ্ছি না। ক্লাস থ্রি-র শিশুটি তখন হালকা আনতমুখ; লজ্জা নয়, প্রবল রাগ নিয়ে বন্ধুটির দিকে তাকিয়ে। আমি ঘোর কাটিয়ে তার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বললাম,

– শুনো, তুম কিতনা উঁচাই পে রহতে হো উসসে তুম বড়া নেহি বনতে হো। তুমহারা দিল অউর সোচ জিতনা বড়া হোগা, তুম উতনা উঁচাই পে যাওগে।

এরপর ঘটল সেই কেলেঙ্কারিটি। সে বুঝেছে সে ধরা পড়ে গেছে। আপন আদরের বর্মটি, তা সে যত ঠুনকো, যত মিথ্যের, যত লজ্জারই হোক না কেন, সেই ছিল তার একমাত্র পরিচয়, ‘শিভালরি’ রক্ষার একমাত্র হাতিয়ার। আমার জ্ঞানবাক্যে তার বর্মে চির ধরেছে। সে বুঝেছে আমি জানতে পেরেছি তার আসল সত্তা, যা নিতান্তই সাধারণ নাগরিকের। এখন এই ক্ষুদ্র মার্জার-মাফিক জীবন, যা দুঃসহ রকমের সত্য, এক্কেবারে সাধারণ রক্তমাংসের, তা নিয়ে সে করবেটা কী? 

তাই চোখের পলকে সে ছুটে গেল সামনের দেওয়ালে। সজোরে মাথা ঠুকতে লাগল। নেহাত জনবহুল নিমন্ত্রণ বাড়ি। তাই সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে মাথা ফাটার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া গেল।

আজও ভাবি, সেই শিশুটি, বয়স কত হবে– আট? যে বয়সে শুধু রূপকথার স্বপ্নপুরীর সঙ্গী হওয়ার কথা ছিল তার; কথা ছিল বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি করার, পড়া ফাঁকি দেওয়ার, জোনাকি ধরার আর মাকে ছাড়া ঘুম না আসার– সে-বয়সে নিজের সব সাবলীল, অকিঞ্চিৎকর ইচ্ছেগুলোকে এমন স্বনির্মিত মেকি বর্মের আড়ালে কী করে লুকিয়ে ফেলল সে? কী করে অতটুকু বয়সেই হয়ে উঠল জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায়? সর্বজ্ঞ মেকি আয়োজনের মাঝে নিকের অস্তিত্বটাকেই ভুলে গেল বেমালুম?

এই যে একটা ঝাঁ-চকচকে আপাত আয়োজনের মাঝে আপন সাদাসিধে ইচ্ছেগুলোকে লুকিয়ে রাখার, আপন কল্পনার জগৎটাকেও এআই দিয়ে হোয়াইট ওয়াশ করে দেখনদারির পৃথিবীর সঙ্গে নিজের নাকেও দড়ি পরিয়ে ক্রমাগত বনবন ঘুরতে থাকার অমোঘ আকর্ষণ, একেই কি তবে জীবন বলে ডাকব? 

তবে সভ্যতার কী হবে? ইয়ুভাল নোহা হারারি যে বলেছিলেন, আমরা মানুষেরা বাকি প্রাণীদের থেকে উন্নত হতে পেরেছি শুধু এই কারণেই যে আমরা সকলে মিলে একই সময়ে, একসঙ্গে একটা গল্পে বিশ্বাস করেছি…

হয়তো বোকা বোকা, খানিক সিলি, তবু এই গল্পগুলোই আমাদের জীবন ছিল। সভ্যতার ভিত্তি ছিল। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে সেই কল্পনাগুলোই যদি ক্রমাগত সেঁধিয়ে যায় মেকি খোলের অন্তরালে, তবে কি আমাদের গল্প লিখবে চ্যাটজিপিটি?