ক্রীড়া-মনোবিদ, ডা. নানকি জে চাড্ডা বলছেন, ‘একথা ঠিক। সোশাল মিডিয়া এ যুগের ক্রিকেটারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।’ ইন্সটাগ্রামে ফলোয়ার সংখ্যার নিরিখে, বিরাট কোহলি স্থান পৃথিবীতে তৃতীয়। ডাক্তার চাড্ডা আরও বললেন, ‘আমার বিশ্বাস, কোহলি নিজেকে, নিজের খেলা, নিজের দল সর্বোপরি নিজের পরিবারের ওপর গভীর মনোনিবেশ করতে পেরেছেন। ফলে বহু নেতিবাচক মন্তব্য থামিয়ে দিতে তিনি সফল। বহির্বিশ্বের পরিবর্তে দৃষ্টি রেখেছেন অন্তরে।’ আজ বিরাট কোহলির ৩৫তম জন্মদিন।
আমাদের এই সোশাল মিডিয়াসর্বস্ব পৃথিবীর জলহাওয়ায়, প্রথম বেড়ে উঠেছিল ভারতের কোন ক্রিকেটীয় সুপারস্টার? উত্তরটা সহজ– অবশ্যই বিরাট কোহলি। তাই প্রতিটি ক্রীড়া-সম্প্রচারক টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিটি ম্যাচে নির্দিষ্ট একটি ক্যামেরা বরাদ্দ করে রাখে বিরাটের জন্য। যতক্ষণ খেলা, ততক্ষণ জুম ইন। জুম আউট। যেন খুঁড়ে দেখতে চায় আবেগ। এদিকে, প্রশান্ত এবং আগ্রাসী বিরাট কোহলি– দুই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী শব্দ। অথচ ক্রিকেটের মধ্যেই কিন্তু বিরাট খুঁজে পেয়েছেন অন্তরের নিবিড় শান্তি। নইলে কি টিকে থাকতে পারতেন? এতগুলো টানা মরশুম!
দীর্ঘ ১৫ বছরের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার। এযাবতকালে সোশাল মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে অসংখ্যবার। কেন্দ্রে বিরাট কোহলি। ঠিক এরপরেই যখন, ১৮ নম্বর জার্সি গায়ে, ব্যাট করতে নামছেন! কভার ড্রাইভের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আস্ত শরীর। দেখে মনে হয় যেন একজন ধ্যানী। এই ধ্যানমগ্নতাই তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ।
সাফল্য কী? ক্ষমতাই বা কী? বিরাট তা পরিমাপ করে নিয়েছেন নিজের প্রতিটি ইনিংসের নিরিখে। দলের জন্য কতখানি কার্যকর সে– এই প্রশ্নই সেই সাফল্যের ভিত্তি। সোশ্যাল মিডিয়ার ফলোয়ার সংখ্যা সেখানে ভিত্তিহীন!
সত্যি বলতে, বিরাট কোহলির যে প্রতিভা, তা দিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে তিনি সক্ষম। পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন ক্রিকেট-উপযুক্ত শরীর, তেমনই রপ্ত করেছেন ক্রিকেটের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলি। ইন্সটাগ্রামের ২৬২ মিলিয়ান ফলোয়ার এবং টুইটারের ৫৮.৭ মিলিয়ান ফলোয়ার যখন নির্ধারণ করছিল, বিরাট কোহলি কী করবেন অথবা করবেন না, কিংবা কী বলবেন আর কী বলবেন না– তখন, সেই সংখ্যাতীত প্রতিক্রিয়া থেকে নিজের মস্তিষ্ককে বিচ্ছিন্ন করে ডুব দিয়েছেন ক্রিকেটে। এই সময়েই তো তাঁর অসীম প্রশংসা প্রাপ্য!
আরও পড়ুন: অজস্র ট্রফি-সহ, জলসংকটের বার্সেলোনায় কয়েক ফোঁটা অশ্রু রেখে গিয়েছিলেন মেসি
মার্চ মাস। ২০০৬। টুইটারের যাত্রাপথ শুরু হল। দু’-বছর পরেই, অর্থাৎ ২০০৮ সালের অগাস্ট মাসে, একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট-দুনিয়ায় প্রথমবারের জন্য আবির্ভূত হলেন বিরাট কোহলি। আর যখন ইন্সটাগ্রাম মানুষের দুয়ারে পৌঁছল, ২০১০-এর অক্টোবরে, ঠিক পরের বছরই, জুন মাসে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক। একমাত্র সোশাল মিডিয়ার এই ক্রমবিকাশের প্রেক্ষাপট লক্ষ করলেই, আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে কী বিপুল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি! একেবারে গোড়া থেকেই।
এ তুলনা অমূলক। তবু এই নিরীক্ষণের প্রয়োজন আছে। চটজলদি। সাল ১৯৮২। যখন সমগ্র ভারত প্রেমে পড়তে শুরু করেছে রঙিন টেলিভিশনের! তখন কপিল দেব ফর্মের চূড়ায়! আবার নয়ের দশকের সূচনাপর্বে, শচীন তেন্ডুলকারের উত্থান এবং গোটা দেশে কেবল এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনের আগমন-বার্তা– মিলেমিশে একাকার। কী আশ্চর্য! মহেন্দ্র সিং ধোনি উঠে এসেছিলেন শচীন তেন্ডুলকার এবং বিরাট কোহলির মধ্যবর্তী সময়ের অভ্যন্তর থেকে।
আরও পড়ুন: নতুন দেশ আবিষ্কারের স্বপ্নে ক্রিশ্চিয়ানোই ফুটবলের ভাস্কো দা গামা
বিশ শতাব্দীর শুরুতে, ভারতে হুহু করে গজিয়ে উঠেছিল যে সমস্ত কেবল এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশন নিউজ চ্যানেল, তারা যদি গত প্রজন্মের ক্রিকেটারদের কাটাছেঁড়া করে, তবে এ-যুগে, বিরাট কোহলিই প্রথম ক্রিকেটার যিনি লক্ষ লক্ষ ব্যক্তিগত অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে, একটি নির্মম পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন। হচ্ছেন। প্রতিনিয়ত। সোশাল মিডিয়া আসলে যে কোনও ক্রিকেটার এবং অন্য সমস্ত ক্রীড়াবিদকে ওই অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচেই এনে ফেলে।
নিঃসন্দেহেই সোশাল মিডিয়া একইসঙ্গে আশীর্বাদ ও অভিশাপ। তেমনই হতে পারে একটি দুর্দম ভার।
এমন নয় যে, বিগত বছরে ক্রিকেট অনুরাগীদের কোনওরকম ব্যক্তিগত মতামত ছিল না। শুধু ছিল না মতপ্রকাশের এই বিনে-পয়সার প্ল্যাটফর্ম। কেউ একে-অন্যের গায়ে অকথ্য ভাষায় ঘেন্না ছিটিয়ে দেয়নি, কারণ তারা তো এক অথবা একাধিক ক্রিকেটারের ভক্ত! অনুরাগীদের এহেন আচরণে বিরাট কোহলি কিংবা তাঁর সতীর্থরা উদ্বেলিত হতেন না নিশ্চিত। কিন্তু আজ শুধুমাত্র সেই ক্রিকেটীয় ভক্তি থেকে অনুরাগীরা সরে গেছে। অনেক দূরে।
বিরাট কোহলি প্রতিটি সোশাল মিডিয়া পোস্টের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ দাবি করেন– মনে পড়ে, এ-কথা তাঁকে অস্বীকার করতে বাধ্য করা হয়েছিল? যখন লকডাউন চলছে, বিরাটের এক প্রতিবেশী সে সময় আচমকা একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন। সেই ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, স্ত্রী অনুষ্কা শর্মার সঙ্গে বিরাট ক্রিকেট খেলছেন! এই সমস্তটাতেই যদি গভীর মনোযোগ দেওয়া যায়, আমরা ঠিকই বুঝতে পারব কোন অস্থিরতার মধ্যে ছিলেন বিরাট!
কেউ বলতেই পারেন, এ আর এমন কী?
আরও পড়ুন: এই ক্রিকেট বিশ্বকাপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলের জন্য একটি লেট-কমেন্ট্রি
দেখা যাক, ফুটবল-বিশ্বের অন্যতম সফল ম্যানেজার, অ্যালেক্স ফার্গুসন, কোন চিন্তাভাবনার হদিশ দিয়েছেন তাঁর বইয়ে! তিনি বলছেন, ‘‘আমার পরম সৌভাগ্য যে, কেরিয়ারের সিংহভাগ সময়টাতেই আমাকে লড়াই করতে হয়নি। সোশাল মিডিয়ায়। ‘দ্য সান’ অথবা ‘ডেইলি মিরর’-এর মতো সংবাদপত্রের তুলনায় টুইটার-ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের নিত্যদিনের খোঁজখবর নেওয়া অনুরাগীদের বরং বেশি।
ফার্গুসন লিখছেন, ‘কেউ কেউ এমনও বলে যে, গায়ের চামড়া মোটা না হলে যাবতীয় অকথা-কুকথার সঙ্গে মোকাবিলা করা অসম্ভব! বিশেষত টুইটারে। সেই সমস্ত মন্তব্য অশ্লীলতাকে ছাপিয়ে যেতে পারে বহুমাত্রায়। তবু একজন ফুটবল-ম্যানেজার হিসেবে যা-কিছুর মুখোমুখি হতে হয়েছে, সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন বোদ্ধাদের সৌজন্যে, সে অভিজ্ঞতা টুইটারের চেয়েও যে খারাপ, এমন নয়। তবে, সামাজিক মাধ্যমগুলিতে অন্তত একটা সুনির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে। আছে সুনির্দিষ্ট একটি পথও, যে কোনও প্রশ্নের উত্তর আদান-প্রদানের। আছে কারণ, যদি কেউ কখনও অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া উগড়ে দেয়!’
আরও পড়ুন: ডেলিভারি বয়, ইলেকট্রিক অ্যাপরেন্টিস থেকে ক্রিকেট বিশ্বকাপের মঞ্চ: ডাচ রূপকথায় নতুন পালক
প্রকৃতপক্ষে, এটা সোশাল মিডিয়ার যুগ। সমসাময়িক ক্রীড়াবিদদের মানসিকতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিরাট কোহলির চ্যালেঞ্জটি আরও কঠিন হয়েছে, যেহেতু তাঁকে পথ বাতলে দেওয়ার মতো কোনও অভিজ্ঞ মানুষ নেই। ক্রিকেটার বা অন্য কোনও ক্রীড়াবিদ নয়। সমাজবিদ অথবা ক্রীড়া-মনোবিদও নয়। তিনি নিজেই খুঁজতে চেষ্টা করেছেন সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে যুঝতে চাওয়ার কৌশল।
ক্রীড়া-মনোবিদ, ডা. নানকি জে চাড্ডা বলছেন, ‘একথা ঠিক। সোশাল মিডিয়া এ যুগের ক্রিকেটারদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।’ ইন্সটাগ্রামে ফলোয়ার সংখ্যার নিরিখে, বিরাট কোহলি স্থান পৃথিবীতে তৃতীয়। ডাক্তার চাড্ডা আরও বললেন, ‘আমার বিশ্বাস, কোহলি নিজেকে, নিজের খেলা, নিজের দল সর্বোপরি নিজের পরিবারের ওপর গভীর মনোনিবেশ করতে পেরেছেন। ফলে বহু নেতিবাচক মন্তব্য থামিয়ে দিতে তিনি সফল। বহির্বিশ্বের পরিবর্তে দৃষ্টি রেখেছেন অন্তরে।’
যাই হোক। সোশাল মিডিয়াতে বিরাট কোহলির প্রতিক্রিয়া সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হয়ে উঠল কি উঠল না, সেসব তুচ্ছ। বিরাট কোহলি আসলে যতখানি নিখুঁত হয়ে উঠলেন এদ্দিনে, সে যাত্রাপথ তিনি উপভোগ করছেন ভরপুর। আনন্দও পেয়েছেন। এবং সুদীর্ঘ এ ক্ষতবিক্ষত যাত্রাপথ, জ্বলজ্বলে উদাহরণ ভাবী-সুপারস্টারদের কাছে।
গল্পগাছায় বুঝতে পারতাম তাঁর বোধ ছিল প্রখর, অত্যন্ত ভালো পড়ুয়া, এবং প্রচুর ইউরোপিয়ান সিনেমা দেখেছেন। এবং এমনভাবেই দেখেছেন যে সেসব সিনেমার রেফারেন্স মনে অটুট থাকত। আমার কোনও ছবি দেখে বলে দিতে পারতেন, কোন দৃশ্যে বুনুয়েলের ছাপ, আর কোন দৃশ্যে চ্যাপলিন। প্রয়াত শ্যাম বেনেগাল, রইল একটি স্মৃতিলিখন।
একবার কলকাতা থাকাকালীন আমাকে ওঁদের বাড়িতে যেতে বলেছিলেন বীরেনদা। যামিনী রায়ের ছবি দেখতে। যামিনী রায়ের রামায়ণের ছবি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ছবি থেকে রং খসে পড়ছে। আমি যদি কলকাতায় কোনও ছবি-চিকিৎসার মানে, ‘রেস্টোরেশন’-এর রাস্তা বের করতে পারি। যামিনী রায়ের রামায়ণের ১৭ খণ্ডে ক্যানভাসে চিত্রায়নের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন সারদাচরণ।