মায়াকোভ্স্কি নাম শুনলেই এক অদ্ভুত একমাত্রিকতা আমাদের পেয়ে বসে। তাঁর বিপ্লব এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রতি নিষ্ঠা যে আদতে এক সোচ্চার প্রেমের বহিঃপ্রকাশ, একে আমরা কখনও স্বীকৃতি দিইনি। এতদিন আমরা তাঁকে যেভাবে এঁচে নিয়েছি, সেটা তাঁর আংশিক চরিত্রের এক পূর্ণাবয়ব ছবি তৈরি করেছে। সে ছবি সত্যের সঙ্গে লুকোচুরি করেই বেরিয়েছে।
নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, আজ, ১৯ জুলাই, ২০২৪, ভ্লাদিমির মায়াকোভ্স্কির ১৩২তম জন্মদিন। সাধারণভাবে, তাঁর নাম চোখে পড়লেই আমাদের মনে পড়ে যায় ‘পাতলুন পরা মেঘ’ অথবা ‘লেনিন’-এর মতো দীর্ঘ কাব্যের শিরোনাম, মনে আসে ‘সোভিয়েত পাসপোর্ট’, ‘অধিবেশনের ভূত’, ‘আমাদের কুচকাওয়াজ’-এর মতো কবিতাসমূহের অসামান্য রাজনৈতিক উচ্চারণ। তাঁর আমলাতন্ত্র-বিরোধী কবিতা ‘অধিবেশনের ভূত’ সম্পর্কে লেনিনের প্রশংসাসূচক উক্তি আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য মায়াকোভ্স্কি প্রীতির কারণ। স্তালিন একবার বলেছিলেন, ‘মায়াকোভ্স্কি সোভিয়েত যুগের শ্রেষ্ঠতম এবং সবচেয়ে প্রতিভাবান কবি।’ স্তালিনীয় শিক্ষায় বড় হয়ে ওঠা বামপন্থী বাঙালির কাছে এই ‘সোভিয়েত যুগ’ শব্দযুগল কাব্যপ্রতিমায় প্রতিভাত হয়ে ওঠে মায়াকোভ্স্কি নামের মধ্য দিয়েই।
কিন্তু সত্যি বলতে কী, এক কসাক বনরক্ষক পরিবারে জন্মানো মায়াকোভ্স্কি, যিনি কখনও বলশেভিক পার্টির সদস্য ছিলেন না, ছিলেন রুশ ও সোভিয়েত সাহিত্যধারার এক প্রতিবাদী মুখ, ফিউচারিস্ট বা ভবিষ্যৎবাদী ঘরানার প্রধান ব্যক্তিত্ব। তিনি আদতে ছিলেন একজন কবি– লিরিক কবি, একজন শিল্পী, একজন প্রেমিক। কিন্তু এই পরিচয়ে তিনি নিজে খুব একটা স্বচ্ছন্দ ছিলেন বলে মনে হয় না। বিপ্লব এবং লেনিনের প্রতি প্রবল নিষ্ঠা তাঁকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছিল বিপ্লবী রাজনীতির অভিমুখে। আর তাই, এর গুরুভার তিনি নিজেই নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবের চারণ, বিপ্লবের গাথাকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, সেই ভার তিনি শেষ দিন অবধি বহন করতে যথেষ্ট কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করেছেন।
১৯৩০ সালে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া মায়াকোভ্স্কি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লিও ট্রটস্কি সার কথাটা বলেছিলেন: ‘এটা সত্যি নয় যে, মায়াকোভ্স্কি প্রাথমিকভাবে একজন বিপ্লবী ছিলেন এবং তারপর কবি, যদিও তিনি আন্তরিকভাবেই এমন হওয়ার কামনা করতেন। আসলে মায়াকোভ্স্কি প্রাথমিকভাবে ছিলেন একজন কবি, একজন শিল্পী, যিনি পুরনো জগৎকে প্রত্যাখান করেছিলেন কিন্তু তার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হতে পারেননি।’ এখন, নতুন সমাজতান্ত্রিক মানুষ হতে গেলে পুরনো জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবীর পক্ষেও কতটা সমীচীন, সেই নিয়ে তর্কবিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু বাস্তব সত্য এইটাই, ‘সোভিয়েত যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে প্রতিভাবান কবি’ বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত সমাজেও যে সমস্যাগুলো দেখেছিলেন, এবং তার প্রতি যেভাবে সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছিলেন, তাতে তার কবি চরিত্রের প্রতিফলনই ঘটেছিল, প্রতিফলন ঘটেছিল এক দুর্নিবার প্রেমের।
কিন্তু মায়াকোভ্স্কি নাম শুনলেই এক অদ্ভুত একমাত্রিকতা আমাদের পেয়ে বসে। তাঁর বিপ্লব এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রতি নিষ্ঠা যে আদতে এক সোচ্চার প্রেমের বহিঃপ্রকাশ, একে আমরা কখনও স্বীকৃতি দিইনি। এতদিন আমরা তাঁকে যেভাবে এঁচে নিয়েছি, সেটা তাঁর আংশিক চরিত্রের এক পূর্ণাবয়ব ছবি তৈরি করেছে। সে ছবি সত্যের সঙ্গে লুকোচুরি করেই বেরিয়েছে।
মায়াকোভ্স্কির কাব্যকৃতির পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন এখনও হয়নি, অন্তত বাঙালি সমাজে। তাঁকে সর্বদাই আমরা দেখে এসেছি এক প্রবল প্রতাপান্বিত কমিউনিস্ট বিপ্লবী ভাষ্যকার হিসেবে। কিন্তু রক্তমাংসে গড়া একজন কমিউনিস্ট, একজন বিপ্লবী, তো প্রেমিকও বটে! আমার মনে পড়ে যায় অনেক ছোটবেলায়, মায়াকোভ্স্কির সুইসাইড নোটের কবিতাটা অনুবাদ করেছিলাম। তাতে প্রেমের যে আকুতি ছিল, তা ভোলার নয়। নিচে সেটা তুলে দিচ্ছি:
রাত্রি-গাথা
ঘড়ির কাঁটায় রাত্রি একটা বাজে—
চোখ বুজে আছো, নিঝুম ঘুমের ঘোরে।
ছায়াপথে আজ রূপোলী নদীর মায়া,
টুপ টুপ ক’রে আকাশ পড়ছে ঝ’রে।
নিঁদ-মহলের আনাচ-কানাচ ঘোরো,
বসে থাকি আমি শিয়রের ঐ কোণে—
তার-বার্তায় জাগাতে চাইনা তোমায়,
বিচ্ছেদে শেষ হয়েছে সবের মানে।
প্রেমের খেয়ার কঙ্কাল পড়ে আছে
দিন-যাপনের গ্লানির বালুর চরে—
তোমাতে-আমাতে হয়ে গেছে শোধ-বোধ,
কী হবে আজকে ক্ষতের হিসেব করে?
ভেবোনা ওসব, তাকাও এদিক পানে—
স্তব্ধতা নামে এ মহাজগৎ-বুকে।
তারার চাদরে আকাশ ঢেকেছে মুখ,
চিত্ত জাগুক যুগের সৃষ্টি সুখে।
একাধিক সম্পর্কের ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া মায়াকোভ্স্কির জীবনে স্থায়ীভাবে যেটুকু রয়ে গিয়েছিল সেটা হল সোভিয়েত ইউনিয়ন, কমিউনিস্ট মতাদর্শ এবং সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর প্রশ্নহীন ভালোবাসা। আর ঠিক সেই কারণেই ট্রটস্কির উপরোক্ত লেখায় উল্লেখিত দুর্বলতা সত্ত্বেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত সোভিয়েত সমাজ ব্যবস্থার বিবেক এবং সমালোচক। বিপ্লবের প্রতি তাঁর প্রবল নিষ্ঠা ও প্রেম না থাকলে এমন হয়ে ওঠা কি আদৌ যায়? নিজের শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘উচ্চকণ্ঠ’-তে মায়াকোভ্স্কি লিখেছিলেন: ‘ভবিষ্যতের / উজ্জ্বল দিনগুলোতে/ কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমিটির/ সামনে দাঁড়িয়ে আমি/ কাব্যিক যত ঠগ জোচ্চোর/ আর ধাপ্পাবাজদের/ মাথার ওপরে/ বলশেভিক পার্টি কার্ডের মতো/ তুলে ধরব আমার একশো খণ্ডের/ যত পার্টি বই,/ তার সবগুলো।’
ভ্লাদিমির মায়াকোভ্স্কি আমাদের হৃদয়ে চিরজীবী হোন।