Robbar

এত দিলে দত্যি ও দানো, বর্মটি ভুলে গেছ দিতে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 23, 2025 4:01 pm
  • Updated:May 26, 2025 3:57 pm  

যে মেয়ে জোর গলায় হেসে উঠতে পারে, গেলাসের তরল ভাগ করে নিতে পারে, বিনা প্ররোচনায় গান গাইতে পারে, পুরুষ বন্ধুর হাতে হাত মিলিয়ে আত্মগত কথনের কবিতা লিখতে পারে, সর্বসমক্ষে বলতে পারে নিজের শরীরী স্মৃতির বৃত্তান্ত, সে মেয়েকে আসলে সবাই সহজলভ্য ভাবে। খুব সহজেই ধসিয়ে দেওয়া যায় তার চারপাশের দেওয়াল, তার নিজস্ব ঐকান্তিক বর্মের দুর্ভেদ্যতা, সহজেই তাকে ডেকে নেওয়া যায় বিছানায়, অসম্ভব অনায়াসে তার দেহের পরশ চাওয়া যায় ‘কনসেন্ট’-এর তোয়াক্কা না করে– এমনটাই চিরকালীন উপপাদ্য, সহজে তয়ের-করা ফরমুলা। 

অরুন্ধতী দাশ

রাস্তার ওপার থেকে অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছিলাম, একটা চোরাই আড়চোখ। মাঝেমাঝেই যে ছুরিটা চালাচ্ছে চাউনির ভেতর থেকে, তাকে ‘অন্তর্ভেদী’ বলা চলে কি না জানি না, তবে আবরণভেদী তো বটেই। তখন আমি ক্লাস নাইন, অনভ্যাসের শাড়ি আমার ইউনিফর্ম সে-বছর থেকেই। শাড়িতে প্রোমোশন পাওয়াটা ছিল আমাদের বাগবাজারের পুরাতনী স্কুলের ক্লাস নাইন স্পেশাল চার্ম। সে আনন্দের চোটে কোনও দিন ওই খসখসে সুতির বারোহাত কাপড় সামলানোর শ্রম নিয়ে ভাবিনি, বরং ততদিনে ‘আমি তখন নবম শ্রেণি’ পড়ে ফেলেছি আর মনের মাঝে গুঞ্জরিয়া উঠছে নিজের শাড়িপরিহিত কাল্পনিক বিম্বটি, পুলকিত তনুমনপ্রাণ! কিন্তু শাড়ি পরে স্কুলবাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার প্রথম সপ্তাহেই যে এইরকম একটা লোকের মুখোমুখি পড়ে যাব, যার নরুণচেরা চোখ বারবার পিছলে যাবে আমার কোমর আর বুকের ষোড়শী খাঁজে, তা তো ভাবিনি! একটু পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম লোকটার দিকে, মনে আছে। হঠাৎ পিঠের খাঁজ বরাবর একটা তীব্র জ্বালা, আর চারপাশে হইহই। রাস্তার লোকজন ছুটে আসার আগেই আমি বুঝতে পারলাম, আমার ব্লাউজের পিঠটা দু’-ফালা করে চিরে দেওয়া হয়েছে, ফিনকি দিয়ে বেরনো রক্ত ছিটকে এসে লেগেছে আমার কনুইয়ে, লাল হয়ে যাচ্ছে আমার লালপাড় সাদা শাড়ি। লোকটা ছুটে পালিয়ে যাচ্ছিল দূরে, আর আমি ক্রমশ উবু হয়ে বসে পড়ছিলাম রাস্তায়। না, ওই অসহ্য যন্ত্রণায় শুধু নয়, পিঠবরাবর লম্বালম্বি চালানো ব্লেডে কেটে ছিঁড়ে-পড়া ব্লাউজ আর অন্তর্বাসের লজ্জা ঢাকতে। আমি কাঁদিনি, চিৎকারও করিনি। শুধু রক্তভেজা পিঠের ওপরে স্কুলের ব্যাগটা পরে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম বুকের ওপরে হাত জড়ো করে। স্কুলে যাইনি পরপর চারদিন। পাঁচ নম্বর দিনে যখন বেরলাম, তখনও আমি শাড়িই পরে আছি, স্কুলে যাওয়ার পোশাকে, কিন্তু ব্লাউজের তলায় মোটা স্পোর্টস ইনার, তার ওপরে ক্যামিসোল। আমার বর্ম। স্কুলের ব্যাগটাও বদলাতে হয়েছিল, রক্ত লেগে জবজবে হয়ে গিয়েছিল বলে। আজও আমার পিঠে সেলাইয়ের দাগ আছে, ঠিক পাঁচটা। সেদিনের বর্মহীন যোদ্ধার ক্ষতচিহ্ন হয়ে।

এর অনেক দিন পর, তখন যাদবপুরে পড়ি, ক্রমশ লিঙ্গ আর শরীর সচেতনতার নানা ট্যাবু ঝেড়ে ফেলার শিক্ষা আহরণ করছি খোলা হাওয়ায় ভেসে-আসা আলাপী মশকরায়। হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে চিত্ত উঠছে ঝলমল করে, মেজাজ ঝোড়ো, বলিয়েকইয়ে বলে নামডাকও হয়েছে কিঞ্চিৎ। একদিন ক্যান্টিনে হাওয়া গরম হয়ে উঠেছে, বিষয়: মেয়েদের পোশাক বিতর্ক। চূর্ণী আচমকাই বলে বসল, কেন পরব অন্তর্বাস? বিদেশে মেয়েরা অন্তর্বাস পুড়িয়ে দিয়ে রাস্তায় নামছে প্ল্যাকার্ড হাতে, শরীরে মুক্তি চেয়ে। আর আমরা এখানে বসে বসে ফুল কভারেজ না পুশ আপ, লাইল্যাক না রোজি– তার বিজ্ঞাপন দেখব? আমি চুপ। পিঠের ওই পুরনো সেলাইফোঁড়াইয়ের কাছটা কেমন যেন শিরশির করে উঠল। চূর্ণীর গলার শির যত ফুলে উঠছে, আমার গলার কাছে ততই পাকিয়ে উঠছে ব্যথা। খানিক বাদে কাঁপা হাতে চূর্ণীর পিঠে হাত রেখে বলেছিলাম, শিরদাঁড়া থাকতে হয়, পিঠ দু’-ফালা হয়ে গেলে শিরদাঁড়া বেঁচে থাকে কি না বলতে পারি না। বন্ধুরা কী বুঝেছিল জানি না, তবে আমি ঝেড়ে ফেলেছিলাম ক্যামিসোলের বর্ম, সেদিন থেকেই। আর আমার পাশে অদৃশ্য ঢাল-তলোয়ার হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিল আমার বন্ধুর রাগত কণ্ঠস্বর।

শিল্পী: ফ্রিদা কাহলো

কিন্তু এত সহজে এসব গল্প থেকে নিষ্কৃতি মেলে না। চানঘরের অন্তরালে হাত থেকে পিছলে যাওয়া সাবানের ওপরে পায়ের পাতা যেমন পড়বেই, তেমনই নাছোড়। তাই বছর তিনেকের মধ্যেই আমার চোখ পড়ে যায় দৈনিক কাগজে প্রকাশিত একখান অনামা স্বীকারোক্তিতে, শিরোনাম ‘ক্ষমা করিনি’। ঘটনা রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনের। লাস্ট মেট্রোর জন্য অপেক্ষারত মেয়েটি টের পেয়েছিল, একটু দূর থেকে বিশ্রী আঙুলের ইঙ্গিতে নিজের উত্থিত লিঙ্গের জানকারি তাকে পৌঁছে দিচ্ছে কেউ। অনেকটা হেঁটে, দূরবর্তী থামের আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। হঠাৎ সম্বিত ফেরে জামায় ছিটকে আসা সাদা তরলের অভিঘাতে। চমকে তাকিয়ে দেখে প্যান্টের চেন টানছে লোকটা। মেয়েটি সেদিন সেখানেই বমি করে ফেলে, আর তারপর বাড়ি ফিরে জামা কাচতেই থাকে, কাচতেই থাকে। সারাজীবনের জন্য শুচিবায়ুগ্রস্ত হয়ে গেছে মেয়েটি, ক্ষমা করেনি, করবেও না কোনও দিন। তার বর্ম, সাবান।

ভেবেছিলাম, যথেষ্ট পোড় খেয়ে ফেলেছি ইতিমধ্যেই। ছোট চুল আর ভারী চশমার বর্ম আমার মেয়েজীবনের নরম আবেগ বাইরে থেকে ঢেকে রাখে অনেকটাই। আমাকে একঝলক দেখলে আর যা-ই হোক, সঙ্গ চাইতে পারে, কিন্তু প্রথম দর্শনেই আমার আসঙ্গ চাইবে না কেউ। এহেন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আমি তখন চষে বেড়াই পথঘাট। শনিবারের রাত হলেই বন্ধুরা মিলে চরতে বেরিয়ে পড়ি একটু বেশি রাতের শহর। মধ্য কলকাতার অফিসপাড়ার দরজা বন্ধ হলে সাংবাদিক বন্ধুরা তাদের গভীর রাতের ‘পাতা ছাড়া’ সেরে যোগ দেয় দলে, ক্রমশ শহরের রাস্তায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে আমাদের বুট-স্টিলেটো-স্লিপার-স্নিকার্সের ছাপ। এমনই একদিন শহরের এক নিরালা পানীয়-ঠেকে ঠেক গড়েছি আমরা জনা সাত। গান শুনছি এন্তার, আর গল্পের সুরে গড়াচ্ছে রাত। নেশাতুর রাত আমার গলা ভেজাচ্ছিল না বটে, কিন্তু যে আগুনের কাউন্টার ভাগ করে নেওয়া যায়, তার ধূম লেগেছিল হৃৎকমলে। তা ছাড়া, বন্ধুদের নরম কথা আর উচ্চকিত হাসির আপন-করা মায়ার আবেশ তার নিজস্ব মাধুরীতে বুঁদ করেই রেখেছিল আমায়। দিনের তৃতীয় সিগারেটটা ধরাতে যাব, হঠাৎ পিছনের টেবিল থেকে একটু উঁচু গলার প্রশ্ন, ‘ক্যান আই হ্যাভ দ্য লাইট প্লিজ?’ ভালো করে না-তাকিয়েই যাকে অগ্নিসংযোগের ব্যবস্থা সরবরাহ করলাম, সে যে ধন্যবাদ দিতে একবারে সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবে, ভাবিনি। ধন্যবাদ দেওয়ার সময় বিলিতি কায়দায় হাত ঝাঁকাল সে। তখন বুঝিনি, ছোঁয়ার অছিলা। বুঝলাম, যখন হাত ছাড়ার আগে মৃদু চাপ টের পেলাম করতলে। ভুলই ভাবছি, এ বিশ্বাস তখনও ছিল পাহাড়প্রমাণ আত্মবিশ্বাসের উপরিতলে, খানিক আগে শেষ করা কোল্ড কফির ওপরের ক্রিমের মতো। কিন্তু খানিক পরে যখন আমি উঠে যাচ্ছি ফিমেল ওয়াশরুমের দিকে, বুঝতেও পারিনি পিছু নিয়েছে ছায়াশরীর, এবার অন্য আগুনের খোঁজে। যখন ধরতে পারলাম, ততক্ষণে সে আমাকে ঠেসে ধরেছে দেয়ালে, আর বলছে, ‘উইল ইউ নাউ গিভ মি লাইট?’ আমার পাঁচ আঙুলের দাগ অচেনা পুরুষগালে সে রাতে বসে যাওয়ার অনেক পরে, ভোররাতে একান্ত মশারির ভেতর কাঁদতে কাঁদতে আমি ভাবব– আমার অপরাধ মেয়ে হয়ে চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে রাতযাপন, সর্বসমক্ষে ধোঁয়া গেলা আর অচেনা মানুষের সঙ্গে কথা বলতে না থমকানো। তৎকালীন প্রেমিক আমাকে সে রাতে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে অন্তত ছাব্বিশবার একথাটাই বলেছিল যে, নেলপলিশড আঙুল আর সিগারেটের মধ্যে একটা চণ্ডালগুরু (রাজনৈতিক অশুদ্ধতা মাপ করবেন) সম্পর্ক আছে। বিশ্বাস করুন, আজও আমি চেনা চৌহদ্দির বাইরে আর কোনও রকম নেশায় যাই না। আমার বর্মের পরত অভেদ্য।

This may contain: an image of a man standing on top of a pile of coins
সূত্র: ইন্টারনেট

আজ আমার অভিজ্ঞতা, আমার বিষাক্ত ফোটোগ্রাফিক স্মৃতিসম্পন্ন অভিজ্ঞতা আমাকে যে সিঁটকে যাওয়া অভিব্যক্তির, কুঁচকে যাওয়া ভুরুর, ঠোঁট বাঁকানো হাসির বর্ম পরিয়ে দিয়েছে, তার প্রতিটি পরতে আমার গায়ে সেঁটে যায় উচ্চনাসা ব্যক্তিত্বের সুদূর তকমা। আমি জানি, যে মেয়ে জোর গলায় হেসে উঠতে পারে, গেলাসের তরল ভাগ করে নিতে পারে, বিনা প্ররোচনায় গান গাইতে পারে, পুরুষ বন্ধুর হাতে হাত মিলিয়ে আত্মগত কথনের কবিতা লিখতে পারে, সর্বসমক্ষে বলতে পারে নিজের শরীরী স্মৃতির বৃত্তান্ত, সে মেয়েকে আসলে সবাই সহজলভ্য ভাবে। খুব সহজেই ধসিয়ে দেওয়া যায় তার চারপাশের দেওয়াল, তার নিজস্ব ঐকান্তিক বর্মের দুর্ভেদ্যতা, সহজেই তাকে ডেকে নেওয়া যায় বিছানায়, অসম্ভব অনায়াসে তার দেহের পরশ চাওয়া যায় ‘কনসেন্ট’-এর তোয়াক্কা না করে– এমনটাই চিরকালীন উপপাদ্য, সহজে তয়ের-করা ফরমুলা। এই সহজ রেসিপির থেকে বেরতে পারা যায় কি না। আদৌ বেরতে কোনও দিন চাইব কি না, জানি না। শুধু জানি, বর্মের আর-এক নাম সংনাহ। আমাদের প্রাচীন মহাকাব্য বলে, এই সংনাহ ধারণেরও নির্ধারিত বয়স আছে। যে বয়স হওয়ার আগে, যে যোগ্যতা অর্জন করার আগে ক্ষত্রিয়পুরুষ সংনাহধারণ করার অনুমতি পায় না। দেহে দু’খানি স্তন আর একখানি ত্রিবলীসঙ্গমের উপযুক্ত যোনি নিয়ে জন্মালে, এই সংনাহ ধরতে হয় জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি। এই সংনাহ আমার আপাতত চিরন্তন। ‘আপাতত চিরন্তন’-এর মতো অক্সিমোরনকে পাশাপাশি বসিয়েও আজ এই মুহূর্তে এ কথাই লিখে রাখি, বর্ম আমার অটুট এখন। এ কাচের দেওয়ালে চিড় ধরাতে পারে, এমন সূর্যরশ্মির ফোকাস এখনও এ নারীজন্মে দেখিনি। সংনাহ আমাদের ছিল না, বর্ম আমাদের তাই গড়ে নিতে হয়। চামড়ার মতো মোটা পরত সেঁটে নিতে হয় চরিত্র আর অস্তিত্বের গায়ে, নিরুপায় আঠালো অবিচ্ছেদ্যতা তার সর্বাঙ্গে। ‘এত দিলে দত্যি ও দানো, বর্মটি ভুলে গেছ দিতে’।