আমাদের বাড়ির ঠাকুর ধবধবে সাদা, ডাকের সাজ। গলায় গাঁদা ফুলের মালা, হলুদ। এই ফুলের গন্ধ একেবারেই ভালো লাগে না। তার ওপর প্রায় একইরকম গাঁদার মালা পরে একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকে দেখেছি, ভোটের আগে। করজোড়ে গলি দিয়ে সহাস্যে হেঁটে যেতে। তাই হলুদ গাঁদার ফুল নিয়ে বিশেষ উৎসাহ জন্মায় না, এড়িয়ে চলি। কিন্তু যেবার বাসন্তী রঙে শাড়ি ছোপানো হল এক প্রতিবেশীর উঠোনে, চোখ ঝলসে গেল।
“I swam across
I jumped across for you
Oh, what a thing to do
‘Cause you were all yellow”
Coldplay
ক্লাস থ্রি। লক্ষ্মী ছেলের মতো ব্ল্যাকবোর্ড থেকে অঙ্ক টুকছি খাতায়। দরজা ঠেলে এক কর্মচারী ঢুকলেন। এক হাতে ঝাঁটা, অন্য হাতে ছোট বেলচা গোছের এক বস্তু। তিনি স্কুলের মাইনে করা জমাদার। ক্লাস পেরিয়ে বারান্দার দরজা খুলে বাইরে গেলেন। ওই বারান্দায় তখন ক্লাস টু-এর একটি নতুন সেকশন চালু হয়েছে। স্থানসংকুলান, তাই এই ব্যবস্থা। কয়েক মিনিট পর ওঁর প্রত্যাগমন, পিছনে হাপুস কাঁদতে থাকা একটি ছাত্র। তার চোখের জলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাফ প্যান্টের ফাঁক দিয়ে অন্য একটি স্রোত বয়ে চলেছে, যার রং হলুদ। শিক্ষক মহাশয়, তথা সারা ক্লাস নাকে রুমাল। শুধু জমাদারের কোনও তোয়াক্কা নেই। ছেলেটি আমাদের ক্লাস থেকে বেরনোর ঠিক আগের মুহূর্তে কেউ কেউ চেঁচিয়ে ওঠে– ‘প্যান্টে হেগেছে’, ‘ক্লাস টু খায় গু’ ইত্যাদি। সে সজল চোখে দেবানন্দ মার্কা ঘাড় ঘোরায়, তারপর অদৃশ্য। শুধু ওই হলদে গন্ধ ক্লাসময় বিরাজ করে যতক্ষণ না কড়া ফিনাইলে ঘর-দালান মোছা হয়। ওই রঙের আতঙ্ক আমার মনে গেঁথে যায়, কারণ আমি ছেলেটির জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে থাকি। বয়স আর একটু বাড়লে, যখন উত্তরাধিকারসূত্রে আমাশাপ্রাপ্ত, এই বিশেষ রংটিকে একটু গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করি। ‘কেস পুরো জন্ডিস’– বাক্যটি যেদিন প্রথম ব্যবহার করি সন্ধের রকবাজিতে, ওই রোগের ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান হয়নি। পাড়ার বন্ধু বাপির যখন হল, শুনলাম তার চোখ, মুখ, গা থেকে আরম্ভ করে বিছানা, বালিশ পর্যন্ত হলদে হয়ে গেছে। কেউ ছুঁয়ে দিলে সেও হলুদ হয়ে যেতে পারে– সেই ভয়ে হপ্তা তিনেক আমারা অনেকেই তার বাড়ির চৌকাঠ মাড়ালাম না। রামায়ণে লক্ষ্মণও তাহলে জন্ডিস কেস নাকি? কে জানে। এদিকে স্কুলে প্রত্যেক পরীক্ষার আগে হাড় হিম করা আর এক সাবধানবাণী শুনছি– ‘রিভাইজ না করলে চোখে সরষে ফুল দেখবে।’ পরীক্ষার আগের দিন যদি কোনও বিষয় প্রথমবার পড়ি, সেই প্রচেষ্টাকে আর যাই হোক ‘রিভাইজ করা’ বলা যায় না। এভাবেই সরষে ফুল এড়িয়ে চলি। ক্রমে চোখে চশমা ওঠে। চারচোখে প্রথম সরষের খেত দেখা ট্রেনের জানলা দিয়ে। তখন কয়লার ইঞ্জিন। বাইরে, কালো ধোঁয়াকে হাত দিয়ে সরিয়ে– ও হরি, এ তো সেই হলুদ। জুনিয়রের মুখ, বাপির বিছানা আর সিঁড়িভাঙা অঙ্ক দিগন্ত ছোঁয়া সরষে খেতে ভর করে আমায় জাপ্টাতে আসে। ভাগ্যিস তখনই ট্রেনের অবিরাম হুইসল আর পাল্লা দিয়ে আরও কালো ধোঁয়া।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সেইবারই প্রথম আমি স্বহস্তে ধুতি পরেছি। গিঁটটা জুতসই হয়নি বোঝা গেল। এইসব কঠিন সময়ে পুরুষ বন্ধুদের কাছে পাওয়া ভার। তারা যে যার গিঁট টাইট দিচ্ছে বা ইতিউতি সিগারেট টানছে। বান্ধবী এগিয়ে আসে। ভাগ্যিস বক্সার পরেছিলাম সেদিন। কাছেই, নিজের প্রতিষ্ঠানে, কলোনিয়াল পিলারের আড়ালে আশ্রয় নিই। বান্ধবী যত্ন করে ধুতি জড়িয়ে দিচ্ছে কোমরে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আতঙ্কের হলুদ রং বদলায় রাঙাদির বিয়ের দিন, সকালে। ছাদে, শাড়ির ওপর গামছা জড়িয়ে, যুবতী। বাড়ির ও পাড়ার মহিলারা তাঁকে বাটা হলুদ মাখাচ্ছেন। গালে, কপালে, দুই হাতে, গলায়। কানের লতিতেও। এ কি সেই একই হলুদ? ধন্দে পড়ে যাই! রাঙাদিকে উজ্জ্বল লাগে, তাঁর সেদিনের উচ্ছ্বাস যেন একটু অন্যরকম। হলুদের ফাঁক দিয়ে মুখের লালচে আভা, লজ্জায় না আনন্দে– বলা কঠিন।
কৈশোর এলে অবশেষে হলুদ নিয়ে গবেষণা একমুখী হয়। ঠিক যখন সরস্বতী পুজোর মানে বদলে যায়। আমাদের বাড়ির ঠাকুর ধবধবে সাদা, ডাকের সাজ। গলায় গাঁদা ফুলের মালা, হলুদ। এই ফুলের গন্ধ একেবারেই ভালো লাগে না। তার ওপর প্রায় একইরকম গাঁদার মালা পরে একটি রাজনৈতিক দলের নেতাকে দেখেছি, ভোটের আগে। করজোড়ে গলি দিয়ে সহাস্যে হেঁটে যেতে। তাই হলুদ গাঁদার ফুল নিয়ে বিশেষ উৎসাহ জন্মায় না, এড়িয়ে চলি। কিন্তু যেবার বাসন্তী রঙে শাড়ি ছোপানো হল এক প্রতিবেশীর উঠোনে, চোখ ঝলসে গেল। শাড়ি পরলে এমনিতেই মেয়েদের পরিণত দেখায়, তার ওপর ওই রং, আর খোঁপায় বা কানের পাশে গোঁজা ফুল। ঝলমলিয়ে উঠল স্যাঁতসেঁতে গলি, যেখানে হলুদ বললে আঙুলে আঙুল জড়িয়ে টিকটিকি দেখানো দস্তুর ছিল এদ্দিন। বয়সের একটা চৌকাঠ পেরতেই মনের মধ্যে রঙের প্যালেট উল্টে গেল নিমেষে, ভ্যান গখের সূর্যমুখীর মতো। মনে হল, এই রং গায়ে না মাখলে মানুষ হব না। তাই হলদেটে পাঞ্জাবি, নিচে ক্ল্যাসিকাল ধুতি। বছরের এই একটিমাত্র দিন মেয়েদের স্কুল-কলেজে ছেলেদের জন্যও অবারিত দ্বার। সদলবলে প্রসাদ খেতে যাব। অর্থাৎ আত্মপ্রসাদ। এক বান্ধবীর দায়িত্ব আমাদের তার স্কুলে নিয়ে যাওয়ার। সে প্রাক্তনী এবং সদ্য কলেজে। বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। স্কুলের গেট থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে আমার ধুতি খুলে গেল। সেইবারই প্রথম আমি স্বহস্তে ধুতি পরেছি। গিঁটটা জুতসই হয়নি বোঝা গেল। এইসব কঠিন সময়ে পুরুষ বন্ধুদের কাছে পাওয়া ভার। তারা যে যার গিঁট টাইট দিচ্ছে বা ইতিউতি সিগারেট টানছে। বান্ধবী এগিয়ে আসে। ভাগ্যিস বক্সার পরেছিলাম সেদিন। কাছেই, নিজের প্রতিষ্ঠানে, কলোনিয়াল পিলারের আড়ালে আশ্রয় নিই। বান্ধবী যত্ন করে ধুতি জড়িয়ে দিচ্ছে কোমরে। আমি দু’হাতে ওই হলুদ পাঞ্জাবি তুলে চোখ ঢাকি।
কলকাতার কালো-হলুদ ট্যাক্সি একদিন পুরো হলুদ হল। অনেকে ছ্যা ছ্যা করলেন– ‘এঃ হেঃ, কালচার একেবারে মাখিয়ে দিল রে।’ কিন্তু সেই পীতাম্বর যান যখন সবুজ ময়দান ফুঁড়ে একপাক ঘুরে এল ট্রাম লাইনকে সাক্ষী রেখে, তাঁরা হতবাক। কারণ সেই ট্যাক্সির পিছনের সিটে একটি হলুদ শাড়ি আর একটি হলুদ পাঞ্জাবিতে যাচ্ছেতাই জট পড়ে গিয়েছিল। তাদের খিলখিল উচ্ছলতায় ঈষৎ টিপসি রেড রোড বিকেলের রোদে নিজের নাম পাল্টে নেয়, কাউকে না বলে। এমনকী, ধর্মতলায় পাইস হোটেলের ডালে হলুদের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল হঠাৎ। সে হোটেলে আমি খেয়েছি অনেক আগেই। আমাশার সঙ্গে সহবাসের চুক্তি করে, জন্ডিসের ভ্রূকুটিকে রাস্তার শরবতে চুবিয়ে, হলুদ মলাটের সেলোফেন ছেলেমানুষি থেকে নীল ছবির তিনতলায় উঠে যেদিন ভেবেছি লায়েক হলাম, সেদিন। সে বয়সে নিম্নদেশ ঢাকা থাকে ধুলোমাখা জিনসে, মাসে যা একবার কাচা হয়। একটা জামা কি কেনা উচিত টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে? লিন্ডসে, নিউ মার্কেট? সাত দোকান তেরো ব্র্যান্ড পেরিয়ে যখন অসহায় পকেট হাতড়াচ্ছি, কাকতালীয়ভাবে সুদূর মার্কিন দেশ থেকে ব্র্যান্ডেড উপহার আচমকা গায়ে এসে পড়ে। এক দাদাস্থানীয় এনআরআইয়ের কলকাতা আগমনের সূত্রে। সেই কলারওলা টি-শার্ট বহরে এক সাইজ বড়, তবে তার কাঁচা-হলুদ রং।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সরস্বতী পুজোর আরও ফিচার
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়: আদিতে চার হাত, তবে সরস্বতী দু’-হাতেও বিদ্যেবতী
তন্ময় ভট্টাচার্য: সরস্বতী নদী ও আদিগঙ্গা: প্রচলিত মৃত্যু-তত্ত্বের বিপরীতে
চিরন্তন দাসগুপ্ত: ইনকনফিডেন্ট নায়ক অমল পালেকর-কে রমণী-মোহন বিদ্যায় হাতেখড়ি দিয়েছিলেন অশোক কুমার