দোলযাত্রা আর বৃন্দাবন একে অপরের সমার্থক। রাধাকৃষ্ণকে প্রাণকেন্দ্রে রেখে বৃন্দাবন মেতে ওঠে দোল-উৎসবে। রঙের আমেজে বিভোর হয়ে থাকে বৃন্দাবনবাসী। দোলের দিনে সেই রং-খেলার উৎপত্তিস্থলে গিয়ে কেমন দেখলেন রঙের উৎসব? সেই টাটকা অভিজ্ঞতাই লিখছেন রিয়া দেব রায়।
আমি সাধারণত একা একা ঘুরতে যাওয়ার পক্ষে। কারণ আমার হঠাৎ হুজুগের সঙ্গী শেষ মুহূর্তে জোগাড় করা সম্ভবও হয় না। আবার কখনও কখনও আমার পছন্দসই জায়গাগুলো আমার পরিচিতদের তেমন সয় না। তেমনই এক হঠাৎ-হুজুগের সিদ্ধান্তে এবারে বৃন্দাবন যাওয়া। দোল উৎসবে আমার যতটা আনন্দ হয় পুজোর সিন্নি খাওয়ার জন্য, ততটাই অনাসক্তি রং খেলা নিয়ে। কিন্তু রংয়ের উৎসবের সময় আমি সশরীর গিয়েছি রং-খেলার উৎপত্তিস্থলে!
কীভাবে রং খেলা থেকে নিস্তার পাব ভাবতে ভাবতেই আমার ট্রেন সফর কাবার! আমার আবার ট্রেনে চেপে ঘুরতে যাওয়ার প্রতি একটা টান আছে। সেই অভিজ্ঞতাকে কোনও দিনই বিমানপথ টেক্কা দিতে পারেনি– পারবেও না।
প্রায় ২৮ ঘণ্টার পর মথুরা জংশনে নেমে দেখি এক্কেবারে লোক থইথই! আমি একটামাত্র পিঠের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ায় বিশেষ অসুবিধা হয়নি যাতায়াতে। বৃন্দাবন পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় এক ডজনের বেশি বাহন প্রতিশ্রুতি দিল আমাকে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু তাদের প্রতিশ্রুতি এবং ভাড়ার বিস্তর পার্থক্য। অতএব উঠে পড়লাম এক অত্যন্ত নম্রভাষী দাদুর অটোয়। জংশন থেকে ৬০ টাকায় পৌঁছে গেলাম চৈতন্য বিহারে, যেখান থেকে ১৫ মিনিট হেঁটে প্রেমমন্দির। প্রেমমন্দির থেকে ঠিক ৩ মিনিট দূরত্বে একটা গেস্ট হাউসে ব্যাগ রেখে অল্প বিশ্রাম নিয়ে শুরু হল আমার বৃন্দাবন ভ্রমণ।
কথায় আছে, বৃন্দাবন এলে দর্শন শুরু করতে হয় বাঁকে বিহারীর মুখ দেখে। রিকশা নিয়ে রওনা দিলাম। বছরের প্রথম আবির খেলা দেখলাম ওখানেই। শত-সহস্র মানুষের ঢল-তবু মনে হল, সবাই যেন জায়গাটার সবকিছু চেনে। আমারও মনে হয়নি যে, প্রথমবার এসেছি। আরেকটা খুব মিষ্টি একটা বিষয় লক্ষ করলাম– এখানে সম্বোধনে কোনও ‘দাদা’, ‘দিদি’, ‘কাকু’, ‘ম্যাডাম’ নেই– সবাই এখানে ‘রাধে’।
এইদিন ট্রেন থেকে নেমে কিছু খাওয়ার সময় হয়নি, মন্দিরে ঢুকতে না ঢুকতেই মনে হল একটু পেট পুজো করা দরকার। একটু খিদে পাচ্ছিল। তবে মিষ্টির নয়– দেখি অদ্ভুতভাবে এক অপরিচিত মানুষ ডেকে বললেন, ‘রাধে, প্রসাদ’ বলে একবাটি খিচুড়ি ধরিয়ে নিমেষের মধ্যে উধাও! এখানে মানুষ বিশ্বাস করেন, প্রত্যেকের মধ্যে ঈশ্বর বাস করেন তাই তাঁদের আচার-ব্যবহারও খানিক অন্যরকম। সেদিন আশেপাশের প্রচুর মন্দির দর্শন করি– মদনমোহন, কাত্যায়ণী, প্রেমমন্দির, ইস্কন– ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় একডজনেরও বেশি। বৃন্দাবনে কিন্তু প্রচুর বাঙালি থাকেন। এদিকে বাঙালি পর্যটকের আধিক্যও বেশি। প্রতিটি মন্দিরে হরেক রং– তবুও অযাচিতভাবে কেউ রং লাগাতে আগ্রহী নয়– যেটা আমার সবচেয়ে বেশি মনে ধরেছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কথায় আছে, বৃন্দাবন এলে দর্শন শুরু করতে হয় বাঁকে বিহারীর মুখ দেখে। রিকশা নিয়ে রওনা দিলাম। বছরের প্রথম আবির খেলা দেখলাম ওখানেই। শত-সহস্র মানুষের ঢল-তবু মনে হল, সবাই যেন জায়গাটার সবকিছু চেনে। আমারও মনে হয়নি যে, প্রথমবার এসেছি। আরেকটা খুব মিষ্টি একটা বিষয় লক্ষ করলাম– এখানে সম্বোধনে কোনও ‘দাদা’, ‘দিদি’, ‘কাকু’, ‘ম্যাডাম’ নেই– সবাই এখানে ‘রাধে’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
প্রথমদিন মুশলধারে বৃষ্টি নামে। গোটা বৃন্দাবনের রাস্তায় গলে গলে পড়ছে রং। ফেরার পথে আমার সারা পায়ে রং দেখে অটোচালক বলে ওঠেন, ‘রাধে, আপকা রং পসন্দ নহী হ্যায় ক্যায়া?’ আমি যখন বলি যে তেমন একটা নয়, উনি বলে ওঠেন, ‘ইসি লিয়ে রাধামাধবনে বারিষ করদি, তাকি আপকো উনকে ঘর আকে তকলিফ না হো।’
কাকতালীয় বিষয়টা, তবুও বৃন্দাবনের রন্ধ্রে একটা ম্যাজিক আছে। অত হাজার হাজার শরণার্থীর মাঝেও শান্তির খোঁজ পাওয়া যায়। কথায় আছে, বারসানা যাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এখানকার মানুষজনের বিশ্বাস মাত্র ১০% মানুষ নাকি রাধারানির জন্মস্থান দর্শন করার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায়। বৃষ্টির প্রকোপে দ্বিতীয়দিনই ভেবে নিয়েছিলাম, আমি হয়তো সেই ১০% এর মধ্যে পড়ি না– তাই সেইদিন বেরিয়েও বৃন্দাবনের মন্দির দর্শন করেই সন্তুষ্ট হয়েছি। রাধাবল্লভ, সেবাকুঞ্জ, শাহজীমন্দির দর্শন করে পৌঁছলাম নিধিবন।
রংয়ের আমেজে সক্কলে মত্ত! আমি চিন্তায় মরছি, পাছে গায়ে রং লাগে– কী যে বুদ্ধি আমার– কেউ রংয়ের ভয় নিয়ে রং-এর ঘাঁটিতে এই সমরে আসে? কিন্তু কখন যে অলিগলি ঘুরে সময় বয়ে গেল, টের পেলাম না। নিধিবন ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় সন্ধের পর মানুষজনের ঘোরাফেরা নিষেধ। রাধামাধব স্বয়ং উপস্থিত থাকেন সেই সময়ে– প্রতিদিন। অনেক প্রচলিত গল্প শোনা যায় তাই নিয়ে। যমুনাঘাট গিয়ে আনাচ-কানাচে অজস্র মন্দির দর্শন করে ফেরার পথে যমুনামন্দিরের ঠিকপাশে দেখই যমুনাকুণ্ড– যেখানে গোপীরা স্নান করতেন এবং শ্রীকৃষ্ণ খেলার ছলে তাঁদের বিরক্ত করতেন। এই লীলাক্ষেত্র এখন দর্শনের জায়গা।
ফেরার পথে আচমকা মেঘগর্জন দেখে একটু স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ যমুনার পাড়ে দাঁড়িয়েছিলাম। ভিজলে ভিজব– হঠাৎ এক বছর পাঁচেকের মেয়ে এসে আমায় ডাকল। সাড়া দেওয়ায় আমার হাতভর্তি করে দিয়ে গেল আবির। অতঃপর দে ছুট! বুঝলাম না আশপাশে এত রং– ও আমার গায়ে না দিয়ে হঠাৎ হাতে দিয়ে ছুটল কেন? আমি অবাক হয়েছি দেখে পাশে থাকা এক নৌকাচালক বলে উঠলেন, ‘লে লো বেটি, রাধাবল্লভকে প্যায়ার কা রং মিলা হ্যায় তুমকো’– কেন বোঝার চেষ্টা করলাম না আর।
ম্যাজিক এক্সপ্লেন করলে ম্যাজিকের মর্ম থাকে নাকি। যমুনার বুকে আবিরটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরলাম, মাথার তখনও বারসানায় যাওয়ার হুজুগ নামেনি। ঠিক করলাম, ঝড়ঝঞ্ঝা হলেও যাব– কীভাবে তা নয় পরের দিন ঠিক করা যাবে।
তৃতীয়দিন ভোরবেলা উঠে বেরিয়ে পড়লাম। গাড়ি ভাড়া করা ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু ওভাবে অতদূর যেতে রাজি নয় বৃন্দাবনের স্থানীয় অটো-টোটো চালকেরা। প্রায় ঘণ্টাখানেক সন্ধানের পর আসেন হরিহরদা। তিনি বলেন, আমার ভাগ্য খুবই ভালো তাই ওর সন্ধান পেয়েছি। বৃন্দাবন কিংবা মথুরার কোনও স্থানীয় চালকের বিনা অনুমতিতে বারসানায় গাড়ি চালানো নিষেধ। শেষমেশ নিজেকে ভাগ্যবতী মেনে নিয়ে প্রায় ঘণ্টাদুয়েক পথ পেরিয়ে রাধাকুণ্ডের জল মাথায় নিয়ে পৌঁছলাম বারসানায় রাধামাধবের মন্দিরে। প্রথম পা রেখেই বুঝলাম জায়গায়া একটু অন্যরকম। একটা অদ্ভুত অনুভূতি, যেটা ভাষায় বোঝানো দায়। মন্দিরে উঠতে গেলে প্রায় ৪০০ সিঁড়ি পার করতে হয়। নিমেষে উঠে গেলাম। জানি-না কেন টেরও পেলাম না। সকালবেলায় ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘ আর নেই, চড়া রোদ, উঠতে উঠতে দেখি ‘রাধাকৃষ্ণের বিবাহস্থল’ পেরিয়ে এলাম। জায়গায় জায়গায় বিবাহিত রাধারানির দর্শন। মন্দিরে প্রবেশ করতেই দেখি হাজার হাজার মানুষ ‘রাধে রাধে’ বলে উঠল– সে কি গর্জন! এই দৃশ্য দেখে আমি হতবাক। মানুষ উন্মত্ত হয়ে রং খেলছে– সবই আবির। একমাসের বেশই উৎসব তবুও উচ্ছ্বাস কমেনি বিন্দুমাত্র। বারসানায় আমার একবছরের প্রথম রং খেলা। নানারকমের রং আমার গায়ে এসে পড়ে। অচেনা মানুষজন, বিভিন্ন বয়সের একে অপরকে দোলের শুভেচ্ছা জানায়। হয়তো এই প্রথমবার এত গরমে রং খেলতে ভালো লাগছিল। গোটা জায়গাটা আবিরে লাল। রং মেখে বসে রইলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেমন জানি মন খারাপ করছিল ফিরে আসতে, অথচ ফিরতে তো হবেই। চলে এলাম। এইদিন গোবর্ধনমন্দির পরিক্রমা সেরে ফিরি বেশ দেরি করে। মনটা অদ্ভুত ভারাক্রান্ত। সন্ধের দিকে গিয়ে বসলাম বিড়লামন্দিরে। গীতাপাঠ শুনলাম খানিকটা। পরের দিন ফেরা। আমার গোকুলদর্শন করা বাকি ছিল, টোটোর হরিহরদা বললেন সকালে নিয়ে যাবেন।
আমি বারণ করি। বাড়ি ফিরব। ফিরে আবার হুজুগ তুলতে হবে তো।
ছবিঋণ: লেখক
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved