ক্লাসে বসে যে সব ছাত্রছাত্রী, তাদের কাছ থেকে তো আমরা কত কী শিখি! এ কথা কোন্ শিক্ষক অস্বীকার করতে পারবেন? তা সিলেবাসের পাঠ হতেও পারে, নাও হতে পারে। সিলেবাসের পাঠ সম্বন্ধেও যে কিছুই শিখি না, তা তো নয়। আমার কোনও ছাত্রী (এখানে ‘ছাত্রী’ কথাটা বলা দরকার) যে ভাবে সুছাঁদে ও সুশৃঙ্খলভাবে সব গুছিয়ে রাখত, তাকে দেখে আমি নিজেও একটু শৃঙ্খলা শিখেছি, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ছাত্রদের প্রশ্নগুলিও আমাকে শিখিয়েছে, কখনও বিষয়টা নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে এগিয়ে দিয়েছে।
প্রতিবার শিক্ষক দিবস আসে, আর প্রতিবার এই কথাটা আমার মনে ক্রমশ পোক্ত থেকে পোক্ততর হতে থাকে– শিক্ষক আর ছাত্র বলে কোনও মৌলিক দ্বিধান বা বাইনারি কিছু নেই। হ্যাঁ, তার সঙ্গে এটাও বলে নিই যে, এ লেখায় ‘শিক্ষক’ কথাটির মধ্যে আমি শিক্ষক/শিক্ষিকা দুইই বোঝাব, ‘ছাত্র’ কথায় ছাত্রছাত্রী। সেটা সকলের পছন্দ নাও হতে পারে, হয়তো এও এক ধরনের পুরুষ-প্রাধান্যের প্রমাণ, কিন্তু পশ্চিমি ধরনে শুধু স্ত্রীলিঙ্গের ব্যবহারও (ছাত্রী = ছাত্রছাত্রী) নিশ্চয় পাঠকদের অনভ্যস্ত লাগবে।
শিক্ষক, শিক্ষিকার চাকরি আছে, অবশ্যই আছে। সেটা মানব-সমাজ ভেবেচিন্তেই তৈরি করেছে সেই কবে। একদল লোক গুরু বা শিক্ষকের জীবিকা পাবেন, বিশেষ শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে। পুরুষশাসিত ও পুরুষপ্রধান সমাজে প্রথমে পুরুষেরা, অনেক পরে মহিলারাও আসবেন এই জীবিকায়, ক্রমে একটা বয়সের ছাত্রদের কাছে মহিলাদের শিক্ষক হিসেবে কার্যকারিতা অনেক বেশি হবে। প্রথমে বিষয় সম্বন্ধে ও যাপননীতি সম্বন্ধে বিশেষ শিক্ষা, পরে, বিশেষত স্কুল স্তরে শিক্ষণ সম্বন্ধে বিশেষ শিক্ষা তার সঙ্গে যুক্ত হবে। এই জীবিকাবদ্ধ গুরু ও শিক্ষকেরা তাঁদের বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা ছাত্র-প্রজন্মতে সঞ্চারিত করবেন। প্রথমদিকে প্রত্যক্ষ পাঠের মধ্য দিয়ে না হোক, জীবনাচরণে ভালোমন্দ শেখাবেন, ভাষার সুব্যবহার– কথিত ও লিখিত– উভয় ভাষায় শেখাবেন। সেই সঙ্গে এও আশা করা যায় যে, শিক্ষাস্তরের নিচের তলার দিকের শিক্ষকেরা ছাত্রদের উপরের দিকের শিক্ষায় পৌঁছবার জন্য তৈরি করে দেবেন।
শিক্ষকের চাকরিই (রাষ্ট্রনির্ধারিত, সমাজ-নিযুক্ত বা স্বনিযুক্ত) তাঁদের ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দেয়। ছাত্রদের ক্ষেত্রে এটা চাকরি নয়, কিন্তু সমাজ-নিয়ন্ত্রিত একটা ভূমিকা। প্রথমপক্ষের ক্ষেত্রে সেটা ‘দানের’ বা ‘সঞ্চারের’ বা ‘সংক্রমণের’, আর দ্বিতীয়দের ক্ষেত্রে সেটা ‘গ্রহণের’, ‘সঞ্চারিত’ বা ‘সংক্রামিত’ হওয়ার। এ যেন একটা একমুখী প্রক্রিয়া বা ইংরেজি প্রবচনে one-way traffic, একজন উপরে, আর-এক পক্ষ নিচে। দাতা ও গ্রহীতা। প্রথমপক্ষ হবেন একটি নির্দিষ্ট বয়সের, দ্বিতীয়পক্ষ তুলনায় অনেক কম, বয়সের। কখনও পরের প্রজন্মের, কখনও পরের পরের প্রজন্মেরও।
প্রজন্মের ব্যবধান আছে বলেই দুয়ের আচরণবিধিও দীর্ঘদিন ধরেই নির্দিষ্ট। শিক্ষকেরা মূলত আধিপত্যের আসনে। তাঁরা প্রথমদিকে, যেখানে প্রজন্মের ব্যবধান সবচেয়ে বেশি হয় সেই স্কুলস্তরে, ছাত্রদের ধমকাতে পারেন, মারতেও পারেন। অন্তত কিছুদিন আগে পর্যন্ত তাই ছিল। গ্রামের পাঠশালায় অভিভাবক তাঁর বালক সন্তানকে শিক্ষকের কাছে জিম্মা করে দিয়ে ‘গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করা’ শব্দান্তরে ‘মানুষ’ করার প্রার্থনা জানাতেন, শিক্ষকও সেটা স্মিতমুখে তাঁর কর্তব্য হিসেবে মেনে নিতেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সব বাক্যবন্ধ বোধ হয় ব্যবহৃত হত না, যতদূর অনুমান করি। উচ্চশিক্ষায় এই মারধোরের ব্যাপারটা সাধারণভাবে থাকে না, সেখানে জ্ঞান ও দক্ষতার সঞ্চার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পায়। তখন ছাত্ররা লালন ও তাড়নের বয়স পেরিয়ে যায়, পনেরো বছর বয়স পেরোলে তো পুত্রকে মিত্রবৎ আচরণেরই নির্দেশ আছে আমাদের শাস্ত্রে। অন্যদের শাস্ত্রেও নিশ্চয়ই এ-রকম কিছু আছে।
দ্বিতীয়পক্ষ, অর্থাৎ ছাত্ররা, তারা চাকরি করে না, কিন্তু তাদের ভূমিকাটি তারা পালন করতে বাধ্য হয় এই সামাজিক সংবিধানে। তাদের কাজ শিক্ষা নেওয়া। তার জন্য তাদের একটা ‘আচরণবিধি’ও তৈরি করে দেয় আমাদের সমাজ। তারা শিক্ষাদানের কালে শান্ত ও বিনয়ী হবে, গুরুর কথা শুনবে, গুরুকে সম্মান করবে, এবং ‘প্রণাম করে’, ‘প্রশ্ন করে’ আর ‘সেবা করে’ তারা শিক্ষা অর্জন করবে। অবশ্য আমাদের দেশে সবাই প্রথাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র হবার সুযোগ পায় না। কিন্তু সে ঘ্যানঘ্যানানি এখানে অবান্তর। অন্য রকমেরও ছাত্র হতে পারে, অর্থাৎ ‘ওস্তাদে’র কাছে তার কারখানায় বা দোকানে বা কর্মশালায় নানা বিদ্যা শিখতে পারে। তারাও ছাত্র নিশ্চয়ই।
…………………………………………………..
প্রজন্মের ব্যবধান আছে বলেই দুয়ের আচরণবিধিও দীর্ঘদিন ধরেই নির্দিষ্ট। শিক্ষকেরা মূলত আধিপত্যের আসনে। তাঁরা প্রথমদিকে, যেখানে প্রজন্মের ব্যবধান সবচেয়ে বেশি হয় সেই স্কুলস্তরে, ছাত্রদের ধমকাতে পারেন, মারতেও পারেন। অন্তত কিছুদিন আগে পর্যন্ত তাই ছিল। গ্রামের পাঠশালায় অভিভাবক তাঁর বালক সন্তানকে শিক্ষকের কাছে জিম্মা করে দিয়ে ‘গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করা’ শব্দান্তরে ‘মানুষ’ করার প্রার্থনা জানাতেন, শিক্ষকও সেটা স্মিতমুখে তাঁর কর্তব্য হিসেবে মেনে নিতেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সব বাক্যবন্ধ বোধ হয় ব্যবহৃত হত না, যতদূর অনুমান করি। উচ্চশিক্ষায় এই মারধোরের ব্যাপারটা সাধারণভাবে থাকে না, সেখানে জ্ঞান ও দক্ষতার সঞ্চার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পায়।
………………………………………………….
যারা সুযোগ পায়, তারা শিক্ষাজগতের ওই ভূমিকা পালন করে। সাধারণভাবে। এ কথাটা জুড়ে দিলাম এই কারণে যে, ইতিহাসে এর ব্যত্যয় ঘটতেও দেখা গেছে এবং যাচ্ছে। দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯৬৮ সালে ফ্রান্সে এবং ইদানীংকালে বাংলাদেশে। শিক্ষাজগতে তাদের নির্দিষ্ট ভূমিকার যেমন তারা ব্যতিক্রম ঘটায়, তেমনই তার বাইরেরও কিছু ভূমিকা তারা গ্রহণ করে।
আমি আমার কথাগুলিকে শিক্ষার পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। এ কথাও মনে করিয়ে দিতে চাই না যে, আমরা কেবল ইশ্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালের মধ্যে আটকে থেকেই শিখি। পাঠকেরা জানেন, আমরা শিখি অন্য পাঠ থেকে– স্বাধীন পড়াশোনা– পাঠ্যের বাইরে বই, সংবাদপত্র ও পত্রপত্রিকা, অন্যান্য নানা জীবিত ও মৃত মানুষের জীবন, কর্ম ও উপদেশ থেকে, পশুপাখির আচরণ এমনকি প্রকৃতিপাঠ থেকে। এ ব্যাপারে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রবীন্দ্রনাথ থেকে সুনির্মল বসু পর্যন্ত আমাদের সচেতন করে গেছেন। সে ঠিক আছে। কিন্তু মানুষ শিক্ষক আর মানুষ ছাত্রের এই শিক্ষাব্যবস্থাটাই আমাদের চোখে পড়ে। এক, ওই one-way traffic; দুই, ওই আধিপত্য ও আনুগত্যের বিন্যাস; তিন, ওই আধিপত্য অনুসারে আচরণগত সংবিধান।
২.
যে কথাটা এবারে বলবার, তা হল, ওই একমুখী শিক্ষণের ব্যবস্থায় কি কখনও ব্যতিক্রম হয় না? নিশ্চয়ই হয়, সেটা আমরা আমাদের শিক্ষকের সুপরিসর জীবন থেকেই বুঝে নিয়েছি। অর্থাৎ, ছাত্র কি কখনও শিক্ষকের শিক্ষক হয়ে ওঠে না? ক্লাসঘরের বাইরে তো নিশ্চয়ই হতে পারে– সে গবেষণা করবে, বই লিখবে, সে বই তার শিক্ষকের কাছেও নতুন নতুন জ্ঞান পরিবেশন করবে। আমার প্রচুর ছাত্র, তারা সকলে আমার অধীনে গবেষণা করেছে, এমনও নয়– চমৎকার সব গবেষণামূলক বই লিখেছে, আমি তাদের বই থেকে প্রচুর শিখেছি। তারা কীভাবে একটা মূল ধারণাকে বিস্তার করেছে, তথ্য জুড়ে, বিশ্লেষণ করে, প্রশ্ন তুলে, উত্তর দিয়ে, তা আমার চর্চাকেই অনেক পরিশীলিত করেছে। তারা নিজেরাও প্রতিষ্ঠান বা সমাজের শিক্ষক হয়ে উঠেছে। কিন্তু তখন তারা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রের যে ভূমিকা, তা অতিক্রম করে গেছে।
কিন্তু ক্লাসে বসে যে সব ছাত্রছাত্রী, তাদের কাছ থেকে তো আমরা কত কী শিখি! এ কথা কোন্ শিক্ষক অস্বীকার করতে পারবেন? তা সিলেবাসের পাঠ হতেও পারে, নাও হতে পারে। সিলেবাসের পাঠ সম্বন্ধেও যে কিছুই শিখি না, তা তো নয়। আমার কোনও ছাত্রী (এখানে ‘ছাত্রী’ কথাটা বলা দরকার) যে ভাবে সুছাঁদে ও সুশৃঙ্খলভাবে সব গুছিয়ে রাখত, তাকে দেখে আমি নিজেও একটু শৃঙ্খলা শিখেছি, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ছাত্রদের প্রশ্নগুলিও আমাকে শিখিয়েছে, কখনও বিষয়টা নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে এগিয়ে দিয়েছে।
……………………………………………….
আরও পড়ুন পারমিতা ভট্টাচার্য-র লেখা: ‘আমি’র মুক্তি যিনি ঘটাতে পারেন, তিনিই শিক্ষক
……………………………………………….
কাজেই যখন ভারতের এই শিক্ষক দিবস আসে তখন আমি একটু মুশকিলে পড়ে যাই। আমাকে প্রচুর ছাত্রছাত্রীরা প্রকাশ্যে, ফোনে বা ফেসবুকে প্রণাম জানায়। আমি তাদের কী শিক্ষা দিয়েছি, সেটা তাদের জীবনে কতটা কাজে লেগেছে, তার হিসেব তারা করে কি না জানি না, কিন্তু তারা তাদের রাষ্ট্র ও সমাজ-নির্ধারিত ভূমিকা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। আমরা তাদের জীবন নির্মাণ করি, এটা একটা অতিরঞ্জিত দাবি– তারা নিজেরা এবং আরও অনেকে তাদের জীবন নির্মাণ করে। কিন্তু তারা যে ভালোবাসা আমাকে দেয়, নিজের সন্তানের ভালোবাসা ছাড়া তার তুলনা আমি কোথাও পাই না। আমি তাদের ভালোবাসা কি সে ভাবে ফিরিযে দিই? তাদের অনেকে অকালে চলে গেছে, এই শোকও আমরা বহন করি। যারা আছে তারা সবাইকে নিয়ে আনন্দে, কর্তব্যে জীবনের সঙ্গে লগ্ন হয়ে থাক।
………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
………………………………………………………