সব ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বেশ চলছিল ওঁর পরিব্রাজক জীবন ! আজ এই বইমেলায়, তো কাল কোনও কবিতাপাঠের আসরে। একেবারে সুন্দরবনের ম্যাংগ্রোভস থেকে দার্জিলিং-এর পাইন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেই যাত্রা! যাত্রার শুরুটা হয়েছিল ‘শ্রীরামপুর স্টেশনের একটি মহুয়া গাছ’ নিয়ে। শ্রীরামপুর স্টেশনে মহুয়া গাছটা দেখেই কবির মননে শুরু হয়ে গিয়েছিল একটি ভাবনার nucleation… সেই ভাবনার nucleation থেকেই জন্ম হয়েছিল একটি কবিতার। সেই কবিতাই কালে রূপ নিয়েছিল একটি গানের। সুর দেওয়া হল। জন্ম হল একটি অসাধারণ লোকগীতির। যার ডায়ালেক্ট পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার আদিবাসীদের ভাষার সঙ্গে মেলে।
চলে গেল মারাংবুরু..
ফেসবুকেই খবরটা পেলাম। একটা পোস্টিং, যিনি লিখেছেন তাঁকে চিনি না, তবে, যাঁকে নিয়ে লিখেছেন তাঁকে তো বিলক্ষণ চিনি! ‘কবিবুড়ো’। এ নামেই ডাকতাম তাঁকে। সকলের সামনে অবশ্য ‘অরুণদা’ বলেই সম্বোধন করতাম। উনিও আমাকে ‘বুড়ো’ বলেই সম্বোধন করতেন। ওঁর কাছে অবশ্য সব ছেলেই ‘বুড়ো’, আর সব মেয়েই ‘বুড়ি’ ছিল। সেখানে বয়সের কোনও সীমা-টিমা ছিল না। সেখানে সবাই ‘বুড়ো’ আর সবাই ‘বুড়ি’। এই ‘বুড়ো-বুড়ি’-র দলের সবার জন্য বরাদ্দ থাকতো ‘লজেন্স’। এই ‘লজেন্স’-এরও বিবর্তন দেখেছি। একদম প্রথম দিকে যেমন দেখেছি ঝোলার থেকে বের হত ‘লেবু লজেন্স’, তেমনই অনেক অনেক পরে দেখেছি ‘অ্যালফানলিবে’।
গোয়াতে একসঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ঘটনাচক্রে সেটা ছিল বড়দিন। প্রায় সবার কাছে উনি হয়েছিলেন চলমান ‘সান্তাক্লজ’ ! চেহারাটাও তো তাই ছিল। একেবারে শেষের দিনেও এতটুকু অন্যরকম ছিল না! মাথায় হলুদ ফেট্টি। গায়ে লাল রঙের জামা। আর পরনে থাকত নীল রঙের জিনস্। ইদানীং গায়ে আরেকটা গয়না চেপেছিল, সেটা হচ্ছে ‘খাদা’। সেটার রংও ছিল কখনও হলদে, কখনও গেরুয়া, আবার কখনও ঘিয়ে।
সব ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বেশ চলছিল ওঁর পরিব্রাজক জীবন ! আজ এই বইমেলায়, তো কাল কোনও কবিতাপাঠের আসরে। একেবারে সুন্দরবনের ম্যাংগ্রোভস থেকে দার্জিলিং-এর পাইন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেই যাত্রা! যাত্রার শুরুটা হয়েছিল ‘শ্রীরামপুর স্টেশনের একটি মহুয়া গাছ’ নিয়ে। শ্রীরামপুর স্টেশনে মহুয়া গাছটা দেখেই কবির মননে শুরু হয়ে গিয়েছিল একটি ভাবনার nucleation… সেই ভাবনার nucleation থেকেই জন্ম হয়েছিল একটি কবিতার। সেই কবিতাই কালে রূপ নিয়েছিল একটি গানের। সুর দেওয়া হল। জন্ম হল একটি অসাধারণ লোকগীতির। যার ডায়ালেক্ট পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার আদিবাসীদের ভাষার সঙ্গে মেলে। একেবারে মনে হয় গানটির ভিতর দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় লাল পাহাড়ির দেশে, পৌঁছে যাওয়া যায় মাদলের দেশে! গানটির জনপ্রিয়তা যেন বুলেট ট্রেনের গতিতে ছুটে চলল দেশে-বিদেশে! গানটি শুধু প্রতিবেশী বাংলাদেশেই নয়, বিদেশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যাত্রা, থিয়েটার, সিনেমাতেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে গানটি। এই গানটিই কবিবুড়োকে চিনিয়েছে, সমুদ্র-সমান জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে, মানুষের ভালোবাসা এনে দিয়েছে।
চলে গেছেন কবি-বুড়ো। থেকে যাবে এই গানটি।
স্মৃতির পথ ধরে একটু পিছনের দিকে চলে যাই। সালটা ’৭২ হবে। কবি চাকুরিসূত্রে হিন্দমোটরস-এ তখন। সেন্ট্রাল ল্যাবে। প্রথম দিকে চন্দননগর-হিন্দমোটরস লোকাল ট্রেনে যাতায়াত। তারপর চুঁচুড়ার ফার্ম সাইড রোডে বাড়ি। বাড়ির নাম দিলেন ‘সোনাজুড়ি’। অতঃপর লোকাল ট্রেনে চুঁচুড়া-হিন্দমোটরস যাতায়াত। মাঝেমাঝে খেয়াল হলে শ্রীরামপুর-শেওড়াফুলি-ভদ্রেশ্বরে নেমে যেতেন। সেভাবেই একদিন শ্রীরামপুরে নেমে গেলেন। স্টেশনেই চোখে পড়ে গেল মহুয়া গাছটা। তারপরই সেই ভাবনার nucleation…প্রসব হল কবিতার লাইনের… ও তুই লাল পাহাড়ির দেশে যা… রাঙা মাটির দেশে যা… হিথাক তুকে মানাইছে নারে… ইক্কেবারেই মানাইছে নারে…! কবিতাটা গান হল, তারপর সবটা ‘মিথ’ হয়ে গেল!
স্মৃতি বলছে একটা ইপি রেকর্ড তৈরি হয়েছিল। একদিকে কবি অরুণ চক্রবর্তীর তিনটি কবিতায় সুর দিয়ে গান। অন্যদিকে একই ডায়ালেক্টে লেখা অন্য তিনটি কবিতায় সুর দিয়ে গান। কবির নাম অরুণ চট্টোপাধ্যায়। গাইলেন বাঁকুড়ার শুশুনিয়াবাসী সুভাষ চক্রবর্তী। তিনিও কিছুদিন আগে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন। তার মধ্যে ছিল ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা…’ গানটি। গানটি উড়তে উড়তে উড়তে উড়তে কবি অরুণের ভাষাতেই হয়ে গেল ‘আকাশে আলভোলা’ ! শুশুনিয়াতে নিজের দোতলা বাড়ির সবটা ঘুরে ঘুরে দেখাতে গিয়ে সুভাষ বলেছিলেন মনে আছে… ‘এই যে ইটগুলো দেখছেন, এর সবটাতেই অরুণদার নাম লেখা হয়ে আছে…’। ইপি রেকর্ডটার বাম্পার সেল হয়েছিল। সেটা হয়েছিল ওই ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা…’ গানটির কারণেই।
চুঁচুড়ার সোনাজুড়ি’র দেড়তলার ঘরে কবিতার আসর বসত মাঝে মাঝে। আড্ডাও হত। সবটাই কবিতা নিয়ে। বহুবার ওই ঘর থেকে হারিয়ে যাওয়া কবিতার খাতা বা কাগজ খুঁজে দিয়েছি। তেমনই একটা কবিতার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ‘আধখানা ঘর’। অরুণদা বলেছিলেন, ‘জানিস বুড়ো, এই কবিতাটা আমার অক্সফোর্ডের এক বন্ধু অনুবাদ করেছিল। নাম দিয়েছিল, ‘Half-a-room’। কবিতার একটা লাইন ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল… ‘ইচ্ছেমতো খুন করছে এমনই এক কসাই…লোহার দরজা ঝুলছে নোটিশ…আমার মাত্র আধখানা ঘর কোথায় তোমায় বসাই…!’
আলোচনা হয়েছিল কবির সঙ্গে। কী লাইনই লিখেছেন! গ্লোবালাইজেশন ও কনজিউমারিজমের চরম দিনে বসে অনুভব করতে পারছিলাম, কবিতার লাইনগুলো কী নির্মম কথাটাই না বলছে! একদিন আমাদের প্রত্যেকের ‘একখানা’ করে পূর্ণাঙ্গ ঘর ছিল, যা এখন ছোট হতে হতে আধখানা হয়ে গিয়েছে। সেই আধখানা ঘরে আমরা এখন আমাদের অতি প্রিয়জনকেও বসতে দিতে পারছি না। অক্সফোর্ডের বন্ধু লিখলেন… “ I’ve half a room…Where do I let you sit in comfort…”।
………………………………………………
সালটা ’৭২ হবে। কবি চাকুরিসূত্রে হিন্দমোটরস-এ তখন। সেন্ট্রাল ল্যাবে। প্রথম দিকে চন্দননগর-হিন্দমোটরস লোকাল ট্রেনে যাতায়াত। তারপর চুঁচুড়ার ফার্ম সাইড রোডে বাড়ি। বাড়ির নাম দিলেন ‘সোনাজুড়ি’। অতঃপর লোকাল ট্রেনে চুঁচুড়া-হিন্দমোটরস যাতায়াত। মাঝেমাঝে খেয়াল হলে শ্রীরামপুর-শেওড়াফুলি-ভদ্রেশ্বরে নেমে যেতেন। সেভাবেই একদিন শ্রীরামপুরে নেমে গেলেন। স্টেশনেই চোখে পড়ে গেল মহুয়া গাছটা। তারপরই সেই ভাবনার nucleation…প্রসব হল কবিতার লাইনের… ও তুই লাল পাহাড়ির দেশে যা… রাঙা মাটির দেশে যা… হিথাক তুকে মানাইছে নারে… ইক্কেবারেই মানাইছে নারে…! কবিতাটা গান হল, তারপর সবটা ‘মিথ’ হয়ে গেল!
………………………………………………
কবির কোনও ভ্যানিটি ছিল না। যেখানে সেখানে বসে পড়তেন চায়ের ঠেকে। কেউ চাইলেই এক টুকরো কাগজে কোনও কবিতার লাইন লিখে দিতেন। তারপর সেটার কী হত, জানতেও চাইতেন না। এমনিই সরল জীবন-যাপন। তাই তো লিখতে পেরেছিলেন… ‘জীবন বড় সহজ ছিল…কেন জটিল করলে…ভুলভুলাইয়া ভুলের বাগান…শুধুই ঘুরে মরলে…!’
ওঁকে নিয়ে ঘুরেছিলাম পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-মেদিনীপুর-বীরভূমের অনেক গ্রাম। বীরভূমটাই বেশি মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, ঝাড়গ্রামের একটা গ্রামের কথা। একটা সেল্ফ-হেলপ গ্রুপের কথা। আদিবাসী মেয়েদের গ্রুপ ছিল সেটা। যখন আমরা উঠব উঠব করছি, মেয়েদের লিডার বলে উঠল, ‘তু থেইক্যে যা…’। আমাকে নয়, অরুণদাকে। অরুণদা হাসি হাসি মুখ করে বলেছিলেন, ‘কী খাওয়াবি বল?’ মেয়েটি একটুও না ঘাবড়িয়ে বলেছিল, ‘ভাত দিব’। অরুণদা, ‘শুধু ভাতে কী হবে রে!’ মেয়েটি– ‘নুন দিব’। অরুণদা, ‘তাতেও হবে নারে’। ‘লঙ্কা দিব’। অরুণদা মাথা নেড়েছিল। মেয়েটি পাশের আরেকটি মেয়েকে শুধিয়েছিল, ‘তুর ঘরকে পিঁয়াজ আছে?’ মেয়েটি বলেছিল, ‘হ। আর কা চাই?’ ভাবটা এইরকম! অরুণদার চোখে জল এসে গিয়েছিল। অরুণদা পান্তা’র দোকান চেয়েছিলেন এদের জন্য।
এই ছিল কবিবুড়োর আরেক দিক। মানুষের সঙ্গে মেশার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল। আর ওঁর কবিতার ‘ফ্যান’ যে কোথায় কোথায় লুকিয়ে থাকত, তা বলা মুশকিল। বীরভূমের রাজনগর ব্লকে ওয়াটারশেড ডেভেলপমেন্টের ওয়ার্কশপ চলছে। বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটল পর পর। অরুণদাকে অ্যাফরেস্টেশনের একটা ক্লাস নিতে বললাম। স্কুলের রুমে ক্লাস চলছে। জানলার বাইরে থেকে কারা যেন উঁকি মেরে দেখছে। ক্লাসের সবাই তো অরুণদাতে মজে আছে। বাইরের ওরা তাহলে কে?
পরদিন বিডিওর মুখে শুনেছিলাম। বাইরে থেকে যারা উঁকি দিচ্ছিল তারা সামনের একটা ক্লাবের সদস্য সব। ওরা একটা কাণ্ড ঘটিয়েছিল। এই রাস্তায় একটা ছোট্ট জঙ্গল ছিল। জঙ্গল কাটার ষড়যন্ত্র হচ্ছিল। ওরা বন্ধ করে দিয়েছিল। অরুণদার ক্লাসের প্রভাব নাকি! গাছ তো ‘সবুজ সন্ন্যাসী’ অরুণদার কাছে। ‘গাছ বোনার গান’ কবিতাই তো এনে দিয়েছিল জাতীয় পুরস্কার।
শেষদিন ফিল্ডের কাজ চলছিল। ব্লকের সভাপতি এসে হাজির সেখানে। জানালেন আজ হুল পরব। অনুষ্ঠান হবে। অরুণদাকে উনি বিশেষ অতিথি হিসাবে নিয়ে যেতে চান। অরুণদা আমার দিকে তাকালেন। সভাপতি বলেছিলেন, ‘আপনি আমাদের মারাংবুরু’। সার্কিট হাউসে এসে সেদিন লিখেছিলেন ‘হুল পরব’ কবিতা। ২৮ বছর বাদে প্রসব হয়েছিল কবিতাটার।
ওই বীরভূমেই বাউলদের গাইতে দেখেছি– ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা’ গানটি। জয়দেবের বাউল মেলায়।
সেই মেলায় কবি শক্তি, সাহিত্যিক সমরেশ বসুর কথা শুনেছি ওঁর মুখে। কবি শক্তিকে বাঁচিয়েছিলেন মৃত্যুর মুখ থেকে। সবটাই আছে ‘কখনো উজানে কখনো ভাটায়’ লেখাটায়। বেরিয়েছিল মাসকাবারি ‘ই-ম্যাগাজিন’-এ। মারাংবুরু দেখে যেতে পারলেন না!
………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………..