ভারতের কোয়ালিশন রাজনীতির আজকের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে কেন তাঁর মৃত্যু একটি বড় ক্ষতি, সেটা বোঝাতে রাজ্যসভা সদস্য হিসেবে তাঁর শেষ দিনটির কথা উল্লেখ করতে হয়। তাঁকে বিদায় জানাতে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সমাজবাদী দলের সদস্য অশ্রুসজল হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছেন। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ইয়েচুরি। সমাজবাদী সদস্যকে সান্ত্বনা দিতে শাসক বেঞ্চ থেকে ছুটে আসছেন বিজেপি সদস্য মুক্তার আব্বাস নকভী। একটা সময়ে প্রকাশ কারাত সীতারাম ইয়েচুরিদের সমালোচনা করে পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির মানুষ বলতেন, ওঁরা তো ভোটে না জিতে নেতা হয়েছেন। হ্যাঁ, সীতারাম ইয়েচুরি কখনও ভোটে জিতে মন্ত্রী বিধায়ক হননি। তারপরও দলমত নির্বিশেষে যে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা তিনি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্জন করেছিলেন, সেটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।
জনসাধারণ তাঁকে শেষবার দেখেছে গত ২২ আগস্ট, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্মরণসভার ভিডিও বার্তায়। হাসপাতালের বিছানায় বসে পাঠানো ৬ মিনিটের বার্তায় তিনি দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন যে, তাঁর প্রিয় বুদ্ধদার মৃত্যুর পর কলকাতায় এসে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেননি। এমনকী, স্মরণসভায় আসার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আসতে পারলেন না।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মৃত্যুর আগের দিন চোখের ছানি অপারেশন করিয়েছিলেন সীতারাম। ফলে পরের দিনই কলকাতায় আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কলকাতা থেকে দলের তরফে জানানো হয়েছিল ২২ আগস্ট নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের স্মরণসভায় প্রধান বক্তা হিসেবে থাকবেন সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। ১৯ তারিখ হঠাৎই নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁকে ভর্তি করানো হয় নতুন দিল্লির এইমস হাসপাতালে। নেতাজি ইনডোরে তাঁর যে ভিডিও বার্তাটি দেখানো হয় সেখানে তাঁকে সামান্য দুর্বল দেখালেও, সেখানে উপস্থিত দলীয় কর্মী সমর্থকরা কল্পনাও করতে পারেননি যে, সেটাই জীবিত সীতারামকে তাঁদের শেষ দেখা!
আসলে, সত্যিই অসময়েই চলে গেলেন সীতারাম ইয়েচুরি। বয়স হয়েছিল ৭২। তবু তাঁর এই চলে যাওয়া অসময়েই। বয়সটা ততটা বিচার্য বিষয় নয়, ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান সময়ে তাঁর অনুপস্থিতি একটা অর্থবহ শূন্যতারই সৃষ্টি করবে। ভারতের বিরোধী রাজনীতির জন্য তাঁর মৃত্যু নিঃসন্দেহে একটি আঘাত। অথচ লোকসভায় তাঁর দলের সদস্য সাকুল্যে চারজন। রাজ্যস্তরে দলের সরকার রয়েছে একমাত্র কেরলে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় একজনও সদস্য নেই। পরপর তিনটি নির্বাচনে হেরে গিয়েছে দল। ত্রিপুরাতেও দীর্ঘদিনের বাম শাসনের অবসানের পর একের পর এক নির্বাচনে হেরেই চলেছে বামপন্থীরা। হিংসাত্মক আক্রমণে বহু কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। অসংখ্য কর্মী ঘরছাড়া। এতগুলো ‘নেই’ এর পরও ভারতের রাজনীতিতে বামপন্থীদের গুরুত্ব কমেনি। প্রশংসা বা নিন্দা– যে অর্থেই হোক, বামপন্থীদের নিয়ে কথা বললে সিপিআইএমের কথা বলতেই হয়।
দলের এই সর্বভারতীয় গুরুত্ব এবং রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সীতারাম ইয়েচুরির মর্যাদার আসনটি নির্বাচনী পাটিগণিতের হিসেব দিয়ে বোঝা যাবে না। আর বিষয়টা শুধু মর্যাদার নয়, গ্রহণযোগ্যতারও। মতপথ নির্বিশেষে সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে সীতারাম ইয়েচুরির গ্রহণযোগ্য ছিল প্রশ্নাতীত। এই গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদাই তাঁকে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের দলগুলির কৌশল ও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সামনের সারিতে নিয়ে এসেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও সীতারামকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে সরাননি রাহুল গান্ধী বা ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের অন্য নেতারা। ১৯৯৬ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ও ইউপিএ সরকারের অভিন্ন সাধারণ কর্মসূচির রচনায়ও তাঁর ছিল অগ্রণী ভূমিকা। বিভিন্ন মত-পথের মানুষ ও দল সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে অভিন্ন পথ নির্মাণ করতে পারার দক্ষতার কথা মনে রেখে আজকের আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনার পর কোনও কোনও মহল তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে অভিহিত করেছে হরকিষেণ সিং সুরজিতের ঘরানার কমিউনিস্ট হিসাবে। এটা কি সত্যিই কোনও আলাদা ঘরানা?
কমিউনিস্ট রাজনীতিতে ব্যক্তিনেতার ওপর দলীয় নীতি কৌশল নির্ভর করে না। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সমষ্টিগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই। জ্যোতি বসুর মতো কমিউনিস্ট নেতাকেও নিজের মতের বিপরীত সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রিত্বের অনুরোধ প্রত্যাখান করতে হয়েছে। বামপন্থী রাজনীতির এটাই বৈশিষ্ট্য। তবে এই বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও বামপন্থী রাজনীতিতেও কোনও কোনও সময়খণ্ডে ব্যক্তিনেতা সুনির্দিষ্ট এমন কিছু ভূমিকা পালন করেন যা বামপন্থী রাজনীতিতে বাঁকবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। ১৯৭৭ সালের আগেও কেরল ও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কমিউনিস্টরা রাজ্য সরকার গঠন করেছে, তবু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনে একটি অঙ্গরাজ্যে সরকার পরিচালনার নীতিগত কৌশলের পথটি রচনায় মুখ্য ভূমিকা ছিল জ্যোতি বসুর। ১৯৫৯ সালের কেরল ও ১৯৬৭, ১৯৬৯ সালের পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতার পর ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসা বামপন্থীদের সর্বক্ষণের আশঙ্কা ছিল যে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে মধ্যপথে সরকার ভেঙে পড়বে। দু’বার পূর্ণ মেয়াদে সরকার চলার পর সীমাবদ্ধ ক্ষমতায় সরকার পরিচালনার বিকল্প পথ নিয়ে ভাবনাচিন্তার শুরু হয়। জ্যোতি বসু এই বিশেষ ভূমিকাটিতেই অনন্য হয়ে ওঠেন। হরকিষেণ সিং সুরজিতের অবদান ছিল ভিন্ন ক্ষেত্রে। ১৯৭৭ সালের পর জাতীয় স্তরে ‘কোয়ালিশন রাজনীতি’র সূচনা হয়। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৬ কোয়ালিশন রাজনীতিতে প্রচুর ভাঙাগড়া হয়। কংগ্রেস-বিরোধিতাসর্বস্ব বিরোধী রাজনীতির দ্বিমেরু আরএসএস প্রশ্নকে ঘিরে ত্রিমুখী চরিত্র অর্জন করে।
কোয়ালিশন রাজনীতির এই পর্বেই বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির নীতিকৌশল প্রণয়নে হরকিষেণ সিং সুরজিতের ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সুরজিতের মৃত্যুর পর সীতারাম ইয়েচুরি এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এই সময়পর্বে কংগ্রেস ও বিজেপির সঙ্গে সমদূরত্বের বিরোধী রাজনীতি ধীরে ধীরে বিজেপি বিরোধিতায় কেন্দ্রীভূত হয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সমন্বয়ের পথে এগোয়। সীতারামকে শুধু বিরোধী জোট গঠন নয়, নিজের দলের রণকৌশলগত বাঁকবদলেও অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হয়েছে। তর্কবিতর্ক ও তীব্র মতপার্থক্যের একটি কঠিন পর্বে তিনি সুদক্ষ নাবিকের মতো দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালনা করেছেন।
রাজনৈতিক মহলে সীতারামকে কৌশলগত প্রশ্নে নমনীয় বলে মনে করা হলেও সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে দলের অভ্যন্তরে তাঁর পরিচয় একজন নিবেদিত মার্কসবাদী লেনিনবাদী হিসেবেই। জনগণের জীবন-জীবিকার অর্থনৈতিক প্রশ্নকে দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতেন। আবার আজকের সময়ে দলিত রাজনীতি ও প্রান্তিক লিঙ্গের সমানাধিকারের সংগ্রামকে মার্কসবাদী শ্রেণি রাজনীতির সঙ্গে সমন্বিত করার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। ভারতের কোয়ালিশন রাজনীতির আজকের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে কেন তাঁর মৃত্যু একটি বড় ক্ষতি, সেটা বোঝাতে রাজ্যসভা সদস্য হিসেবে তাঁর শেষ দিনটির কথা উল্লেখ করতে হয়।
তাঁকে বিদায় জানাতে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সমাজবাদী দলের সদস্য অশ্রুসজল হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছেন। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ইয়েচুরি। সমাজবাদী সদস্যকে সান্ত্বনা দিতে শাসক বেঞ্চ থেকে ছুটে আসছেন বিজেপি সদস্য মুক্তার আব্বাস নকভী। একটা সময়ে প্রকাশ কারাত সীতারাম ইয়েচুরিদের সমালোচনা করে পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির মানুষ বলতেন, ওঁরা তো ভোটে না জিতে নেতা হয়েছেন। হ্যাঁ, সীতারাম ইয়েচুরি কখনও ভোটে জিতে মন্ত্রী-বিধায়ক হননি। তারপরও দলমত নির্বিশেষে যে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা তিনি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্জন করেছিলেন, সেটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার বিশ শতকের মার্কসবাদী রাজনীতির পথ থেকে একুশ শতকের মার্কসবাদী পথ অনেকটাই ভিন্ন হয়ে গিয়েছে। মৌল আদর্শে অটল থেকে নতুন সময়ের ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো মেধা ও সংবেদন সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ভারতের বামপন্থী রাজনীতিতে খুব বেশি নেই। সীতারাম ইয়েচুরি ছিলেন সেই হাতেগোনা বামপন্থীদের একজন। এই কারণেও তাঁর মৃত্যু বামপন্থী আন্দোলনে জন্য এক বড় শূন্যতার সৃষ্টি করবে।