আসলে গল্পটা কাঁধের। শক্ত কাঁধ আর নরম কাঁধ। মন কিন্তু সকলেরই পরিণত। তাই ছোটদের জন্যে লেখা মানে আমার চেয়ে বুদ্ধিমান, মেধাবী এবং অনেক বেশি স্পর্শকাতর একটি মনের খোরাক জোগানোর কাজ। শক্ত কাজ। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি কখনও ছোটদের জন্যে কিছু লিখিনি, লিখব না… আমি লিখি আমার বন্ধুদের জন্য, তাদের কারও কারও বয়স আমার চেয়ে বেশ কম।
ছোটদের জন্য লেখা? সে আবার কী? কে ছোট? কীসে ছোট আর কতটা ছোট? বয়সে ছোট; তার মানে সময়ের হিসেবে? আচ্ছা বেশ। কিন্তু সময়ের গোলকধাঁধা, সময়ের মার যে মুহূর্তে মনে করেছি যে, খানিকটা আত্মস্থ করতে পেরেছি, ঠিক সেই মুহূর্তে জীবন জানান দিয়েছে অন্য কিছু। আর এগুলো ছাড়া পড়ে রইল বুদ্ধি, মেধা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই বুদ্ধি আর মেধার একেবারে প্রাথমিক স্তর কী জানেন? গভীর এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ। সেখানে ছোটদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া খুব কঠিন কিন্তু। ওসব লেখা-টেখা ছাড়ুন, আমার ছোটবেলার একটা ঘটনা বলি এই প্রসঙ্গে।
আটের দশক প্রথম দিক, সে-সময় পৃথিবীটা অন্যরকম ছিল। পাড়ার একটি কি দু’টি বাড়িতে সাদা-কালো টিভি থাকত, সেখানেই আমরা দল বেঁধে বাচ্চারা স্পাইডারম্যান কার্টুন-সিরিয়াল দেখতে যেতাম। একদিন গিয়ে দেখলাম তাদের বাড়িতে রঙিন টিভি এসেছে। সেই টিভি-র গোল গোল সুইচ থেকে আলো বেরচ্ছে, মনে হচ্ছে এত সুন্দর সুইচগুলো! ‘এখন থেকে সব ছবি রঙিন দেখতে পাবি বুঝলি?’– বেশ গর্বের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে বলল সেই প্রতিবেশী দাদা। আমি ওই আলো বের হওয়া সুইচগুলোর দিকে (রেডিয়াম দেওয়া ছিল বোধহয়, বড় হয়ে বুঝেছি) এগিয়ে গেলাম একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য, সুইচ বা নবগুলো ঘোরানোর অভিপ্রায় আমার ছিল না মোটেই। কিন্তু সেই প্রতিবেশী দাদার মা, যাঁকে আমি ‘জ্যেঠিমা’ বলতাম, তিনি ধমকে উঠলেন। আমি চমকে উঠে থতমত খেয়ে ওঁর দিকে তাকিয়েছিলাম। উনি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। আমি কুঁকড়ে। তারপর তো কত সময় চলে গিয়েছে, জীবনে কত ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু জ্যেঠিমার ওই তাকানোটা ভুলিনি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আটের দশক প্রথম দিক, সে-সময় পৃথিবীটা অন্যরকম ছিল। পাড়ার একটি কি দু’টি বাড়িতে সাদা-কালো টিভি থাকতো, সেখানেই আমরা দল বেঁধে বাচ্চারা স্পাইডারম্যান কার্টুন-সিরিয়াল দেখতে যেতাম। একদিন গিয়ে দেখলাম তাদের বাড়িতে রঙিন টিভি এসেছে। সেই টিভি-র গোল গোল সুইচ থেকে আলো বেরোচ্ছে, মনে হচ্ছে এত সুন্দর সুইচগুলো! ‘এখন থেকে সব ছবি রঙিন দেখতে পাবি বুঝলি?’– বেশ গর্বের সঙ্গে বুক ফুলিয়ে বলল সেই প্রতিবেশী দাদা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কেন ভুলতে পারিনি? কী সে অস্বস্তি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে? এই ঘটনার প্রায় ২৫-৩০ বছর পর আধুনিক সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল-এর একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম ‘অন এডুকেশন’ নামে, যেখানে তিনি লিখছেন– ‘do not humiliate other people- this should be the basic education of human civilization.’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: সন্দেশে লেখকদের পারিশ্রমিক ছিল লেখার সঙ্গে বাবার অলংকরণ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আজ বুঝি, জ্যেঠিমা তাঁর বৈভব দিয়ে হীনমন্যতার খাদের একেবারে কিনারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। কী যেন এক ভারী মনখারাপ বয়ে বেড়িয়েছিলাম কয়েকদিন। অন্য কারও কেনা নতুন জিনিসে হাত দিতে গেলেই আমার সেই প্রতিবেশী জ্যেঠিমার মুখটা মনে পড়ে যেত। এখন আর অত প্রকটভাবে মনে পড়ে না। জীবনের আরও নানা অপমান, কখনও খুশি কিংবা না পাওয়ার আফসোসের ভিড়ে সেই মুখ আজ যেন অনেক দূরে চলে গিয়েছে, স্পষ্ট দেখতে পাই না। শুধু সেই ভারী মনখারাপটা অনুভব করতে পারি এখনও। অথচ দেখুন কি আশ্চর্য শিক্ষাই তো দিয়েছিলেন সেদিন তিনি। অদ্ভুত এক বিমূর্ত বিষয় নিয়ে শিক্ষা– মালিকানা। এটা আমার, এটা তোমার– কিংবা এই মানুষটা আমার, কারণ ওকে আমি ভালোবাসি– এমনই নানা বিদ্ধ অবাস্তব অনৈতিক বিষয়। পরে ভেবে দেখেছি, এতটা রূঢ় না হলে খুব কি অসুবিধে হত ভদ্রমহিলার? কে জানে!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: শিশু সাহিত্যে কমছে শিশুদের ভিড়, প্রকাশকরা ঝুঁকছে বড়দের বইয়ে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আর কয়েকদিনের মধ্যেই বাবাকে বললাম, আমাদের টিভি কেন নেই বাবা? আমাদের টিভি চাই। কান্নাকাটিও জুড়েছিলাম বোধহয়। তখন সেই মুহূর্তে টিভি কেনার সামর্থ ছিল না হয়তো। সন্তান কিছু চাইলে তা না দিতে পারার মধ্যেও অসহায়তা আছে , যারা বায়না করে তারা সেই অন্ধকার খুপরি মন খারাপের খোঁজ হয়তো পায় না। অথবা পায় অনেক বছর পর, নিজে জোয়াল কাঁধে হেঁটে যেতে যেতে।
আসলে গল্পটা কাঁধের। শক্ত কাঁধ আর নরম কাঁধ। মন কিন্তু সকলেরই পরিণত। তাই ছোটদের জন্যে লেখা মানে আমার চেয়ে বুদ্ধিমান, মেধাবী এবং অনেক বেশি স্পর্শকাতর একটি মনের খোরাক জোগানোর কাজ। শক্ত কাজ। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি কখনও ছোটদের জন্যে কিছু লিখিনি, লিখব না… আমি লিখি আমার বন্ধুদের জন্য, তাদের কারও কারও বয়স আমার চেয়ে বেশ কম।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
খাটের তলায় বিছানো আম আর প্রতি রাতে জলে ভেজানো আম চলত বৈশাখের শেষ থেকে জৈষ্ঠ্যের শেষ অবধি। সকালে টিউশন পড়তে যাওয়ার আগে চারপিস আম দিয়ে মুড়ি। পড়ে এসে পুকুরে চান করতে গিয়ে দু’পিস। গায়ে আমের রস পরলে স্যাটাস্যাট ধুয়ে ফেল। একে বলে একশোভাগ চ্যাটচ্যাট-মুক্ত আম খাওয়া।
ছাতা নিয়ে যে যাচ্ছে নিজেকে কোনও রকমে বাঁচাতে, তার দিকে তাকাও হাসিমুখে, ইশারায় অন্তত জানাও তার কাঁধ ভিজে গেছে, পিঠের ব্যাগ ভিজছে, জলের স্রোতে পা রাখাই দায়। ইশারা না-বুঝলে চিৎকার করেই বলো। জলে পা রাখো, চুল ভিজে যাক, বৃষ্টির তোড়ে দৃষ্টি ঝাপসা হোক, জামার সঙ্গে শরীর জুড়ে যাক।
২৫ বৈশাখের সময় যেমন অনেক সময়েই সঞ্চালক হিসেবে থেকেছি স্টুডিও-তে, কখনও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, কখনও রবীন্দ্র সদনের অনুষ্ঠান দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে বলেছি রবীন্দ্রনাথের কথা, পড়েছি তাঁর রচনা থেকে, ঠিক সেই ‘গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড’ পদ্ধতিতে পুজোর বৈঠক সম্প্রচারিত হত।