Robbar

মাতৃভাষা, মানে মায়ের বুলি, মানে মায়ের ডায়লগ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 21, 2024 5:11 pm
  • Updated:February 21, 2024 5:40 pm  

বহু যুগ হল, জনগণ খিল্লিকে ভেবে নিয়েছে ‘হাস্যরস’। টুসকিতে মেসেজ ফরোয়ার্ডের দৌরাত্ম্যে, মায়েরা হয়ে গেছে ‘মিম মম’। হ্যাহ্যাল্যাল্যাখৌখৌ ফেলে, আলতো একটু ভাবলে মনে হয়, কতটা অপার্থিব হা-হুতাশে বসে থাকে সে, ‘মেরে করণ অর্জুন আয়েঙ্গে…’। যেন নিজের কিছু করার নেই, করার ছিলই না। জ্বলন্ত চোখ ও পড়ন্ত শাড়ি ছাড়া, কবি তাকে দিয়েছেন শুধু হিসহিসে বুলি।

উদয়ন ঘোষচৌধুরি

কবি বললেন– কারণ, চুপ থাকলে তিনি চাপে পড়ে যাবেন, পেমেন্ট ক্রেডিট হবে না– তাই, এক সঘন প্রত্যুষে বলেই ফেললেন, ‘মা মাগো মা মাগো মা, আমি এলুম তোমার কোলে, তোমার ছায়ায় তোমার মায়ায় নালে ঝোলে অম্বলে…।’ ব্যস, ওমনি দেশি মাতৃকুণ্ড আদেখলাপনায় ধেইধেই। মাতৃশক্তির হাল হল এমন বেহাল, গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে সুটকেস গুছিয়ে ভিন-শহরে গমনোদ্যত ছেলের সঙ্গে হেঁড়ে-কণ্ঠী বাবার লাফড়ার মাঝে পড়ে, ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি মা’ কী বলবে ভেবে না পেয়ে, চকিত চমকিত অস্ফুটে স্বামীকে, ‘এ তুমি কী বললে!’ (যেন কী কী বলা উচিত ছিল, সবই নিজের জানা ছিল; শুধু আলজিভে হাজা হয়েছে বলে বলতে পারেনি) এরপর, সিঁড়িতে ধাঁ ধাঁ ধাবিত ছেলের পিছুপিছু, আঁচলের খুঁট চুষতে চুষতে বং-মাতৃকার একটাই চিরাচরিত বাণী, ‘যাসনে বাবা, যাসনে…’ (সিনেমা: দেয়া নেয়া)।

পর্দার 'ঝগড়াটে' ছায়া দেবী অবিরাম কুড়িয়েছেন দর্শকের অভিশাপ, অন্তিম পরিণতি হয় চরম মর্মান্তিক
‘দেয়া নেয়া’ ছবিতে মায়ের চরিত্রে ছায়া দেবী

পুরুষতন্ত্রের সহজ ফরমুলা– দুনিয়ায় যা কিছু উৎপাতের উৎস, তার একখানা মাতৃ-ভার্সন পুঁতে দিন। কেল্লা ফতে হবেই, আপনি শুধু তারিয়ে তারিয়ে ‘তারারারা’ করুন। নইলে, ভেবেচিন্তে দেখুন, টিকে থাকার যথেচ্ছ জগঝম্প ও ঢিসুম ঢিসুম, পদবি থেকে সম্পত্তি– সব যদি বাবার খামে, শুধু ভূমি আর ভাষার বিল কেন কাটে মায়ের নামে? হ্যাঁ, বাঙালির তর্ক করার জায়গা তো ফেসবুকে আছেই, এখানে বরং এই ফাঁকে কয়েকটা পয়েন্ট উসকে দিই।

মাতৃভাষা, মানে মায়ের বুলি, মানে মায়ের ডায়লগ। অলিখিত সাংবিধানিক অধিকারে, যেহেতু আমরা সিনেমা বুঝে ফেলি হামার আগেই, অতএব অথ সিনে-মায়ের কিছু বুলি।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

মা– কবি যাকে বললেন, ‘মমতাময়ী’– সে তো মূলত পিতৃতান্ত্রিক। তাছাড়া উপায়ও নেই তার। ‘সভ্যতা’ নামের প্রকৃষ্ট বেলুনটি আবিষ্কারের প্রথম দিনেই গুঁজে দেওয়া হল সম্পত্তির অধিকার। আলফা পুরুষ মারামারি করল, জমি নিয়ে। আর, নারীর জমিতে বীজ বপনের আগে, মাথায় সুচারু ঢুকিয়ে দিল এক রূপকথা, ‘বংশ’। এই ‘বংশ’-এর সার্বিক অর্থ, বাংলাতে কেন দু’রকম– সে তো ঢুকেছে যাদের, তারাই জানে। না জানলে, ‘ল্যান্ড গোল্ড উইমেন’ (ডিরেক্টর: অবন্তিকা হরি) দেখুন। অতি সাংঘাতিক ব্যাখ্যা দেওয়া আছে।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

বহু যুগ হল, জনগণ খিল্লিকে ভেবে নিয়েছে ‘হাস্যরস’। টুসকিতে মেসেজ ফরোয়ার্ডের দৌরাত্ম্যে, মায়েরা হয়ে গেছে ‘মিম মম’। হ্যাহ্যাল্যাল্যাখৌখৌ ফেলে, আলতো একটু ভাবলে মনে হয়, কতটা অপার্থিব হা-হুতাশে বসে থাকে সে, ‘মেরে করণ অর্জুন আয়েঙ্গে…’। যেন নিজের কিছু করার নেই, করার ছিলই না। জ্বলন্ত চোখ ও পড়ন্ত শাড়ি ছাড়া, কবি তাকে দিয়েছেন শুধু হিসহিসে বুলি। দিব্যি চার হাত-পায়ের একটা মানুষ গোটা ফিলিমে বেঁচে রইল, শুধু সন্তানদের ফিরে আসার অপেক্ষায় (সিনেমা: করণ অর্জুন)।

What was the name of Salman Khan in the movie 'Karan Arjun'? - Quora
‘করণ অর্জুন’ সিনেমায় শাহরুখ-সলমনের সঙ্গে রাখি গুলজার

কিংবা, ‘ক্যা ইসি দিন কে লিয়ে তুমহে পাল-পোষ কর বড়া কিয়া থা?’ (সিনেমা: গোলমাল) বা, ‘মেরে দুধ কা কর্জ চুকানে কা ওয়াক্ত আ গয়া হ্যায়… (সিনেমা: মাদার ইন্ডিয়া) বা, ‘জিস মা নে তুঝে নও মাহিনেঁ কোখ মেঁ রাকখা, জনম দিয়া, আজ তুনে উসে হি ভুলা দিয়া…’ (সাত-আটের দশকে একাধিক ফিল্মে প্রায় অস্ত্রের মতো ব্যবহৃত)। বাক্যগুলো ভাবলে, একটা দেওয়া-নেওয়া, একটা লেনদেনের ছবি মাথায় আসছে না? মাথায় আসছে না আমূল ম্যানিপুলেশনের প্যাঁচ? সন্তান প্রসব ও পালন– আদতে তো একটা জৈবিক ব্যাপার, বায়োলজিক্যাল প্রসেস। সেসবে ঐশ্বরিক রূপ দিয়ে, বাড়-ফার খাইয়ে, পেমেন্ট পেয়ে বেড়াতে চলে গেলেন কবি। ওদিকে, মা ও সন্তান, টানাপোড়েনে। মাতৃদুগ্ধ হয়ে গেল অনন্ত ঋণ। হোম লোনের ইএমআই চুকে গেল, এসবিআইয়ের লাঞ্চ আওয়ার শেষ হয়ে গেল– নার্গিস-নিঃসৃত ডায়লগ এমন গেঁথে গেল উপমহাদেশে, অশেষ আকুলি নিয়ে, সে দুধের দাম আর শোধ হল না।

This Iconic 1957-Film Made Sunil Dutt, Raaj Kumar And Rajendra Kumar Stars Overnight - News18
‘মাদার ইন্ডিয়া’ সিনেমায় মায়ের চরিত্রে নার্গিস

তাছাড়া, কবেই বা বায়োলজি বুঝতে চেয়েছে মা! নইলে, কে আর বলবে, ‘অউরৎ কা শরীর এক রহস্য কা খাজানা হোতা হ্যায়, এক বন্ধ গুফা মে রেহতা হ্যায়, অউর ইয়ে গুফা কব খুলতি হ্যায় পতাহ হ্যায়?’ (সিনেমা: শুভ মঙ্গল সাবধান)। এমন জীববিজ্ঞান পইপই পড়ালে, সন্দেহ নেই, জগৎসভায় জনসংখ্যায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবই। ওই একই অশিক্ষার আঁধার ঘনিয়ে ওঠে যখন প্রৌঢ় পুরুষের ঠোঁটে, ‘আকেলি লড়কি খুলি তিজোরি কে তরাহ হোতি হ্যায়…’, আলুথালু নায়িকার নাইট ড্রেস নেত্রজিহ্বায় লেহন করতে করতে, অন্ধকার সিনেমাহলে আমাদের ক্যালব্যাল হাসি (সিনেমা: জব উই মেট)।

‘তরা ভাবস আমি কন্দল করি… দশডা বছসরে মনডা আমার কোনখান থিক্যা কোনখান চইল্যা গেসে… ক্যামন য্যান হইয়া যাইতাসি আমি…’ হ্যারিকেনের আলোয় সেলাই-রত মায়ের আফসোসের সান্ত্বনায় মেয়ে যেই বলে, ‘চিন্তা কইরো না মা, আমি তো আছি…’ ব্যস, যেন এই ফাঁদ বেছানোর অপেক্ষাতেই বসেছিল মা! সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে মেপে নেয় মেয়েকে; জানে, মেয়ের জ্যোৎস্নায় ঘুরঘুর করছে এক সম্ভাব্য প্রেমিক; আঁকুপাঁকু বলে, ‘তরও ত সাধ-আল্লাদ আছে… কে জানে, হয়তো আরও কিছু আছে!’ মা-মেয়ের এই দৃশ্যে, যে কথোপকথন এঁকে গেলেন ঋত্বিক ঘটক, সম্ভবত, ম্যানিপুলেটিভ মাতৃভাষায় এরচে’ বড় মাইলস্টোন আর নেই (সিনেমা: মেঘে ঢাকা তারা)। ধ্বস্ত সংসারের জোয়ালটা টানতে, রোজগেরে মেয়েকেই বলি করতে হবে; তা সে যে মূল্যেই হোক। স্নেহ তো চর্বিরই আরেক নাম; পয়সার স্বাভাবিক স্রোতে ভাঁটা ঢুকে গেলে, চর্বি থাকে কি কোথাও?

মেঘে ঢাকা তারা'র নীতারা সবার মধ্যে বেঁচে থাকতে চায়, সাক্ষী থাকে পাহাড়
‘মেঘে ঢাকা তারা’র একটি দৃশ্য

মা– কবি যাকে বললেন, ‘মমতাময়ী’– সে তো মূলত পিতৃতান্ত্রিক। তাছাড়া উপায়ও নেই তার। ‘সভ্যতা’ নামের প্রকৃষ্ট বেলুনটি আবিষ্কারের প্রথম দিনেই গুঁজে দেওয়া হল সম্পত্তির অধিকার। আলফা পুরুষ মারামারি করল, জমি নিয়ে। আর, নারীর জমিতে বীজ বপনের আগে, মাথায় সুচারু ঢুকিয়ে দিল এক রূপকথা, ‘বংশ’। এই ‘বংশ’-এর সার্বিক অর্থ, বাংলাতে কেন দু’রকম– সে তো ঢুকেছে যাদের, তারাই জানে। না জানলে, ‘ল্যান্ড গোল্ড উইমেন’ (ডিরেক্টর: অবন্তিকা হরি) দেখুন। অতি সাংঘাতিক ব্যাখ্যা দেওয়া আছে।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

আরও পড়ুন: পুরো উপমহাদেশই আমাদের ঘর, বলেছিলেন গুলজার

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

ধরুন, আমরা বছর সাতেকের এক বালক। নাম, রসকুট্টি। সাতসকালে উঠে অপেক্ষা করছি, আজ ফিরবে নিরুদ্দেশ বাবা, যাকে আজন্ম দেখিনি। দাঁত মাজা ফেলে, চান করা ভুলে, বারবার দৌড়ে এসে খুলছি দরজা, ‘ডিগিডিগিডিগিডিগিঢিসস’ রবে। আর, আনন্দলহরি থামিয়ে হতাশ দেখছি, চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দুধওলা, দাঁড়িয়ে ঘেশকুটে পাড়াতুতো পরিবার। শেষমেশ, প্রবল নাটকীয় ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে ট্যাক্সি থেকে নামছে বাবা; যে আর ‘বাবা’ কি না– তা-ই বুঝতে পারছি না। কেননা, বাবা পরেছে আগুনরঙা শাড়ি, গলায় বাহারি হার, লতিয়ে পড়ছে চুল– আর, হ্যাঁ, বুক দুটোও বিরাট! (সিনেমা: সুপার ডিলাক্স)।

Watch Super Deluxe | Netflix
‘সুপার ডিলাক্স’ সিনেমার একটি দৃশ্য

বলুন তো, রসকুট্টির বাবা, মণিকম ওরফে শিল্পা– মা নয়? সন্তানকে সে ম্যাজিক দেখায়; দেখায়, কীভাবে শুধু আশীর্বাদ করলেই মানুষ তাকে দিয়ে দেয় দু’-দশ টাকা। ওইটুকু ছেলের আকণ্ঠ কৌতূহলে, যেভাবে সে অনর্গল বোঝাতে থাকে লিঙ্গ থেকে লিঙ্গান্তরের দর্শন– বলে, ‘খুব তাড়াহুড়োতে জুতো পরার সময়ে যেরকম পা গুলিয়ে ফেলি, ওরকম তাড়াহুড়োতে ভগবান আমাকে ফেলে দিয়েছেন পুরুষের ছাঁচে…’; ছেলের স্কুলে অপমানিত হয়ে, আনমনে বিড়বিড়োয়, ‘কী ভুল করেছি আমি? আমরা কি চুল কাটি না? নখ কাটি না? ওভাবেই একটা বেদরকারি জিনিস কেটে ফেলেছি শরীর থেকে…’ বলুন, গলার কাছে একটা অবোধ পিণ্ড দলা পাকায়নি আপনার?

‘সুপার ডিলাক্স’-এই আরেক মা, লীলা। মায়ের অভিনীত পর্ন, ‘মাল্লু আনকাট’ দেখে ফেলেছে ছেলে। লজ্জায়, ঘেন্নায়, আক্রোশে পালাতে পালাতে হয়ে গেছে অ্যাক্সিডেন্ট। হাসপাতালে ছেলেকে দেখতে এসে, মা পরিষ্কার বলে, ‘সমাজে যেমন ডাক্তার দরকার, ওটা একটা কাজ… পর্নে অভিনয় করাও জাস্ট একটা কাজ…’ জানতে চায় ছেলে, ‘কেউ জবরদস্তি করেছিল তোমায়?’ স্পষ্ট মাতৃভাষায় লীলার উত্তর, ‘না… সমাজে হাজার হাজার মানুষ পর্ন দেখে… তাদের যদি কেউ কাঠগড়ায় না তোলে, তাহলে শুধু অ্যাক্টরদের কেন!’

‘গান্ডু’ ছবির একটি দৃশ্য

‘গান্ডু’-র কপাল খারাপ; তার মা, লীলা নয়। দাসবাবুর দেহ-কুলুঙ্গিতে শুয়ে, রোজগার তার। ছেলে তা জানেও। দাসবাবুর মানিব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে গান্ডু, নেশার খরচ জোগাতে। ছেলের মুখে মা যখন শোনে, উপার্জনটা মায়ের নয়, টাকাটা দাসবাবুর– শরীর-বেচা অসহায় মা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে ওঠে, ‘ফালতু একটা… আমি তোকে মেরে দেব, তোকে মেরে দেব আমি!’ আর, পরদিন, ছেলে যখন আবার আসে টাকা চুরি করতে? দাসবাবুর চোখ বেঁধে, বিপরীত বিহারে আসীন মা আড়াল করে সন্তানকে। সংলাপহীন ওই দৃশ্যে মায়ের দু’চোখে আমরা সেই মাতৃভাষা দেখি– যা মূক, যা বাঙ্ময়।

ও, বিপরীত বিহারের মানে খুঁজছেন? ওটার বাংলা, ‘কাউগার্ল পজিশন’।