কালীপুজোর শেষে যেমন প্রতিমা নিরঞ্জন হয়, শ্বেতকালীর ক্ষেত্রে অবশ্য তা নয়। ১০-১২ বছর অন্তর প্রতিমার ভাসান হয়। নতুন প্রতিমা তৈরি করতে কলকাতার কুমোরটুলি থেকে শিল্পীরা আসেন। শ্বেতকালীর এই প্রতিমা তৈরি হয় গঙ্গামাটি দিয়ে। কেন শ্বেতকালী বলা হয়? তারও ব্যখ্যা দিয়েছেন সেবাইত নির্মল স্বাহা চৌধুরী। তাঁর যুক্তি, ‘যে দেবীর ডান পায়ের নিচে কালভৈরব আর বাম-পা ছুঁয়ে থাকে বিরূপাক্ষের মাথা, তিনি স্বাভাবিকভাবেই কালী হবেন।’
নামের সঙ্গে যোগ রয়েছে ‘কালী’ শব্দটি, অথচ দেবীর বর্ণ শ্বেত শুভ্র! তার ওপর আবার অন্য কালী-প্রতিমার মতো দেবীর চার হাতও নয়, স্রেফ দু’হাত। আরও যদি ভালো করে এই দেবীর রূপের কথা বলা যায়, তাহলে বলতে হয় শরৎকালের জ্যোৎস্নার মতো ধপধপে শ্বেতবর্ণ তার রূপ। দেখলেই যেন মনে নেমে আসে এক অপার স্নিগ্ধতা।
হরিপালের এই ‘শ্বেতকালী’ বা মা রাজবল্লভীর খোঁজ পেয়েছিলাম বছর সাতেক আগে। ‘শ্বেতকালী’ নামটা শুনেই বেশ আগ্রহ জেগেছিল। সেই আগ্রহ নিয়েই ছুটেছিলাম হরিপাল স্টেশন থেকে ১৮ কিলোমিটার ভিতরে রাজবলহাটের মা রাজবল্লভীর মন্দিরে। লোকমুখে জানা যায়, রাজবলহাটের এই মন্দিরের বয়স প্রায় ৮০০ বছরের কাছাকাছি। হরিপাল স্টেশন থেকে রাজবলহাট আসার এই পথটাও অপূর্ব। দু’ধারে চাষের জমি আর যদি আপনি দুর্গাপুজোর কিছুটা আগে আসেন তাহলে এই চাষের জমি সংলগ্ন অঞ্চলেই দেখতে পাবেন সারি সারি কাশবন। একটু হাওয়া দিলেই সেই কাশের বনে এমন হিল্লোল উঠবে যে, দৃশ্য আপনার মনটাকে তরতাজা করে দেবে।
ফিরে আসা যাক শ্বেতকালীর প্রসঙ্গে। দেবী রাজবল্লভী বা এই শ্বেতকালী ত্রিনয়না। অন্য কালীর মতো আবার জিভ বের করাও নেই। দেবীর দুই হাতের একটিতে (ডান) রয়েছে ছুরি। অপরটিতে (বাম) রয়েছে রুধির অর্থাৎ রক্তের পাত্র। ডান পায়ের নিচে শায়িত কালভৈরব ও বাম-পা ছুঁয়ে রয়েছে বিরূপাক্ষের মাথা। দেবী শাড়ি পরিহিতা। এখানে দেবীর পূজাপাঠ হয় প্রাচীন জলঘড়ির সময় অনুসারে। ঘোড়িয়াল অর্থাৎ জলঘড়ির পরিচালক প্রতি মুহূর্তে সময় মেপে পুরোহিতদের সময় বলে দেন, আর সেই সময় দেখে পুরোহিত পুজো করেন শ্বেতকালীর।
…………………………………………………
আরও পড়ুন প্রসূন বিশ্বাস-এর লেখা: শহরাঞ্চলে ঝুলন হারাচ্ছে, হারাচ্ছে ঝুলনের পুতুলও
…………………………………………………
তবে ইদানীং আর সারা বছর আর জলঘড়ি মেপে পুজো হয় না। ঘড়িয়াল সারা বছর সময় দিতে পারেন না। যদিও দুর্গাপুজোর পঞ্চমী থেকে দশমী– এই ছ’দিন ঘড়িয়াল সময় দেখে পুরোহিতকে সময় বলে থাকেন এখনও। শ্বেতকালীর আরও একটা বৈশিষ্ট চোখে পড়ার মতো। তা হল, দেবীর গর্ভগৃহে তামাকের গড়গড়া থাকে। মাঝরাত্রে দেবীর নাকি তামাক খাওয়ার ইচ্ছে হয়! তাই এমন ব্যবস্থা।
……………………………………………………
দেবী রাজবল্লভী বা এই শ্বেতকালী ত্রিনয়না। অন্য কালীর মতো আবার জিভ বার করাও নেই। দেবীর দুই হাতের একটিতে (ডান) রয়েছে ছুরি। অপরটিতে (বাম) রয়েছে রুধির অর্থাৎ রক্তের পাত্র। ডান পায়ের নিচে শায়িত কালভৈরব ও বাম-পা ছুঁয়ে রয়েছে বিরূপাক্ষের মাথা। দেবী শাড়ি পরিহিতা। এখানে দেবীর পূজাপাঠ হয় প্রাচীন জলঘড়ির সময় অনুসারে।
……………………………………………………
বর্তমানে স্থানীয় স্বাহা চৌধুরী, বন্দ্যোপাধ্যায় ও পালধী– এই তিন বংশের পুরোহিত বা সেবাইতরা পুজো করে আসছেন শ্বেতকালীর। স্বাহা চৌধুরী বংশের সেবাইত নির্মল সাহা বলছিলেন, ‘আমাদের এই মন্দির প্রায় সাড়ে আটশো বছরেরও প্রাচীন। তিন পরিবার মিলে আমরা পালা করে দেবীর পুজো করে আসছি। এখানে নিত্যভোগের ব্যবস্থা রয়েছে। দুর্গাপুজোর সময় জাঁকজমকপূর্ণ পুজোও হয়। ঘড়িয়াল তখন থাকেন। কালী পুজোর দিন মন্দির সাজানো হয়। পুজোও হয়। দর্শনার্থীরা বহু দূর-দূরান্ত থেকে আসেন।’ সেবাইত জানিয়েছেন, কালীপুজোর শেষে যেমন প্রতিমা নিরঞ্জন হয়, শ্বেতকালীর ক্ষেত্রে অবশ্য তা নয়। ১০-১২ বছর অন্তর প্রতিমার ভাসান হয়। নতুন প্রতিমা তৈরি করতে কলকাতার কুমোরটুলি থেকে শিল্পীরা আসেন। শ্বেতকালীর এই প্রতিমা তৈরি হয় গঙ্গামাটি দিয়ে। কেন শ্বেতকালী বলা হয়? তারও ব্যখ্যা দিয়েছেন সেবাইত নির্মল স্বাহা চৌধুরী। তাঁর যুক্তি, ‘যে দেবীর ডান পায়ের নিচে কালভৈরব আর বাম-পা ছুঁয়ে থাকে বিরূপাক্ষের মাথা, তিনি স্বাভাবিকভাবেই কালী হবেন।’
……………………………………………………..
আরও পড়ুন প্রসূন বিশ্বাস-এর লেখা: যে পটচিত্র আঁকতে শিল্পীরাই রাজি নন
……………………………………………………..
কীভাবে এই শ্বেতকালী মন্দির প্রতিষ্ঠা হল? তা নিয়েও একাধিক লোকগাথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তার মধ্যে জনপ্রিয় হল, একবার নাকি পার্শ্বস্থ সরস্বতী নদী দিয়ে যাচ্ছিল এক বণিকের সপ্তডিঙা। এখন যেখানে রাজবলহাট, সেখানেই নোঙর করে বণিকের বজরা। প্রচুর লাভের সম্ভাবনায় এমনিতেই তখন বণিকের মন উৎফুল্ল। বণিক ডাঙায় এক অপরূপা সুন্দরী নারীকে দেখে কামাসাক্ত হয়ে তাকে বজরায় ডাকেন। কিশোরী বণিকের সেই ডাক শুনে বজরার দিকে এগিয়ে এসে যখন সেই বজরায় পা দেন, তখন আকস্মিক সেই বজরা ডুবে যেতে থাকে! এভাবে ছয়-ছ’টি বজরা ডুবে যাওয়ার পর বণিক নিজের ভুল বুঝতে পেরে কিশোরীর পা ধরে ক্ষমা চান। তখন দেবী রাজবল্লভী নিজের স্বরূপে দর্শন দিয়ে মন্দির নির্মাণের আদেশ দেন। দেবীর আদেশে মন্দির নির্মাণ করেন সেই অনুতপ্ত বণিক।
এই ঘটনাকে স্মরণ করে আজও দুর্গাপুজোর সময় কলার খোলে সাতটি ছোট ডিঙা তৈরি করে মন্দির সংলগ্ন মায়ের স্নানঘাটে ভাসানো হয়। তবে এই জনশ্রুতির পাশাপাশি মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে আরও কয়েকটি ব্যাখ্যা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, সেগুলোকেও অস্বীকার করা যায় না। কেউ কেউ বলেন, ভুরসুট পরগনার রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেইসব লোকশ্রুতি নিয়ে না-হয় অন্য কোনও সময় কথা বলা যাবে।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………