রবীন্দ্ররচনায় বহুল ব্যবহৃত নৌকা ও নাবিকের চিত্রকল্প এই কবিতাতেও প্রযুক্ত, যে নাবিক কথককে ওপারে নিয়ে যাবে। ওপারেই ঘুমের দেশ, সেখানে রয়েছে ‘ঘোমটা পরা’ ছায়া। এই সমাসক্তিটি লক্ষণীয়। ছায়া ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে প্রকৃতি-অঙ্গ হিসেবে। সেখানে ছায়া বস্তু বা অবজেক্ট। রবীন্দ্রনাথ ছোটদের কবিতায় লিখেছেন, ‘ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি/ আছে আমাদের পাড়াখানি’। ছায়ার উপস্থিতি ঘোমটার মতো, ‘ছায়ারূপ ঘোমটা’। কিন্তু ছায়া নিজেই এ গানে অবগুণ্ঠিতা নারী।
ছায়া কী? কাকে বলে ছায়া? আলোর বিপরীত অন্ধকার। ছায়া কিন্তু শুধু আলোর অভাবটুকু। আলো আছে, কেবল তাপের দহনটা নেই। তার কারণ, আলোর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ছায়ার উৎস। কী সেই উৎস? কোন কায়া?
১৯১০ সালে রবীন্দ্রনাথের লেখা গান ‘আবার এসেছে আষাঢ়’। সঞ্চারীতে বলা হচ্ছে “রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ’পরে/ নবতৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে।” এর অর্থ কী? ক্ষণে ক্ষণে মাঠজমিতে ছড়ানো ঘাসের ওপর মেঘের ছায়া পড়ছে। বাদলের অর্থ এখানে মেঘ। বাংলা শব্দভাণ্ডারে বাদল মানে বৃষ্টি বা বর্ষা। কিন্তু বাদল বলতে হিন্দিতেও মেঘই বোঝায়, অবনীন্দ্রনাথও লিখছেন, ‘পুবে বাদল উঠল’। ‘ছবি ও গান’-এর ‘বাদল’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “শ্যামল বনের শ্যামল শিরে/ মেঘের ছায়া নেমেছে রে,/ মেঘের ছায়া কুঁড়েঘরের ’পরে।”– সেই মেঘের ছায়াই এখানে ‘বাদলের ছায়া’। অতএব ছায়ার উৎস এখানে মেঘ। এই গানে ছায়া কেবল মেঘেরই, কিন্তু কখনও কখনও, কোনও কোনও গানে তার সঙ্গে কল্পনা আর জন্মান্তর-স্মৃতির পথে আসে বহুযুগ আগের কোনও দৃশ্য। বর্তমান বর্ষা আর অতীত বর্ষা মিশে যায়। আষাঢ়ের মেঘ ছায়া দিলেই সেই ‘কালো মেঘের ছায়ার সনে’ ‘কালিদাসের কাল’ থেকে ভেসে আসে উজ্জয়িনী নগরীর সুগন্ধ, রেবানদীর হিল্লোলধ্বনি, এমনকি তরুণী নাগরিকার চোখের ভাষাও। ১৯২২ সালে লেখা গান ‘বহুযুগের ওপার হতে’। ওই একই সালে লেখা ‘আজ আকাশের মনের কথা’ গানেও ঠিক একই উচ্চারণ। “দিঘির কালো জলের ’পরে/ মেঘের ছায়া ঘনিয়ে ধরে/ বাতাস বহে যুগান্তরের প্রাচীন বেদনা যে…” নববর্ষার নবমেঘের ছায়াই আসলে অনুঘটকের মতো পুরনো স্মৃতি, বিগত জন্মের স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলেছে। নইলে বাতাসের সাধ্য কী তাকে বয়ে আনে!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
১৯২৫ সালে লেখা বর্ষাশেষের গান ‘শ্যামল ছায়া নাই বা গেলে’-র কথা। ছায়া এখানে উদ্দিষ্ট। তাকেই অনুনয়ের সুরে বলা হচ্ছে, ‘নাই বা গেলে’। এই অনুরোধ যে প্রকৃতি রক্ষা করবে না, তা কথক জানে। কিন্তু তাতে আক্ষেপ নেই। কারণ, বর্ষা আর শরতের মধ্যপর্বে যে মানুষটি আছে, সে আলো আর কালোর যুগলমূর্তি চেনে। ফলে সে এও জানে, কোনও সূচনাই একেবারে আচম্বিত নয়, এক সমাপ্তির প্রান্ত থেকেই তা আসে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বেশিরভাগ সময় আষাঢ় বা শ্রাবণের বর্ষার অনুষঙ্গেই ঘুরে ঘুরে এসেছে ছায়ার কথা। ‘কদম্বেরই কানন ঘেরি’ বা ‘কাঁপিছে দেহলতা থরথর’ তেমনই গান। কিন্তু শুধু বর্ষার মেঘচ্ছায়ার দৃশ্যবর্ণনাতেই তো আটকে থাকতে পারে না রবীন্দ্রনাথের ন্যারেটিভ। তাই মাঝে মাঝেই ছায়া থাকলেও ছায়ার উৎসকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯২২ সালেই লেখা ‘ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে’। বর্ষাসংলগ্নতা থাকলেও ছায়া এখানে বর্ষা-অধীন নয়। স্থায়ী আর অন্তরাতে ঝড়ের মেঘের যে উদ্দামতা ছিল, সঞ্চারীতে তা একদম স্তিমিত হয়ে আসে। প্রকৃতির চিৎকৃত কলরবের ভিতরে বসেই নিবিষ্ট এক মানুষ দেখতে থাকে ‘ছায়াময় দূর’-কে। কীসের ছায়া, তা কিন্তু আর বিবেচ্য নয়, বরং ছায়া এখানে আবছা, ঝাপসা এবং রহস্যের সূচক। ঠিক পরের বছর লেখা গান ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। বর্ষা-প্রসঙ্গ এখানে আরও কম। প্রথম বাক্যের পর ছায়ার আর উল্লেখ নেই গানের কোথাও; এমনকী আষাঢ়দিনের মেঘ ও মেঘগর্জনের উল্লেখ থাকলেও বৃষ্টির দিকে কথকের চোখ নেই। তাই গানে বৃষ্টিপাতের বিবরণই নেই। আছে এক ফুলের কথা। কেয়া, কেতকী। ‘যে মধু হৃদয়ে ছিল মাখা, কাঁটাতে কী ভয়ে দিলি ঢাকা!’– অবধারিতভাবে মনে পড়ে না ‘শেষের কবিতা’-র কেতকী মিত্রের কথা? অমিতের প্রত্যাখ্যান ও অবহেলায় নিজের স্বাভাবিক মাধুর্যকে এক উগ্র রুক্ষ মুখোশে চাপা দিয়েছিল সে, কেতকীর কাণ্ড যেমন রুঢ়, কণ্টকময়। কেতকীর লালিত্যকে ঢেকে যে কেটি হয়ে উঠেছিল, সেই অবগুণ্ঠিতাকে চিনতে পারা সহজ ছিল না। রবীন্দ্রগানের আষাঢ়ের কেয়াও গোপনে কারও অভিসারে আসে, কিন্তু সমর্পণ করতে পারে না নিজেকে, ‘আপনায় লুকায়ে দেয়া নেয়া’ চলে। এই আত্মগোপন, আড়ালের ছলনাই একাত্ম হয়ে গেছে ছায়ার অপ্রকটতার সঙ্গে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
রবিচ্ছায়া-য় রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা: রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিভাবনায় মানুষ ব্রাত্য ছিল না
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আলোর বিপরীতার্থ না হলেও ছায়া আলোর বিপরীতধর্মী তো বটে। বৃত্তের একার্ধে যদি আলো, রৌদ্র, তাপ ইত্যাদি থাকে, তবে অন্য অর্ধে ছায়া থাকবে। এই দুই অর্ধ মিলে বৃত্ত কিন্তু একটিই। ধরা যাক, ১৯২৫ সালে লেখা বর্ষাশেষের গান ‘শ্যামল ছায়া নাই বা গেলে’-র কথা। ছায়া এখানে উদ্দিষ্ট। তাকেই অনুনয়ের সুরে বলা হচ্ছে, ‘নাই বা গেলে’। এই অনুরোধ যে প্রকৃতি রক্ষা করবে না, তা কথক জানে। কিন্তু তাতে আক্ষেপ নেই। কারণ, বর্ষা আর শরতের মধ্যপর্বে যে মানুষটি আছে, সে আলো আর কালোর যুগলমূর্তি চেনে। ফলে সে এও জানে, কোনও সূচনাই একেবারে আচম্বিত নয়, এক সমাপ্তির প্রান্ত থেকেই তা আসে। শীতের শুষ্ককঠোর প্রাণ থেকেই যেমন নববসন্ত আসে, তেমনই বর্ষার মেঘমলিন মুখকেই আলোয় সাজিয়ে দেয় শরৎ। ছায়া কেবল আলোর পরিপূরক। শরতের ধানের খেতে তাই রোদ আর ছায়া ‘লুকোচুরি খেলা’ খেলে। আকাশে সূর্যের সঙ্গে সাদা মেঘের খেলা চলছে বলেই কিন্তু পৃথিবীর মাটিতে এই আলো-ছায়া।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
রবিচ্ছায়া-র পবিত্র সরকারের লেখা: ছায়াসুনিবিড়
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
প্রকৃতি পর্যায়ের গান হলেও ১৯৩৮-এ লেখা ‘আমার প্রিয়ার ছায়া’ ঠিক প্রকৃতির ছায়ার কথা বলে না। আকাশ বৃষ্টিসজল, বিরহের বিষণ্ণ সুর বাজছে সেখানে। সেই আকাশেই ভাসছে ‘প্রিয়ার ছায়া’৷ ছায়া পড়ার কথা মাটিতে, কিন্তু এই ছায়া আকাশে। আসলে আকাশ এখানে নিজেই প্রেমিকের বিষণ্ণ মনটি। মনে যার বাস, সে তো রক্তমাংসের মানুষী নয়। তাকে ছোঁয়া যায় না, ধরা যায় না। আবারও, সে রহস্যময় কোনও সুদূরের অধিবাসিনী। এমনকী, গানটি শুনলে এমন সিদ্ধান্ত করাও অযৌক্তিক হবে না যে, এই ছায়াময় অগম্যতাই কল্পপ্রিয়াকে আরও কাঙ্ক্ষিত করে তুলেছে। এ গানের প্রায় ৫০ বছর আগে লেখা ‘মধুর মধুর ধ্বনি বাজে’। সেই গানে সম্বোধিত দেবী সারদা, বীণাপাণি। দেবীর কাছে পৌঁছনোর পথ অজানা, দূরত্ব দুর্লঙ্ঘ্য। কারণ, তিনি তো আছেন এক নিভৃত মনকোণে, ‘ছায়াময় মায়াময় লোকে’। কথক দেবীকে চান আলোকের স্পষ্টতায়। ছায়া আর আলো এখানে শুধু বিপরীতমুখী নয়, লেখকের চয়েস বা শ্রেয়বোধটিও বেশ পরিষ্কার। আলোর পবিত্র সত্য নগ্নতা আর মোহের আবছায়া অস্পষ্টতার বিভাজন খুব প্রত্যক্ষভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
খেয়া কাব্যগ্রন্থের ‘শেষ খেয়া’ কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে লেখা শেষ করব। পঙ্কজকুমার মল্লিক সুরারোপিত গান ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’। ১৯০৬-এ প্রকাশিত হয়েছিল ‘খেয়া’ বইটি। রবীন্দ্রজীবন ও রবীন্দ্রমানসের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় থাকলে জানা যায়, এই সময়পর্বে এক অদ্ভুত মানসিক দোলাচলের ভিতর ছিলেন তিনি। মানসিক উদ্বেগ, অশান্তি, জীবনবৈরাগ্য, মৃত্যুর প্রতি অদম্য আকর্ষণ, আত্মহননের তীব্র ইচ্ছে, এই সমস্ত অনুভূতিই নানারকমভাবে তাঁর এই সময়ের লেখায় প্রতিফলিত হয়। রবীন্দ্ররচনায় বহুল ব্যবহৃত নৌকা ও নাবিকের চিত্রকল্প এই কবিতাতেও প্রযুক্ত, যে নাবিক কথককে ওপারে নিয়ে যাবে। ওপারেই ঘুমের দেশ, সেখানে রয়েছে ‘ঘোমটা পরা’ ছায়া। এই সমাসক্তিটি লক্ষণীয়। ছায়া ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে প্রকৃতি-অঙ্গ হিসেবে। সেখানে ছায়া বস্তু বা অবজেক্ট। রবীন্দ্রনাথ ছোটদের কবিতায় লিখেছেন, ‘ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি/ আছে আমাদের পাড়াখানি’। ছায়ার উপস্থিতি ঘোমটার মতো, ‘ছায়ারূপ ঘোমটা’। কিন্তু ছায়া নিজেই এ গানে অবগুণ্ঠিতা নারী। ছায়ার এই নারীস্বরূপ কোথায় পেলেন রবীন্দ্রনাথ? পুরাণ থেকে কি?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
রবিচ্ছায়া-র সম্বিত বসুর লেখা: রবীন্দ্রনাথ এখানে হস্তাক্ষর শেখাতে আসেননি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ভারতীয় পুরাণ বলে, সূর্যের এক সঙ্গিনী ছায়া। সূর্যের স্ত্রী সঞ্জনার ছায়া তিনি। ছায়া বড় রহস্যময়। অবয়ব নেই, অবয়বের আভাসমাত্র আছে। শরীর নেই, শরীরের মায়াবিভ্রম আছে। সবই যেন জাদু! ছায়ার গর্ভেই নাকি জন্মান শনি। গ্রিক পুরাণের সূর্যদেবতা হেলিওসের স্ত্রী পার্সে, আদতে তিনি জলপরী। এই পার্সে জন্ম দেন নানারকম ডার্ক ম্যাজিক জানা সন্তানদের। আলোক ও পবিত্রতাময় সূর্যের এমন সব আঁধারজগতের সন্তান হওয়া বেশ অভাবনীয়, কিন্তু তার পিছনে রয়েছে পার্সের পিচ্ছিল অন্ধকার শক্তিই। পুরাণ-আখ্যান আবার মাঝে মাঝেই তাঁকে যুক্ত করেছে রহস্যময়ী চন্দ্রদেবী হেকেটির সঙ্গে। সূর্যের উজ্জ্বলতা, স্পষ্টতা, প্রকটতার ঠিক উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে এই রহস্য, ছলনা, ইলিউশন ও ডিলিউশন। কীরকম ডিলিউশন? ‘অস্তাচলে তীরের তলে ঘন গাছের কোল ঘেঁষে/ ছায়ায় যেন ছায়ার মতো যায়…’ জীবন-মৃত্যুর দোটানায় পড়ে রবীন্দ্রনাথ এক অসম্ভব উৎপ্রেক্ষা রচনা করলেন।
সূর্যের তো ছায়া পড়ে না, পড়তে পারে না। অনন্ত, অবিশ্রাম আলোবিকিরণের ভেতর যে ক্লান্তি, তা থেকেই এই রবি তৈরি করে নিলেন এমন ছুটির কোল, ছায়া।
লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত প্রতিটি ছবিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
… রবিচ্ছায়া-য় আরও পড়ুন …
পবিত্র সরকার-এর লেখা: ছায়াসুনিবিড়
রামকুমার মুখোপাধ্যায়-এর লেখা: রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিভাবনায় মানুষ ব্রাত্য ছিল না
জয়দীপ ঘোষ-এর লেখা: ছায়ার সঙ্গে কুস্তি
সম্বিত বসু-র লেখা: রবীন্দ্রনাথ এখানে হস্তাক্ষর শেখাতে আসেননি