Robbar

ছায়াসুনিবিড়

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 8, 2024 1:26 pm
  • Updated:May 8, 2024 9:16 pm  

‘রবিচ্ছায়া’র গৌরব এখানে যে, তা রবীন্দ্রনাথের নিছক গানের প্রথম সংকলন। রবীন্দ্রনাথের সাংগীতিক প্রতিভা যে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক মহৎ পরিণামে পৌঁছেছে, তার প্রথম পর্যায়ের সমস্ত চিহ্নগুলি এ বইয়ের গানে চিহ্নিত আছে, তাঁর শৈলী আর সন্ধানের নানা মুখইতাও। কিছু অভাব লক্ষ করি, যেমন তাঁর প্রকৃতি-পর্যায়ের গান এখনও তেমন সামনে আসেনি, কিন্তু অচিরেই (আমাদের ধারণা তাঁর পূর্ববঙ্গবাসের সময় থেকেই) সেসব গান ক্রমশ তাঁকে এসে দখল করবে।

পবিত্র সরকার

আমরা পৃথিবীর লোক সূর্যের ছায়া দেখার কোনও সুযোগই পাই না। পৃথিবীর ছায়া দেখি চাঁদের উপরে, চাঁদের ছায়া দেখি সূর্যের উপরে। কিন্তু সূর্যের ছায়া? সে কোথায় পড়ে, কোন আকাশে, কোন দূর নক্ষত্রের দেহে? জানি না। আর আমরা বাঙালিরা নক্ষত্রলোক থেকে সরে এসে যে সূর্যকে পেয়েছি, যাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ– তাঁর ছায়া কি কোথাও পড়ে? হ্যাঁ, বঙ্কিমচন্দ্র একবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক ধর্মীয় তর্কের সূত্রে বলেছিলেন, ‘রবির পিছনে একটি ছায়া দেখিতেছি’– সে ছায়ার অর্থ এক। আর যখন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘রবিচ্ছায়া’ বলে একটি বই লেখেন, তার অর্থ আর-এক। হয়তো তার নাম ‘রবিরশ্মি’ দিলেই ঠিক হত, কারণ ওটি একটি গানের বই, রবীন্দ্রনাথের প্রথম গানের বই, তাতে অন্ধকার কিছু নেই, ছায়াও কিছু নেই, পুরোটাই আলো। রবীন্দ্রনাথও ভেবেছিলেন ‘আলো’ কথা।

‘জীবনস্মৃতি’-তে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ‘কবে যে গান গাহিতে পারিতাম না তাহা মনে পড়ে না।’ তা তো হবেই, যে কিন্নরপরিবারে তিনি জন্মেছিলেন, সেখানে প্রায় সকলেই গানের জৈবিক ও স্নায়বিক আগ্রহ নিয়ে এসেছিল, গান ছিল তাঁদের সৃষ্টিপ্রেরণার এক শস্য। তারও মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যে অনন্য, সে কে না জানে? কিন্তু গান গাওয়া এক কথা, তাতে কেবল কণ্ঠস্বর আর গাওয়ার প্রবল আবেগ, আর স্মৃতির সমন্বয় ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। সম্পূর্ণ অন্য কথা হল ‘নিজের’ গান রচনা, কথা ও সুরে যুগলবন্দি করে। নিছক গায়ক তো অভিকার বা পারফর্মার মাত্র; তার সেই ভূমিকাকে অতিক্রম করে গানের রচয়িতা হওয়া তো সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। রবীন্দ্রনাথ তা দুর্ধর্ষভাবে হতে পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ।

Rabindranath Tagore Jayanti 2022: Famous Books by Rabindranath Tagore - The Statesman

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

রবীন্দ্রনাথের নিজের নাকি গানের বই মুদ্রণ সম্বন্ধে কিছু সংকোচ ছিল। কিন্তু তাঁর গানের গুণগ্রাহীরা তাতে নিরস্ত হবেন কেন? তাই আমরা দেখি, ১৩৩৮ আশ্বিনে তাঁর গানের সার্বিক সংকলন গ্রন্থ ‘গীতবিতান’-এর প্রকাশ আরম্ভ হওয়ার আগেই সুভাষ চৌধুরীর হিসেবে রবীন্দ্রনাথের মোট তেরোটি গ্রন্থে তাঁর গানগুলি আশ্রয় পেয়েছিল। অবশ্য গানের বইয়ের বাইরেও গীতিনাট্য, গানের বই, কবিতাগ্রন্থ, কাব্যনাটক—।

……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

তারও পরে কথা থাকে। সেই গান লিখতে হবে, নইলে তা হয়তো হারিয়ে যাবে। মুদ্রিত গ্রন্থের যুগে তাকে হয়তো মুদ্রিত সংকলনে স্থান দিতে হবে, যাতে অন্যরা সে গান ব্যবহার করতে পারে। তা সে করেওছে অনেকে। থিয়েটারের নর্তকী থেকে সংগীতকুশলা বারবনিতা পর্যন্ত, কখনও নিজেদের ইচ্ছামতো সুর বসিয়ে, রবীন্দ্রনাথের কথায়। কলকাতায় তখন ‘রবিবাবুর গান’ একটি চিহ্নিত বিনোদন।

২.

রবীন্দ্রনাথের নিজের নাকি গানের বই মুদ্রণ সম্বন্ধে কিছু সংকোচ ছিল। কিন্তু তাঁর গানের গুণগ্রাহীরা তাতে নিরস্ত হবেন কেন? তাই আমরা দেখি, ১৩৩৮ আশ্বিনে তাঁর গানের সার্বিক সংকলন গ্রন্থ ‘গীতবিতান’-এর প্রকাশ আরম্ভ হওয়ার আগেই সুভাষ চৌধুরীর হিসেবে রবীন্দ্রনাথের মোট ১৩টি গ্রন্থে তাঁর গানগুলি আশ্রয় পেয়েছিল। অবশ্য গানের বইয়ের বাইরেও গীতিনাট্য, গানের বই, কবিতাগ্রন্থ, কাব্যনাটক–। তার মধ্যে ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’র (১৮৮১) পরে ‘কাল-মৃগয়া (১৮৮২), ‘বউঠাকুরানীর হাট’ (১৮৮৩), ‘ছবি ও গান’ আর ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ (দু’টিই ১৮৮৪)-এর পরে আসে ‘রবিচ্ছায়া’র (১৮৮৬, এপ্রিল) পালা।  সিটি কলেজের শিক্ষক যোগেন্দ্রনারায়ণ মিত্র ছিলেন এ বইয়ের প্রকাশক। বইটির নাম ‘আলোছায়া’, ‘ছায়া-আলোক’ বা কী হবে, তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও প্রকাশকের মধ্যে চিঠির আদানপ্রদান হয়েছিল। সম্ভবত যোগেন্দ্রনায়ায়ণই প্রস্তাব করেছিলেন ‘রবিচ্ছায়া’ নামটি, রবীন্দ্রনাথ উত্তরে লেখেন, ‘সে আপনাদের অনুগ্রহ’। এই নামটিই গৃহীত হয়।

Remembering Rabindranath Tagore, the master storyteller - The Statesman

সুভাষ চৌধুরীর মতে, ওই পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের রচিত মোট ৩০০টি গানের মধ্যে মোট ২১০টি ‘রবিচ্ছায়া’তে সংকলিত হয়েছিল। ‘বিবিধ’ সংগীত ছিল ১১৬টি, ব্রহ্মসংগীত ৭৪টি, জাতীয় সংগীত ৭টি ও পরিশিষ্ট ৪টি। ১২টি গানে রাগ-তালের উল্লেখ ছিল না, সম্ভবত পরে সুর দেওয়ার অপেক্ষায় ছিল। ‘বিবিধ’ অংশে পরিচিত গানের মধ্যে আছে ‘নীরব রজনী দেখ মগ্ন জোছনায়’, ‘সমুখেতে বহিছে তটিনি’, ‘সকলি ফুরাল স্বপন-প্রায়’, ‘যে ফুল ঝরে সেই তো ঝরে’, ‘কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া’, ‘আয় তবে সহচরি’, ‘গহনকুসুম-কুঞ্জ মাঝে’, ‘গোলাপ ফুল ফুটিয়ে আছে’, ‘ভাল যদি বাস সখি’, ‘সহে না যাতনা’, ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন’ ইত্যাদি। ব্রহ্মসংগীত পর্যায়ে ‘(তাঁহার) আরতি করে চন্দ্রতপন’, ‘ডুবি অমৃতপাথারে’, ‘এ কী সুগন্ধহিল্লোল বহিল’, ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’, ‘বড় আশা করে এসেছি গো’, ‘আজি শুভদিনে পিতার ভবনে’ ইত্যাদি, জাতীয় সংগীতের মধ্যে ‘তোমারি তরে মা সঁপিনু এ দেহ’, ‘ও গান আর গাস্ নে’, আর পরিশিষ্টে আছে ‘দুখের কথা তোমায় বলিব না’, বা ‘গাও বীণা, বীণা গাও রে’-র মতো গান।

৩.

যেহেতু এটি শুধু গানেরই সংকলন, তাই গানগুলির একটা চলনসই ভাগ করা সম্ভব হয়েছে এ বইয়ে। যদিও আগেকার গীতিনাট্যগুলির (‘বাল্মীকি-প্রতিভা’, ‘কাল-মৃগয়া’, ‘মায়ার খেলা’, ভানুসিংহের পদাবলী’ ইত্যাদি) গান এ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তার কোনও সূত্র এখানে রাখা হয়নি। বিবিধ-এর মধ্যে গীতিনাট্যগুলির গানই বেশি দেখি। প্রেমের গানের সংখ্যা তার মধ্যে তুলনায় বেশি। তবু এ বইয়ে যে সরল বিষয়ভাগ করা হয়েছে, তা থেকে পরে ‘গীতবিতান’-এ আরও সূক্ষ্ম (‘পূজা’, ‘প্রেম’, ‘স্বদেশ’, ‘প্রকৃতি’, ‘নাট্যগীতি’ ইত্যাদি) এবং ‘গীতবিতান’-এর পরিশিষ্টে আরও আরও সূক্ষ্ম উপবিভাগ (যেমন ‘পূজা’র গানগুলিতে ‘বন্ধু’, ‘প্রার্থনা’, ‘বিরহ’, ‘সাধমা ও সংকল্প’, ‘দুঃখ’, ‘আশ্বাস’ ইত্যাদি, অন্যত্র ‘গান, ‘পথ’ এইরকম আরও) বিভাগ করে হবে, তার প্রাথমিক সূত্রপাত এখানে দেখি।

তবে ‘গীতবিতান’ প্রথম সংস্করণে যে রচনার কালানুক্রমে গানগুলিকে সাজানো হয়েছিল, ‘রবিচ্ছায়া’তে সে চেষ্টা করা হয়নি। ‘গীতবিতান’-এর দ্বিতীয় সংস্করণে (১৩৪৮) এই কালানুক্রমিক নীতি পরিত্যাগ করা হয়, এবং একটি প্রচ্ছন্ন ভাবানুষঙ্গ ক্রমে গানগুলিকে সাজানো হয়, যার কথা উপরে উল্লেখ করা হল। আমরা বলতে পারি যে, এতে রবীন্দ্রসংগীতের সাধারণ ব্যবহারকারীদের বিশেষ সুবিধা হয়েছে, কারণ নানা অনুষ্ঠানের উপলক্ষ অনুসারে তাঁরা অনায়াসেই প্রাসঙ্গিক গানটি নির্বাচন করে নিতে পারেন নতুন ‘গীতবিতান’ থেকে। আর বর্ণানুক্রমে পাওয়ার সুযোগ থাকায় তাদের সুবিধা আরও বেড়েছে, ‘রবিচ্ছায়া’ বা আগের সংকলনগুলিতে তা ছিল না। সূচিপত্র আর বর্ণনাক্রমিক সূচি তো এক কথা নয়।

তবু ‘রবিচ্ছায়া’র গৌরব এখানে যে, তা রবীন্দ্রনাথের নিছক গানের প্রথম সংকলন। রবীন্দ্রনাথের সাংগীতিক প্রতিভা যে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক মহৎ পরিণামে পৌঁছেছে, তার প্রথম পর্যায়ের সমস্ত চিহ্ন এ বইয়ের গানে চিহ্নিত আছে, তাঁর শৈলী আর সন্ধানের নানা মুখও এখানেই। কিছু অভাব লক্ষ করি, যেমন তাঁর প্রকৃতি-পর্যায়ের গান এখনও তেমন সামনে আসেনি, কিন্তু অচিরেই (আমাদের ধারণা তাঁর পূর্ববঙ্গবাসের সময় থেকেই) সেসব গান ক্রমশ তাঁকে এসে দখল করবে।

পরে তিনি সমস্ত অভাবই পূরণ করে দিয়েছেন তাঁর গানে। অন্য সব কিছুর কথা বাদই দিলাম। এই লেখক ঠাকুরদেবতা না মানলেও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের এই কথাটা তার মনে পড়ছে— ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাহিত্যের সিদ্ধিদাতা গণেশ’।

রবিচ্ছায়া-য় আরও পড়ুন …

রামকুমার মুখোপাধ্যায়-এর লেখা: রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতিভাবনায় মানুষ ব্রাত্য ছিল না

জয়দীপ ঘোষ-এর লেখা: ছায়ার সঙ্গে কুস্তি

শ্রুতি গোস্বামী-র লেখা: ছায়ার নারীস্বরূপ কোথায় পেলেন রবীন্দ্রনাথ?

সম্বিত বসু-র লেখা: রবীন্দ্রনাথ এখানে হস্তাক্ষর শেখাতে আসেননি