আমি মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী শিল্পীদের বানানো গণেশ মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে দেখি, মেদহীন পেটানো শরীর আর ভুঁড়ি নেই। কিন্তু যার নাম লম্বোদর তার পেট বড় না হলে চলবে কেমন করে! তার সমাধান শিল্পী করে দিয়েছে। গণেশ মাটিতে বসে কোলে একটা মাদল রেখে বাজাচ্ছে। সেটাই ভুঁড়ির মতো দেখাচ্ছে। ভারতের অনেক জনজাতি আছে যাদের জনসংখ্যা তেমন বাড়ে না। এর কারণ অপুষ্টি, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব আর রোগে চিকিৎসার সমস্যা। সে সমাজ ও সংসারে অনেক সময় খিদেয় গণেশের নাড়ি জ্বলে, ভুঁড়ি হবে কী করে?
গণেশের কথা বললে কেন জানি প্রথমেই মনে আসে আমাদের গ্রামের বাড়ির গণেশকে। সাদা আর চকচকে সিরামিকের তৈরি সে পেটমোটা গণেশের উচ্চতা ছিল ইঞ্চি ছয়েক। তবে এভাবে ঠাকুর-দেবতা মাপতে নেই। হাত দিয়ে মাপ বোঝানোর সময়ে বাঁ-হাতের তালু ওপরের দিকে থাকবে কিন্তু ডান হাতের তালু নীচের দিকে থাকবে না। সেটাও থাকবে আকাশের দিকে মুখ তুলে। বন্ধনীর শুরু আর শেষের মুখ একই দিকে রাখার মতো। বন্ধনী আছে, কিন্তু বন্ধন নেই। এতে মাপ বোঝার কোনও অসুবিধে হয় না কিন্তু দেবতা যে সীমাহীন ও অনন্ত– এই বোধটুকু জেগে থাকে ।
অনন্ত ঠিকই, কিন্তু আমাদের গৃহদেবতা সীতারাম, শিব ও মনসার মতো গণেশের মন্দির নেই। বাড়ির একতলার দেওয়ালে যে জোড়া কুলুঙ্গি তার একটাতে থাকত আয়না ও চিরুনি আর অন্যটাতে গণেশ। সঙ্গে ইঞ্চি খানেকের একটা ইঁদুর। গণেশ ও তার বাহনের পাশেই থাকত লক্ষ্মীর কড়ি, খুচরো পয়সা আর পোস্ট অফিসের পিওনের দিয়ে যাওয়া চিঠিপত্র। পায়রার ভালো পালক মিললে মাটি থেকে তুলে সেখানে রেখে দেওয়া হত। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সীতারাম, শিব বা মনসার মতো গণেশ এক জায়গায় স্থির অধিষ্ঠান করত না। আমাদের ছোটবেলায় কুলুঙ্গি থেকে নেমে আমাদের খেলার সঙ্গী হত। বাড়ির গাছের আম, পেয়ারা বা আতা খাওয়ার সময়ে গণেশের মুখেও ঠেকিয়ে দেওয়া হত। এমনকী, বড়দের লুকিয়ে চুরি করে খাওয়া খইয়ের নাড়ু ও নারকেলের পুরের ভাগও পেত। হিন্দু দেবদেবীদের সংখ্যা বিপুল কিন্তু গণেশের মতো এতখানি শৈশব-বান্ধব আর কোনও দেবতা দেখিনি। কোনও রাগতাপ নেই। শিবের মতো ত্রিশূল, দুর্গার মতো বর্শা, এমনকী, কার্তিকের মতো তির-ধনুকও নেই। থাকার বলতে দু’হাতে দু’টি ফুল। পুকুরে চান করতে গিয়ে মা যেমন দুটো পদ্ম কিংবা শালুক ফুল তুলে বাচ্চা ছেলের হাতে ধরিয়ে দেয়, ঠিক তেমনই। শুনেছি গণেশের বত্রিশ রূপ হয় কিন্তু সেসব বাঙালির ঘরে চোখে পড়ে না। গ্রামের দোকানদানিতে, মাথার বেশ খানিক ওপরে, আর এক গণেশের অবস্থান। সিঁদুর মাখা অবস্থায় বেশ গম্ভীর মুখে বসে থাকে। নাম সিদ্ধিদাতা গণেশ।
বাড়ির কুলুঙ্গির গণেশ আর দোকানের পাটাতনের গণেশের বাইরে আরও কিছু গণেশ গ্রামজুড়ে দেখা যেত। বাড়িতে প্রথম ছেলে হলে অনেক ঠাকু’মাই কোল থেকে নামাত না। বংশে ভবিষ্যতে বাতি দেবে বলে দুধ-দই-ঘি থেকে শুরু করে আম, কাঁঠাল, কাতলা মাছের মাথা বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে খাওয়াত। একে কোলে ঘোরা ছেলে, তার উপর ভারী খাওয়া। শরীরে মেদ-মাংস জমত, পেট বাড়ত আর নাদুসনুদুস ছেলে দেখলেই লোকে আদর করে ‘গণেশ’ বলে ডাকত। এভাবেই গ্রামে গণেশদের সংখ্যা বছর-বছর বাড়তে থাকে। তখন গণেশ বললে কোন পাড়ার– সেটাও বলতে হত।
প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টারমশায়ের ছিল আর এক সমস্যা। একই নামে দু’জন ভর্তি হলে এক গণেশকে ডাকলে অন্য গণেশের উঠে আসার ভয়। তাই দু’জন গণেশ প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হচ্ছে দেখে হেডমাস্টার একজনের নাম করে দিলেন গোপাল। খুবই ভালো নাম কারণ স্বয়ং কৃষ্ণের আর এক নাম হল গোপাল। কিন্তু ঠাকু’মা আদরের নাতির নাম বদলাবে কেন? শেষ পর্যন্ত ছেলের দাদু এসে গণেশ ছাড়া চলবে না বলে জানিয়ে দিল। শেষ পর্যন্ত অনেক কথাবার্তা বলে ঠিক হল যে, গণেশের নাম হবে– গণেশগোপাল।
শীতকালে মানুষজনের ধান ঝাড়ার পরে গাঁয়ে আর এক গণেশ আসত পেল্লায় চেহারা নিয়ে। সেটা একটা হাতি আর তার গায়ে খড়ি দিয়ে নাম লেখা থাকত ‘গণেশ’। হাতির মাহুত উত্তরপ্রদেশের কিন্তু বহুভাষী ও বহুলিপি ভারতের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল তার আর তাই কাউকে দিয়ে হাতির গায়ে বড় বড় বাংলা অক্ষরে ‘গণেশ’ নামটি লিখিয়ে আনত। হাতি হচ্ছে শুভের প্রতীক আর সেখান থেকেই গজমুণ্ড গণেশ হল শুভকারী। মাহুত থাকত গণেশের পিঠে আর একজন লোক একটা বড় বস্তা নিয়ে হাতির পিছনে পিছনে হাঁটত। ভালুক বা বাঁদর খেলা হলে চার-আট আনা পয়সা দিয়ে দেখা যেত কিন্তু হাতিকে দিতে হত ডালায় করে ধান। এর কারণ হাতির পেট বড় আর খিদেও বেশি। গজ আর গজাননে এখানে ভীষণ মিল। হাতিকে দেখিয়ে দু’সের ধান বস্তায় ঢেলে দিলে মাহুত গণেশকে বলত শুভ শুঁড়টি মাথায় ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করতে। সে আশীর্বাদ বছরের পর বছর পেয়েছি। একবারই শুধু পিঠে চড়েছি পাঁচ সের ধান দিয়ে। এটাকে বলে গজপতি হওয়া। ঋকবেদের যুগে গজপতি ছিল ইন্দ্র, পরে আমাদের দেশের অনেক রাজা গজপতি নাম নেয়। ‘সিংহ’ রাজার চেয়ে ‘গজ’ রাজার আভিজাত্য বেশি ছিল। পাঁচ সের ধানের বিনিময়ে গণেশের পিঠে চড়ে আমি সে রাজকীয় আভিজাত্য ভোগ করেছি। তবে পাঁচ সের ধানে ইন্দ্রলোক বা ইহলোকের দীর্ঘস্থায়ী গজরাজ হওয়া যায় না। ফলে পাড়া ঘুরিয়ে গজাসন থেকে আমাকে নামিয়ে দিল। তার কিছুদিন পরে আবার গণেশের শুঁড় ফিরে এল। আমাদের সীতারামের মন্দিরে হাতেখড়ি দেওয়ার সময় পুরোহিত-দাদা মেঝেতে প্রথমেই একটি আঁকড়ি কেটে দিল। সেটা হাতির শুঁড়ের মতো। বিদ্যাচর্চা যাতে বিঘ্নহীন হয় তাই গণেশের শুঁড় আঁকা। পরে দাশরথী রায়ের পাঁচালি পড়তে গিয়ে পেয়েছি, ‘দ্বিজ লয়ে হাতে খড়ি, অবধি গণেশ-আঁকুড়ি, ষড়ক্ষর লিখে দেয় ভূমিতে।’ পরে নানা বড় ও শুভ কাজে গণেশ-আঁকড়ি আঁকতে দেখেছি।
ওই শুঁড়ের মতোই গণেশের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল ভুঁড়িওলা পেট। যা থেকে গণেশের আর একটি নাম লম্বোদর। উদরটি স্থূল হওয়ার কারণ সে আশৈশব খাদ্যরসিক। ভারতচন্দ্র রায় ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘বড় পুত্র গজমুখে চারি হাতে খান/ সবেগুণ সিদ্ধি খেতে বাপের সমান।’ হাঁ-মুখটি হাতির, ফলে বেশ বড়। আর খায় চার হাতে। ফলে মা পার্বতী পাতে একবার ভাত-তরকারি দিতে না দিতে সে ডাক দেয়– মা আন, মা আন। আর ভিক্ষাজীবী থেকে শিব যখন কৃষিজীবী হল তখন সংসারে আর আগের অভাব থাকল না। পার্বতী তখন অন্নদা। কাজেই লম্বোদরের উদরপূর্তিতে আর কোনও সমস্যা থাকল না। কিন্তু এসবই তো আমাদের নিজস্ব জগতের কথা। এর বাইরে নানা জনজাতির মানুষ আছে। তাদের নিজস্ব গণেশও আছে। ২০০৪-’০৫ সাল নাগাদ ভারতীয় লোকগল্পের একটি সংকলন করার পরিকল্পনা নিয়েছি। বাংলাতে করব এবং যতখানি সম্ভব মূল ভাষা থেকে সরাসরি অনুবাদ করাব– এই ছিল পরিকল্পনা। ভিল লোকগল্পের জন্য ভগবানদাস পটেলের স্মরণ নিয়েছিলাম কারণ তিনি প্রায় সারাটা জীবন গুজরাতের আদিবাসী সংস্কৃতি সংরক্ষণে কাজ করেছিলেন আর পাহাড়ি ভিলদের দেড় হাজার লোককথা ক্যাসেটবন্দি করেছিলেন।
ভগবানদাস পটেল আমাকে ফেরাননি। বেশ কিছু লোকগল্প দিয়েছিলেন। তার একটি হল ভিলদের দেবদেবীদের উৎসকথা। সেখানে রয়েছে যে, এই বিশ্বের সূচনা হয়েছিল দেবী অম্বার কারণে। মহাসমুদ্রের অতলে অম্বা করতালি দেয় আর তাতে দু’টি ডিম তৈরি হয়। তারপর দীর্ঘ ধ্যানপর্ব শেষে অম্বা দেখে ডিম দুটো থেকে দুটো বাচ্চা জন্ম নিয়েছে। অম্বা সমুদ্রের তলা থেকে উঠে তাদের নিয়ে শিবের কাছে গেল। শিব তখন কোনও একটা বিষয়ে এতই চিন্তায় যে, অম্বা আর বাচ্চা দুটোকে না দেখেই বেরিয়ে গেল। খানিকক্ষণ পরে অম্বাও নদীতে চানে গেল। একটু পরে শিব ঘরে ফিরে বাচ্চা দুটোকে দেখে জিজ্ঞেস করল– তারা কে আর কোথা থেকে এসেছে। তারা শিবকে বলল যে, তার এত খোঁজখবর নেওয়ার কী আছে? সে বরং নিজের কাজে মন দিক। শিব চটে গিয়ে করাত দিয়ে একটা ছেলের মাথা কেটে ধুনির পাশে পুঁতে দিল আর তা থেকে বিশাল লম্বা একটা নারকেল গাছ জন্ম নিল। ওদিকে অম্বা চান থেকে ফিরে দেখে একটা বাচ্চার মুণ্ডহীন ধড় মাটিতে পড়ে আছে। তারপর অম্বার রাগ ও চিৎকারে শিব মাথা খুঁজতে বের হল। তখন দেবী তার দেহমৃত্তিকার একটি কণা তুলে সমুদ্রে নিক্ষেপ করল। তা থেকে ন’লক্ষ হাতি জন্ম নিল। তারা সমুদ্রে ঘুরতে লাগল। একটা হাতি থপথপ করে হাঁটছিল কারণ তার দুটো মাথা। তার শরীরে ভারসাম্য আনতে শিব একটা মাথা কেটে ফেলল আর সেটাই মুণ্ডহীন শিশুটির মাথায় বসিয়ে দিল। হাতির মাথা বড় বলে শিশুটির গলায় ঠিক বসছিল না। শিব মাথার উপরে একটা ঘা দিতেই বসল কিন্তু অতিরিক্ত চাপে পেটটা ফুলে উঠল। অতিরিক্ত খাদ্য খেয়ে নয়, মাথায় হাতের ঘায়ে পেটটা ফেঁপে উঠেছে। ‘ভিল’ শব্দটি দ্রাবিড়ীয়, যার অর্থ ধনুক। মনে হয় শিকারী জাতি থেকে এই নাম। এসব ঘরে বছরের বারোটা মাস কাটে চণ্ডীমণ্ডল-এর ফুল্লরার বারোমাস্যার মতোই। তাই পেটে মেদ জমা কঠিন। শিব শিশুটির প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিল আর নাম দিয়েছিল গুণকো। হ্যাঁ, আমাদের গণেশ।
বছর দশ-বারো আগে দিল্লিতে একটা সাহিত্যসভায় গিয়েছি। ভাবলাম অজিত কৌরকে একবার ফোন করা দরকার। নয়ের দশক থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় লেখক ও সাহিত্য সংঘের নানা কাজে জড়িয়ে আছি। তাছাড়া অজিত কৌরের লেখার আমি ভক্ত পাঠক। ফোন করতেই বললেন, সিরি ফোর্টে তাঁর সংঘ, সংগ্রহশালা আর একই সঙ্গে বাসস্থানে যেতেই হবে। ব্যস্ততার কথা বললাম আর তাতে বললেন যে, দুপুরের খাওয়ার বিরতিতে তাঁর ওখানে যেতে। একে ভালোবাসার টান আর সে সঙ্গে মায়ের মতো বয়স, তাই যেতে হল। খাওয়ার ঘরে নয়, তাঁর থাকার ঘরে বসিয়ে আলুর গরম পরোটা, গাজরের হালুয়া ইত্যাদি খাওয়ালেন। তখনও জানতাম না যে, এর চেয়েও বড় এক প্রাপ্তি আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। ওঠার মুখে আমার হাতে ইঞ্চি দশেকের একটা গণেশের মূর্তি ধরিয়ে দিলেন। বললেন যে, মধ্যপ্রদেশ গিয়েছিলেন আর সেখানের আদিবাসী শিল্পীদের কাছ থেকে গণেশের মূর্তিটি নিয়ে এসেছেন। দিল্লি ও আগ্রার সার্ক সম্মেলনে দেখেছি আদিবাসী শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এনে প্রদর্শনী ও বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। আমি গণেশের মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে দেখি মেদহীন পেটানো শরীর আর ভুঁড়ি নেই। কিন্তু যার নাম লম্বোদর তার পেট বড় না হলে চলবে কেমন করে! তার সমাধান শিল্পী করে দিয়েছে। গণেশ মাটিতে বসে কোলে একটা মাদল রেখে বাজাচ্ছে। সেটাই ভুঁড়ির মতো দেখাচ্ছে। ভারতের অনেক জনজাতি আছে যাদের জনসংখ্যা তেমন বাড়ে না। এর কারণ অপুষ্টি, বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব আর রোগে চিকিৎসার সমস্যা। সে সমাজ ও সংসারে অনেক সময় খিদেয় গণেশের নাড়ি জ্বলে, ভুঁড়ি হবে কী করে?
আমি নিজেও যে গণেশ নির্মাণে জড়িয়ে পড়ব, তা কোনও দিন ভাবিনি। ২০১২-’১৩ সাল নাগাদ ‘হর-পার্বতী কথা’ নামে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করি। কথার আরম্ভ হর-পার্বতীর বিয়ে দিয়ে। বর শিব আর বরযাত্রীর দল তিব্বতের কৈলাস থেকে একটার পর একটা গ্রাম পেরিয়ে গিরিরাজের রাজধানী ওষধিপত্রে আসে। বিয়ের পর হর কিছুদিন ওষধিপ্রস্থে থেকে যায় মেনকা ও গিরিরাজ হিমালয়ের ইচ্ছেয়। বরযাত্রীর দল বৃষটিকে নিয়ে চলে যায় কারণ তারা ভাবে রথে চড়িয়ে হিমালয় জামাই ও মেয়েকে করে কৈলাসে পাঠাবে। কিছুদিন পরে হর ও পার্বতী কৈলাসে ফিরবে বলে ঠিক করে। দরজার সামনে রথ এনে রাখা হয় কিন্তু শিব পায়ে হেঁটে কৈলাসে ফিরবে বলে জানায়। আসলে ওষধিপ্রস্থে আসার সময় পাহাড়ি নানা গ্রামের বউ-ঝিরা বলেছিল নতুন বউকে দেখিয়ে নিয়ে যেতে। হর ও পার্বতী যাত্রা করে আর মলহারী, মরগাঁও, হোতি , সেলসেল, মালচাক, খেংলুং ইত্যাদি গ্রামে দিন ও রাত কাটাতে কাটাতে চলে। এক সময় পাংটাং পেরিয়ে তারা খেংলুং জনপদের পথে শতদ্রু তীরে। দিনান্তের সোনার রং পাহাড় চূড়ায়। আকাশে গৈরিক রাগ। নদীতীর ধরে চলেছে পাঁচটি হাতি। পশুপতি শিব দর্শনে তারা খানিক থামে। মা হাতির শুঁড়ে মাস ছয়েকের একটি দ্বিপদ শিশু। কোনও মা গাছের তলায় বা পাহাড়ের গর্তের মুখে রেখে চলে গিয়েছে। মা হাতি শিশুটি শুঁড়ে তুলে হয়তো বেশ কিছুদিন লালন করছে আর এখন বয়ে নিয়ে চলেছে। হরের পাশে পার্বতীকে দেখে তার হাতে শিশুটিকে দিয়ে চলে যায়। এই হল উপন্যাসের গজানন যাকে পিঠে বেঁধে পর্বত-কন্যা পার্বতী কৈলাসে নিয়ে চলে। কৈলাসে গিয়ে যম, যমী, কুবের ও অন্যান্য সকলের সাহায্যে ভালোই সংসার পাতে পার্বতী। নধর গজাননও মহানন্দে কাটায়। হঠাৎ গবাদিপশুর মড়ক লাগে। হাজার হাজার ভেড়া, চামর, চমরী তিব্বতের গ্রামে গ্রামে মরে যেতে থাকে। পেটের খিদে মেটাতে মানুষজন হাহাকার করে। হরের ভিক্ষে মেলে না, পার্বতীর ধার মেলে না চাল। লম্বোদর গজাননের পেট ঝরে, শরীরের হাড় গোনা যায়। তারপর হরের নেপাল প্রান্তের কর্ণালী নদীতীরের ভূ-খণ্ডে হলকর্ষণ। প্রচুর ধানের ফলন হয়। পার্বতী অন্ন রাঁধে। পর্বতবাসীরা অন্নসত্রে আমন্ত্রণ পেয়ে দলে দলে আসে। পার্বতী অন্নকূটের অন্ন বিতরণ করে। মায়ের পাশে উপবিষ্ট গজানন।
গ্রামের বাড়ির কুলুঙ্গির গণেশ থেকে শুরু করে কৈলাসে পার্বতীর অন্নকূটের পাশে বসে থাকা গজানন পর্যন্ত আমার গুণকো সম্পর্ক। এই ভালোবাসার বাঁধন কাঁচিতে কাটে না, ঝড়ে ছেঁড়ে না, আগুনে পোড়ে না।