তামিল ছবি ‘মহারাজা’ কিছু দিন আগে নেটফ্লিক্সে রিলিজ হয়েছে। নেটফ্লিক্সের দাবি ফিল্মটা সারা ভারতে প্ৰথম নম্বরে স্ট্রিম হচ্ছে। কেউ যদি উল্টো প্রশ্ন করে যে, কেন দাদা, দক্ষিণী ছবির মতো ছবি বানাব কেন?, তাকে আমি প্রশ্ন করব, ফিল্মটা দক্ষিণী ভুলে গিয়ে আমরা এটাও তো ভাবতে পারি যে একটা ভালো তারকা-অভিনেতাকে নিয়ে একটা ভালো থ্রিলার, বা একটা ভালো ফিল্ম, যেটা নিয়ে শুধু কলকাতার সিরিয়াল-দেখা মানুষজন নয়, সারা ভারত হইহল্লা করবে– এইরকম একটা ফিল্ম তো আমরা বানাতেই পারি? বানাই না কেন?
আমরা শুনতে থাকি যে, বাংলা সিনেমায় টাকা নেই, বাজেট নেই, প্রয়োজন মতো শুটিং ডেট পাওয়া যায় না, ইত্যাদি, তাই আমাদের সিনেমা যেমন হয় তেমন হয়, তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য পরিচালক-প্রযোজকদের ফেসবুকে কেঁদে-কুকিয়ে পোস্ট দিতে হয়।
এ বছর নিথিলান সামিনাথানের তামিল থ্রিলার ‘মহারাজা’ জুনের মাঝামাঝি হলে বেরয়। নিউজ রিপোর্ট অনুযায়ী, ফিল্মটার বাজেট ২০ কোটি। ফিল্মটার অধিকাংশ ইন্টিরিয়র লোকেশনে শুট হয়েছে: ৫০% গল্প একটা পুলিশ স্টেশনের ভিতরে, ৩০% বিভিন্ন ঘরের ভিতর, আর বাদ বাকিটা রিয়েল লোকেশনে, রাস্তাঘাটে ঘটে।
সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ভাষায় মুম্বইতে এই ফিল্মের BTL (below the line) বাজেট হতে পারে ৬ কোটি: ‘BTL’ মানে তারকা আর প্রধান কলাকুশলীদের (যেমন পরিচালক, সম্পাদক, সাউন্ড ডিজাইনার) ছাড়া যে-টাকাটা ধরা হয়। বাকি টাকার সিংহভাগ ধরে নিচ্ছি ফিল্মের হিরো বিজয় সেতুপতি নিয়েছেন। আর কিছু সামান্য টাকা বরাদ্দ প্রচারের জন্য।
জাতীয় স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ফিল্মটা অল্প বাজেটের ছবি। ফিল্মটা কামিয়েছে ১০০ কোটির ওপরে। টাকার প্রসঙ্গ বাদ রেখেও যদি কথা বলি, ফিল্মটা অত্যন্ত ভালো একটা থ্রিলার (ফিল্মটার জেন্ডার পলিটিক্স নড়বড়ে, সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি)। আমি যদি কলকাতার স্ট্যান্ডার্ডে বাজেট ধরি, যেখানে কম টাকায় বা অর্ধেকজনকে টাকা না দিয়ে সিনেমা বানানো হয়, তাহলে এর BTL দাঁড়ায় ৬০ থেকে ৮০ লাখ। দেড় দু’কোটি বাকিদের জন্য; এটা হল ATL (above the line) বাজেট। টোটাল তিন কোটি ধরলাম। খুব একটা এক্সপেন্সিভ না।
তাহলে আমরা ‘মহারাজা’-র মতো সিনেমা বানাতে পারছি না কেন?
ফিল্মটা কিছু দিন আগে নেটফ্লিক্সে রিলিজ হয়েছে। নেটফ্লিক্সের দাবি ফিল্মটা সারা ভারতে প্রথম নম্বরে স্ট্রিম হচ্ছে। কেউ যদি উল্টো প্রশ্ন করে যে, কেন দাদা, দক্ষিণী ছবির মতো ছবি বানাব কেন?, তাকে আমি প্রশ্ন করব, ফিল্মটা দক্ষিণী ভুলে গিয়ে আমরা এটাও তো ভাবতে পারি যে একটা ভালো তারকা-অভিনেতাকে নিয়ে একটা ভালো থ্রিলার, বা একটা ভালো ফিল্ম, যেটা নিয়ে শুধু কলকাতার সিরিয়াল-দেখা মানুষজন নয়, সারা ভারত মাতবে– এইরকম একটা ফিল্ম তো আমরা বানাতেই পারি? বানাই না কেন?
ফিল্মটায় প্রধান ভিলেনের চরিত্রে আছেন অনুরাগ কাশ্যপ, যিনি এখানে এসে খুব কারেক্ট কথা বলে যান, যে বাংলা সিনেমা ‘ঘটিয়া’। তার পরিচালিত ‘কেনেডি’ দেখতে আগের বছর কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে মারপিট লাগে হলে ঢুকতে পারেনি বলে। ‘কেনেডি’-ও অল্প টাকা দিয়ে বানানো টাইট একটা থ্রিলার। আপনি বলুন শেষ কোন বাংলা ফিল্মের জন্য মারপিট হয়েছে টিকিট কাউন্টারে? বোধহয় ‘অমর সঙ্গী’ আর ‘গুরু দক্ষিণা’ ১৯৮৭ সালে।
তাহলে আমরা কি ধরে নিতে পারি যে, বাংলা সিনেমা এখন এত নিকৃষ্ট মানের হচ্ছে, তার কারণ, যারা এই সিনেমা বানাচ্ছে, তারা হয় সিনেমা বোঝে না, বা সিনেমা ঠিক করে বানানোর প্রতি তাদের কোনও উৎসাহ বা সৎ ইচ্ছে নেই?
যাই হোক, বাংলা সিনেমা নিয়ে গতানুগতিক ঘ্যান ঘ্যান করার পর আসি ফিল্মের প্রসঙ্গে। ছবির নাম ‘মহারাজা’। বিষয়বস্তু: বিজয় সেতুপতি সেলুনে চুল কাটার কাজ করেন। একদিন তিনি থানায় হাজির হন অভিযোগ নিয়ে যে, তার বাড়ি থেকে একটা লোহার বালতি, যার নাম ‘লক্ষ্মী’ দিয়েছেন, সেটা চোরেরা এসে হাপিস করে দিয়েছে। আর কিছু চুরি যাইনি। প্রথমে তাঁকে কেউ সিরিয়াসলি নেয় না। তারপর যখন তিনি পুলিশকে সাত লাখ টাকা অফার করেন চোর ধরার জন্য, পুলিশ নড়েচড়ে বসে। সত্যিই তো, একটা বালতির জন্য যে সাত লাখ টাকা দিতে পারবে, তার কাছে মালকড়ি নিশ্চয়ই আছে। তদন্ত শুরু হয়।
সেখান থেকে জানা যায়, বালতিটা একটা red herring, অর্থাৎ একটা ছুতো গল্প এগোনোর জন্য, যেমন কুয়েন্তিন তারান্তিনোর ‘পাল্প ফিকশন’-এ সুটকেসটা, যেটার ভিতরে চকচকে, ঝলমলে কিছু একটা আছে, সেটা প্লট এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার ভিতরে কী আছে, আমরা শেষ অবধি জানতে পারব না।
বালতি খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরোলো: জানা গেলো ফিল্মটার আসল গল্প বদলা-কেন্দ্রিক। ফিল্মের বর্তমান দিনের গল্পের ১৫ বছর আগে মহারাজার (সেতুপতি) জন্য প্রফেশনাল ডাকাত সেলভামকে (অনুরাগ কাশ্যপ) জেলে যেতে হয়, নিজের স্ত্রী আর বাচ্চা মেয়েকে হারাতে হয়। সেলভাম জেল থেকে বেরিয়ে বদলা নিতে চায়, আর সেটা করতে গিয়ে নৃশংস একটা কিছু হয়ে যায়।
বাকি ফিল্মটা একটা সাউথ কোরিয়ান-স্টাইল রিভেঞ্জ থ্রিলার, কিন্তু তামিল মশলায় রান্না করা, কাড়ি পাতা, নারকেল, ইলায়ারাজা দিয়ে। ফিল্মটার প্রধান অন্তঃস্তল কোরিয়ান ফিল্ম ‘ওল্ডবয়’ থেকে ধার করা, অথবা বলা যেতে পারে ‘ওল্ডবয়’-কে নতুন ভাবে প্যাকেজ করা হয়েছে।
ফিল্মটার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হল তার প্লটিং। প্লটিং আর গল্প (বা স্টোরি) কিন্তু দুটো আলাদা জিনিস। স্টোরি হল: রাম ভালো ছেলে, সেই কোনও দিন স্কুল কামাই করে না, হঠাৎ সে স্কুল আসা বন্ধ করে দিল, টিচার তার বাড়ি গিয়ে খুঁজতে গিয়ে দেখে রাম সেখানে আর থাকে না কারণ তার বাবার চাকরির ট্রান্সফার হয়েছে। গল্পটা কালানুক্রমিক, পর পর ঘটনা ঘটছে। এবার প্লটিং হল: এই গল্পটার কোন অংশ কীভাবে আর কখন জানানো হবে দর্শককে, সেটা মাথায় রেখে লেখা। তখন গল্পের ঘটনাগুলো আগে-পিছে করা হবে সাসপেন্স তৈরি করার জন্য। ‘মহারাজা’-র প্রধান গুণ হল অস্বাভাবিক রকমের ভালো প্লটিং। আপনি দেখা শুরু করলে শেষ সিন অবদি দেখতে হবে পুরো গল্পটা বোঝার জন্য।
ফিল্মটার একমাত্র সমস্যা হলো, যেটা অধিকাংশ ভারতীয় পুরুষ মানুষ দ্বারা লেখা এবং পরিচালনা করা ফিল্মের দোষ: মেয়ে এবং মহিলারা ধর্ষিতা হন আমাদের প্রধান পুরুষ চরিত্রদের গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণে। আমি ফেমিনিস্ট তর্কে যদি নাও যাই, কারণ সেটা আমার চেয়ে ভালো অনেকেই করতে পারবেন, তাহলেও, রেপ প্লট ডিভাইস হিসেবে ব্যবহার করাটা বেশ প্রিমিটিভ আর বোরিং। আমরা ২০২৪ সালেও এসব দেখছি কেন যে, একটা পুরুষকে রাগ করে স্ক্রিনে অ্যাকশন করতে হলে, কয়েকটা মেয়েকে রেপ হতে হবে?
লেখা শেষ করার আগে আমি আমার শুরুর প্রশ্নটা আবার মনে করিয়ে দিয়ে যাই: আমরা অল্প টাকায় বাংলায়, একটা ভালো থ্রিলার বানাতে পারছি না কেন?
যে উন্মত্ত জনতার ঢেউ রবীন্দ্রনাথকে প্রয়াণের পর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ঢেউ হয়ে ওঠা জনতার অন্তর্গত মানুষগুলি কি জানতেন, তাঁদের এই মানুষটির প্রতি বিশ্বের মানুষের গভীর শ্রদ্ধার কথা! কয়েক মাস পড়ে, এই সংখ্যাটি কি হাতে নিয়ে দেখেছিলেন ভিড়ের মানুষেরা?