বেলা তবে পৃথিবী ঘুরে কী উপলব্ধি করল, ডানকানের কী হল, ম্যাক্সেরই বা হলটা কী, শহরের হোটেল থেকে বর্ণাঢ্য জাহাজে বেলা আর ডানকান পৌঁছালো কী করে এবং সর্বোপরি বেলা কি আদৌ বেলা নাকি অন্য কেউ, আর সে ফিরে এলো কি– এসব প্রশ্নের উত্তরই ‘পুওর থিংস’-এর প্রকৃত উপজীব্য।
নীল জল, ছাইরঙা জাহাজ আর সবুজ ধোঁয়া। মিঠে সূর্যের আলোয় ডেকের ওপর আরামকেদারায় বসা সুন্দরী বেলা, বৃদ্ধা মার্থা এবং কৃষ্ণাঙ্গ হ্যারি আলোচনা করছে দর্শন নিয়ে। বেলা, এমারসন পড়ছে। কিন্তু মার্থা উপদেশ দিচ্ছে গ্যেটে পড়ার জন্য। হ্যারি হঠাৎ বলে ওঠে, ‘আমরা যতই দর্শনের মধ্যে দিয়ে জীবনকে বোঝার চেষ্টা করি না কেন, ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা সকলেই নিষ্ঠুর জানোয়ার একেকজন। এই নিষ্ঠুর জানোয়ারত্ব নিয়েই আমরা বেঁচে থাকি এবং এটা সঙ্গে করেই আমাদের মৃত্যু হয়।’ হঠাৎ এই আলোচনায় এসে উপস্থিত হয় ডানকান। সে বেলাকে ‘আনন্দ করতে’ নিয়ে যেতে চায়। বেলা তা নাকচ করে। বেলার হাতে-ধরা এমারসনের বই ডানকান জলে ছুড়ে ফেলে দেয়। মার্থা নিজের হাতে থাকা বইটা বেলাকে দেয়। ডানকান রেগে সেটাও সোজা জলে ফেলে। কিন্তু বেশিক্ষণ সে দাঁড়াতে পারে না। তার রাগ বদলে যেতে থাকে। বেলাকে ‘আনন্দ করতে’ নিয়ে যেতে চাওয়া নিষ্ঠুর ডানকান তখন অভিমানে ভেজা প্রেমিক। ছলছলে চোখ নিয়ে সে নিজের মদ আর জুয়োর আড্ডায় ফিরে যায়।
এতক্ষণ যা ঘটল সাধারণ দর্শক হলে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেতে পারে। কিন্ত ইয়োর্গোস লান্তিমোসের সিনেমার সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে, তারা জানে বর্তমান সময়ের এই জিনিয়াস তার নির্মাণগুলিতে এমন হরবখত করেই থাকেন। শিল্প আর বাণিজ্যের দ্বৈতে থাকা সিনেমার জন্য তিনি এমন অনেক পরত খুলে দিতে পারেন যাতে দর্শক তথাকথিত ‘এন্টারটেন্ড’ হবেন ঠিকই কিন্তু সেই বিনোদনের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসে তার উপলব্ধি হতেও পারে, নন্দনতত্ত্বের পৃথিবীতে সে কী কেবল ‘নিষ্ঠুর জানোয়ার’ মাত্র?
এবারের অস্কারে ‘ওপেনহাইমার’-এর থেকেও বেশি আলোচিত ছবি ছিল ইয়োর্গোস লান্তিমোসের ‘পুওর থিংস’। তার আগে অবশ্য ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার জেতা হয়ে গিয়েছিল এ-ছবির। স্কটল্যান্ডের বিশিষ্ট লেখক অ্যালাসডেয়ার গ্রে-এর একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি ‘পুওর থিংস’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মানবশরীরের ব্যবচ্ছেদ যে কী অবলীলায় লান্তিমোস এ-ছবিতে দেখিয়ে ফেলেছেন, তাতে অনেকে ঘাবড়েও যেতে পারে। এমনিতে লান্তিমোস তাঁর ছবিতে যে হিংসা দেখান তা ঠিক কুয়েন্তিন তারান্তিনো বা পার্ক চ্যান ইউক গোষ্ঠীর রক্তে রক্তে ছয়লাপজনিত হিংসা নয়। তিনি আমাদের জীবনের চিরচেনা কিন্তু চাপা হিংসা যেমন অসহায় রোগীর প্রতি সাহচর্যকর্মীর হিংসা, সন্তানের প্রতি মা-বাবার হিংসা কিংবা প্রেমিকাকে ফটাস করে চড় মেরে দেওয়া প্রেমিকের হিংসার মতো গা-সওয়া হিংসা দেখান। ‘পুওর থিংস’ তার খুব ব্যতিক্রম নয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অ্যাবসার্ডিটি, ডার্ক হিউমার কিংবা অদ্ভুত চরিত্র নিয়ে সিনেমার ইতিহাসে অনেক নির্মাণ আছে। কিন্তু লান্তিমোসের পৃথিবী এই একই জিনিসগুলি আরও অন্যরকম, আরও জোরালো ভাবে তৈরি করে। এসবের আবেদন দর্শকমনকে যারপরনাই ভাবায়। কখনও আবার ক্ষতবিক্ষতও করে। মনে হয়, এমন তো আগে দেখিনি! ‘পুওর থিংস’-এ যেমন ভিক্টোরিও লন্ডন শহরে একজন পাগলাটে ডাক্তার গডউইন ব্যাক্সটার (উইলেম ডিফো) একটি জলে-ডোবা মৃত নারীদেহ পায়। সেই দেহ আবার গর্ভবতী। গডউইন সেই দেহটিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলেন। নতুন প্রাণ দেন। আর মেয়েটির মস্তিষ্কে স্থাপন করেন তারই মৃত সন্তানের মস্তিষ্ক! গডউইন ব্যাক্সটারের নবনির্মাণের নাম হয় বেলা ব্যাক্সটার (এমা স্টোন)।
প্রবল আকর্ষণীয় তরুণী শরীর আর সদ্যোজাত শিশুমস্তিষ্কের বেলা তার এ-দুটি সত্তা প্রথমেই মেলাতে পারে না। এর মধ্যে ম্যাক্স ম্যাকান্ডেলস (রামি ইউসেফ) গডউইনের সহকারী হয়ে আসে। তার ওপর দায়িত্ব বর্তায় বেলাকে বড় করে তোলার। এও যেন একরকমের শিশুপালন। বেলা তার চারপাশটা, ভাষা ও অক্ষর, নিজেরই শরীরের চরমসুখপ্রদায়িনী জায়গাগুলিকে চিনতে শুরু করে। গডউইন ঠিক করেন ম্যাক্স আর বেলার বিয়ে দেবেন। সেই সূত্রে ডানকান ওয়েডারবার্ন (মার্ক রাফালো) নামক এক উকিলকে তিনি খবর দেন। কিন্তু ডানকান বেলাকে নিয়ে পালাতে চায়। বেলার শরীরের প্রতি সে পাগলপানা হয়ে ওঠে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: পুরুষ মানেই সে শাসক আর নারী মানেই সে শোষিত, এই একপেশে সমীকরণ ‘লাপতা লেডিজ’ বিশ্বাস করে না
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ম্যাক্স দুঃখ পেলেও, গডউইন বেলা আর ডানকানের পালানোকে গুরুত্ব দেন না। তিনি প্রথম প্রথম বেলাকে নিরীক্ষা হিসেবে ঘরে আটকে রাখলেও, কেবল ছ্যাকরাগাড়িতে মাঝে মাঝে বাইরে নিয়ে গেলেও তাঁর মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে যে বেলার নিজেকে, নিজের পৃথিবীকে ঢুঁড়ে দেখা দরকার। বেলা তবে পৃথিবী ঘুরে কী উপলব্ধি করল, ডানকানের কী হল, ম্যাক্সেরই বা হলটা কী, শহরের হোটেল থেকে বর্ণাঢ্য জাহাজে বেলা আর ডানকান পৌঁছল কী করে এবং সর্বোপরি বেলা কি আদৌ বেলা নাকি অন্য কেউ, আর সে ফিরে এল কি– এসব প্রশ্নের উত্তরই ‘পুওর থিংস’-এর প্রকৃত উপজীব্য।
পুরো ছবিটা লান্তিমোস ফিসআই লেন্স ব্যবহার করে কেবল জুম-আউটের কারুকৃতিতে তৈরি করেছেন। এমন শিল্প ছবিকে ঘনত্ব দিয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে ওঁর অন্যান্য প্রকরণ যেগুলি ‘লান্তিমোসের ছবি’ বলে আলাদা করে দেয়, যেমন মাথার পেছন থেকে ক্যামেরা, চরিত্রের কোনও এক সময় চোখ-বাঁধা থাকা, ফ্রেম থেকে চরিত্রের মুখ কেটে বেরিয়ে যাওয়া, বোকা বোকা হাসির মুহূর্ত, আলোয় পুরোপুরি জ্বলে যাওয়া ফ্রেম, মানে যেগুলি সিনেমার সৌন্দর্যতত্ত্বের ফেলানি জিনিসপত্র সব– সেগুলি ‘পুওর থিংস’-এ তেমন মজুত নেই, কিন্তু এ-ছবিতে বিকট হিংসার মুহূর্তরা আছে।
মানবশরীরের ব্যবচ্ছেদ যে কী অবলীলায় লান্তিমোস এ-ছবিতে দেখিয়ে ফেলেছেন, তাতে অনেকে ঘাবড়েও যেতে পারে। এমনিতে লান্তিমোস তাঁর ছবিতে যে হিংসা দেখান তা ঠিক কুয়েন্তিন তারান্তিনো বা পার্ক চ্যান ইউক গোষ্ঠীর রক্তে রক্তে ছয়লাপজনিত হিংসা নয়। তিনি আমাদের জীবনের চিরচেনা কিন্তু চাপা হিংসা যেমন অসহায় রোগীর প্রতি সাহচর্যকর্মীর হিংসা, সন্তানের প্রতি মা-বাবার হিংসা কিংবা প্রেমিকাকে ফটাস করে চড় মেরে দেওয়া প্রেমিকের হিংসার মতো গা-সওয়া হিংসা দেখান। ‘পুওর থিংস’ তার খুব ব্যতিক্রম নয়।
তবে একটি ব্যাপারে ইয়োর্গোস লান্তিমোস পুরোপুরি জিতে গেছেন– এ-ছবিতে বেলা ব্যাক্সটারের চরিত্রে অভিনেত্রী এমা স্টোনকে কাস্ট করে। এমা এই অস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেলেন। সে পুরস্কার এর আগে অনেকেই পেয়েছেন। এমার নিজেরও এটি দ্বিতীয় অস্কার। কিন্তু ‘পুওর থিংস’-এ যে অভিনয়টা এমা করেছেন, তা বোধ করি গত কয়েক দশক ইংরেজি ছবি দেখেনি। এমনিতে অস্কারে অভিনয়-পুরস্কারের নিন্দা আছে যে জীবনীচরিত্র, যৌনকর্মী, খুনি, প্রতিবন্ধী কিংবা রূপান্তরকামী চরিত্রের জন্য পুরস্কার বাঁধা থাকে কিন্তু এমার বেলা ব্যাক্সটার চরিত্রটির আগেও কোনও সূত্র নেই, পরেও থাকবে কি না সন্দেহ। সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র যার হাঁটাচলা কথাবলা জড়বুদ্ধি শিশুর মতো, সারল্যে সে যখন তখন স্তন আর যোনি অনাবৃত রাখছে, যৌনকর্ম করে শরীরের বিভিন্ন অংশ সে কী বিভীষিকাময়, তা আবিষ্কার করছে। প্রথমে একরকমের আধোকথা আবার চরিত্রটির বিস্তার হচ্ছে যখন– তখন স্পষ্ট ইংরেজি আসছে, মুখে এই হাসি– এই অবাক-হওয়া, আবার এই চোখ ফুঁড়ে কান্নার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলছেন এমা। শুধু কান্নাই যে কতরকমের হতে পারে তা ‘পুওর থিংস’ না দেখলে উপলব্ধি হয় না। এমা স্টোনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্যান্য অভিনেতারাও অনন্যসাধারণ অভিনয় করেছেন এ-ছবিতে।
‘পুওর থিংস’ ও এমা স্টোনের বেলা ব্যাক্সটার, সিনেমার ইতিহাসে বহুদিন থেকে যাবে। ইয়োর্গোস লান্তিমোস নিজে যতদিন না আরেকটি নির্মাণ দিয়ে আবার সব তছনছ করবেন, ‘পুওর থিংস’-এর ব্যঞ্জনা, আবেদন আরও অনেক বছর আলোচকদের ভাবিত করবে নিঃসন্দেহে। সেদিন বেলা, মার্থা আর হ্যারির মতোই সমালোচকেরা কোনও অচিনদেশের বালুকাবেলায় কিংবা কোনও জাহাজের ডেকে জীবন ও সিনেমার পারস্পরিক দর্শন নিয়ে আলোচনা করবেন। হয়তো সেদিনও থাকবে নীল জল, ছাইরঙা জাহাজ আর সবুজ ধোঁয়া!