রামু বুঝেছিলেন, সিনেমাটা নিজেকেই বানাতে হবে; সুতরাং, সিনেমাটা শিখতে হবে। প্রোডিউসার সুরেন্দ্র তখন নাগার্জুনকে নিয়ে নতুন সিনেমায় হাত দিয়েছেন; ডিরেক্টর, বি. গোপাল। সুরেন্দ্রকে বলে-কয়ে, গোপালের ফিফথ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ঢুকে পড়লেন রামু। স্ক্রিপ্ট-রিডিং সেশনে, এমন এমন সাজেশন আর আইডিয়া দিতে শুরু করলেন তিনি, ক’দিনের মধ্যেই পেয়ে গেলেন প্রোমোশন! মানে, হাউজ থেকে দিয়ে দিল যাতায়াতের গাড়ি।
ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আপনি কী কী করতে পারেন? দুনিয়াকে অবাক করে, রাম গোপাল বর্মা খুলে বসলেন ভিডিও রেন্টাল লাইব্রেরি, ‘মুভি হাউজ’। পুঁজি, ২০,০০০ টাকা। ব্যবসা শুরুর আগেই, পরিচিত একজন ঠকিয়ে দিল অর্ধেক টাকা।
রামু ঘাবড়ালেন না। নিম্নবিত্ত এলাকায় দোকান। রোজকার খাটনির শেষে, লোকজন এলে, তাঁদের বসিয়ে, গল্প শোনাতে শুরু করলেন তিনি– রুচি বুঝে, রসিয়ে-কষিয়ে, সিনেমার গল্পই। ফলে, দুটো কাজ হল। এক, গল্প শোনার লোভে, গরিবগুরবো মানুষের ভিড় বাড়তে থাকল; ভিড় দেখে, কৌতূহলে, পয়সাওয়ালারা ক্যাসেট ভাড়া করতে শুরু করলেন। দুই, মজবুত হতে থাকল রামুর স্টোরিটেলিং স্কিল।
আরও পড়ুন: বর্ষা এনেছিল দেব আনন্দের ‘গাইড’
মাস আটেক পর, পুলিশ এসে, থানায় নিয়ে গেল তাঁকে। অপরাধ, ‘আখরি রাস্তা’-র পাইরেটেড কপি তাঁর দোকানে। লকআপে ঢুকে, রামু কাজে লাগালেন স্টোরিটেলিং স্কিল; বন্ধু বানালেন পুলিশেদের। কলেজকালে তাঁর কাজ ছিল এলাকার গুন্ডা-মস্তানদের খেয়াল করা– সমাজের কাছে অচ্ছুত লোকগুলো কী করেন, কেন করেন, তাঁদের জীবন কেমন– এইসব। এবার বুঝতে শুরু করলেন পুলিশের সাইকোলজি।
জিতেন্দ্র-শ্রীদেবী জুটিতে, বাপ্পি লাহিড়ীর মিউজিকে, ‘হিম্মতওয়ালা’ তখন সুপারহিট; ডিরেক্টর, রাঘবেন্দ্র রাও। পরবর্তী সিনেমার জন্য, রাঘবেন্দ্রকে সাইন করিয়েছিলেন নাগার্জুনের ভাই, ভেঙ্কট। কিন্তু, ভেঙ্কটের কাছে কোনও স্টোরি ছিল না। খবরটা পেয়েই, স্টোরি নিয়ে হাজির হলেন রামু। ভেঙ্কট বললেন, ‘তেলুগু মার্কেটে খাবে না, অন্য কিছু দাও!’ (সেদিনের নাকচ কাহিনি, পরে, ‘রাত্রি’; হিন্দিতে, ‘রাত’।)
ঘণ্টা খানেক পরেই আবার এলেন রামু, সঙ্গে নতুন স্টোরি– এবার, স্টুডেন্ট পলিটিক্সের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশিয়েছেন ‘অর্ধসত্য’, ‘অর্জুন’, আর ‘কালচক্র’। ভেঙ্কটের খুব পছন্দ হল; কিন্তু, রাঘবেন্দ্র বললেন, ‘ভীষণ এক্সপেরিমেন্টাল!’
আরও পড়ুন: ভারতের প্রথম অভিনেতা যিনি সেক্রেটারি রেখেছিলেন
রামু বুঝলেন, সিনেমাটা নিজেকেই বানাতে হবে; সুতরাং, সিনেমাটা শিখতে হবে। প্রোডিউসার সুরেন্দ্র তখন নাগার্জুনকে নিয়ে নতুন সিনেমায় হাত দিয়েছেন; ডিরেক্টর, বি. গোপাল। সুরেন্দ্রকে বলে-কয়ে, গোপালের ফিফথ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ঢুকে পড়লেন রামু। স্ক্রিপ্ট-রিডিং সেশনে, এমন এমন সাজেশন আর আইডিয়া দিতে শুরু করলেন তিনি, ক’দিনের মধ্যেই পেয়ে গেলেন প্রোমোশন! মানে, হাউজ থেকে দিয়ে দিল যাতায়াতের গাড়ি।
এদিকে ডিরেক্টরের চোখের বালি, রামু। দোষ, অ্যাটিটিউড আর ফটরফটর ইংরেজি। প্রোডিউসার বাজেট কমাতে বলায়, গোপাল বললেন, ‘নতুন ছোকরাকে কাটাও!’ বাস্তবিক, রামুর দ্বারা কাজকম্ম হচ্ছিল না। নিরুপায় সুরেন্দ্র তাঁকে বললেন, ‘এমনি থাকো, কিন্তু কোনও দায়িত্ব নিও না।’
খুশিই হলেন রামু। ইউনিটের বাকিরা যখন ভাবছেন, ‘ছেলেটা ফালতু সময় কাটায়!’ – রামু আবার কাজে লাগালেন স্টোরিটেলিং স্কিল। এবার, শ্রোতা, শটের ফাঁকে ফাঁকে, নাগার্জুন। অচিরে, রামু আখ্যা পেলেন, ‘নাগার্জুনের চামচা’।
তেলুগু ইন্ডাস্ট্রিতে, নাগার্জুন তখন উদীয়মান স্টার! ততদিনে, ভেঙ্কট, সুরেন্দ্র আর নাগার্জুনের সঙ্গে গাঢ় হয়েছে রামুর সম্পর্ক। মনে মনে নাগার্জুন চাইছেন এবার রামু একটা সিনেমা বানাক। কিন্তু, তাঁর বাবা, ‘অন্নপূর্ণা স্টুডিওজ’-এর কর্ণধার, নাগেশ্বর রাও বললেন, ‘শুধু ইংরেজি কপচালে, ইংলিশ নভেল আর ফিল্মের মুখস্থ বুলি আওড়ালে, ডিরেক্টর হওয়া যায় না।’
পরিচালক তরণী তখন একটা শুটিং করছেন, যেখানে একটা সিনের স্ট্রাকচার নিয়ে নাগেশ্বরের সন্দেহ হল। ব্যাপারটা বোঝাতে না পেরে, তরণী দোহাই পাড়লেন, ‘এটা রামু আর সুরেন্দ্রর মাথা থেকে বেরিয়েছে।’ দু’জনকে ডেকে, নাগেশ্বর যখন হম্বিতম্বি করছেন, রামু তাঁকে থামালেন; পুরো দৃশ্যটা ব্যাখ্যা করলেন; গোটা সিনেমাতে সেটার গুরুত্ব বোঝালেন। নাগেশ্বর বললেন, ‘সিনটা তাহলে তুমিই শুট করো! দেখি, কেমন হয়!’ সেদিন বাড়ি ফিরে, ছেলেকে বললেন তিনি, ‘নতুন ছোকরাটি বেশ ইম্প্রেসিভ!’
আরও পড়ুন: বন্দুকের নলই ভালবাসার উৎস! ‘গানস অ্যান্ড গুলাবস’ ও আমাদের লালচে বিকেল
নাগার্জুনের মুখে খবরটা শুনে, রামু বুঝলেন এটাই তাঁর কাঙ্ক্ষিত সিনেমার সুযোগ; ঝুলি থেকে বের করলেন স্টুডেন্ট পলিটিক্সের সেই বাতিল গল্প। নায়ক, ভবানী; খলনায়ক, শিবা। নাগার্জুন রাজি, তবে একটা শর্তে: পাল্টাপাল্টি করতে হবে সুর-অসুরের নাম। আনকোরা পরিচালক, এক বাক্যে, মেনে নিলেন নায়কের আবদার। শুরু হল ‘শিবা’-র প্রি-প্রোডাকশন।
কয়েক বছর আগে, ‘আমেরিকান সিনেমাটোগ্রাফার’-এ, স্টেডিক্যাম সম্বন্ধে পড়েছিলেন রামু। জিনিসটা খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল তাঁর। ভাবলেন, প্রথম সিনেমাতেই কোথাও যদি কাজে লাগানো যায় সেটা! এদিক-সেদিক কথা বলতে বলতে, জানতে পারলেন, চেন্নাইয়ে ওই যন্ত্র একখান আছে বটে; কিন্তু, চার বছর ধরে পড়ে পড়ে ধুলো জমছে, কেউ কখনও ব্যবহার করেনি। মুখ বেঁকালেন সিনেমাটোগ্রাফার গোপাল রেড্ডি, ‘এ দেশে ওই ক্যামেরা হ্যান্ডেল করার লোক কোথায়!’
রামু ঘাবড়ালেন না। খোঁজ লাগালেন চারিদিকে। জানা গেল, বম্বের এক বঙ্গসন্তান, জার্মানি থেকে সিনেমাটোগ্রাফি শিখে, আমেরিকা থেকে স্টেডিক্যামের আলাদা ট্রেনিং নিয়ে, বম্বের বেশ্যাপল্লি আর ডাব্বাওয়ালাদের নিয়ে ডকু বানিয়ে ঘুরছেন। নাম, দীপ পাল। চেন্নাই থেকে স্টেডিক্যামটা আনিয়ে, দীপকে ডাকা হল সেটা চালাতে।
দীপের বাবা, কোলিন পাল। কোলিন ছিলেন মেনস্ট্রিম হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পাব্লিসিস্ট। উর্দু মেশানো ভাষার বদলে, কথ্য হিন্দুস্থানি ভাষা ব্যবহারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তিনি। এখনের সময়ে যে-হিন্দি আমরা পর্দায় শুনতে পাই, বহু বছর আগে, তার পিছনে ছিল এক বাঙালির হাত। কোলিনের বাবা, নিরঞ্জন পাল। নিরঞ্জন ছিলেন বম্বে টকিজে স্ক্রিপ্টরাইটার, ডিরেক্টর। যে দুটো ব্লকবাস্টার রাতারাতি দেশের হার্টথ্রব করে তুলেছিল অশোক কুমারকে– ‘অচ্ছুত কন্যা’ আর ‘জীবন নাইয়া’– সে দুটো তাঁরই লেখা। নিরঞ্জনের বাবা, পরাধীন ভারতে রাজনীতির গ্রাফ বদলে দেওয়া ‘লাল-বাল-পাল’ ত্রয়ীর, হ্যাঁ, বিপিন চন্দ্র পাল।
রিলিজ হল ‘শিবা’। ভারতীয় অ্যাকশন ফিল্মের চোখে এসে পড়ল সজোর এক ঘুসি। সাধারণ দর্শক থেকে ক্রিটিককুল– সকলেই হাঁ হয়ে গেলেন রামুর ডেবিউতে। দীপ পালের কাজ এত দ্রুত ছাপ ফেলল ইন্ডাস্ট্রিতে, ‘শিবা’ রিলিজের এক বছরের মধ্যে, দশটারও বেশি স্টেডিক্যাম আনাতে হল এদেশে।