শ্বাসরোধী অন্ধকারে চিনার, পাশে দেওদার, তার পাশে জলপাই, ফিসফিস করে জানতে চাইছে কোন কাঠে যিশু ‘ক্রুশবিদ্ধ’ হয়েছিলেন? কোন কাঠে ‘ইলাহি’ বা ‘আল্লাহ্ হু আকবর’ খোদাই করা হয়? কোন কাঠে নির্মিত হন হিন্দু দেবতারা? গাছেদের কোনও ধর্ম হয় না। অন্ধকার আরও ঘন হয়ে উঠতে থাকে। নিচে কালচে ঘাসে আর পাথরে জলপাই-রঙা পোশাক হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায়। সারা দেশ– যুদ্ধ না যুদ্ধ নয়, ধর্ম না ধর্ম নয়, হিন্দু না হিন্দু নয়, রক্ত না রক্ত নয়– এই নিয়ে উত্তাপের শেষ পর্যায়ে। যখন ব্ল্যাক-আউট, সমস্ত মন জুড়ে, মাথা জুড়ে– টায়ারের টিউবের ভিতরকার অন্ধকারের মতো ঘন থকথকে হয়ে উঠছে, ঠিক তখনই একটা, দুটো, তিনটে করে জোনাকি জ্বলে উঠতে থাকে। আবার আলোর জন্ম হয়।
সম্পূর্ণ অন্ধকারের ভিতর শান্ত হয়ে, ধৈর্য্য ধরে বসে থাকুন। দেখবেন কোনও না কোনও অদৃশ্য উৎস থেকে একটা আলোর জন্ম হচ্ছে। হয়তো চারপাশ নিশ্ছিদ্র, হয়তো স্পন্দন ব্যাতীত সবকিছু স্থির, তবু ওই অন্ধকার এক আলোর সঞ্চার করতে থাকে; আর আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে ধীরে ধীরে বইতে থাকে বাতাস– এক হাওয়ার জন্ম হয়। সে হঠাৎই সরিয়ে দেয় মিথ্যে এক আবরণ, যা দৃষ্টি আড়াল করত আমাদের– যাকে আমরা অবিচল, অমোঘ ভবিতব্য ভেবে ফেলেছিলাম; আর সরে আসে সেই অন্ধকার, আমরা দৃষ্টি ফিরে পাই। একটা হালকা আলোর রশ্মি ক্রমে জোরালো হতে হতে নক্ষত্রের মতো ঝলমল করতে থাকে। দমকা হাওয়ায় দু’-হাট হয়ে খুলে যায় ঘরের দরজা আর বন্ধ, পরিত্যক্ত সিনেমা হলের ভিতর পরপর দৃশ্যের জন্ম হয়।
আমরা খেতে পাই বা না-পাই, ভগবান খাবেনই। সে দেবালয় হোক বা মসজিদ, গীর্জা অথবা মঠ, গুরুদ্বার কিংবা এগিয়ারি। ঈশ্বরকে উপবাসে রাখতে নেই। উপাসনার, দেব ভজনার, আচার-বিচার, শুচি-অশুচি, শুদ্ধ-অশুদ্ধ, পবিত্র-অপবিত্র, ছুৎ-অচ্ছুৎ আর ধর্ম-বিধর্মের চর্চার কোনও বিরাম থাকতে পারে না। নিজ ধর্ম আর পরধর্মের সুদীর্ঘ রক্তাক্ত ইতিহাসের পাতা শান্ত সাদা ধ্যানমগ্ন কখনও নয়। সেই প্রবাহ হতে হবে অবিচ্ছিন্ন
ঘৃণা-হিংসা-প্রতিশোধের এক নির্মম দলিল। এত কথা, এই অবতারণা যে ঘটল এবং তার ধারাবাহিকতা কোন দিকে ইশারা করে তা সকলেরই জানা। গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁও গণহত্যা সম্বন্ধে গুগল বলছে– ‘উগ্রপন্থীদের হাতে হিন্দু পর্যটকদের হত্যা। মৃতের সংখ্যা ছাব্বিশ।’ কিন্তু রক্তপাত, যা দৃশ্যমান বা দেখা যায় না– তার স্রোত কাশ্মীরের পাহাড়-উপত্যকা ছাপিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে গোটা দেশ। সীমান্তে চমকে উঠেছে কাঁটাতার। চিনারের হিমস্নাত পাতাগুলি রাতের আঁধারে এক আতঙ্ক-ঘেরা স্তব্ধতায় অপেক্ষা করছে ভোরের, অথচ ভোর হচ্ছে না।
গোটা দেশ অপেক্ষা করছে প্রতিশোধের। উগ্রপন্থী এবং তাদের লালন করা প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে সমুচিত জবাব দিতে প্রয়োজনে যুদ্ধেও যেতে রাজি ভারতবর্ষ– যে দেশ সাংবিধানিক অর্থে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। যে দেশে ন্যূনতম নয়টি মূল ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস। যে দেশ দুশো-সত্তরটি মাতৃভাষায় কথা বলে। কিন্তু মরেছে তো ‘হিন্দু’। বেছে বেছে মারা হয়েছে তাদের। আর মেরেছে তো অহিন্দু, ম্লেচ্ছ ‘মুসলমান’– যারা দখল করেছিল এই দেশ। যারা ধ্বংস করেছিল হিন্দুদের বসবাস, সংসার, শান্তি আর দেবালয়। যারা নির্মম, নির্দয়, অন্যের ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু। যারা তাদের ধর্ম দিয়ে পৃথিবী গ্রাস করতে চায়। ফলে কীসের সেক্যুলারিজম? কীসের ধর্মনিরপেক্ষতার সুযোগ দিয়ে বারবার নিজের দেশের মাটিতে নিজের ধর্মের মানুষকে ইসলামের বলি হতে বাধ্য করা? মুছে দাও ওই ‘সেক্যুলার’ শব্দ। নির্মাণ করো হিন্দুরাষ্ট্র। ধ্বংস করো হিন্দুবিরোধী সকলকে।
এখানে, ঠিক এইখানে স্পষ্ট দু’ভাগে ভাগ হল সমাজ, সমাজমাধ্যম ও মনন। কেন নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ, সেক্যুলার বা নাস্তিক বলা যাবে না? কারণ ‘সেক্যুলার’ বলা মানেই পরোক্ষে ইসলামকে ইন্ধন দেওয়া। কারণ ‘নাস্তিক’ বলা মানে কম্যুনিস্ট। ওরাই ধর্ম মানে না, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। ওরা শিক্ষিত মুখোশের আড়ালে হিন্দুত্বের শত্রু; ফলে দেশের শত্রু। ওরা পাকিস্তানের মদতকারী বেইমানের দল। অথচ, যারা হিন্দুত্বের ধ্বজার ছায়ায় বসে পরপর ভুয়ো খবর, ভুয়ো রিল, মিথ্যে প্রচার করে চলেছে; যারা সুচতুরভাবে দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশে হিন্দুদের নিপীড়ন, বি.ডি.আর-এর পায়ে বি.এম.এফ-এর ক্ষমাভিক্ষা, ইসলামি প্রচারক সাজা কাঁচা অভিনেতার মুখে হিন্দুত্বের অপমান; যারা পরক্ষণেই ভারত-পাকিস্তান, ভারত-চীন, ভারত-তুরস্ক, ভারত-বাংলাদেশের সামরিক শক্তির তুলনামূলক তালিকা ওড়াচ্ছে হাওয়ায়; হাতে ত্রিশূল আর তরোয়াল নিয়ে গরিব মুসলমানের ঘরবাড়ি আক্রমণের ছবি ছড়িয়ে দিচ্ছে সমাজমাধ্যমে– তাদের এবং এই দুই পক্ষের কারওরই মনে পড়ছে না হিন্দুর হাতে হিন্দু দলিতের হত্যা, মুসলিম পুরুষের হাতে মুসলিম নারীর শ্বাসরোধ। মনে পড়ছে না আসাম, মণিপুর, দান্তেওয়াড়া আর অচলমাড়ে দেশের সেনার হাতে দেশেরই মানুষের (‘মাওবাদী’ এই অজুহাতে) হত্যা।
অথচ ভোর হচ্ছে না। শ্বাসরোধী অন্ধকারে চিনার, পাশে দেওদার, তার পাশে জলপাই, ফিসফিস করে জানতে চাইছে কোন কাঠে যিশু ‘ক্রুশবিদ্ধ’ হয়েছিলেন? কোন কাঠে ‘ইলাহি’ বা ‘আল্লাহ্ হু আকবর’ খোদাই করা হয়? কোন কাঠে নির্মিত হন হিন্দু দেবতারা? গাছেদের কোনও ধর্ম হয় না। অন্ধকার আরও ঘন হয়ে উঠতে থাকে। নিচে কালচে ঘাসে আর পাথরে জলপাই-রঙা পোশাক হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায়। সারা দেশ– যুদ্ধ না যুদ্ধ নয়, ধর্ম না ধর্ম নয়, হিন্দু না হিন্দু নয়, রক্ত না রক্ত নয়– এই নিয়ে উত্তাপের শেষ পর্যায়ে। যখন ব্ল্যাক-আউট, সমস্ত মন জুড়ে, মাথা জুড়ে– টায়ারের টিউবের ভিতরকার অন্ধকারের মতো ঘন থকথকে হয়ে উঠছে, ঠিক তখনই একটা, দুটো, তিনটে করে জোনাকি জ্বলে উঠতে থাকে। আবার আলোর জন্ম হয়।
হ্যাঁ, আমি বলছিলাম এই বছর আই.এস.সি-তে প্রথম হওয়া সৃজনীর কথা। বলছিলাম মাধ্যমিকে প্রথম হওয়া আদৃতর কথা। বলতে চাইছি পহেলগাঁও গণহত্যায় জঙ্গিদের গুলিতে নৌ-সেনা আধিকারিক স্বামী বিনয় নারওয়ালকে হারানো তাঁর স্ত্রী হিমাংশী নারওয়ালের কথা। সেই সৃজনী, যে তার পদবি অস্বীকার করে তাকে ছুঁড়ে ফেলতে প্রতিজ্ঞ; সেই সৃজনী, যে মনে করে মানুষের পদবি তার জাত, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, প্রাদেশিকতার চিহ্ন বহন করে। সৃজনী বিশ্বাস করতে শিখেছে জাত-পাত, ধর্ম-বিধর্ম, গোত্র-বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ, বর্গ, সম্প্রদায়– এই সবের ঊর্ধ্বে যে বিভাজনহীন, নিপীড়নহীন সমাজ– সেই সমাজ শুধু মানুষ নয়, মানবের জন্ম দেয়। সৃজনী সেইরকম এক পৃথিবীতে বড় হতে চায়। আদৃত দ্ব্যর্থহীন বলে উঠতে পারে সাম্প্রদায়িক বিভাজন উপড়ে না ফেললে কোনও সমাজ, কোনও জাতি, কোনও দেশ এগোতে পারে না। মধুচন্দ্রিমার দিনে স্বামীকে চোখের সামনে বুলেটবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখা হিমাংশী শোকার্ত-নিরুদ্বেগে সারা ভারতবাসীকে জানাতে পারে তাঁর স্বামীর হত্যাকারীরা ‘মানুষ’ নয়, তারা ‘উগ্রপন্থী’। উগ্রপন্থীদের কোনও ধর্ম হয় না। ফলে মুসলমান-বিদ্বেষ বা হিন্দু-জাগরণ নয়, কাশ্মীরিদের আক্রমণ নয়, লড়াই এই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। সমাজমাধ্যমে হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে ওঠেন হিমাংশী, আর তখনই তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন স্বাতী চতুর্বেদী। এসে দাঁড়ান প্রাক্তন নৌ-প্রধানের স্ত্রী ললিতা রামদাস।
যুদ্ধ হয়তো হবে। রাতের আকাশে ফ্লেয়ার আর ক্ষেপনাস্ত্রের খেলা আলো ফেলবে নিচের পৃথিবীতে। যেখানে সীমান্তের দু’দিকেই ভয়ার্ত, ক্ষুধার্ত মানুষ দৌড়বে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। যেখানে সঘন জঙ্গলে পাশাপাশি স্থির চিনার, দেওদার, আর জলপাই ফিসফিস করে বলবে, ভুলে যেও না, সেদিন সারা কাশ্মীরের মানুষ প্রতিবাদে পথে নেমেছিল। মানুষ বাঁচাতে গিয়ে গুলি খেয়েছিল এক গরিব সহিস। ভুলে যেও না সেই ইমামের কথা। ভুলো না– অন্ধকারে ধীরে ধীরে আলোর জন্ম হয়।