সমীক্ষা বলছে, আন্তর্জাতিক শ্রমশক্তির প্রায় ৪৩ শতাংশ নারী কিন্তু জমির মালিকানা সেই নারীদের খুবই কম। অথচ নারী যদি জমির সঠিক মালিকানা পেত, কৃষি-উৎপাদনে পুরুষের তথাকথিত ‘সহকারী’র ভূমিকা পালন না করে স্বাধীনভাবে চাষবাসে জড়াত তবে পৃথিবীতে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের অন্নসংস্থান নিশ্চিত ছিল। তাই প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর দিনটি পালিত হওয়া জরুরি যাতে গ্রামীণ মহিলাদের লিঙ্গবৈষম্য, কাজের সুযোগের অসমানতা এবং ক্ষয়িষ্ণু স্বাস্থ্যের মতো বিবিধ সমস্যার দিকে দৃকপাত করা যায়।
লেদুভাইয়ের কাছে একটা হাঁস চেয়েছিল মায়মুন। সেই হাঁসকে মেয়েটি নিজে না খেয়ে ভাত দিত। হাঁস পুকুরে খেললে মায়মুনের আনন্দ দেখে কে! সে স্বপ্ন দেখত একটা হাঁস থেকে দুটো হাঁস হয়েছে তারপর চারটে, তারপর ছটা। হাঁস যে চারটে ডিম দিল একদিন, মায়মুনের মা জয়গুন চাইল বাচ্চা ফোটানোর জন্য দুটো ডিম রেখে মসজিদের হুজুরকে বাকিগুলো দেওয়া হোক। জয়গুনের বড় ছেলে হাসু ‘আন্ডা’ নিয়ে মসজিদে গেলও। কিন্তু জয়গুন, জব্বর মুনশি’র পরিবার যে পর্দা করে না। যৈবতী নারী ময়মনসিং যায় চাল বেচতে। তার বাসার যে-কোনও জিনিস হারাম। হাসুকে হুজুর তাই বকাঝকা দিয়ে ভাগিয়ে দিল। বিফলমনোরথ হাসু জয়গুনকে জিজ্ঞেস করে, ‘মা! জ়ুম্মাগরে হুজুরে কি কৈসে হুনসো তুমি?’’ জয়গুন শক্তমুখে উঠে দাঁড়ায়। অন্য কাজে চলে যাওয়ার আগে পরিষ্কার ঘোষণা করে, ‘কৈতে ব্যাবাকই পারে। বাড়ির থনে না বাইরৈলে কেউ মুখে তুইল্লা দিব? কেউরটা চুরিও করি না, খয়রাতও লইনা। কাম কইরা খাই!’
১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শেখ নিয়ামত আলি ও মাসিউদ্দিন শাখের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ সিনেমাতে ঠিক এই সংলাপে এসে আমরা আটকে যাই। চালচুলোহীন গ্রাম বাংলার এক নারী বলছে সে কাজ করে খায়। কারও থেকে সে চুরিও করে না আর ভিক্ষাও নেয় না। তার জোরের জায়গা নিজের পরিশ্রম। অথচ সমীক্ষা বলছে, উপমহাদেশের গ্রামীণ নারীর এই শ্রম প্রায় পারিশ্রমিকহীন। সে চাষের কাজের সমস্ত পর্যায়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, সে বাচ্চা মানুষ করে, গৃহকর্ম করে, হাতের নানা কাজ যথা সেলাই-ফোঁড়াই, আচার বানানো, বিড়ি-বাধার মতো বহু রকম কাজ করে। কিন্তু পুরুষের তুলনায় তার পারিশ্রমিক নগণ্য শুধু নয় চাষের জমির মালিকানাও তার নেই বললেই চলে। এমনিতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যেকার ক্ষমতার দূরত্ব যোজন খানেক। কাজের সুযোগের সমানতা নেই বললেই চলে। কিন্তু তার মধ্যেও রয়েছে শহরের নারী ও গ্রামের নারীর অবস্থার বিস্তর ফারাক। গ্রামে শিক্ষার হার কম। মেয়েদের ক্ষেত্রে ভয়ংকর রকম তলানিতে। বাল্যবিবাহ এখনও গ্রামে রীতিমতো প্রকট। সঙ্গে সন্তান নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত তা অনেক সময়ই গ্রামের নারীর হাতে থাকে না। অপুষ্টি তাদের মধ্যে মারাত্মক। এর মাঝে রাষ্ট্রের তথাকথিত উন্নয়ন কিংবা গত শতাব্দীর বিশ্বায়ন অনেক জায়গাতেই গ্রামের নারীর চিরাচরিত কাজ কেড়ে নিয়েছে। চাষের কাজেই এমন সব যন্ত্র চলে এসেছে যা নারীকে কর্মহীন করেছে। এতে গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা আরও বেড়ে গিয়েছে।
করিম বকশ জয়গুনের দ্বিতীয় স্বামী। মাছমারা আর স্ত্রী প্রহারে সে সিদ্ধহস্ত। জয়গুনের শরীরে নাকি কোনও জায়গা বাদ নেই যেখানে করিম বকশের মারের চিহ্ন নেই। দুর্ভিক্ষের সময়ে জয়গুনকে ছেড়ে দিয়ে করিম আরেকটি বিবাহ করে। আগের পক্ষের ছেলে (জব্বর মুনশি’র) হাসু আর করিমের কন্যা মায়মুনকে নিয়ে জয়গুন রাস্তায় এসে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। ছোট ছেলে কাসুকে মায়ের সঙ্গে ছাড়েনি করিম। জয়গুন করিমের পা ধরেছে। ছটফট করে কেঁদেছে। কিন্তু ফল হয়নি। সে গলাধাক্কা খেয়েছে। জয়গুন তাতে দমে যায়নি। প্রথমে বাড়ি বাড়ি উঠোন-লেপা, ধান-মাড়াইয়ের কাজ সে করত। তারপর লালুর মায়ের সঙ্গে চাল কিনে এনে বিক্রি করতে শুরু করে। একদিন ধান-মাড়াইয়ের কাজে গিয়ে লালুর মাকে সে ময়মনসিংহ গিয়ে চাল আনার প্রস্তাব দিয়েছিল। লালুর মা রসিকতা করে বলেছিল, ‘তুই ময়মনসিন গ্যালে মাইনষে না তরে রাইখ্খা দেয়!’ নিজের দুর্ভাগ্যের প্রতি হেসে উঠে জয়গুন বলে, ‘রাখবার সময়ই রাখল না আর অহন রাখব!’ সে তারপর ‘চাউল লইবেননি, চাউল!’ বলে বলে বিভিন্ন বাড়ির দরজায় গিয়ে হাজির হয়। তার রোজগার হয়। কিন্তু ট্রেনপথে চাল আনার কসরত কম নয়। বাংলা বিভক্ত হয়ে এক দিক পাকিস্তানে যায়। সবাই বলাবলি করে চাল সস্তা হবে। কিন্তু কোথায় কী! অবাঙালি পেয়াদা এসে চাল লুঠ করে। মেয়েদের অসম্মান করে। অন্যদিকে গদু প্রধান জয়গুনকে পুনর্বিবাহের প্রস্তাব দিলে সে নাকচ করে। জমি-বাড়ির লোভ দেখিয়ে তাকে হস্তগত করা যায় না। জয়গুনের যে কারও দয়ার দরকার নেই। কোনও পুরুষের প্রয়োজন নেই তার। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তা মানবে কেন। মায়মুনের বিয়ের দিন গ্রামের পুরুষেরা জয়গুনকে দিয়ে ‘তওবা’ করিয়ে নেয় যে সে গ্রামের বাইরে কাজ করতে যেতে পারবে না। মেয়ের ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে সব মেনে নেয় জয়গুন।
……………………………
আমাদের বাস্তবতায় গ্রামই যেহেতু এখন আর দৃশ্যমান নয় তাই গ্রামের নারীর কথা কী করে বলা হবে? সময়েরও পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রামের নারীর কর্মসংস্থান যেমন কমেছে তেমন তারাও নতুন নতুন পথে কাজের সন্ধান শুরু করেছে। ইউটিউব-ফেসবুকের দৌলতে ভারতের বহু গ্রামীণ নারী রীতিমতো রোজগার করছে। শহুরে মানুষ গ্রামের দারিদ্র, দূরত্ব আর মেয়েদের জীবনের ভিডিও দেখে বিনোদন পাচ্ছে। অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। এটা শুধু ভারতের কাহিনি নয়, নেপাল-ভুটান-বাংলাদেশ-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা– সবখানেই গ্রামের নারীর একটি নতুন রকম কর্মসংস্থান এখন সোশ্যাল মিডিয়া।
……………………………
২০০৮ সাল থেকে জাতিসংঘ ১৫ অক্টোবর দিনটিকে চিহ্নিত করেছিল ‘আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস’ হিসেবে। শহরের নারী ও গ্রামের নারীর মধ্যে অবস্থানগত পার্থক্য রয়েছে। এমনকী, গ্রামের পুরুষও যা সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পায় সেসব থেকে গ্রামের নারী লিঙ্গগত বৈষম্যের জন্য বিচ্যুত। এবং এটা ভারতীয় উপমহাদেশ, এশিয়া কিংবা আফ্রিকার সমস্যা নয়। তথাকথিত উন্নত দেশেও দেখা গিয়েছে গ্রামের নারী শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে কম, তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এবং সন্তানের সংখ্যা অনেক। তাদের স্বাস্থ্যও ভঙ্গুর। সমীক্ষা বলছে, আন্তর্জাতিক শ্রমশক্তির প্রায় ৪৩ শতাংশ নারী কিন্তু জমির মালিকানা সেই নারীদের খুবই কম। অথচ নারী যদি জমির সঠিক মালিকানা পেত, কৃষি-উৎপাদনে পুরুষের তথাকথিত ‘সহকারী’র ভূমিকা পালন না করে স্বাধীনভাবে চাষবাসে জড়াত তবে পৃথিবীতে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের অন্নসংস্থান নিশ্চিত ছিল। তাই প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর দিনটি পালিত হওয়া জরুরি যাতে গ্রামীণ মহিলাদের লিঙ্গবৈষম্য, কাজের সুযোগের অসমানতা এবং ক্ষয়িষ্ণু স্বাস্থ্যের মতো বিবিধ সমস্যার দিকে দৃকপাত করা যায়।
গ্রামীণ নারীর কথা ভারতীয় সাহিত্য ও সিনেমায় স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে উঠে আসত। মাহবুব খানের ‘মাদার ইন্ডিয়া’ (১৯৫৭), শুভেন্দু রায়ের ‘সওদাগর’ (১৯৭৩) আমরা দেখেছি। আমরা সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেন-এর বহু নির্মাণে গ্রামীণ নারীর কথা পেয়েছি। কেতন মেহতা-র ‘মির্চ মসালা’ (১৯৮৭) কিংবা কল্পনা লাজমি-র ‘রুদালি’ (১৯৯৩)– সিনেমাতেও লক্ষ করেছি গ্রামের নারীর অসহনীয় জীবনযুদ্ধ। দক্ষিণ ভারতের সিনেমাতেও এমন উদাহরণ অনেক আছে। অথচ ভারতীয় সিনেমার অঙ্গন থেকে ধীরে ধীরে গ্রামের নারীর কথা যেন এখন হারিয়ে যাচ্ছে।
……………………………………………
আরও পড়ুন রাধামাধব মণ্ডল-এর লেখা: গ্রামীণ মেয়েদের গ্রীষ্মদুপুরের আড্ডা কি চিরতরে হারিয়েছে?
……………………………………………
আমাদের বাস্তবতায় গ্রামই যেহেতু এখন আর দৃশ্যমান নয় তাই গ্রামের নারীর কথা কী করে বলা হবে? সময়েরও পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রামের নারীর কর্মসংস্থান যেমন কমেছে তেমন তারাও নতুন নতুন পথে কাজের সন্ধান শুরু করেছে। ইউটিউব-ফেসবুকের দৌলতে ভারতের বহু গ্রামীণ নারী রীতিমতো রোজগার করছে। শহুরে মানুষ গ্রামের দারিদ্র, দূরত্ব আর মেয়েদের জীবনের ভিডিও দেখে বিনোদন পাচ্ছে। অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। এটা শুধু ভারতের কাহিনি নয়, নেপাল-ভুটান-বাংলাদেশ-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা– সবখানেই গ্রামের নারীর একটি নতুন রকম কর্মসংস্থান এখন সোশ্যাল মিডিয়া।
প্রাক্তন স্বামীর কাছে রেখে আসা ছোট সন্তানটিকে জয়গুন ভুলতে পারে না। বড় ছেলে হাসু ছোট ভাই কাসুর জন্য লুকিয়ে কদমা, চড়কি, চিনে বাদাম দিয়ে আসে। হোক তাদের বাবা আলাদা। মা তো এক। কাসুকে যে হাসু কী ভালোবাসে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না! কাসু অসুস্থ হলে জয়গুন তাদের বাড়িতে থেকে কাসুর যত্ন নিয়ে নিমোনিয়া রোগ থেকে বাঁচায়। কিন্তু প্রাক্তন স্বামীর ঘরে জলস্পর্শ করে না সে। কাসুর দেখভালের জন্য মায়মুনের সেই হাঁস বেচে দেয় জয়গুন। সাধের আমগাছটি বিক্রি করে। সমাজের সব ‘তওবা’ নস্যাৎ করে লালুর মা-র সঙ্গে সে কাজ নেয় চালকলে। করিম বকশ হোক আর গদু প্রধান– কারওর বশ্যতা স্বীকার করে না জয়গুন। কেন? কারণ, সে কাজ করতে পারে। তার শ্রমের জোরই তার শক্তি।
পৃথিবীর সব গ্রামীণ নারীর ব্যাপারে এ-কথা সত্যি। আর ঠিক এই জায়গায় শেখ নিয়ামত আলি ও মাসিউদ্দিন শাখের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র জয়গুন সিনেমার ইতিহাসে বিবৃত সব গ্রামীণ নারীর থেকে আলাদা। তার নারীত্ব-মাতৃত্বের থেকেও বড় তার শ্রমিক-কৃষকের পরিচয়। সে কোনও ক্ষেত্রে পুরুষের থেকে খাটো নয়। নারী প্রকৃতই তাই। আজ ‘আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস’-এ সে-কথা আমরা যেন ভুলে না যাই।
.……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..