কলকাতার চিনাপাড়া নিয়ে আড্ডার এটা দ্বিতীয় পর্ব। দুঃখের কথা, এটা শেষ পর্বও। কলকাতার চিনাপাড়াকে চিনতে, খানিক ভেতরে ঢুকে পড়তে, এই আড্ডা হয়তো বা সহায়ক হবে। হয়তো খানিকটা আন্তরিক হওয়া যাবে, খানিকটা হেঁটে আসা যাবে ট্যাংরায়, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে, টেরিটি বাজারে। জানা যাবে, বাংলা জানা চিনাদের কথা। জানা যাবে, এক বাঙালি মেয়ে এক চাইনিজ ছেলের প্রেমে পড়ে পরিবার ছেড়ে চলে এসেছিল। কলকাতার এই টুকরো-টাকরা চাইনিজ খবরটবর, তেমন করে নেওয়া হয়নি। ক্রমাগত একরকম হওয়া ও একরকম করে দেওয়ার যে রাজনীতি, এই আড্ডা আসলে তার বিরুদ্ধে।
স্ট্রেলা চেন মারা গেলেন, তুমি গেছিলেও, পারলৌকিক প্রক্রিয়াটা কীরকম?
সিড়িটি শ্মশানে পোড়ানো হল ওঁকে। খুবই মনখারাপ হয়েছিল। শরীর খারাপ হলে আমার স্ত্রী মাঝেমধ্যেই চিকেন স্ট্যু বানিয়ে দিত ওঁকে। একবার চিনাপাড়ার ছবি দিয়ে আমি একটা ক্যালেন্ডার করেছিলাম। স্ট্রেলা দোকানে রেখেছিলেন। দোকানে আসা অনেকে টাকা দিয়ে সেই ক্যালেন্ডার কিনে নিতে চেয়েছে বলে স্ট্রেলা মুখঝামটাও দিয়েছিল সেইসব অতি-উৎসাহী ক্রেতাকে। চিনাদের যে পারলৌকিক প্রক্রিয়া, তা আসলে দু’রকমের– কবর আর চুল্লি। দেখবে, ট্যাংরাতে ৬-৭টা কবরস্থান রয়েছে। ইদানীংকালে কবর দেওয়ার রেওয়াজ কমে এসেছে। চার বা পাঁচ বছর পর কবর আবার তোলা হয়।
চার-পাঁচ বছর পর কবর তোলা হয়!
হ্যাঁ, প্রথমে এ কাজের জন্য একটা দিন ঠিক করা হয়। সেই নিদিষ্ট দিনে প্রত্যেকটা স্কেলিটন পরিষ্কার করা হয়। তারপর পুজো করে একটা ছোট বেদি করে রেখে দেওয়া হয়। বলা হয়, এবারই আসলে বসতি পেল সেই মৃত মানুষটি। এই যে প্রক্রিয়া, এটা নিয়ে অনেকের দ্বিমত রয়েছে। কেউ বলে এটা চিনদেশীয় পদ্ধতি নয়। কেউ বলে যে না, এরকম ওখানে প্রচলন রয়েছে। কিন্তু এটাই চাইনিজদের ইউনিকনেস!
কিন্তু কবর থেকে তুলে, পরিষ্কার করে, আবারও কবরে রাখা, এটা কেন?
ওরা অনেকেই একটা সময় ভাবত যে, একদিন হয়তো চিনদেশে ফিরে যাবে সব্বাই। তখন কি বাপ-ঠাকুরদাদের কবর এভাবেই রয়ে যাবে নাকি! তখন এই স্কেলিটনগুলোও নিয়ে চলে যাবে। অর্থাৎ, সবাই নিজের দেশে ফিরবে। যে জীবিত নয়, সে-ও। এটা করতে প্রবল খরচ এবং মনুষ্যবলও লাগে। এই খরচটা কুলিয়ে উঠতে না পারার জন্যই বোধহয় কবর ব্যাপারটা উঠে যাচ্ছে! আর এখন কলকাতার চিনাদের জনসংখ্যা ক্রমশ কমতির দিকে।
কী আশ্চর্য দর্শন বিজয়দা! আচ্ছা, তুমি যে এতকাল ধরে চিনাপাড়ায় যাতায়াত করেছ, তোমার সবথেকে ইন্টারেস্টিং লেগেছে কাকে?
সে, আমার বন্ধু, ভাটিয়া। ‘ওয়াং’ পদবির অনেকে আছে দেখেই, ওকে এই নাম দেওয়া। আমার দেখা জীবনের সেরা চাইনিজ চরিত্র ও। এত বড় হৃদয়, এত পরোপকারী– ভাবা যায় না! ও যখন মেডিক্যাল কলেজে মারা গেল, মারা যাওয়ার সময় ওর বোন আর আমি– এই দু’জন ছিলাম। মনে হবে, একেবারে সিনেমার চরিত্র। আমার বাবা তখনও বেঁচে, কিন্তু ভাটিয়া যখন মারা গেল, মনে হল, আমার সবথেকে কাছের কেউ চলে গেল। এই ভাটিয়ার সঙ্গে কত দিন ওঁর কাজের জায়গা কালিম্পং শহরে আমি কাটিয়েছি। কত সব স্মৃতি এখনও ঘুরে-ফিরে আসে!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
একবার জামাটা খুলেছে, দেখি ওর ওই চেহারায় বিরাট দাগ। যেন অপারেশনের। আগে দেখিনি। বললাম, ‘ক্যায়া রে, হার্ট কা কুছ প্রবলেম হ্যায়?’ ও বলে, ‘হ্যাট শালা, দোস্ত নে চাকু মার দিয়া।’ বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘কিউ?’ বলে, ‘আপসমে লাফড়া হুয়া! হাম ভি চালায়া থা। পুলিশ কেস-ফেস নেহি হুয়া, দোস্ত থা, সব অ্যাডজাস্ট হো গ্যায়া।’ যে-কেউ এই কাটা দাগ দেখলে শিউরে ওঠবে। অন্য চাইনিজ বন্ধুরা বারবার বলেছে, ‘বিজয় তুম ও ভাটিয়াকে সাথ মত্ যাও, বহুত ডেঞ্জারাস হ্যায়।’ কিন্তু আমার তো ডেঞ্জারাসের দিকেই বেশি নজর, ওখানেই জীবনের যত রস।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কী পেয়েছিলে তুমি চরিত্রটায়?
খুব রাফ অ্যান্ড টাফ! ক্যারাটে মাস্টারের মতো দেখতে। টাক মাথা। ইয়া মাস্ল। জীবনটাকে যেন তুড়ি মেরে কাটাত। প্রচুর মহিলা বন্ধু ছিল ওর। বিয়ে করেছিল, সেপারেশন হয় পরে। যা রোজগার সবই উড়িয়ে দিত। ফলে যা হয়, মৃত্যুর সময় কোনও পয়সা ছিল না। আত্মীয়স্বজনরা দাঁড়ায়নি। ও আমাকে চিনেপাড়ায় দুরন্ত অ্যাকসেস দিয়েছিল। আমাকে কবরে ওই স্কেলিটন পরিষ্কার করার ছবি তোলার সুযোগ করতে দিয়েছিল ও-ই। বলেছিল, ‘বিজয়, তু কিউ নেহি যায়েগা? মেরা মম্মি কা হ্যায়।’ আমি দেখলাম, ভাটিয়া নিজের মায়ের স্কেলিটন নিজের হাতে পরিষ্কার করছে। প্রথমে বাংলা মদ দিয়ে পরে হুইস্কি! দীর্ঘ সময় ধরে হয় এই প্রক্রিয়াটা। কবরস্থানে পরিবারের লোকজন, বন্ধু-বান্ধব আসে এই অনুষ্ঠান দেখার জন্য। তারপর রাত্রিবেলায় সবাই মিলে ডিনার পার্টিতে যায়। এটাও ওদের ট্রাডিশন।
এ তো একেবারে অন্য একটা কলকাতা বিজয়দা!
হ্যাঁ, অন্য জগৎ একেবারে! ভাটিয়া নিজে খুব ‘মাজং’ খেলত। এখানকার একটি বিশেষ ক্লাবেই হত এই খেলাটা। বিশেষ করে, চিনা নববর্ষের সময় এই খেলার প্রচণ্ড রকম চল। মাজং বোর্ডে সারাক্ষণ ভিড় লেগে থাকত। ‘মাজং’ আসলে চিনদেশের খুব প্রচলিত জুয়া খেলা। আমি নিজেই চিনদেশে দেখেছি, প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায়, বাড়ির বারান্দায় লোকজনরা মিলে মাজং খেলে চলেছে। অনেকটা আমাদের তাস খেলার মতো।
একবার এই ভাটিয়াই জামা খুলেছে, দেখি, ওর ওই চেহারায় বিরাট দাগ! যেন অপারেশনের। আগে দেখিনি। বললাম, ‘ক্যায়া রে, হার্ট কা কুছ প্রবলেম হ্যায়?’ ও বলে, ‘হ্যাট শালা, দোস্ত নে চাকু মার দিয়া।’ বললাম, ‘কিউ?’ বলে, ‘আপস মে লাফড়া হুয়া! হাম ভি চালায়া থা। পুলিশ কেস-ফেস নেহি হুয়া, দোস্ত থা, সব অ্যাডজাস্ট হো গ্যায়া।’ যে কেউ এই কাটা দাগ দেখলে শিউরে ওঠবে! অন্য চাইনিজ বন্ধুরা বারবার বলেছে, ‘বিজয় তুম ও ভাটিয়াকে সাথ মত্ যাও, বহুত ডেঞ্জারাস হ্যায়।’ কিন্তু আমার তো ডেঞ্জারাসের দিকেই বেশি নজর, ওখানেই জীবনের যত রস।
ওদের বাড়িতে গেছিলে, কী খাওয়াদাওয়া হত?
ওদের বাড়িতে যেটা করে, তা হল মিট বল, স্যুপ বল। আর কিছু হয় মাশরুম দিয়ে। সেটা আমরা পাই না। চায়না থেকে আসে। কেউ হয়তো বাইরে গেল, নিয়ে এল। চাইনিজদের সব থেকে পছন্দের খাবার হল শুয়োরের মাংস, বিশেষ করে রোস্ট পর্ক। পুজো থেকে শুরু করে যে কোনও অনুষ্ঠানে এই পদটা থাকবেই। এছাড়া কিছু পার্সোনাল পার্টিতে স্পেশাল কিছু ডিশ হয়। ধরো, স্টিম ভেটকি। বড় এককিলো সাইজের ভেটকি। আসবে একটা পাত্রে, মনে হবে জলের মধ্যে ভেজানো আছে। সঙ্গে কিছু ভেজিটেবলসও থাকে। সাদা রং। দেখলে মনে হবে, কাঁচা। যখন খাবে, বুঝবে অসাধারণ টেস্ট! ব্রয়লার খুবই অপছন্দের, সব দেশি মুরগি। বিফ ততটা নয়।
‘নিউ ইয়ার্স ইভ’ এ-ও তো গিয়েছ প্রায়শই। কী দেখেছ?
হ্যাঁ, সে তো দেখেছি, তবে প্রায় ১০-১২ বছর আগের কথা, নিউ ইয়ার্সের দিন, বন্ধু জো আমাকে বলল, ‘বিজয়, তুমি আলেয়ার অম্বর রেস্টুরেন্টের কাছে থাকবে। তারপর ট্যাংরায় যাব।’ জো এল। টিপটপ ড্রেস পরে। তারপর সেই রেস্তরাঁর ভেতর নিয়ে গেল। গিয়ে একখানা খাম দিল। লাল খাম, চাইনিজ ডিজাইন করা, সম্ভবত চাইনিজে হ্যাপি নিউ ইয়ার লেখা। খুলে দেখি, সেখানে ৫০০ টাকা! বললাম, ‘এটা কী!’ বলল, ‘নাও, আমরা প্রিয়জনদের নতুন বছরে এটা দিয়ে থাকি সাধ্যমতো।’ তারপর ট্যাংরায় গেলাম। মেলা হয় দু’দিন ধরে। প্রচুর চাইনিজ স্টল। লায়ন ড্যান্স, গান বাজনা– সবই জমিয়ে হয়। এ বছর প্রচুর চাইনিজ এসেছে বাইরে থেকে। কোভিডের পর যেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এয়ার টিকিটের দাম বেড়ে গিয়েছিল বলেই আসত না। এখন খানিকটা হলেও কমেছে। ভাবো, চায়না বা সিঙ্গাপুরে যায় না। এখানে আসে, কারণ এই কলকাতা শহরেই একসময় কাটিয়েছিল। এই শহরের ফেলে যাওয়া স্মৃতি তো আছেই, এছাড়া বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়, বাবা-মা– প্রত্যেকের সঙ্গে আবার মিলিত হয় এই চিনা নর্ববষকে কেন্দ্র করে। যে কারণে ওঁরা চাকরির সব ছুটি জমিয়ে রাখেন। এমনও হয়েছে, কোম্পানি ছুটি দিতে রাজি ছিল না দেখে চাকরি ছেড়ে দিয়েও এখানে চলে এসেছে। এ বছর কানাডা, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রচুর প্রবাসী কলকাতার চিনা লোকজন এসেছেন। এই নতুন বছরের সময় কলকাতার চিনাদের বেশিরভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য দিন সাতেকের জন্য ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়। এই সময়টায় একাধিক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে থাকার সুযোগ হয়েছিল। প্রচুর খাওয়া-দাওয়া গল্প-আড্ডা। একটা জিনিসে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম! অনেক বাড়িতেই মোগলাই খানা– বিশেষ করে বিরিয়ানি-চাপের প্রচুর বন্দোবস্ত থাকত। সবাইকেই দেখতাম চেটেপুটে সাফ করে দিত। এছাড়া পরিবারের বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, এবং বাড়িতে আসা আত্মীয়-স্বজনরা মিলে তাস দিয়ে জুয়া খেলার আসর বসানো হয়। এটা চিনা নতুন বছরের একটি রিচুয়াল বলতে পারো।
বিজয়দা, এতক্ষণ যাদের কথাই বললে, প্রত্যেকেই তো ছেলে। তোমার কি কোনও চাইনিজ মেয়ে-বন্ধু নেই?
নিউ মার্কেটে একটা চাইনিজ জুতোর দোকান ছিল। কিন্তু ব্যবসা একেবারেই চলত না। কিন্তু যে বসে দোকানে, সেই ছেলেটার বিয়েও দিতে হবে। আত্মীয়স্বজনরা বলেছিল, ‘এখানকার চাইনিজরা তো জানে তোর কী হাল, তুই চায়নার মেয়ে বিয়ে কর।’ শেষমেশ তাই-ই হয়। চায়নার গন্ডগ্রাম থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয় মেয়েটিকে, বিয়েও হয়। প্রোজেক্ট করা হয়েছিল, পাত্র কলকাতার বিরাট ব্যবসায়ী। বিরাট ঠাঁটবাঁট। মেয়েটির বাড়ি ছিল এমনিই দুঃস্থ, অনেকের পরিবার। ফলে যা হয়। মেয়েটি এখানে এসে দেখে ফুটুর ডুম হাল! এদিকে দুটো বাচ্চাও হয়ে গিয়েছে। মেয়েটি তখন টেরিটি বাজারে সকালবেলায় এসে খাবার বিক্রি শুরু করে দিল। সে বিপুল অ্যাক্টিভ। ওকে কেন্দ্র করে ঠেক বসত একটা। ও দেখত, আমি, জো-র বন্ধু, ছবি তুলছি। চ্যাংড়ামিও করত। আমি হয়তো বসে আছি, একটা স্যুপ বল হঠাৎ দেখি সামনে চলে এল। বলল, ‘ইয়ে তেরে লিয়ে।’ ওর আসল নাম ভুলেই গিয়েছি, তবে লোকে নাম দিয়েছিল: ‘চিলি’– মানে লঙ্কা। একবার দু’জন লোকাল লোক ওর পিছনে লাগতে গিয়েছিল, সে এমন উল্টে ঝাড় দিয়েছিল যে তাদের হালুয়া টাইট! তারপরই ওই নাম। এখনও ও বেকড আইটেম নিয়ে আসে।
টেরিটি বাজারে তো অনেক মহিলাই চাইনিজ খাবার বিক্রি করেন, আর কাউকে মনে পড়ছে?
একজন ছিলেন অত্যন্ত বৃদ্ধা, শীর্ণ চেহারা, নাম লিয়াঙ লিং, ট্যাংরা থেকে আসতেন। ভাবতাম, এই বয়সে কী কষ্টটাই না করছেন! আমার পরিচিত, মিস্টার লি-কে বলেছিলাম, ‘লি, ওঁর কি কেউ নেই? এই বয়সে এরকমভাবে খাটছেন?’ লি বললেন, ‘মিস্টার চৌধুরী, আপনি গিয়ে বলুন না, বুঝবেন! ওঁর ছেলে ইংল্যান্ড থেকে আমাদের হাতে-পায়ে ধরে প্রায়ই মাকে এই বিজনেস বন্ধ করানোর জন্য। ওঁর পরিবার কী করে জানো?’ বললাম, ‘না জানি না, বলো?’ লি বললেন, ‘এক ছেলে ইউকে-তে গ্রিন কার্ড হোল্ডার ডাক্তার, এক ছেলে তাইওয়ানের ইঞ্জিনিয়ার, আর এক মেয়ে তাইওয়ানের কর্পোরেট। ওরা বলে, আমরা টাকা দিচ্ছি, যত লাগবে তত টাকা দিচ্ছি, মা যেন এইসব বিক্রি না করে!’ কিন্তু ভদ্রমহিলা শোনেননি। প্রথমবার ওঁর ছবি তুলতে গিয়েছিলাম যখন রেগে মারতে এসেছিলেন। পরে দারুণ সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল। করোনার সময় নিজে রান্না করে নিজে খাবেন, পারেননি। দুম করে একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যান ওঁর ঘরেই, মারা যান।
এই যে একটা কমিউনিটি বিজয়দা, তোমার কী মনে হয় এটা কতদিন টিকে থাকবে কলকাতায়? অনেকেই বলে, টেরিটি বাজার আগের মতো নেই। ট্যাংরা যদিও ব্যবসা জমিয়েছে, তাও।
দেখো, ট্যাংরা, ১৫-২০ বছর আগের যে আবহাওয়া, এখন তা আর নেই। অনেক পুরনো মানুষ মারা গিয়েছেন। গলিঘুঁজিতে হাঁটতে হাঁটতে দেখতাম টুনিলাইট, শুনতে পেতাম চাইনিজ গান ভেসে আসছে। হঠাৎই মনে হত, চায়নাতেই হেঁটে বেড়াচ্ছি। এই ব্যাপারটা এখন কমে এসেছে। তবে থাকবে, বদলে বদলে গিয়ে কোথাও একটা থেকে যাবে।
তুমি চাইনিজ জানো? কলকাতার চিনেরা বাংলা জানেন কেউ কেউ?
না, আমি চাইনিজ জানি না। এখন আর সেই স্কুলিংয়ে যেতেও পারব না। তবে এখন কলকাতারই অনেক চিনা চাইনিজ জানে না। তবে, দু’-তিনজন পেয়েছিলাম, যারা চমৎকার বাংলা জানে। জানে মানে, একেবারে তাক লাগিয়ে দেওয়া বাংলা!
যেমন, খানিক বলো!
কাফো বলে একজন ছিলেন। আসানসোলের দাঁতের ডাক্তার। এক চায়ের দোকানে বসে এমন বাংলা বলেছিলেন, আমি হাঁ! কাফো বলেছিলেন, ‘আরে, আমি কী বাংলা জানি, আমার ভাইপোর বাংলা শুনলে আপনি চমকে যাবেন। মুখটা দেখে বুঝবেন, চিনা মাল আছে। ও তো আবার শালা বাঙালি মেয়েকে প্রেম করে বিয়ে করেছে!’
বলো কী! চাইনিজ ছেলে প্রেম করে বাঙালি মেয়েকে বিয়ে! ঝামেলা হয়নি?
আমারও একই প্রশ্ন ছিল। কাফো বললেন, ‘‘ভাইপোও ডাক্তার, চাকদার দিকে চেম্বার। ওই লোকালিটিরই একজন মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয়। বিয়ের দিকে যাচ্ছে ব্যাপারটা, তখন একদিন হঠাৎই মেয়ের বাড়ির লোকজন এসে বিরাট উৎপাত করে! বলে, ‘শালা কুত্তা খায়, ব্যাঙ খায়, আরশোলা খায়– এর সঙ্গে আমাদের মেয়ের বিয়ে!’ ভাইপো খানিক দমে গেল। ওকে বোঝানোও হল যে, এরকম করলে বাঙালি মহল্লায় থাকা যাবে না। পাড়ার লোকও ওদের দলে। ভাইপো আর এগোল না। কিন্তু কী হল জানেন বিজয়?’ বললাম, ‘কী?’ ‘একদিন সেই মেয়েটিই ছেলের বাড়িতে এসে হাজির। বলে, ও আর বাড়ি যাবে না। ভাইপো তখনও রাজি না। এদিকে লোকাল ক্লাবে খবর গেল। ওরা বলল, ‘মেয়ে চলে এসেছে ছেলের বাড়িতে– এ বিয়ে তো তাহলে হবেই! পুরো পাল্টি! অবশেষে ওদের বিয়ে হল। এমনকী, মেয়ের বাড়ির লোকজন পরে বলেছে, ব্রয়লার খেতে খেতে গলায় চড়া পড়ে গেল, একটু পর্ক-ফর্ক হলে বলো, আসব!’
দুর্দান্ত বিজয়দা, এ তো সিনেমার গপ্প! অনেক আড্ডা হল, রেকর্ডার বন্ধ করার আগে শেষ প্রশ্নটা করি– ‘কলকাতা’ তোমার কাছে কী?
মানুষ, মানুষ আর মানুষ। কলকাতায় এখনও পকেটমার আছে, চোর-চিটিংবাজ-দালাল-সিন্ডিকেট– সব আছে, তবু এই কলকাতার মধ্যে এখনও কিছু আশ্চর্য মানুষ রয়েছে। এই কলকাতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে তারাই। এই কলকাতাতেই, জানো সম্বিত, একজন সেতার সারান। দোকানে বসেন। আড্ডা মারেন না, এদিক-সেদিক যান না। শুধুই তাঁর দোকানে বসেন আর সেতার সারান। ওঁর বাবা, মাথায় ঝাঁকা তুলে সেতার-সরোদ বিক্রি করতেন এককালে, রাস্তায় ঘুরে ঘুরে। তিনিই ওঁকে বলেছিলেন, ‘সেতারটা শিখে নে, নইলে ঠিকমতো সারালি কি না, বুঝবি কী করে?’ আমি শুনেছি সেই উন্মাদের মতো, সেতারে ডুবে থাকা ওঁর বাজানো। একদিন ওঁর সেতার বাজানো রেকর্ড করে বাড়িতে চালিয়েছিলাম, আমার স্ত্রী বলল, ‘রবিশঙ্কর?’ এতটাই ভালো! এই কলকাতায় হাওড়া ব্রিজ, মনুমেন্ট, ভিক্টোরিয়া, মিউজিয়াম– এই সমস্ত কিছুই থাকতে পারে, কিন্তু এই সমস্ত কিছু পেরিয়ে এইসব মানুষই কলকাতার ফাউন্ডেশন। যাকে দেখার জন্য তুমি বারেবারে আসবে। আসতেই থাকবে।
(সমাপ্ত)
পড়ুন এই আড্ডার প্রথম পর্ব: চিনাপাড়ার প্রতিটা মানুষের মধ্যে একটা ইতিহাস-মেশানো গল্প আছে, যা আমি পড়তে চেয়েছিলাম