কৈশোর থেকেই কিশোরকুমারের অন্ধ ভক্ত। আজীবন তাঁকেই ‘গুরু’ মেনেছেন। কিশোরকুমারের সঙ্গে দেখা করতে বারবার ছুটে গিয়েছেন বোম্বেতে। মৃত্যুর পর তাঁর জুতোজোড়া প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের ঠাকুরঘরে। সা-রে-গা-মা শেখেননি, তবু একসময় তাঁর ডেট না পেলে পিছিয়ে দেওয়া হত শোয়ের তারিখ। কারণ তিনি মাইক ধরলেই, মনে হত, কিশোরকুমার স্বয়ং গান গাইছেন। বাংলায়, বিশেষত মফস্সলে একসময় ছিল এই ‘কণ্ঠী’-শিল্পীদের রাজত্ব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছেন তাঁরা। বিশ্ব সংগীত দিবসে রোববার.ইন খোঁজ নিল তেমনই এক শিল্পীর। তিনি ‘কিশোর-কণ্ঠী’ গৌতম ঘোষ।
প্রচ্ছদের আলোকচিত্র: কৌশিক দত্ত
ঘণ্টায় ক’টা সিগারেট খান, গৌতমবাবু?
এই রে! এ তো ভয়ানক প্রশ্ন! সত্যি বলতে কী, গুনে দেখিনি। (হাসি) আসলে খুব মাপজোক করে চলা আমার জীবনধর্ম নয়। যখন মন চায় খাই, আবার হয়তো টানা দু’ ঘণ্টা একটাও খেলাম না।
গত আধ ঘণ্টায় আপনি চারটে বড় সিগারেট খেয়েছেন। আপনার ‘গুরু’ কিন্তু সিগারেট খাওয়া একদম পছন্দ করতেন না!
আমার সামনে কিন্তু কোনও দিনও একথা বলেননি যে, ‘পছন্দ করি না’। (হাসি) তবে হ্যাঁ, নিজে খেতেন না। আর সেভাবে দেখলে, অনেকেই ‘স্মোকিং’ ব্যাপারটা পছন্দ করেন না। খুব একটা ভালো জিনিস তো নয়। তবে কিশোরকুমার কিন্তু ‘সিগারেট’ নিয়ে গান গেয়েছেন! তার একটা গল্পও আছে…
কীরকম?
এ ঘটনাটা আমার নিজের চোখে দেখা নয়। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, গান লিখতেন– তাঁর মুখে শোনা। কিশোরকুমারের জীবনের শেষ তিন বছর পুজোর অ্যালবামের গান শিবদাসদাই লিখতেন। শিবদাসদা ওঁর সামনে সিগারেট খেতেন না। উনি যখন গান লিখতেন, অনেক সময় কিশোরকুমার বসে থাকতেন সামনে। ফলে সিগারেট খাওয়ার হলে, উনি, ‘কিশোরবাবু, এক মিনিট বসুন, আমি আসছি’– বলে বেরিয়ে গিয়ে একটা সিগারেট খেয়ে আসতেন। এটা কিশোরকুমার খেয়াল করেছিলেন। কিশোরকুমার একবার ওঁকে একটা সোনালি রঙের ছাইদান উপহারও দিয়েছিলেন।
তা একবার এরকম গান লেখার সময়, কিশোরকুমারও আছেন, কথায় কথায় ওঁকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আচ্ছা শিবদাসবাবু, এই পৃথিবীতে আপনি সবচেয়ে বেশি কাকে ভালোবাসেন?’
–‘আমার পরিবার। আমার স্ত্রী-সন্তান।’
–‘অসম্ভব! হতেই পারে না।’
শিবদাসদা অবাক হয়ে বলছেন, ‘কেন?’
–‘আপনি আমার বাড়িতে কতদিন আছেন?’
–‘দিন ১৫ হবে।’
কিশোরকুমার বলছেন, ‘আপনি ১৫ দিন আপনার স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে থাকতে পেরেছেন। কিন্তু আপনি ১৫ মিনিট সিগারেট না খেয়ে থাকতে পারেন না। তার মানে সিগারেট হচ্ছে আপনার জীবনের সবচেয়ে প্রিয়! আচ্ছা, আমাকে বলুন তো সিগারেট খেলে কী উপকার হয়?’
শিবদাসদা তো প্রশ্ন শুনে আমতা আমতা করছেন। তখন বলছেন, ‘মুখে না বলতে পারেন একটা গান লিখে ফেলুন দেখি, সিগারেটের উপকারিতা নিয়ে!’
সেই লেখা হল গান। কিশোরকুমার গাইলেন, শিবদাসদার লেখা গান–
সিগারেট নহ তুমি শ্বেত-পরি
গোল গোল সাদা আহা মরি মরি
ভাবনার প্রতি পলে তুমি সাথী
দু’টি ঠোঁটের মাঝে আমি জড়িয়ে ধরি
চমৎকার! এসে থেকে যে-সমস্ত টুকরো টুকরো গল্প শুনছি, তাতে মনে হচ্ছে আপনি কেবল ‘কিশোরকণ্ঠী’ নন, আস্ত একটা কিশোর-অভিধানও বটে। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে কিশোরকুমারের গান গাইছেন…
১৯৭২-এ প্রথম গান গাওয়া। তখন আমি বিনা পয়সায় অনুষ্ঠান করতাম। ‘প্রফেশনাল’ যদি বলো, সেটা ’৭৪ সাল থেকে। কিশোরকুমারের গানও ওই তখন থেকেই…
গানবাজনা শুরুর প্রেক্ষাপটটা কেমন ছিল?
পিছনের কথা কেউ তো জানতে চায় না। টালিগঞ্জে আমাদের বাড়ির ওখানে একটা ক্লাব ছিল। ‘রং বদল’। আমি নিজেও সেই ক্লাবের সদস্য ছিলাম। এখনও সেই ক্লাবের সঙ্গেই আছি। যখনকার কথা বলছি, তখন আমাদের কত বয়স– সবে স্কুল পার করেছি হয়তো। তো খেয়াল চাপল, পুজোর সময় ক্লাবের জলসা করা হবে। তখন তো এইসবের খুব চল ছিল। সারা রাত্তির ধরে সংগীতের অনুষ্ঠান, জলসা হত। রাতারাতি উদ্যোক্তা হয়ে গেলাম। মানে, বন্ধুবান্ধবরা সব মিলে। কিন্তু জলসা করার অত টাকাপয়সা তো নেই। শেষে এর-ওর-তার বাড়ি থেকে দু’ টাকা, পাঁচ টাকা চাঁদা নিয়ে স্থানীয় শিল্পীদের ডেকে করা হল অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠান চলাকালীন, কী হয়েছে, আগের শিল্পীর গান শেষ, কিন্তু পরের শিল্পী তখনও এসে পৌঁছয়নি। কী হবে! তো সকলে আমাকে ধরল, ‘তুই তো ক্লাবে গান গাস, তুই কয়েকটা গান গেয়ে স্টেজটা ধরে রাখ!’ প্রথমে আমি রাজি হইনি, শেষে ক্লাবের সম্মানের কথা ভেবে উঠে পড়েছিলাম। হারমোনিয়াম আমি জীবনে ছুঁইনি। কিন্তু সেদিন হারমোনিয়ামের ওপর লোক-দেখানো আঙুল চালিয়েছিলাম (হাসি)। খান দুয়েক গান গেয়েছিলাম, তার মধ্যে পরের শিল্পী এসে গেল। ব্যস! সেই আমার প্রথম জনসমক্ষে গান গাওয়া।
সেই অনুষ্ঠানেও কি কিশোরকুমারের গানই গেয়েছিলেন?
না, সেটা কিন্তু মান্না দে-র গান গেয়েছিলাম। তো যাই হোক, গান গেয়ে নামার পর লোকজন খুব প্রশংসা করেছিল। অনেকেই বলেছিল, ‘তোর গানের গলা এত ভালো– অনুষ্ঠানে গান গাস না কেন!’ যদিও তখনও গান গাইব, শো করব– এ-ব্যাপারটাকে ‘সিরিয়াসলি’ দেখিনি।
আপনার বাড়িতে কি গানের পরিবেশ ছিল?
আমার মা খুব ভালো গান গাইতেন। মা সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ছাত্রী ছিলেন। তখনকার দিনের মহিলা তো– বাড়ির মেয়েরা গানবাজনা করবে, ওটুকুই, এদিক-সেদিক গাইতে যাওয়া কল্পনার বাইরে ছিল। তারপর বিয়ে হয়ে গেল। ব্যস! মায়ের গানবাজনাও বন্ধ হয়ে গেল। আমি কিন্তু মা-কেই প্রথম জানিয়েছিলাম যে, শিল্পী হতে চাই। আমি তো কখনও গান শিখিনি। সা-রে-গা-মা জানি না। ‘তাল’ বললে গাছের তাল বুঝি; ‘স্কেল’ বললে মাপার স্কেল। আমার যেটা ছিল সেটা হল গান শোনার কান, আর গান বোঝার মতো হৃদয়। ব্যস!
কখনও গান শেখার ইচ্ছে হয়নি?
শিখব কীভাবে! আর্থিক অবস্থা তো তখন খুব একটা ভালো ছিল না। পাঁচ বোন, আর আমি এক ভাই। বাবা কলকাতা কর্পোরেশনে চাকরি করতেন। ’৭২ সালেই বাবা রিটায়ার করলেন। সেই অভাব-অনটনের মধ্যে তখন আমি প্রাণপণে সংসার টানছি। ভোর চারটের সময় উঠে চলে যেতাম রানিকুঠির পেপার সেন্টারে। সেখান থেকে কাগজ নিয়ে লোকের বাড়ি-বাড়ি দিতাম। একটু বেলার দিকে ফুটপাথে বসতাম কাগজ নিয়ে, পাশাপাশি ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’, ‘দেশ’ বিক্রি করতাম। তখন সবে টালিগঞ্জ আইটিআই-তে সিভিল ড্রাফটস্ম্যানশিপ পড়তে ঢুকেছি। বিকেলে ফিরে ক্লাস টু-থ্রি-র দু’-তিনটে বাচ্চাকে পড়াতাম। দিদি খবরের কাগজের ঠোঙা বানাত; আমি পড়িয়ে উঠে সেই ঠোঙা দোকানে দোকানে বিক্রি করতাম। কিছুদিন একটা মোমবাতি তৈরির কারখানায় রাতে চার ঘণ্টা করে কাজ করেছি। সেখানে ১০০ মোম তৈরি করলে এক টাকা দিত। ফলে দু’বেলা ঠিকমতো খাবার জুটত না যেখানে, সেখানে গান কীভাবে শিখব!
সেই পরিস্থিতিতে ‘গান গাওয়া’-কে পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো এত বড় ‘রিস্ক’ নিলেন কীভাবে?
প্রথমে তো শুধুই গান গাইতাম। পেশা করার কথা ভাবিনি। তবে লোকের প্রশংসা, হাততালি নিয়মিত শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া যায়। তখন আমাদের পাড়ায় এক ভদ্রলোক ছিলেন, অ্যাকোর্ডিয়ান বাজাতেন। তাঁকে ধরলাম, যদি আমার সঙ্গে অনুষ্ঠানে খানিক বাজান। এরকমভাবে আরও কিছু লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগও হয়ে গেল। তবে এখন মনে হয়, ‘রিস্ক’ নিয়ে ভুল কিছু করিনি।
কিশোরকুমারের গানই গাইবেন এটা কবে থেকে ঠিক করলেন? এবং কেন করলেন?
ছোটবেলায় বিভিন্ন শিল্পীর গান শুনতাম। সব শিল্পীকেই ভালো লাগত। কিন্তু কিশোরকুমারের গান আমাকে স্পর্শ করত। মনে হত, বুকে কীরকম একটা খোঁচা মারছে। সেই আবেগটা নিজে গাইতে গেলেও তৈরি হত। একটা সময় তো আমি সকলের গানই স্টেজে গাইতাম। তো দেখলাম, যখন আমি কিশোরকুমারের গান গাইছি সেটা সকলকে আরও বেশি ছুঁয়ে যাচ্ছে। অনেকেই তখন আমাকে বলত, ‘তুই সবার গান গাস না, শুধু কিশোরকুমারের গান গা। তোর গলায় কিশোরকুমারের গানটাই ভালো লাগে’। এটা এমন একটা সময়– যখন আমি মনে মনে এই বিশেষ পক্ষপাতটা উপলব্ধি করতে পারছি; আবার শ্রোতারাও আমার থেকে সেটাই চাইছে। তারপর থেকেই আমি কিশোরকুমারকে ধরে নিলাম।
…………………………………………………………………………
ওঁর মৃত্যুর মাস দুয়েক পরে অমিতদা একদিন বাড়িতে ডাকলেন। সেইবার গিয়ে আমিই ওঁকে বলেছিলাম, কিশোরকুমারের স্মৃতি হিসেবে কিছু একটা নিয়ে যেতে চাই। উনি আমায় একটা পেন দিতে চেয়েছিলেন। কাঠের একখানা পেন কিশোরকুমার ব্যবহার করতেন– কলমখানার গায়ে আমেরিকান ডায়মন্ডে ওঁর নাম খোদাই করা ছিল। কিন্তু আমি সেটা নিতে চাইনি। আমি বলেছিলাম, কিশোরকুমার তো আমার ‘ভগবান’, রাখলে ওঁর পায়ের জিনিসই রাখব। আমার কাছে ওঁর ব্যবহৃত এক জোড়া জুতো রাখতে দিন।
…………………………………………………………………………
এই যে বললেন, বিভিন্ন শিল্পীর গান শুনতেন– এই গান শোনাটা ঠিক কীভাবে হত?
তখন পরিবেশটা তো অন্যরকম ছিল। পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠান হত, জলসা হত। এবং সেটা লেগেই থাকত। তখন কিন্তু পাড়ায় একটা গানের অনুষ্ঠান হলে, যে শিল্পীই গান-না-কেন, মানুষ শুনতে যেতেন। দ্বিতীয়ত রেডিওতে গান শোনা। তখন তো টেপ-রেকর্ডারের এত রমরমা ছিল না, গ্রামোফোন ছিল। যদিও আমাদের বাড়িতে সেসব ছিল না। তখন খেতেই পাই না তো গ্রামোফোন! কিন্তু গান শোনাটা হয়েই যেত। কারও দোকানে হয়তো রেডিও বাজছে, বা রাস্তায় মাইকে গান চলছে– এভাবে গান শোনা হত। সেখানে যেমন শোনার কোনও ‘চয়েস’ থাকত না, তেমন গান শোনার মধ্যে একটা বৈচিত্রও এসেছিল। ভগবান আমায় একটা বড় ক্ষমতা দিয়েছেন– আমি খুব তাড়াতাড়ি গান তুলতে পারি। একবার একটা গান শুনলে সুরটা আমার মাথার মধ্যে রয়ে যায়। যে গানগুলো একবারে তুলতে পারতাম না, সেগুলো শুনতে সিনেমাহলে চলে যেতাম। কেবল একটা গান তোলার জন্য একই সিনেমা আমি ৮-১০ বার দেখেছি– এরকমও হয়েছে। ছবিটা দেখিওনি, গানটা হয়ে গেলেই হল থেকে বেরিয়ে এসেছি। গানের সুরটা তোলা হয়ে গেলে, গানের কথার জন্য চলে যেতাম হাজরা মোড়ে। ওখানে, ফুটপাথে– কিশোরকুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মহম্মদ রফি, মান্না দে এঁদের বিভিন্ন গানের কথা লেখা বই বিক্রি হত। খুব সস্তার কাগজে ছাপা, পাতলা চটি বই। খুব কম দামে সেইগুলো কিনে আনতাম।
কিশোরকুমারের গান গাওয়ার আগে থেকেই তো আপনি ওঁর ‘ভক্ত’ বা ‘ফ্যান’ যাকে বলে…
কিশোরকুমারের ‘ভক্ত’ নয়, কিশোরকুমার আমার ‘ভগবান’! কিশোরকুমারের ভক্ত তো সারা দেশে, সারা পৃথিবীতে আছে। হাজার-হাজার লাখ-লাখ মানুষ ওঁর ভক্ত। আমার মতো, ওঁর গান গান, এমন মানুষও নিশ্চয়ই অনেক আছে। কিন্তু আমি বলব, কিশোরকুমার আমার ‘অন্নদাতা’। আজ যে-ক’জন মানুষ আমাকে চেনেন, ওঁর গানের জন্যই তো চেনেন। ওঁর গান গেয়েই তো আমার, আমার পরিবারের পেট চলেছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। তাই তিনি আমার ‘অন্নদাতা’। আমার জীবনে, আমার মা-বাবার পরে যদি কারও স্থান থেকে থাকে, তিনি অবশ্যই কিশোরকুমার।
ওঁর গান গাইতে গিয়ে, আরও স্পষ্ট করে বললে ‘কিশোরকণ্ঠী’ হয়ে উঠতে গিয়ে, ঠিক কোন কোন টেকনিক্যাল বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হয়েছিল?
এখানে ‘কণ্ঠী’ শব্দটায় আমার আপত্তি রয়েছে। মানুষ আমায় ‘কিশোরকণ্ঠী’ বলেন। কিন্তু ‘কণ্ঠ’ তো কখনও অনুকরণ করা যায় না। কণ্ঠ, গলার টোন ঈশ্বর একেকজনকে একেকরকম দেন। সাদৃশ্য থাকতেই পারে অবশ্য। আমি কিন্তু কিশোরকুমারের গলা নকল করার চেষ্টা করিনি কখনও। আমি তাঁর গান গাওয়াটাকে খুব মন দিয়ে পড়তাম। ওঁর ইমোশনগুলো রিড করার চেষ্টা করতাম। আরও পরে, যখন কিশোরকুমারের সঙ্গে আলাপ হল, উনি আমায় বলেছিলেন ‘অনুকরণ’ না করে ‘অনুসরণ’ করতে। তখন ওঁর স্টাইল অফ ডেলিভারি, উচ্চারণ, গানের ভেতরের যে অভিনয়টা– সেগুলো ফলো করার চেষ্টা করতাম। গান শুনে শুনে অ্যানালাইজ করতাম– একটা এক্সপ্রেশনের নেপথ্যে ওঁর যে মনটা, সেটাকে বোঝার চেষ্টা করতাম। বোম্বে গিয়ে আমি এই নকল না-করার শিক্ষাটাই পেয়েছি।
কিন্তু বোম্বে যাওয়ার আগেই তো আপনি ‘কিশোরকণ্ঠী’ হিসেবে বাংলায় বিখ্যাত হয়ে গেছেন?
হ্যাঁ, ’৮৪-তে বোম্বে যাওয়া। কলকাতায় তখন কিন্তু আমার বেশ নামডাক। এক নাইটে সাতটা-আটটা শো-ও করেছি। সারা পশ্চিমবঙ্গে শো করে বেরিয়েছি। একটা সময় ছিল, পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও কলেজ ছিল না– যে কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানের তারিখ আমার জন্য চেঞ্জ হয়নি। এক মাসের জায়গায় দু’ মাস কলেজ সোশ্যাল পিছিয়ে গেছে, কারণ– গৌতম ঘোষের ডেট পাওয়া যায়নি। কিন্তু কী জানো, মনে হত– হচ্ছে না। লোকে হাততালি দিচ্ছে, অনুষ্ঠানের অর্গানাইজাররা বাড়িতে এসে পড়ে আছে। কিন্তু কোথাও যেন একটা খামতি থেকে যাচ্ছে। মনে হত, আমাকে আরও জানতে হবে, শিখতে হবে। কিন্তু শিখব কীভাবে? আলাদা করে ‘কিশোরকুমারের গান’ কেউ শেখায় নাকি! তখন মনে হল, কিশোরকুমারকে সামনে থেকে দেখতে হবে– কীভাবে মাইক্রোফোন ব্যবহার করছেন, কীভাবে একটা নতুন গানকে ট্রিট করছেন, কীভাবে গানের মধ্যেকার অভিনয়টা ফুটিয়ে তুলছেন, এমনকী ওঁর হাঁটাচলা পর্যন্ত– ওঁর পাবলিক শো, ওঁর রেকর্ডিং সামনে থেকে না দেখলে এগুলো শিখতে পারব না। সেই চলে গেলাম বোম্বে। নিজের কেরিয়ার গড়ার জন্য আমি বোম্বেতে যাইনি। ওঁর জন্য গিয়েছিলাম, সেইজন্যই ওঁর মৃত্যুর পরে আর থাকিনি।
বোম্বের যোগাযোগটা কীভাবে হয়েছিল?
গিয়েছিলাম নিজে নিজেই, আগুপিছু না ভেবে। বোম্বেতে আমার পরিচিত দু’-একজন বাঙালি মিউজিশিয়ান ছিলেন। বাপি লাহিড়ীর গ্রুপে তাঁরা কাজ করতেন। তাঁরা তখন আমাকে খুব সাহায্য করেছিলেন। তখন বোম্বেতে যে-যে স্টুডিওতে কিশোরকুমারের রেকর্ডিং থাকত, আমি সেখানে পৌঁছে যেতাম। প্রথম প্রথম আমায় ভেতরে ঢুকতে দিত না। বাইরে থেকে দেখতাম, শুনতাম। বোম্বের ভি.টি স্টেশনের ফুটপাথে একরকম চটি বই পাওয়া যেত। কোন মাসে কোন স্টুডিওয় কোন ছবির কোন গানের রেকর্ডিং হবে, কোন আর্টিস্ট গাইবে– এইসব লেখা থাকত। ওখান থেকে আগেই দেখে নিতাম কোথায়, কবে কিশোরকুমারের গান আছে। ‘ফেমাস’, ‘বোম্বে ল্যাব’, ‘মেহবুব’ স্টুডিওয় প্রায়ই ওঁর রেকর্ডিং থাকত।
বাপি লাহিড়ীর সুবাদেই আমার প্রথম মেহবুব স্টুডিওর ভেতরে ঢোকা; রেকর্ডিস্ট অভিনন্দন ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ। সেটা সম্ভবত ’৮৫ সাল। অভিদাকেই বলেছিলাম কিশোরকুমারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়ার কথা। বললেন, ‘চল, আলাপ করিয়ে দিচ্ছি। ভালো মানুষ।’ অভিদা গিয়ে ওঁকে আমার সম্পর্কে বলেছিলেন।
উনি সব শুনে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকালেন, তারপর একখানা গান শোনাতে বললেন। ভাবো একবার! আমার ঈশ্বর আমার সামনে বসে আমার গান শুনতে চাইছে! আমার তো হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। তবু ভয়ে ভয়ে চার লাইন গাইলাম। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, ‘গানটা তুমি খুব একটা খারাপ গাও তা নয়; কিন্তু খুব একটা ভালোও গাও না। এখনও অনেক জানতে হবে, অনেক শিখতে হবে।’ পরে আরও অনেকবার সাক্ষাৎ হয়েছে, অনেক খুঁটিনাটি কথা বলতেন গান নিয়ে। তবে সেদিনের প্রতিটা মুহূর্ত আমার স্মরণে আছে। বলেছিলেন, ‘তুমি আমার গান গাও– তাতে কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু আমার গানটা আমার মতো করে গাওয়ার চেষ্টা কোরো না। তাহলে জীবনে কিছু করতে পারবে না। হয়তো সাময়িক খ্যাতি পাবে। কিন্তু তোমার নিজস্ব সংগীত-জীবনটার ক্ষতিই হবে তাতে।’
আপনি তো ওঁর বাড়িতেও গিয়েছেন বেশ ক’বার?
প্রথম দিনের আলাপের পর, আমাকে একদিন ডেকে বললেন, ‘বাড়িতে এসো একদিন, একসঙ্গে চা খাব’। আমার বেশ একটু ভয় হচ্ছিল, কিশোরকুমারের বাড়িতে একা যাব– যদি ঢুকতে না দেয়, চিনতে না পারে! বাপিদাকে বললাম বিষয়টা। তখন বাপিদার সেক্রেটারি ছিলেন ভরতজি। বাপিদা ভরতজিকে বলেছিলেন আমায় সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। কিছুক্ষণ চা-টা খাওয়া, গল্প-টল্প হয়েছিল। আমার গান নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছিলেন।
ওঁর মৃত্যুর সময় অমিতদা কানাডায় ছিলেন। খবর পেয়ে বোম্বে এলেন দেড় দিন পরে। ওঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আর কে স্টুডিও, চেম্বুরে। সেখান থেকে খান্ডোয়ায়, ওঁর নিজের বাড়িতে। ওঁর ইচ্ছে ছিল সেখানেই ওঁকে দাহ করা হবে। খান্ডোয়াকে উনি ভীষণ ভালোবাসতেন। নিজেকে বলতেন ‘কিশোরকুমার খান্ডেওয়ালা’। আমি এখনও বছরে একবার করে ওঁর খান্ডোয়ার বাড়িতে যাই।
যাই হোক, ওঁর মৃত্যুর মাস দুয়েক পরে অমিতদা একদিন বাড়িতে ডাকলেন। সেইবার গিয়ে আমিই ওঁকে বলেছিলাম, কিশোরকুমারের স্মৃতি হিসেবে কিছু একটা নিয়ে যেতে চাই। উনি আমায় একটা পেন দিতে চেয়েছিলেন। কাঠের একখানা পেন কিশোরকুমার ব্যবহার করতেন– কলমখানার গায়ে আমেরিকান ডায়মন্ডে ওঁর নাম খোদাই করা ছিল। কিন্তু আমি সেটা নিতে চাইনি। আমি বলেছিলাম, কিশোরকুমার তো আমার ‘ভগবান’, রাখলে ওঁর পায়ের জিনিসই রাখব। আমার কাছে ওঁর ব্যবহৃত একজোড়া জুতো রাখতে দিন। অমিতদা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন এই কথাটা শুনে। জুতোজোড়া আজও আমার ঠাকুরঘরে রাখা আছে।
‘কিশোর কুমার জুনিয়র’-এর রজত ঘোষের সঙ্গে বাস্তবের গৌতম ঘোষের কতটা মিল?
পর্দার রজত ঘোষের সঙ্গে বাস্তবের গৌতম ঘোষের একটাই মিল; সেটা হল ড্রিঙ্ক করা। (হাসি) একসময় আমি যা ড্রিঙ্ক করেছি ভাবতে পারবে না। এই যে ছবিতে দেখায়, রজত ঘোষ আকণ্ঠ মদ্যপান করে মঞ্চে উঠছে– এটা কিন্তু বাস্তব। কৌশিক আমায় এই অবস্থায় সত্যিই দেখেছে। কিন্তু মজা হল, অনেকেই ভাবে এই ছবিটা আমার বায়োপিক। সেটা একেবারেই নয়। আসলে কৌশিক ছোটবেলা থেকে আমায় দেখছে। ওদের বাড়িতে আমি একসময় প্রচুর যেতাম। ওর বাবা সুনীল গাঙ্গুলি ছিলেন বিখ্যাত গিটারিস্ট। তখন তো বটুক নন্দী আর সুনীল গাঙ্গুলি এই দু’জনই ছিলেন।
পরবর্তীকালে বড় হয়েও আমাকে এ পাড়ায় দেখেছে– আড্ডা মারতে, গান গাইতে। কোনওভাবে আমার এই ‘কণ্ঠী’ সত্তাটা ওকে ইন্সপায়ার করেছিল হয়তো। কিন্তু ছবির গল্পের সঙ্গে আমার জীবনের কোনও মিল নেই। তাছাড়া আমার মনে হয়েছে ‘কণ্ঠী’ শিল্পীদের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক স্ট্রাগলের জায়গাটা যতটা তুলে ধরা যেত– সিনেমায় ততটা দেখানো হয়নি। সেটা হলে, সিনেমাটা আরও ভালো হতে পারত।
বোম্বে প্রসঙ্গে ফিরি। ১৯৮৪-’৮৭। এই সময়টায় বোম্বেতে কিশোরকুমারের প্রায় সমস্ত বড় শো আর রেকর্ডিং আপনি সামনে থেকে দেখেছেন?
শো-এর থেকেও আমি রেকর্ডিংটাই বেশি দেখতে চাইতাম। শো দেখা মানে আসলে ‘পারফর্মার’ কিশোরকুমারকে দেখা, আসল মানুষটাকে রেকর্ডিং-এ বেশি পাওয়া যেত। ওঁর বেশ কিছু হিট গানের রেকর্ডিং আমি সামনে থেকে দেখেছি। ওঁর জীবনের শেষ গানটা পর্যন্ত। ’৮৭ সালের ১২ অক্টোবর। ‘ওয়াক্ত কি আওয়াজ’– মিঠুন চক্রবর্তী আর শ্রীদেবীর ছবি। সেই ছবিটার জন্য, বাপি লাহিড়ীর সুরে, আনজানজির লেখা একটা গান। মেহবুব স্টুডিওতে, উনি আর আশা ভোঁসলে ডুয়েট গাইলেন। ওটাই ওঁর জীবনের শেষ গান। ১৩ তারিখ বিকেলে খবর এল উনি আর নেই!
আচ্ছা, বোম্বে-ফেরত গৌতম ঘোষ কি ‘কণ্ঠী’-তকমা মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন?
না। আমি মুছতে পারতামও না। কিন্তু বোম্বে-ফেরত গৌতম ঘোষের গানের দর্শন আমূল বদলে গিয়েছিল। কিশোরকুমারই বদলে দিয়েছিলেন। এখানে একটা কথা বলি। কিশোরকুমারের জীবনের প্রথম প্লে-ব্যাক ১৯৪৮ সালে, ‘জিদ্দি’ ছবিতে। উনি তখন কে.এল সায়গলের অন্ধ ভক্ত। প্রথম প্লে-ব্যাকে কিশোরকুমার কিন্তু অনেকটা ‘সায়গল-কণ্ঠী’। ‘মরনে কি দুয়ায়েঁ কিউ মাগুঁ’– তুমি শুনে দেখো গানটা, বুঝতে পারবে। আসলে প্রত্যেক শিল্পীরই কোনও-না-কোনও ‘ইনস্পিরেশন’ থাকে।
কিশোরকুমার গানের ক্ষেত্রটা এত ‘ভার্সাটাইল’– একটা লোক, যে ‘আ চলকে তুঝে’ গাইছে, আবার ‘কোই হামদম না রহা’ গাইছে, আবার ‘মনা জনাব নে পুকারা নেহি’ গাইছে, আবার সেই লোকটাই গাইছে ‘আরে ভাই নিকল কে আ ঘরসে’! এই নাটক, এই বৈচিত্রটা আমায় খুব আকর্ষণ করত। এটা বোধহয়, ওঁর পরে, সবচেয়ে ভালো গানের মধ্যে আনতে পেরেছেন অমিতকুমার। সারা জীবন চেষ্টা করেও আমি এই বৈচিত্রটা আয়ত্ত করতে পারিনি।
লতাজির সঙ্গে ডুয়েট গাওয়ার ঘটনাটা কি বোম্বে যাওয়ার আগে?
হ্যাঁ। ১৯৮৩ সাল, ২৭ নভেম্বর। দুর্গাপুর স্টিল গ্রাউন্ডে হয়েছিল অনুষ্ঠানটা। লতাজির সংগীত-জীবনের প্রথম ওপেন-স্টেজ শো। ‘লতা মঙ্গেশকর নাইট’। অরগানাইজার ছিলেন বিশু চক্রবর্তী। আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। উনিই আমাকে লতাজির সঙ্গে এক মঞ্চে গান গাইতে সুযোগ দিয়েছিলেন।
কোন গানটা গেয়েছিলেন?
‘গাতা রহে মেরা দিল’। শুনেছি, উনি আমার প্রশংসাও করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে ৩০ হাজার মানুষের সামনে যে ওঁর সঙ্গে গেয়েছিলাম– সেটা আমার পরিচিতি অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনাটা আমার সংগীত-জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট বলা যায়।
…………………………………………………………………………
মৌলিক শিল্পীদের তুলনায় ‘কণ্ঠী’ শিল্পীদের একটু খাটো করে দেখা হয়। এমনকী মৌলিক শিল্পীরাও ‘কণ্ঠী’দের একটু অন্যরকম চোখে দেখেন। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার, ‘তকমা’র গৌরব যাঁরা সেঁটে দেন, তাঁরাই তকমাপ্রাপ্তদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির শিল্পী’ ভাবেন। অথচ যাঁরা মৌলিক শিল্পী তাঁরা কি শুধুই তাঁদের নিজেদের গানই গান? যেহেতু সারাজীবন একজন শিল্পীর ধার করা গান গেয়ে এসেছি– তাই আমরা ‘কণ্ঠী’, দ্বিতীয় সারির। দশজন আলাদা শিল্পীর দশটা ধার করা গান গাইলে হয়তো ‘অরিজিনাল’ শিল্পী বলা হত।
…………………………………………………………………………
আশ্চর্য যে, ঠিক যখন এই ঘটনাটা আপনার জনপ্রিয়তাকে রাতারাতি বাড়িয়ে দিচ্ছে, তখনই আপনি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বোম্বে যাবার– কারণ আপনার সাংগীতিক ‘দর্শন’ নিয়ে আপনার মধ্যে একটা অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে!
হ্যাঁ। তখনও যে আর্থিক পরিস্থিতি খুব স্বাভাবিক হয়েছে তেমনটা নয়। বোম্বে যাওয়া মানে অনুষ্ঠান বন্ধ, উপার্জনও বন্ধ। তাই অনেকসময় মাঝেমধ্যে হপ্তাখানেকের জন্য কলকাতায় চলে আসতাম। দু’-চারটে শো করে, কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করে আবার ফিরে যেতাম।
বোম্বেতে প্রথম রাতটা কাটিয়েছিলাম আন্ধেরি স্টেশনে। পুলিশের গোঁতা খেতে খেতে, এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে দু’ নম্বরে, বা তিনে– উদ্বাস্তুর মতো। তারপরে মধুদা, মধু সরকার, বাপি লাহিড়ীর দলে ড্রাম বাজাতেন, উনি আমাকে একটা সস্তায় থাকার জায়গা দেখিয়ে দিয়েছিলেন। পশ্চিম গোরেগাঁওতে, এস বি রোডের ওপরে দয়ানন্দ গেস্ট-হাউসের একটা ছোট্ট কামরা– বড়জোর একজন মানুষ শোবার মতো জায়গা। মাসে তিনশো টাকা করে নিত। সেখানে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল রাহুল, পার্থ আর শিশির– এই তিনজন বাঙালি ছেলের। কেমন বন্ধু জানো? রাতে আমি যখন ঘুমোতাম, এরা পালা করে আমার বালিশের তলায় একটা করে দশ টাকার নোট গুঁজে রেখে যেত। যাতে সকালের খাবারটা খেতে পারি।
একটা সময়ে তো অনেকেই বিনোদন জগতে কেরিয়ার গড়তে বোম্বে গিয়ে পড়ে থাকতেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠার চূড়ায় থেকেও আপনার এই ‘স্ট্রাগল’টা খুবই বেদনাদায়ক।
কেরিয়ারের জন্য তো আমি বোম্বে যাইনি। এত স্টুডিও ঘুরেছি যে দারোয়ান থেকে ডিরেক্টর সবাই আমাকে চিনতেন। কিন্তু আমি একবারের জন্যও কাজ চাইনি কারওর কাছে। হিন্দি ছবিতে প্লে-ব্যাক করেছি, সেটা অনেক পরে, বাপি লাহিড়ী আমাকে দিয়ে গান গাইয়েছিলেন। ‘হালাল কি কামাই’ আর ‘পাঁচ পাপী’। কিন্তু আমার বোম্বে যাওয়ার মূল লক্ষ্যই ছিল কিশোরকুমার। সারাদিন যে স্টুডিও থেকে স্টুডিওতে ঘুরে বেড়াতাম– সে তো ওঁকে দেখার জন্যই।
বোম্বেতেই কি আপনার প্রথম প্লে-ব্যাক?
না। প্রথম প্লে-ব্যাক কলকাতায়। ‘পলাশ কলি’ নামে একটা বাংলা ছবি। সন্ধ্যা রায় হিরোইন ছিলেন। সেই ছবিটা অবশ্য শুটিং চলাকালীন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কানু ভট্টাচার্যের সুরে একখানা গান গেয়েছিলাম সেই ছবিতে। তার অনেক পরে আমি, শক্তি ঠাকুর আর মহম্মদ আজিজ– আমরা তিনজনে মিলে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা, নীতা সেনের সুর করা একখানা গান গেয়েছিলাম। টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে রেকর্ডিং হয়েছিল। আরও পরে মিঠুনদার ‘পাহাড়ি ফুল’ নামে একটা ছবিতে– সেটাও গৌরীদার লেখা, নীতা সেনের সুর করা। তারপরেই মেহবুব স্টুডিও, বাপিদার সঙ্গে কাজ করা। পরে অবশ্য বাংলায় অঞ্জন চৌধুরী, স্বপন সাহা, অনুপ সেনগুপ্ত, ইমনকল্যাণ চট্টোপাধ্যায় এরকম অনেকের ছবিতে গান গেয়েছি।
এই যে বেশ কয়েকটা ছবিতে গান গেয়েছেন; পাশাপাশি আপনার রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম রয়েছে, বাংলা আধুনিক গানের অ্যালবামও রয়েছে– সেগুলোর ক্ষেত্রে আপনার গায়কীতে ‘কিশোরকণ্ঠী’ গৌতম ঘোষের কোনও প্রভাব পড়েছে কি?
একটা সময়ে প্রাইম মিউজিক, গাথানি, ইবিআই আমার গানের অ্যালবাম বের করেছিল। প্রথম অ্যালবাম ১৯৮৬-তে, বোম্বে থেকে ফিরে রেকর্ড করেছিলাম। পুজোর গান। একটা খুব সত্যি কথা বলি তোমায়, আমি আজ অবধি জীবনে যত গান গেয়েছি– কোনও গানের মধ্যে তুমি কিশোরকুমারের ‘ক’-ও খুঁজে পাবে না। কারণ আমি কিশোরকুমার নই। আর ছবির গান যখন গেয়েছি, ছবির চরিত্রটার ভেতরে ঢুকেই গাইতে চেয়েছি। সেখানেও কিশোরকুমার নেই।
কিন্তু একটা তকমা তো একটা মানুষের চিন্তাভাবনাকে শেপ করে। আপনি না চাইলেও করে। সেই শেপিংটা আপনার অন্য ধারার গানগুলোর ক্ষেত্রে কতটা সুবিধা-অসুবিধা সৃষ্টি করেছে?
‘তকমা’ নিয়ে আমি কখনও এরকমভাবে ভাবিইনি। ফলে তকমার দরুন সুবিধা বা অসুবিধা কোনওটাই হয়নি। তকমা না দিলেও কিছু হত না। কিশোরকুমারকে ভালোবাসি বলেই তাঁর গান গাই। তবে মঞ্চে গাইতে গিয়ে দেখেছি, দশটা অন্য ধারার গান গাইলে যে হাততালিটা পাই, একটা কিশোরকুমারের গান গাইলে তার বহুগুণ বেশি হাততালি জোটে। ফলে আমি জানি, আমাকে এই লোকটার গান গাইতে হবে, কারণ এই লোকটার গানই মানুষ আমার কাছ থেকে শুনতে চায়। দু’ পক্ষের এই চাওয়াটা মিলে গেছে বলেই তো আজ আমার নামের আগে কিশোরকুমারের নামটা বসেছে।
কিন্তু সেটা কি আপনার পরিচয়কে খানিক খর্বও করেনি? অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, এই যে ‘কণ্ঠী’ শিল্পীদের সাধারণ শিল্পীদের তুলনায় একটু নিচু চোখে দেখার একটা রেওয়াজ রয়েছে…
এটা চিরাচরিত প্রথা। মৌলিক শিল্পীদের তুলনায় ‘কণ্ঠী’ শিল্পীদের একটু খাটো করে দেখা হয়। এমনকী, মৌলিক শিল্পীরাও ‘কণ্ঠী’দের একটু অন্যরকম চোখে দেখেন। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার, ‘তকমা’র গৌরব যাঁরা সেঁটে দেন, তাঁরাই তকমাপ্রাপ্তদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির শিল্পী’ ভাবেন। অথচ যাঁরা মৌলিক শিল্পী তাঁরা কি শুধুই তাঁদের নিজেদের গানই গান? যেহেতু সারাজীবন একজন শিল্পীর ধার করা গান গেয়ে এসেছি– তাই আমরা ‘কণ্ঠী’, দ্বিতীয় সারির। দশজন আলাদা শিল্পীর দশটা ধার করা গান গাইলে হয়তো ‘অরিজিনাল’ শিল্পী বলা হত (হাসি)। যদিও বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে এই মনোভাবটা প্রায় নেই বললেই চলে।
মানুষের জীবনে সবকিছুই যে সুখের হবে, আনন্দের হবে তা তো নয়। দুঃখের মুহূর্তও তো থাকে। আরেকটা জিনিস আমি বিশ্বাস করি– দুঃখ, বিরহ, বেদনা না থাকলে সুখের অনুভূতিটাকে বোঝা সম্ভব নয়। প্রচুর অপমানিত হয়েছি। বাংলায়, বোম্বেতেও। তবে সেই অপমানগুলো আমার জেদ বাড়িয়ে দিয়েছে। তবু বলব, শিল্পী হিসেবে আমার কিন্তু কোনও দুঃখ নেই। আমার যা প্রাপ্য, আমি বিশ্বাস করি, তার চেয়ে অনেক বেশি আমি পেয়েছি জীবনে। এক বর্ণ সা-রে-গা-মা না শিখে শিল্পী হয়েছি। সংগীত তো সাধনার জিনিস, সেই সাধনার এতটুকুও তো আমি করিনি। ফলে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব নিয়ে এই বয়সে এসে আমার কোনও আক্ষেপ নেই।
অর্থাৎ আপনি বলছেন, ‘কিশোরকুমারের ছায়া’– এই পরিচয়টা দুঃখের নয়, গৌরবের?
‘ছায়া’ কেন? আমি তো এটাকে আলো হিসেবে দেখি। জীবনে যাকে ভালোবেসেছি, যার গান গেয়েছি, তার নাম যদি আমার নামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়, তার নাম যদি সর্বজনীনভাবে আমার নামের আগে বসে যায়– সেটা কি আনন্দের নয়! আমার তো নিজস্ব কোনও আলো নেই। তাই কিশোরকুমারের আলোয় যদি গৌতম ঘোষ মৃত্যুর পরেও আলোকিত থাকেন– তাহলে সেটাই তো আমার জীবনের সবচেয়ে গর্বের, সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি!
অনুলিখন: পুনম দাস
দীর্ঘ সময়ের কাজ, রাস্তায় অনেকক্ষণ কাটানো, শৌচালয়ের অভাব, পথের নানা বিপদ, চাকরি টেকার অনিশ্চয়তা, পুরুষ সহকর্মীদের শ্লেষ, বসের হাতে হেনস্থার ভয়, কাজটা সহজ ছিল না 'মহিলা সেলসম্যান'দের। বড়লোক কাস্টমারদের মেজাজের ওঠানামাও সামলাতে হত তাঁদের।