কাঁধে ভারী জলভরা চামড়ার ব্যাগ। জল টুপটুপ করে পড়ছে তা দিয়ে। খাস কলকাতায় এ দৃশ্য কিছুকাল আগেও আমরা দেখেছি। ওঁদের চিনেছি, ‘ভিস্তিওয়ালা’ নামে। কিন্তু ভেবে দেখিনি, জলই জীবিকা যাঁদের, তাঁদের জীবন কীরকম? কীরকমভাবে বেঁচে আছেন ভিস্তিরা? রাজাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম যিনি কলকাতার ভিস্তিদের নিয়ে বড় আকারের তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ফুটে উঠল ভিস্তিদের জীবন। যে-জীবন জানতে পারলে অস্বস্তিই হয়। রোববার.ইন-এর তরফে কথা বললেন সম্বিত বসু।
রাজাদিত্যদা, ভিস্তিওয়ালাদের নিয়ে আপনার তথ্যচিত্র ‘ওয়াটারওয়ালা’ দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে, আমি শুরুতেই জানতে চাইব কী করে প্রথম পরিচয় হয়েছিল ভিস্তিওয়ালাদের সঙ্গে?
আমার জন্ম ১৯৭০ সালে। আমাদের ছোটবেলায়, যখন বিশ্বায়ন বহু দূর, বড় হচ্ছিলাম দক্ষিণ কলকাতায় তখন ধারণা ছিল বড় ব্যাগ নিয়ে যাঁরা কাগজ-টাগজ কুড়োতে আসেন বা অন্য কাজকম্মো করেন ঝোলা কাঁধে রাস্তায় রাস্তায়, তাঁরা আসলে ছেলেধরা। এটা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন গুরুজনেরাই। এখন এই চলটা আর নেই। পরিস্থিতি বদলেছে, ছোটদের এসব গল্প দিয়ে আর লাভ নেই। প্রায় প্রবাদের মতো ছিল যে, অঙ্কে কম পেলেই ছেলেধরা ধরে নিয়ে যাবে। তাতে অবশ্য অঙ্কে আমি ভালো হয়ে উঠিনি। আমার দাদা, বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমার দু’জনেরই আগ্রহের জায়গা ছিল ফ্ল্যাশ গর্ডেন, ম্যানড্রেক, অরণ্যদেব। দাদা নরেন্দ্রপুরে পড়ত, আমি অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চ। ও ফিরলে দু’জন মিলে পুরনো এই সমস্ত জমানো কমিকস বাঁধিয়ে একসঙ্গে পড়তাম।
এত সব পুরনো কমিকস পেতেন কোথায়?
উপায় বাতলে দিয়েছিলেন আমার বাবা, কবি-সম্পাদক দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছিলেন, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের কথা। সেখানে প্রচুর পুরনো বইয়ের দোকান ছিল। সেখান থেকেই অনেক কমিকস সংগ্রহ করতাম। মা-বাবার কাছ থেকে নানা সময় টাকাপয়সা নিতাম সে বই কিনব এবং বাঁধাব বলে। এই যে এলাকাগুলো– ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, রয়েড স্ট্রিট, পোদ্দার কোর্ট, বো ব্যারাক– এই অঞ্চলগুলো, এখানে গেলেই খুব ভয় লাগত সেসময়।
কেন?
কারণ ঘন কালো চামড়ার ব্যাগ হাতে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন কিছু মানুষ, যাঁদের ব্যাগ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে চলত রাস্তায়। কখনও রাস্তার কোনও দোকানের বালতিতে জল ঢালতেন তাঁরা, কখনও লম্বাটে বহু পুরনো কোনও ভাঙা বাড়ির প্যাঁচালো সিঁড়িতে উঠে পড়ছেন সেখানে জল দিতে। বাবাকে বলতাম, ছেলেধরা? বাবা বলতেন, না, এঁরা জল দেন। আমি জানতে চেয়েছিলাম বালতি নিয়ে নয় কেন, কেন ব্যাগ নিয়ে? এই প্রশ্নটা ঘুরে বেরিয়েছে বহুকাল আমার মাথায়।
এটাই তাহলে প্রথম ইমপ্যাক্ট, তারপর কি কোনওভাবে যোগাযোগ হল? কথা বললেন?
যখন আমি মাধ্যমিক পাশ করি, আমার এক বন্ধু ও আমি, একটা ক্যামেরা জোগাড় করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পয়সা নেই। অথচ মনে হয়েছিল এঁদের নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। একটা ঠিকঠাক কোনও কাজ। ‘কাজ’ মানে আজকের তথ্যচিত্রের মতো করে ভাবিনি। কিন্তু এঁরা কারা, কোথা থেকে এলেন, কী করেন– এই সমস্ত কিছু। দেখতে দেখতে উচ্চ মাধ্যমিকও হয়ে গেল। যাদবপুরে কিছুদিন তুলনামূলক সাহিত্য পড়ার পর বিএ পড়ার সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়েছি। কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করেছি ওঁদের সঙ্গে। কিছুতেই কথা বলতে চাইতেন না ওঁরা। আমাদের কাছে ছিল পেনট্যাক্স ক্যামেরা। আমার জেঠু ছিলেন কবি, প্রয়াত তপন সেন। তিনিই ক্যামেরা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। কিছু কিছু ডকুমেন্ট করতাম তখন থেকেই। এরপর কাজ আর এগোয় না। আমি ইউরোপে চলে যাই। ফিরে আসি এক পারিবারিক বিপর্যয়ে, ২০১৫ সালে।
……………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন: অরুণ সোমের সাক্ষাৎকার
……………………………………………………………………………………………………………..
আন্দাজ করতে পারি সেই বিপর্যয়। বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু। সে খবরে আমরাও, যাঁরা ওঁর কবিতা পড়েছি, সিনেমা দেখেছি, তাঁরাও খুবই আহত হয়েছিলাম।
দাদা প্রথমে। তার পরপরই বাবা। ৬-৭ মাসের মধ্যেই। বাবার ছোটগল্প ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ অবলম্বনে ফিচার ছবি করছিলাম তখন। বাবা দেখে গিয়েছিলেন শুটিং করছি। তারপরই মনে হল, আমার ফিরে যাওয়া দরকার। তবে বিদেশে নয়। আমার ছোটবেলার ওই স্বপ্নে– বউবাজারে, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে, পোদ্দার কোর্টে, সদর স্ট্রিটে। যেখানে ভিস্তিওয়ালাদের আমি দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম কাজ করব। সেই কাজ বাকি রয়ে গিয়েছিল। আবারও শুরু করলাম তাই।
এটা কোন সময়?
’১৬ সালের শেষের দিক।
এই এতদিনের পার্থক্যে অনেক কিছু বদলে গিয়েছে নিশ্চয়ই?
অবশ্যই। অনেক বেশি পরিমাণে ভিস্তিওয়ালারা ছিলেন আগে। আমি যখন তথ্যচিত্রটা তৈরি করছি, তখন মাত্র দু’জন লোক। আমি কিছু টাকা জোগাড় করে নেমে পড়েছিলাম।
রাজি করালেন কী করে? বলছিলেন যে, ওঁরা কথাই বলতে চান না?
সে এক কাণ্ড! ওঁদের পুরনো সেই তোলা ছবিগুলো দেখাই। বলি যে, অনেক দিন ধরে ওঁদের নিয়ে কাজ করতে চেষ্টা করছি। কথা বলার জন্য পারিশ্রমিক দেওয়ার কথাও বলি। জানাই যে, কোনওরকম ভাবে ডিসটার্ব করব না, শুধু ক্যামেরা ফলো করবে। তখনও তাঁরা নিমরাজিই বলা চলে। ‘আপনার কি জল লাগবে? জল লাগলে কথা বলব, নইলে না’– এইরকমই প্রত্যুত্তর পেয়েছি। অবশেষে ২০০০ টাকা হাতে ধরিয়ে বলেছি কথা বলার জন্য দিলাম। আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলেছেন কথা বলার জন্য ২০০০ টাকা! আপনারা নিশ্চয়ই তালে পুলিশের লোক! পরে জেনেছি, ওঁদের সঙ্গে যাঁরা অনেকসময় কথা বলেছিলেন, তাঁরা কেউ কেউ ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ সত্যি না মিথ্যে, তা অবশ্য জানি না।
যাঁর সঙ্গে শেষমেশ কথা হল, তাঁর কী নাম?
ইসামুল চাচা। খুব পুরনো ভিস্তি।
কলকাতায় কোন কোন জায়গায় জল দিতেন তিনি?
নিউ মার্কেট, বো ব্যারাকস, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, পোদ্দার কোর্ট– মূলত এই জায়গাগুলো। বাড়িতে বাড়িতেও জল দিতেন। তখনও কিন্তু কলকাতা কর্পোরেশনের নেটওয়ার্ক এইরকমভাবে ছড়িয়ে পড়েনি।
ফাইনালি যে তথ্যচিত্রটা করে ফেলেছেন, সেটা তো ঠিক। একবার যে রাজি করিয়ে ফেললেন, তারপর আর কোনও সমস্যা তৈরি হয়েছিল?
বউবাজার থানায় পারমিশন করিয়েছিলাম বো ব্যারাকস-এ শুটিংয়ের জন্য। মুশকিল হল, বো ব্যারাকস নিয়ে অঞ্জন দত্তর একটা সিনেমা ছিল। তা ওঁরা খুব ভালোভাবে নেয়নি। বো ব্যাকারসের এক ভদ্রলোকের দৃঢ় ধারণা ছিল যে, আমি অঞ্জন দত্তর সঙ্গে ছিলাম এবং অভিযোগ ওঠে, বো ব্যারাকস-এর মহিলাদের আমি অপমান করেছি। বহু বুঝিয়ে, থানার পারমিশন দেখিয়ে, বিরিয়ানি খাইয়ে সে কাজ উতরেছিল।
এ তো বিরাট ঝঞ্ঝাট!
সে আর বলতে! আসলে আমি তথ্যচিত্রটাও অনেকটা সময় ধরে করতে চাই। সেজন্য আরও হয়তো এই ধরনের সমস্যা আরও বাড়ে।
……………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন: বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা দুলালচন্দ্র কাঞ্জীর একান্ত সাক্ষাৎকার
……………………………………………………………………………………………………………..
অনেকটা সময় ধরে বলতে, অনেকটা সময়কাল ধরে?
হ্যাঁ। আসলে বড় সময় ধরে একটা কাজ করলে বোঝা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কী কী পরিবর্তন হচ্ছে! আমার একটা ছবি আছে ‘লস্ট ফর ওয়ার্ডস’। মৃতপ্রায় টোটো ভাষার ওপর। টোটোপাড়াতে প্রথম গিয়েছিলাম ২৭ বছর আগে। তখন জঙ্গল। কে ধনীরাম টোটো, কেউ চিনত না। টোটোভাষার স্ক্রিপ্ট না। ২০১৪ সালে যখন তিনি স্ক্রিপ্টটা লিখছেন, তারপর টোটোভাষার কী অবস্থা– এই পুরো সময়টাই আমি ধরেছিলাম। আমি যখন ভিস্তি নিয়ে কাজ করছিলাম, তখনও মনে হয়েছিল যে সময়টা খুব জরুরি। বিশেষ করে যখন অতিমারীর মতো ঘটনাও ঘটে গেল। দেখেছি পরিযায়ী শ্রমিকদের কী অবস্থা! এই ভিস্তিওয়ালারাও কিন্তু প্রত্যেকেই পরিযায়ী শ্রমিক। শুরুতে যে ইসামুল চাচার কথা বললাম, তাঁকে কিন্তু অতিমারীর পর আর দেখতে পাইনি। জলই জীবন, কিন্তু যে ভিস্তিরা জল দিতেন তাঁদের খবর আমরা রাখিনি।
প্রত্যেকেই যে পরিযায়ী বলছেন, এঁরা কলকাতার বাইরে থেকে আসেন?
কর্মসূত্রে, বিহারের বার্সই থেকে, কাটিহার জেলা, জিতওয়ারপুর একটি গ্রাম। সেখানেও পর্যন্ত গিয়েছি। ওঁরা চাননি যদিও।
এক্ষেত্রে কী করে বোঝালেন? এ তো আরও দুষ্কর ব্যাপার!
এ আরেকজন ভিস্তি। নাজিম শেখ। তাঁকে বললাম যে, জন্নতে যাওয়ার আগে মানুষের তো কিছু ইচ্ছে থাকে। আমাকে আপনার বাড়ি নিয়ে চলুন। আমি কোনও সমস্যা তৈরি করব না। লিখিত মুচলেকা দিচ্ছি। শুধু শুটিং করে চলে আসব। আপনি যে টাকা চাইবেন, আমি দিতে প্রস্তুত।
অতএব রাজি?
নাজিম শেখের স্ত্রী খুবই রেগে গিয়েছিলেন। সিনেমা জগতের প্রতি তিনি খুব বিরূপ।
বিহার গিয়ে কী দেখলেন?
দারিদ্র। নাজিমদের একটা জমি ছিল। বেআইনিভাবে সে জমি ওঁদেরই আত্মীয়রা কেড়ে নিয়েছে। প্রচুর ঋণ। নাজিম মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না। এমনকী, স্ত্রীও অসুস্থ। দুঃখের বিষয়, ভিস্তি নিজাম একদিনের জন্য ভারতের সম্রাট ছিলেন। শেরশাহের সঙ্গে হুমায়ুনকে যুদ্ধে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। ভিস্তিরা দিব্যি ছিলেন ব্রিটিশ আমলেও। কর্পোরেশনের রাস্তায় জল দিতেন তাঁরা। পরিস্থিতিটা কী দ্রুত বদলে গেল!
ভিস্তিওয়ালা এ কাজ করে কত রোজগার করতেন?
সত্যি বলতে গেলে, কোনও লাভ নেই এ কাজ করে। একটা ৩০ কিলো ওজনের মশক পিঠে বইতে হয়। ১০ টাকা প্রতি লিটারে বিক্রি করেন। ফলে প্রতিদিন ৩০০ টাকা বড়জোর। এখানে খরচ চালাতে হয়। বাড়িতে পাঠাতে হয় টাকা। নতুন কেউ তো আসবে না আর এই কাজে। তাছাড়া জলই বা তিনি পাবেন কোথা থেকে? কলকাতার বহু জায়গায় তো টিউবওয়েল শুকিয়ে গিয়েছে। তুলে দেওয়া হচ্ছে সেগুলো। কর্পোরেশনের জল অনেকসময় নিতেও দেওয়া হচ্ছে না। বহু মানুষ বিরোধিতা করছেন। কর্পোরেশনের লোকজন এবং অন্যরাও। একটা কারণ অবশ্যই এঁরা ধর্মে মুসলমান। এ জিনিস গত এক দশকে বেড়ে গিয়েছে।
এই যে মশক, যেখানে জল থাকে, তা তো বোধহয় ৬-৮ মাসের বেশি চলে না, তাই না?
হ্যাঁ। বেশি দিন টেকে না। বারবার সারাতে হয়। মশকও আমি জোগাড় করে রেখেছি। কোনও মিউজিয়ামে মশক দেখিনি আমি। মশক রয়েছে কলকাতার একটা মজাদার জায়গায়। সিটি সেন্টার-২-এ। তথ্যচিত্রতেই আছে, এই মশকটা দেখিয়ে আমরা জিজ্ঞেস করেছি সাধারণ মানুষদের যে, এটা কী? তাঁরা কখনও উত্তর দিয়েছেন, এটা এক ধরনের অস্ত্র। কেউ বলছেন জন্তুর শরীর। বোঝা যায়, যে বিশ্বায়ন আমাদের চোখ ঢেকে দিয়েছে।
মশক যাঁরা সারান, তাঁরাও কি এই তথ্যচিত্রে এসেছে?
এসেছে। ২০১৭ সালে তুলেছিলাম। নিউ মার্কেটের পিছনে এক অন্ধকার গলিতে। একটা বন্ধ হওয়া সিনেমাহলের কাছে। এত দুর্গন্ধভরা জায়গা যে, আমরা বমি করতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু তাও, ক্যামেরা অন রাখতে হয়েছিল তথ্যচিত্রের স্বার্থে। পাশেই ছিল খোলা শৌচালয়। দেখলাম ভাত রান্না চলছে সেখানেই। একটা ছোট টিভিও চলছে। মশক সারানো চলছে। ভয়াবহ কষ্ট হয়েছিল এই কাজটা করতে। এটা আমার করা ছবিগুলোর মধ্যে সবথেকে কঠিন কাজ। এছাড়াও বাংলার বহুরূপীদের ওপর তথ্যচিত্র: ‘ডায়িং আর্ট অফ দ্য বহুরূপীস ইন বেঙ্গল’, নাচনীদের ওপর ‘আনটাচেবল’, মৃত্যুর মৃত্যু নিয়ে তথ্যচিত্র ‘ডেথ অফ ডেথ’ এবং ‘দ্য লাস্ট ক্লিক’ করতেও সমস্যায় পড়েছিলাম, কিন্তু এতটা নয়।
আপনার কী মনে হয়, ঠিক কবে থেকে এই পেশার সংকট তৈরি হল?
১৯৯০ সালের পরে, যখন বিশ্বায়ন এল, তা আমার মতে, ভারতের কাঠামোটা বদলে ফেলল। আমাদের কাছে অপশন এসে গেল বহু। প্রচুর আন্তর্জাতিক কোম্পানির প্রবেশ ঘটল। আমরা আন্তর্জাতিক জল খেয়ে তৃপ্ত হতে শিখে গেলাম। আর উল্টোদিকে, ভিস্তিদের প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়ে গেলাম ‘ভারী’দের। পেশাগতভাবে যাঁদের কাজ একই। শুধু ধর্মগতভাবে আলাদা– হিন্দু। ভারীরাও যে খুব ভালো অবস্থানে আছেন, তা নয়। তাছাড়া, টুলু পাম্প এসে পড়ল। ফলে যে-কেউ যে কোনও সময় জল তুলে নিতে পারেন।
তথ্যচিত্রেরও তো একটা ম্যাজিক থাকে, গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে, আপনার ছবিতে সেটা কী?
আমার মনে হয় এই ছবির শুরু ও শেষটা।
……………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন: মনোজ মিত্রের একান্ত সাক্ষাৎকার
……………………………………………………………………………………………………………..
কী সেটা?
ছবিটা শুরু করেছি মহালয়ার দিন দিয়ে, যেদিন ভিস্তিরা জল দিচ্ছেন। দেবীপক্ষের শুরু। আর শেষ করেছি বিসর্জন দিয়ে। নিমতলা ঘাটে একজন মারা গিয়েছেন, দাহ হচ্ছে। একদিকে দুর্গাপ্রতিমার বিসর্জন হচ্ছে, আরেকদিকে জলের ওপর একটা প্রফেশন সেটারও বিসর্জন হচ্ছে।
আচ্ছা, কলকাতার রাস্তায় ঘুরে ঘুরেই তো কাজ করতেন ওঁরা, কোথায় খেতেন?
পোদ্দার কোর্টের কাছে এক দোকানে। খেতেন ডিমভাজা-ভাত, কখনও রুটি। সেখানে খেয়েছি বলেই শুটিং করতে পেরেছিলাম। নইলে পারতাম না। আসলে বুঝতে দিইনি যে ক্যামেরা চলছে। একটা শট রয়েছে যেখানে মানুষ ও কুকুর পাশাপাশি খাবার খাচ্ছে। দেখেছিলাম বিশাল পরিযায়ী শ্রমিকদের লাইন। কম পয়সার খাবারের জন্য ভিড়। ভিস্তিরাও সেখানেই লাইন দেন।
আমরা কী করতে পারতাম, এই হারিয়ে যাওয়াটা বাঁচাতে পারতাম বলে মনে হয়? কোনও উপায়?
আসলে কলকাতা শহরটার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ৫০ বছর আগেকার কলকাতা, আর আজকের কলকাতা এক নয়। কিন্তু সেই বদল করতে গিয়ে আমরা অনেককিছু মুছে ফেলেছি, এলিমিনেট করেছি। খাবার জল না হোক, তাঁদের দিয়ে আমরা রাস্তা ধোওয়াতে পারতাম। গাছে জল দেওয়াতে পারতাম। মানুষ আসলে ভাবছে না। আমি যখন এই তথ্যচিত্র শুরু করেছিলাম তখন ২ জন ভিস্তি ছিলেন, এখন যখন কথা বলছি, আমি জানি না তাঁরা আদৌ আর এ কাজে আছেন কি না। আমার কাছে কলকাতার এই বেড়ে ওঠা ব্যালান্সড নয়। বিশ্বায়নের সঙ্গে ঐতিহ্যের একটা লড়াই রয়েছে সবসময়ই। পৃথিবী জুড়ে একটা প্রচেষ্টা চলছে যে, সংস্কৃতি থাকবে একটাই। ভাষা থাকবে একটাই। কতগুলো ব্র্যান্ড থাকবে। আমার তথ্যচিত্রগুলো এই একরকম হয়ে যাচ্ছে যে পৃথিবী, তার বিপক্ষে। আমার তথ্যচিত্রগুলো এই বৈচিত্রের কথাই বলবে। সে টোটোভাষা নিয়ে হোক বা নাচনীদের নিয়ে। আমি কসমোলজির ছাত্র। কসমোলজি বলে, পৃথিবী ৪৬০ কোটি বছর আগে তৈরি হয়েছে। মানুষ আসার আগে তাহলে অনেক প্রাণী ছিল, তাদেরও অধিকার রয়েছে এই পৃথিবীতে টিকে থাকার। এটা মনে হতে পারে, খুব আদর্শের কথা, কিন্তু এটা আমি বিশ্বাস করি। একটা বাঁধা সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়ার ক্রমশ জোরালো চেষ্টা চলছে। আজ থেকে ১০০ বছর পর বাচ্চারা যখন পড়বে, তখন আর ইতিহাস পড়বে না। কারণ আমাদের ইতিহাস থাকবে না আর কোনও।
শেষ প্রশ্ন করি রাজাদিত্যদা, তোমার নতুন তথ্যচিত্র কী নিয়ে?
সে ব্যাপারে বেশি বলব না। শুধু এটুকুই বলি, তা অন্য ভারতের খোঁজ দেবে দর্শককে। ‘আদার ইন্ডিয়া’ ধরা পড়বে। ভারতের ভেতরে কতগুলো ভারত রয়েছে, জানাবে সেই ছবি। সেই বৈচিত্রের কথাই, আরও একবার, আরেকরকমভাবে জানান দেওয়া।