মাত্র তিনদিন আগে শেষ করেছেন ২১ দিনের অনশন। তবু নিজের মাতৃভূমির জন্য, জলবায়ু রক্ষার জন্য সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর একদিন বিশ্রাম নিয়ে ফের যোগ দিয়েছেন আন্দোলনের মঞ্চে। এই অনশনে কমেছে দশ কিলো ওজন। তাতে কী! আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেখাচ্ছে লাদাখের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়া সোনম ওয়াংচুক-কে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ফাঁকেই রোববার ইন-কে মনের কথা খুলে বললেন তিনি। লাদাখে গিয়ে আন্দোলন মঞ্চে তাঁর একান্ত সাক্ষাৎকার নিলেন সোমনাথ রায়।
প্রশ্ন: প্রথমেই জানতে চাইব, আপনি যে বারবার মহাত্মা গান্ধীর উদাহরণ টানছেন, গান্ধীজির অনশনের কথা বলছেন। তাঁর সেই আন্দোলনের ভাবনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এখানে তা বাস্তবায়িত করছেন কীভাবে?
সোনম: দেখুন, সরকারকে যদি তার প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দিতে হয়, যদি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয় তাহলে সেটা সহিংস পথে, অভদ্রতা করে করতে হবে, এমনটা মনে করি না। আমি বিশ্বাস করি, ভালোবাসাকে সম্বল করে ভারত সরকারের কাছে নিজেদের দাবিকে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। গান্ধীজির আন্দোলনের পথ ভালোবাসা ও শান্তিকে পাথেয় করেই চলেছিল। আমরাও তা অনুসরণ করতে চাই। তবে এখানে অনেকেই আছে, যারা আমায় বলে, অনেকদিন তো হল এই শান্তির পথ অবলম্বন করে আন্দোলন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি চাই, যত দূর সম্ভব শান্তিপূর্ণভাবেই আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথ ধরেই আমরা লাদাখে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই। আমি কয়েক সপ্তাহ আগে উত্তর-পূর্ব ভারতে গিয়েছিলাম। সেখানকার স্থানীয়রা আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, ভারতে ক’টা ভাষা আছে? উত্তরে বলেছিলাম, বাইশ। তখন তারা বলেছিল, বাইশ প্লাস এক। ওই অতিরিক্ত একটা হল– বন্দুকের ভাষা, যে ভাষাটা সরকার বোঝে। আমার এত কষ্ট হল শুনে, বললাম, তেইশ নয় চব্বিশ, আরও একটা ভাষা আছে। ওটা শান্তির ভাষা। সেটাই আমরা লাদাখে প্রমাণ করতে চাইছি। সরকারপক্ষ এবং আমরা– উভয়ের কাছে এটা একটা পরীক্ষা। আমাদের দু’পক্ষকেই প্রমাণ করতে হবে যে, জনগণের শান্তিপূর্ণ বার্তাকেও সরকার স্বীকৃতি দেয়। ভারত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আপনারা বোধহয় জানেন, যখন আমি এখানে টানা ২১ দিন ধরে অনশন করেছি, তখন প্রতিদিন দুই থেকে ছ’হাজার মানুষ আমার সঙ্গে এখানে এসে অনশনে যোগ দিয়েছে। লাদাখের এক তৃতীয়াংশ লোক এই আন্দোলনে শামিল হয়েছে। এদের কথা যদি সরকার না শোনে, তাহলে আর কার কথা শুনবে! আমার বিশ্বাস, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের যে পথ আমরা বেছে নিয়েছি, সরকার নিশ্চয়ই তাঁদের কথা শুনবে।
প্রশ্ন: আপনার ভাবনাটা চমকপ্রদ। কিন্তু ভারতের বিরোধীদলগুলোর দাবি যে, এই সরকার তো গডসে-কে বিশ্বাস করে, গান্ধীকে নয়। তাহলে আপনার কেন মনে হয়, গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যে শান্তির পথে এই আন্দোলন এগিয়ে চলেছে, তাকে সরকার স্বীকৃতি দেবে?
সোনম: গান্ধীজির পথই আমার পথ। অহিংসার পথ ধরেই, শান্তিপূর্ণভাবে আমি আন্দোলন জারি রাখতে চাই। তবে এখানে অনেকে আছেন, যারা বিশ্বাস করে, যে গান্ধী নয়, আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ভগৎ সিংয়ের পথ অবলম্বন করা দরকার। তারা আমায় বলেছে, আপনি গান্ধীর পথে চলুন, আমরা ভগৎ সিংয়ের পথে চলব। আমি নিজের বিশ্বাস কিংবা ধারণাকে তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারি না, তাদের ওপর আমার সেই নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু আমি গান্ধীর পথেই চলব। আমার মতে, শান্তিপূর্ণভাবে আমরা যে আন্দোলন করছি, যে দাবিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি, সরকার নিশ্চয়ই গুরুত্ব দিয়ে তা বিবেচনা করবে।
প্রশ্ন: ২০১৯-এ যখন জম্মু আর কাশ্মীর ভেঙে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি হল, তখন অনেকের মতো আপনিও সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কারণ, লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করার দাবি আপনাদের দীর্ঘদিনের। কিন্তু যেদিন সংসদে এই দাবি পাশ হয় সেইদিন থেকে একটা কথা শোনা যায় যে, জম্মু ও কাশ্মীরে নির্বাচিত সরকার এলেও, লাদাখে আসবে না। সেটা কেন্দ্রের অধীনেই থাকবে। সেই দ্বিচারিতাই কি আপনাদের আন্দোলনের পথে নামতে বাধ্য করল?
সোনম: দুটো ব্যাপার বলার আছে। প্রথমেই আমাদের দাবি ছিল, ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে আমাদের সংরক্ষণ চাই। সেটাও আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। বিধানসভা অনেক বড়, কিন্তু ষষ্ঠ তফসিলিতে কাউন্সিল নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়। এই আশ্বাসই ইস্তাহারে ছিল। এবং আমরা মনে করি, এটা হবেই। আমাদের চিরকালীন দাবি, বিধানসভার সঙ্গেই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হোক লাদাখ। এতদিন এটাই বিশ্বাস করতাম, যে সরকার আমাদের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের তকমা দিয়েছে, সেই সরকার খুব শীঘ্রই আমাদের বিধানসভা গড়ে রাজ্যের সরকার নির্বাচন করার সুযোগ করে দেবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অন্য কথা বলছে। এখনকার অনেকের কাছেই শুনছি, এই কেন্দ্রশাসিত তকমা সরকার লাদাখের স্বার্থে দেননি। দিয়েছে জম্মু-কাশ্মীরকে নিয়ে বৃহত্তর পরিকল্পনার স্বার্থে। এটা আমি আগে মানতে চাইতাম না। কিন্তু এখন আমি সন্দিহান, সত্যিই কি আমাদের জন্য সরকার কিছু করেছে? যদি সত্যিই আমাদের জন্য করে থাকে, তাহলে বিধানসভা তৈরি করা কোনও বড় ব্যাপার নয়। আমরা কোনওদিন ভাবিনি যে, এখানকার জনপ্রতিনিধিরা এখানে মানুষের ভাল-মন্দের খোঁজ রাখবে না, নিজের মর্জিমাফিক তারা চলবে, অর্থের অপচয় করবে। এখন এসব চোখের সামনে ঘটছে। আর সেই অবিচার এখনকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে।
প্রশ্ন: ষষ্ঠ তফসিলের কথা বলছেন আপনারা। কিন্তু দিল্লিতে আপনার বিরুদ্ধে অনেকেই অভিযোগ তুলছে, যে এই ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্গত সংরক্ষণের ফলে শিল্প হবে না লাদাখে। যার ফলে কর্মসংস্থান হবে না এখানে। তখন আপনারাই সেটাকে ইস্যু করবেন, বলবেন কর্মসংস্থান নেই।
সোনম: খুব ভাল প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব দরকার। আসলে সকলকে ভুল বোঝানো হচ্ছে যে, এই সংরক্ষণ একটা দেওয়াল তুলে দেবে। পর্যটন আসতে দেবে না লাদাখে, শিল্প-বাণিজ্য আসার পথে বাধা সৃষ্টি করবে, আসলে এইসব অমূলক আশঙ্কা আর কিছুই নয়। ষষ্ঠ তফসিলের আইন পড়লে বুঝতে পারবেন যে, এই সংরক্ষণ স্থানীয় জনজাতিকে একটা গণতান্ত্রিক মঞ্চ দেয়। বিধানসভার একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ, যেটাকে বলা হয় কাউন্সিল। যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইন বানাতে পারে যে কীভাবে লাদাখে শিল্প আসবে। তাহলেই তো এখানকার মানুষের বিকাশ হবে। এই কাউন্সিলই তো ঠিক করবে আমাদের জন্যে কোনটা ভালো আর কোনটা নয়। আর সেই ঠিক করার লোক যদি স্থানীয় কেউ হয়, তাহলে তো সবচেয়ে ভালো। সে তো আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করেই কাজটা করবে। বাইরের লোক এলে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু সে আমাদের দুঃখ কষ্ট বুঝতে পারবে না। বাইরের লোক এসে এমন কিছু ভুল করে যাবে, যার দায় আমাদের বয়ে চলতে হবে। আরিয়ান ভ্যালি থেকে প্যাংগং লেক, সেখানে থাকা বহু দুর্লভ পশুপাখির আছে, প্রাচীন জনজাতি আছে, সেগুলোকে সংরক্ষণ করা দরকার। লাদাখেও প্রচুর জায়গা আছে শিল্প করার। দেশ-বিদেশ থেকে সেই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। এখানে দেওয়াল তোলার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এই সংরক্ষণের দাবি স্থানীয় মানুষকে একটা অধিকার দেওয়ার। আজ যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা আর থাকবে না, তা পরিচালনা করবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। তা কেমন লাগবে বাংলার মানুষের? তারা কখনও কোনওদিন এটা মেনে নেবে না। কারণ, তারা জানে তারা রাজ্য চালাতে সক্ষম। ঠিক একইভাবে আমাদের দাবি, লাদাখের স্থানীয়রা জানে কীভাবে এই পাহাড়ি রাজ্য পরিচালনা করতে হয়, দিল্লি সেটা জানে না। এখানকার মানুষকে সেই সুযোগ অবিলম্বে দেওয়া উচিত।
প্রশ্ন: আপনি বিশ্বাস করেন লাদাখে শিল্প ও পরিবেশের সুন্দর যুগলবন্দি হবে?
সোনম: সেটা আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ঠিক করবে। সে যদি মনে করে– পরিবেশের স্বার্থে শিল্পকে আটকানোর প্রয়োজন, তাহলে আটকাবেন। যদি মনে করেন শিল্প এলে পাহাড়ের, পরিবেশের কোনও ক্ষতি হবে না, তাহলে শিল্প আসবে। আমাদের মধ্যে থেকে সেই প্রতিনিধি বেছে নেওয়া উচিত, তার ওপরেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুরুদায়িত্ব দেওয়া উচিত। দিল্লি ঠিক করতে পারে না, লাদাখে কী উচিত আর কোনটা অনুচিত।
প্রশ্ন: গান্ধীজির দেখানো পথে অনশনের পর শোনা যাচ্ছে আপনি তাঁর মতো পদযাত্রা করবেন?
সোনম: হ্যাঁ, যেমন জাতির পিতা ১৯৩০ সালে ডান্ডি অভিযান করেছিলেন, লবণ সত্যাগ্রহ, ঠিক তেমনই আমরা ‘পশমিনা পদযাত্রা’ করব। পশমিনার শিল্পীদের কী অবস্থা! শিল্প এলে ওদের কত জায়গা চলে যাবে। আরেকদিকে চীনের অধিগ্রহণ আরও দশ গুণ জায়গা নিয়ে চলে যাচ্ছে। ওদের আর জমি জায়গা বাকি থাকবে না। একটা সময় আসবে ওরা সব ভেড়া বিক্রি করে দিয়ে শহরের কুলি হয়ে যাবে। ওই শিল্পীদের ব্যথার কথা, যন্ত্রণার কথা আমরা দেশ ও বিশ্বের সামনে তুলে ধরব। ওদের সঙ্গেই আমরা পথ হাঁটব।
প্রশ্ন: আপনার মনে হয়, সরকার পদযাত্রার অনুমতি দেবে ?
সোনম: যদি সরকার অনুমতি দেয় তাহলে বুঝতে হবে যে ওই শিল্পীদের কোনও জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। আর যদি অনুমতি না দেয়, তাহলে বুঝতে হবে সরকার আমাদের থেকে অনেক কিছু লুকোচ্ছে। সেই উত্তরের খোঁজেই আমাদের এই পদযাত্রা।
প্রশ্ন: এই উত্তর খোঁজার জন্য অনেককে দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া হয়েছে। আপনার মনে হয় না, এই উত্তরসন্ধানে আপনাকেও দেশবিরোধী কটাক্ষ শুনতে হবে?
সোনম: যে দেশের জমি বাঁচাতে চায় সে দেশদ্রোহী হতে পারে না। দেশদ্রোহী তারাই যারা মাতৃভূমিকে হারিয়ে ফেলতে চায়। দেশ ঠিক করবে কে দেশদ্রোহী, যে দেশের জমি ফেরত আনার পক্ষে লড়ই করে, নাকি যে দেশের জমিকে অন্যের হাতে তুলে দিতে চায়।
প্রশ্ন: আপনি এই আন্দোলন নিয়ে আপনাদের সাংসদকে কিছু বলেননি?
সোনম: কিছু বলিনি। কারণ, এখানে তিনি আসেননি কোনওদিন। উনি তো শাসক দলের। তাই ওঁর পক্ষে দলের বাইরে গিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। তাই আমরা সরাসরি শাসককে বলছি, যে লাদাখের মানুষের সাথে অন্যায় হয়েছে। আমরা কথা দিয়েছিলাম, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারলে আমরা নিজেদের অপরাধী মনে করব। তাই কথা দিয়েছি যখন, তখন আমরা নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকব।
প্রশ্ন: গান্ধীর দেখানো পথে আপনি চলছেন। তাঁর দেখানো পথে কি সক্রিয় রাজনীতিতে আসবেন?
সোনম: আমার রাজনীতিতে আসার প্রয়োজন নেই। লাদাখের অনেক যুবক যুবতী আছে যারা সক্রিয় রাজনীতিতে আসতে পারেন, আমি নিশ্চয় তাদের দিকনির্দেশ নির্ধারণ করতে সাহায্য করব। ওরা যেন সত্যের পথে রাজনীতি করে, যেটা বর্তমানে খুবই বিরল। আমি একজন শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে চাইব।
প্রশ্ন: চাণক্য হয়েই থাকতে চান ?
সোনম: চাণক্য নয়, শিক্ষক হিসেবেই আমি দিশা দেখাব।