আজ বিশ্ব বই দিবস। আজ কলকাতা শহরের বইয়ের ফেরিওয়ালা তরুণ সাউয়ের জন্মদিন। বাড়িতে বাড়িতে তিনি বাহন স্কুটারখানা নিয়ে পৌঁছে দেন বই। পাঠকের বইপড়ার স্বাদ বুঝে তাঁদের কাছে নিয়ে যান বইয়ের ঝুলি। উপুড় করেন। এই বেহায়া গ্রীষ্মে তাঁর তেমন অসুবিধে হচ্ছে না, যতটা অসুবিধে হয় বর্ষাকালে। তিনি সযত্নে, সলজ্জে এড়িয়ে গিয়েছেন একটি প্রশ্ন, তা হল: সবথেকে বেশি ধার কোন পাঠকের? একহাত তুলে তিনি জানিয়েছেন: সে ছাড়ুন।
প্রচ্ছদ: অর্ঘ্য চৌধুরী
প্রচ্ছদের ছবি: কৌশিক দত্ত
তরুণদা, দীর্ঘদিন হল আপনি সরাসরি পাঠকের বাড়িতেই বই পৌঁছে দেন। এর শুরুটা জানতে চাই। কীভাবে ভাবলেন এই পেশার কথা?
এটা আমার ভাবনা ছিল না, ভেবেছিলেন আমার বাবা– গোপাললাল সাউ। বাবা কাজ করতেন নিউ মার্কেটের এক বিখ্যাত বইয়ের দোকানে। ‘দে ব্রাদার্স’-এ। তখনকার নিউ মার্কেটে নানা পণ্যর জন্য দোকানের আলাদা আলাদা সারি ছিল। ফলের দোকানের সারি, জুতোর দোকানের সারি– সেইরকম বইয়ের দোকানের সারিও। সেখানেই ছিল ‘দে ব্রাদার্স’। তখনকার নিউ মার্কেট আজকের মতো নয়, চরিত্রগতভাবে অনেকটাই আলাদা।
যেমন? কীসে আলাদা?
যেমন ধরুন, কুলি পাওয়া যেত। তাঁদের সংখ্যা লেখা ট্যাগ থাকত গায়ে। নিউ মার্কেটের মুখ থেকে তাঁদের মাথার ঝুড়িতে নানা জিনিসপত্র জড়ো করতে করতে রাঘববোয়াল লোকজন যেতেন। তাঁরা প্রত্যেকেই উচ্চবিত্ত। মধ্যবিত্তের নিউ মার্কেট তখনও অনেক দূরের ব্যাপার। কুলিরা গাড়ি অবধি জিনিসপত্র পৌঁছে দিতেন, তার বদলে টাকা পেতেন। এই যে চরিত্র, তা আজকের নিউ মার্কেটে নেই। কুলি হয়তো বা কিছু রয়ে গিয়েছেন এখনও।
বেশ বুঝলাম। তো ওই ‘দে ব্রাদার্স’-এ আপনার বাবা চাকরি করতেন?
হ্যাঁ। বাবা খুব শিক্ষিত ছিলেন না। পিওন-বেয়ারা গোছের চাকরি ছিল। খুব অল্প বয়সেই কাজে ঢুকেছিলেন সেখানে। এই কাজটা করতেই বাবা যথেষ্ট পোক্ত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মুশকিল হল ওই ‘দে ব্রাদার্স’-এর ব্রাদার্স নিয়ে– ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া! তার ওপর ব্যবসায় খরচা বেশি, সে তুলনায় আমদানি কম হতে লাগল। বাবাকে একদিন ডেকে মালিক বলে দিলেন, দোকান আর বেশিদিন নেই, অন্য কিছুর ব্যবস্থা করতে। একটা মজার ব্যাপার ছিল যে, ওই দোকানে যাঁরা বইপত্র কিনতে আসতেন, ভাবতেন যে, বাবা-ই হল দোকান-মালিক! কারণ কাজ করতে করতে বাবার বইয়ের সম্বন্ধে দারুণ জ্ঞানগম্যি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। চেনা পাঠকদের দেখলে, সে কোন বই পছন্দ করতে পারে, একটা আন্দাজ তৈরি হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বাবা সেইসব পুরনো খদ্দেরের বাড়ি-অফিস– সবই চিনত। দোকান বন্ধের মুখে সেখানে গিয়ে বাবা ওঁদের বললেন, যদি আপনার বাড়ি বা অফিসে আমি বইপত্র নিজে এসে দিয়ে যাই, তাহলে কেমন হয়? তাঁরা তো খুবই উৎফুল্ল! বাড়ি বসে টাটকা বইপত্রিকা পাবে, এ জিনিস তো সেকালে ভাবাই যেত না। তখন কোথায় ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন, কিংবা নিত্যনতুন নানা বইয়ের হোম ডেলিভারি করা ওয়েবসাইট!
এ তো দুরন্ত বিজনেস আইডিয়া! এটা ঠিক কোন সময়ের কথা বলছেন?
ওই ধরুন, ’৮০ সালের আশপাশে এই ব্যাপারগুলো ঘটছিল।
আপনার বাহন তো স্কুটার, আপনার বাবারও কি তাই ছিল?
বাবা একটা সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল কিনলেন তখন। সেই সাইকেলে করেই গোটা কলকাতায় বাবা বই দিতেন। গোটা কলকাতা মানে এদিকে বেহালা, ওদিকে দমদম। আর দেখা গেল, বইয়ের এই নেটওয়ার্ক– হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ একটা বই নিলেন, তিনি আরেকজনকে বললেন এইভাবে বই কেনার কথা। এভাবে ছড়িয়ে গিয়েছিল খবর, যে, এমন একজন আছে বাড়ি বাড়ি পছন্দের বই দিয়ে যায়।
আপনি এ কাজে যুক্ত হলেন কবে?
সিটি কলেজে আমি সায়েন্স নিয়ে পড়তাম। বিএসসি পাশ করে বেরলাম ১৯৮৪ সালে। বাবা বললেন, ‘কী হবে আর এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লিখিয়ে, তুই আমার সঙ্গে কাজে নেমে পড়।’ আমিও রাজি। কেনা হল আরেকটা সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল। আমি তখন বাবার সঙ্গে সাইকেল নিয়ে পিছন পিছন যেতাম। ব্যবসাটাও বাড়তে থাকল। তখনকার কলকাতা আজকের মতো না। সাইকেলের ওপর এত নিষেধাজ্ঞাও ছিল না। ফাঁকা, যানজটহীন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে হু হু সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি, গায়ে হাওয়া এসে লাগছে, এখনও সেই কলকাতা মনে পড়ে।
বাড়িতে বই পৌঁছে দেওয়ার সময় কীরকম অভিজ্ঞতা হত? তখন তো ব্যাপারটার মধ্যে উত্তেজনা ছিল অনেক।
সে দারুণ কাণ্ড! বইয়ের জন্য অনেক সময়ই দেখতাম গোটা পরিবার এসে জড়ো হল। বাড়ির সক্কলে যে-যার মতো করে বইপত্রিকা বেছে ঘরের নানা কোণ বেছে নিত। তাদের চোখেমুখে আনন্দ টের পেতাম।
এখন এরকম ‘পাঠক’ পরিবার পান?
খুব কম। খুবই। আর এখন এত সিকিউরিটির চক্কর, ঠিক এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। এত পাহাড় ডিঙিয়ে সম্পর্ক গড়ে ওঠা খুব মুশকিলের। আগে তো ড্রয়িংরুম পর্যন্ত পৌঁছে যেতাম। এমনকী, গোয়েঙ্কাদেরও ড্রয়িংরুম পর্যন্ত চলে গিয়েছি। তাঁরা সাদরে আহ্বান জানাতেন। বলতেন, ‘দেখি, কী বই এনেছেন!’ এই ব্যাপারটা এখন আর নেই।
বাহন সাইকেল থেকে স্কুটার হল কবে?
সে-ও বাবার হাত ধরেই। বাবাই একসময় লুনা স্কুটার কিনলেন। আমি তখনও সাইকেল। তবে তখন হত কী, আমি উত্তরে গেলে, বাবা দক্ষিণে বই দিতে যেতেন। আমি দক্ষিণে গেলে, বাবা উত্তরে। এইভাবে কাজ ভাগ করে নিতাম। মুশকিল হল, এর মধ্যে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
কী দুর্ঘটনা?
খিদিরপুরের মোড়ে বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়। বই নিয়েই যাচ্ছিলেন বাবা। ট্রামলাইনে বাবার স্কুটার স্কিট করে, বাবার ওপর দিয়ে তেল ট্যাঙ্কারের লরি চলে যায়। হঠাৎ আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দাদা এদিক-সেদিকে খুচরো কাজ করত। ওকে তখন বললাম, ব্যবসার দায়িত্ব ভাগ করে নিই চল। দাদা আর আমি ভাগ করে আমাদের ব্যবসা চালালাম তখন। এখন দাদাও নেই। দু’বছর আগে মারা গিয়েছে। কোভিডের পর আমাদের ব্যবসাতে অনেক কর্মচারীই আর নেই। বলতে পারেন, যেটুকু করার একাই সামলাই।
আপনার কাজের ধরন এমনই যে, দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় থাকতে হবেই, বাড়ির বাইরে বেরতে হবেই। অতিমারীর ওই সময়টায় কী মনে হচ্ছিল?
ভীষণই ডিপ্রেসড ছিলাম। বাইরে বেরনোরও তো একটা সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া ছিল। তাছাড়া কীভাবে যে কে সংক্রমিত হবে, তার তো কোনও ঠিক নেই! বোঝা যাচ্ছিল না। এদিকে কোনও ফ্লাইট আসছে না। বিদেশি কোনও ম্যাগাজিনও আসছে না। সে এক আশ্চর্য সময়! এখনও বলব, কোভিডের এতদিন পরেও, বিষয়টা ঠিকঠাক হয়ে ওঠেনি। অনেকেরই পড়ার অভ্যাসে বদল ঘটে গিয়েছে। কিছুটা অর্থনৈতিক কারণেও। কোভিডের আগে আড়াই থেকে তিন লক্ষ টাকার বইপত্রিকা আসত। এখন সেটা দেড় লক্ষ। প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমরা।
বই না পত্রিকা– পাঠকেরা কী বেশি চান আপনার থেকে?
অবশ্যই পত্রিকা। তবে বিদেশি পত্রিকা, বিদেশি সংবাদপত্র। ফাইনালশিয়াল টাইমস, লন্ডন টাইমস, নিউ ইয়র্ক টাইমস, সানডে টাইমস। এগুলো বাবারই তৈরি করা লিংক। চিঠি লিখে লিখে বাবা তখন যোগাযোগ করেছিলেন। এখন আমি মেইল করি। ইন্টারনেটে টাকাপয়সার লেনদেন হয়ে যায়। ফ্যাশন-সিনেমা-ফিল্ম-স্পোর্টস ম্যাগাজিনের বিক্রি সবথেকে বেশি।
এগুলোর দামও নিশ্চয়ই অনেক?
হ্যাঁ। বাংলা-ইরেজি-হিন্দি দেশি পত্রিকার তুলনায় অনেকটাই বেশি। অন্তত দেড়-দু’হাজার তো বটেই।
এত দাম দিয়ে এই যে পত্রিকা বা সংবাদপত্র, কারা পড়েন? বাঙালি কি কেনে?
মূলত প্রতিষ্ঠান এগুলো কেনে। ক্যালকাটা ক্লাব, টলি ক্লাব, বেঙ্গল ক্লাব, স্যাটারডে ক্লাব। তাছাড়া নানা ব্যবসায়ীরা কেনেন। ধরুন যাঁদের গৃহসজ্জার ব্যবসা, তাঁরা নানা আইডিয়ার জন্য এই দামি পত্রপত্রিকা কেনেন। তবে বাঙালিও পড়ে, পড়ে না বললে ভুল বলা হবে।
আপনার বাবার যে পাঠকের কানেকশনের কথা বলছেন, সেসব আপনার এখনও আছে, কিন্তু সেই পাঠকদেরও তো উত্তর প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, তাঁরা কি বই পড়ছেন তেমন?
অনেক ক্ষেত্রেই দেখছি, পড়ায় ঘাটতি হয়েছে। পরের প্রজন্ম আর বইমুখী হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এত বিনোদনের উপাদান গড়ে উঠল যে, পারিবারিকভাবে বই পড়ার ধারাবাহিকতাটা কেটে গিয়েছে। এ বড় দুঃখজনক ব্যাপার।
কলেজ স্ট্রিটের যে বাজার, সেটাও তো পরিবর্তনশীল, সেখানে আপনার যোগাযোগ পদ্ধতি কী?
অনেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, কখনও আমিই করি। ইংরেজি বইয়ের পাঠক, অন্তত আমার মতে, তুলনায় কমেছে। এদিকে বাংলা বইয়ের পাঠক বরং আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে!
বলেন কী! এই যে নানা জায়গায় এত লেখালিখি, বাংলা বইয়ের পড়ুয়া নেই?
আমার তো বই বিক্রেতা হিসেবে একেবারেই তা মনে হয় না। এর প্রমাণ চাইলে বলতে পারি, নতুন নতুন পাবলিশিং হাউজের কথা। আমার কাছেও বাংলা বইয়ের নতুন পাঠক তৈরি হয়েছে। অঙ্ক কষে দেখবেন, যে পরিমাণে পুরনো পাবলিশার্স বন্ধ হয়েছে, তুলনায় অনেক বেশি পাবলিশার্স তৈরি হয়েছে। আবার, হাতে-গোনা সাহিত্যিকদের বাজারটা ভেস্তে গিয়ে টাটকা বিষয় ও লেখকরাও উঠে এসেছেন বলেই মনে হয় এই বিক্রির স্রোত। আমি অন্তত অনেক নতুন বিষয় ও লেখকের বইয়ের অর্ডার পাই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আমি বই নিয়ে গেলে সেই তালিকার ৮০ শতাংশ বই-ই ঋতুপর্ণ ঘোষ কিনে নিতেন। বলতেন, ‘কী করে জানলি যে এই বইগুলোই আমার লাগবে?’ আর এই বই কেনা কিন্তু কোনও লোক দেখানোর জন্য নয়। বইয়ের সঙ্গে কী নিবিড়ভাবে জুড়ে থাকা ছিল ওঁর, আমি দেখেছি। প্রত্যেকটা বইয়ের পাতা উল্টানো শুধু নয়, অগোছালোভাবে পড়া নয়, একেবারে খুঁটিয়ে পড়তেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
প্রায় ৪০ বছর ধরে এই কাজ করে আসছেন, এই কাজ করতে এখনও ভালো লাগে? মনে হয় না অন্য কোনও পেশা হলে ভালো হত?
না। একেবারই নয়। আমি খুব ভালোবাসি এই কাজটা। নিজে বই পড়তেও খুব ভালোবাসি। খবরের কাগজ মন দিয়ে পড়ি। কারণ মনে হয়, না পড়লে আমি বিক্রি করতে পারব না। যেমন ধরুন, এই সলমন রুশদির ‘নাইফ’ প্রকাশিত হল সদ্য। এ নিয়ে আমি খোঁজ রেখেছি সেই প্রথম দিন থেকেই। কবে বেরবে, বিষয় কী, কোন প্রকাশনী, এমনকী, প্রচ্ছদের খবরও।
সবসময়, সব বইয়ের ক্ষেত্রেই কি এই পদ্ধতিটা মেনে চলেন?
হ্যাঁ। সময় পেলে গোটা বইও পড়ে ফেলি। তবে সময় না পেলে, অন্তত ব্লার্বটুকু। ভূমিকাটুকু পড়ে নিই। যাতে আমি যে পাঠককে বিক্রি করছি, সে জানতে চাইলে বইটা নিয়ে দু’চার কথা বলে তার আগ্রহ তৈরি করতে পারি। আমি চিরকালই পাঠকের স্বাদ বুঝে চলি। এতদিনের যোগাযোগে জেনে গিয়েছি কোন বই কাকে দিতে হবে। একটা বই হাতে নিলে আমি বুঝতে পারি, সেই বইয়ের সম্ভাব্য পাঠক কারা। ধরুন, ৫০ জনকে ঠিক করলাম কোনও একটা বইয়ের পাঠক হিসেবে। আমি দেখি, সেই ৫০ জনের মধ্যে ৪৫ জন পাঠকই বইটা নিলেন। ৫ জনের ক্ষেত্রে হয়তো মিলল না।
এ তো দারুণ ব্যাপার! কিন্তু তরুণদা, এমন তো হতেই পারে, কেউ নানা বিষয়ের বই-ই পড়েন। নানারকম স্বাদের বই-ই তাঁকে টানে। বিচিত্র ব্যাপারেই তাঁর আগ্রহ। সেক্ষেত্রে কী করেন?
সেটাও পাঠকের সঙ্গে কথা বলে বুঝে নিতে হয়। কথা বলতে বলতে যে সমস্ত বইয়ের কথা উঠে আসে, তখন বুঝতে পারি, সেই পাঠকের বইয়ের স্বাদ বহুগামী। তখন তাঁর জন্যও নানা স্বাদের বইয়ের ঝুলি হাতে হাজির হই।
এইরকম কোনও পাঠকের কথা মনে পড়ছে তোমার?
ঋতুপর্ণ ঘোষ! ওরকম পাঠক আমি জীব্বনে দেখিনি!
কেন? কী এমন করতেন ঋতুপর্ণ ঘোষ যে আপনার ৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় আর পাননি?
এতরকম বই ওঁর পছন্দের। আর এতরকম বইয়ের কথা উনি অনর্গল বলে যেতে পারতেন! আমি বই নিয়ে গেলে সেই তালিকার ৮০ শতাংশ বই-ই ঋতুপর্ণ ঘোষ কিনে নিতেন। বলতেন, ‘কী করে জানলি যে এই বইগুলোই আমার লাগবে?’ আর এই বই কেনা কিন্তু কোনও লোক দেখানোর জন্য নয়। বইয়ের সঙ্গে কী নিবিড়ভাবে জুড়ে থাকা ছিল ওঁর, আমি দেখেছি। প্রত্যেকটা বইয়ের পাতা উল্টানো শুধু নয়, অগোছালোভাবে পড়া নয়, একেবারে খুঁটিয়ে পড়তেন। ওঁকে নিয়ে বলতে গেলে সারাদিন কেটে যাবে! এখন বড় মনখারাপ হয় যে, দিনের পর দিন ওঁকে মিথ্যে কথা বলেছি!
ঋতুপর্ণ ঘোষকে মিথ্যে! কী মিথ্যে?
ঋতুপর্ণ ঘোষ তখন অসুস্থ। চিকিৎসক বলেছেন, ৯টার মধ্যে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়বেন। একটা কড়া ডোজের স্লিপিং পিলও দিয়েছেন। আমাকে বলতেন, ‘তুই ৯টার মধ্যে আমার কাছে বই নিয়ে চলে আসবি।’ কারণ ৯টা নাগাদ সেই ঘুমের ওষুধ খেয়ে উনি ঘুমিয়ে পড়বেন। আমি বলতাম, আচ্ছা বেশ। কিন্তু নানা কাজে দেরি হয়ে যেত। অনেক সময়ই ৯টা বেজে যেত। ফোন করতেন। তখন হয়তো আমি তালতলা থেকে বেরচ্ছি। যাব লেক গার্ডেনস-এ– ওঁর বাড়ি। বলতেন, ‘বাবু, তুই কোথায়?’ বলতাম, ‘রাসবিহারী, দশ মিনিটে পৌঁছচ্ছি।’ কোথায় তালতলা আর কোথায় রাসবিহারী! অনেকটা দেরি করে গেলেও, উনি সমস্ত বই দেখে আমাকে বিদায় জানিয়েছেন। তারপরে সেই কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ। এমনই বইপাগল লোক!
ঋতুপর্ণ এমন কোনও বই নিয়েছিলেন, যা মনে আছে আপনার?
উনি একটা কাজ করতে যাচ্ছিলেন দ্রৌপদীর ওপর। সে জন্য হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশের ৪৩ খণ্ডের মহাভারত কিনেছিলেন আমার থেকে। কোন খণ্ডে কী আছে, সেসবও ছিল ওঁর ঠোটস্থ! এর পর বুঝতেই পারছেন, কেন বলছি আমার দেখা শ্রেষ্ঠ পাঠক।
হ্যাঁ, আর কোনও সন্দেহ নেই। তা, আপনিও তো বই পড়েন, কিন্তু পড়েন কখন?
সকালে বেরই ১২টায়, বাড়ি ফিরি ৮টায়। তারপর পড়াশোনা করি। রাত্তিরবেলা ছাড়া পড়াশোনা হয় না আমার।
বিশ্ব বই দিবসে আপনার জন্মদিন, কীরকম লাগে ভাবতে?
দারুণ লাগে। কাকতালীয় ব্যাপার! এই পেশায় আসাটা যেন পূর্ব-নির্ধারিত। আমি যদিও এই তথ্যটা জেনেছি অনেক পরে, এক পাঠকের থেকেই।
এত পাঠকের বইয়ের স্বাদ ও স্বাদবদল সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল আপনি, আপনি নিজে কী ধরনের বই পড়তে ভালোবাসেন?
আমি মূলত গদ্যপ্রবন্ধের পাঠক। বাংলায় অন্নদাশংকর রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার ভালো লাগে খুব। তাছাড়া বিভিন্ন নোবেল লরিয়েটের লেখা পড়তেও ভালো লাগে। তবে সব বইয়েরই ব্লার্ব আমি পড়ি। কাজের জন্য। কখনও সেই ব্লার্ব পড়ে গোটা বই পড়ার দিকেও মন চলে যায়।
তরুণদা, কলকাতায় এই বিচ্ছিরি অপদস্থ করা গরম পড়েছে, আপনার কি অন্য বছরের তুলনায় কাজ করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে বেশি?
ও-ই যৎসামান্য। গরমকালে তো একটু গরম তো পড়বেই। তবে তাতে আমার খুব অসুবিধে হয় না। সমস্যা হয় বর্ষায়। বইপত্র ভিজে যায়। প্লাস্টিক, রেনকোট যা পারি তাই দিয়ে বইকে বাঁচাই। ভিজে গেলে সে বই পাঠকদের দিতে খুব অপরাধ হয়।
আজ, বিশ্ব বই দিবসে, আপনি ৬০-এ পা দিলেন তরুণদা। এই পেশা থেকে কি আপনি অবসর নেবেন বলে ভেবেছেন একবারও?
না। আমার পরিবারে এই ব্যবসা চালানোর আর কেউ নেই। কোভিডের আগে কেউ কেউ এরকম ব্যবসা শুরু করেছিলেন, কিন্তু এখন সম্ভবত আমিই একমাত্র। আমার ছেলে, পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়র। সে-ও এই পেশায় আসবে না। তবে ব্যবসার নানা চিঠিচাপাটি লিখে দেয় ও। যেদিন আমি থাকব না, আমার এই ব্যবসাও থাকবে না। তবে, পাঠকেরা নিশ্চয়ই থাকবেন, বই-ও থাকবে। বই ঠিকই পৌঁছে যাবে তার পাঠকের হাতে, এই আমার বিশ্বাস।