মর্তলোকের তাল কাটল আচমকাই। প্রয়াত কিংবদন্তি তবলাবাদক উস্তাদ জাকির হুসেন। রোববার পত্রিকার এক বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর সাক্ষাৎকার। আজ, তাঁর প্রয়াণে, সেই একান্ত সাক্ষাৎকার পুনর্মুদ্রিত হল রোববার.ইন-এ।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
তুই হাততালি দিলে জাকির হোসেন, তবলা বাজানো ছেড়ে পায়রা পোষেন– নিজের কন্যার খুশিয়াল ঝলমলে চেহারার এভাবেই ছবি এঁকেছিলেন কবীর সুমন। যেন এক পৃথিবীর অবিশ্বাস্য, অবাস্তব কোনও বিস্ময়! ঠিক এতটাই, জাকির এবং তবলা জড়িয়ে– প্রায় সমার্থক দু’টি শব্দ যেন। চায়ের বিজ্ঞাপনে যখন দেখি দ্রুত লয়ের জাকির তেহাই অন্তে বলছেন, ওয়াহ্। উস্তাদ নয়, চায়ের গুনগান করুন– আমরা বিশ্বাস করি না সে বিজ্ঞাপন। সাধারণের পৃথিবীর অনেক দূরে যে তাঁর অসাধারণ স্বর্গের অধিষ্ঠান। সেই গ্রহে শুধু তিনি আর তাঁর আবাল্য-বন্ধু তবলা। একটা তালযন্ত্রের রূপ রস গন্ধ বর্ণ– সবটুকু তাঁর কথায়ত্ত, ওই দুই হাতে স্বয়ং ভগবানের বাস। সেই দুই হাতে ঝড় তুলে কলকাতায় বসন্ত ডেকে আনলেন জাকির হোসেন। এসেছিলেন আমান আলির সঙ্গে বাজাতে। অনুষ্ঠানের শেষে সায়েন্স সিটির গ্রিনরুমে তাঁকে কিছুক্ষণের জন্য ধরতে পারলেন বর্ণিনী মৈত্র চক্রবর্তী। বাইরে তখন ঝোড়োহাওয়া, অকালবর্ষণ আর হৃদকমলে তালবৈশাখী।
সঙ্গীত আর ঈশ্বর– সত্যি কি সম্পর্ক আছে কোনও?
খুব দরকার আছে সম্পর্কটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর? দুই-ই এক। ব্রহ্মার মুখনিঃসৃত ধ্বনিই তো নাদ। এই যে গুরুবাদ – সেও তো ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর-এর মিলনে তৈরি। গুরুস্তোত্রমে বলেছে না, “গুরুর্ব্রহ্মা গুরুবিষ্ণুর্গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ/গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ”– এই স্তোত্র থেকেই পরিষ্কার–গুরু আর ঈশ্বর এক, অভিন্ন। সঙ্গীত আর ঈশ্বর কোথায় একসঙ্গে নেই বলুন তো। কৃষ্ণের বাঁশি, নারদের তানপুরা, সরস্বতীর বীণা– এমন বহু সঙ্গীতচিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের পুরাণে। ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র গল্পে, দেবদেবীদের বর্ণনায়। কখনও মানুষও তার ঘেরাটোপ পেরিয়ে সেই দেবতার রূপে সাজতে চায়, দেবতা হতে চায়। সে পথে সঙ্গীতই সেই মোক্ষ, যাকে ছুঁতে পারে মানুষ। মহাভারতে দ্রোণাচার্য যাঁকে আমরা সাধু সন্ন্যাসী বলে মনে করি, তিনিও তাঁর নিজের শিষ্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। ঈশ্বর এবং মানুষ এরা দুই ভিন্ন, এদের কখনও এক করা যায় না। আমি তাই কোনওভাবেই দুটোর মধ্যে, সম্পর্ক স্থাপন করতে চাই না। আমি একটা পথে চলার চেষ্টা করছি যার কোনও সীমা নেই। সীমার মাঝে অসীমকে পেতে চাই আমি। আর এই যাত্রায় আমি কেবল এক ছাত্র মাত্র। প্রত্যেকদিনই নতুন কিছু শিখছি। আমার লক্ষ্য পূর্ণতা অর্জন করা তবে কখনওই সেটা পেতে চাই না। আমার চলার পথটিকে আরও দীর্ঘ করতে চাই।
আপনি যখন তবলা বাজান তখন মনে হয় আপনার হাত দুটি কথা বলছে। আপনি কি মনে করেন যন্ত্রের আলাদা সত্তা আছে?
প্রত্যেক যন্ত্রের এক নিজস্ব আত্মা আছে, শক্তি আছে। প্রতিষ্ঠিত শিল্পীকে মঞ্চে ওঠার আগে বলা হয় ‘গুডলাক গুরুজি’, তাঁরা উত্তর দেন আমি জানি না আজ আমার যন্ত্র কী বলবে। সবাই জানে যে যন্ত্রের এক নিজস্ব সত্তা আছে, আর নিজস্ব সত্তা থাকলে তো সে নিজের মতো করে নিজের কথা বলবে। ভাল লাগুক বা খারাপ সে যা কথা বলতে চায় তাই বলবে। যেদিন সে তোমায় ধারণ করবে সেদিন তুমি বলবে আর যেদিন করবে না সেদিন সে নির্বাক। আমার হাত কথা বলে কারণ আমার যন্ত্রের আত্মা তাকে দিয়ে কথা বলায়।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবর্তনশীল। একদিকে রয়েছে আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস। অন্যদিকে, সমসাময়িক পরিবর্তন। স্বাধীনতার আগে এই সঙ্গীত শুধুমাত্র ধনী অভিজাত বাড়ি বা কোঠার চারদেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। স্বাধীনতার পর আস্তে আস্তে মঞ্চস্থ হতে লাগল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রূপ খানিকটা বদলে গেল। এখনও পরিবর্তন ঘটে চলেছে। আর এরই মধ্যে খানিকটা শোবিজও চলে এসেছে… এটা আপনার কেমন লাগে?
হ্যাঁ, আমি মানি যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পরিবর্তন ঘটে চলেছে। আপনি তো একজনের অনুষ্ঠান দেখতে যাচ্ছেন। একটা শো-তে আপনি কেন যান? বিনোদনের জন্য। আর দর্শকরাই তো চান যে আমরা নিজেদের পরিণত করি, ম্যাচিওর করি। আর শো-তে যখন আসছেন তখন শিল্পীদের প্রেজেনটেবল তো হতেই হবে।
না, আমি বলতে চাইছিলাম যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তো একটু রক্ষণশীল।
না, একেবারেই তা নয়। হ্যাঁ তবে কিছু সীমা অবশ্যই আছে। সেই সীমারেখার মধ্যে থেকে নতুনভাবে গড়ার স্বাধীনতা সবারই আছে। এখন যদি বলেন যে রাগের রূপের পরিবর্তন করব, তা তো ঠিক নয়। রাগের বেসিক কাঠামোকে বজায় রেখে তাকে পুনর্গঠিত করুন, পুনর্নির্মাণ করুন। এত স্বাধীনতার পর কী করে বলেন যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত রক্ষণশীল?
আপনাকে তো ফিউশনের মায়েস্ট্রো বলা হয়।
আমি কোনও কিছুরই মায়েস্ট্রো নই। আমি ফিউশনের ছাত্র, যাবতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ছাত্র। আমার গুরু আমাকে সবসময় একজন ভাল ছাত্র হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি তাঁর এই নির্দেশ সবসময় মেনে চলতে চেষ্টা করি।
আপনার মনকে কে নাড়া দেয় বেশি– ফিউশন না ভারতী শাস্ত্রীয় তাল?
দুটোই। আমি সঙ্গীতে বিশ্বাসী। কোনও ভেদাভেদে নয়। আমি জানি না কেন এই ভেদাভেদ? আচ্ছা বাঙালি না হলে রবীন্দ্রসংগীতের ধুন বাজানো যায় না? একজন উত্তর ভারতীয় যখন দক্ষিণ ভারতীয় তাল বাজান, সেটাও তো ফিউশন। পূর্ব পশ্চিমের মেলবন্ধনও তো ফিউশন। আমার মনে হয় এটা একটা বড় পজিটিভ সাইন। আসলে সঙ্গীতে ভেদাভেদ খাটে না। সেখানে সমন্বয় শেষ কথা। আমার মনে হয় এই ভেদাভেদটা খানিকটা মিডিয়ার করা।
আপনি তো নানা জায়গায় যান। দেশে বিদেশে আপনার প্রচুর ছাত্রছাত্রীও আছে। আপনার কী মনে হয়, ভারতীয় যুবকরা তবলা না ড্রাম, কোন যন্ত্রের দিকে বেশি আকৃষ্ট?
ছন্দ সার্বজনীন ও সহজ। তাই খুব স্বাভাবিকভাবে মানুষকে আকৃষ্ট করে। যে কোনও গান– সে বলিউড-এর হোক বা টলিউড-এর, তার মধ্যে যদি একটা ক্যান্ডি রিদম থাকে তবে তা হিট হবেই। ছন্দের মধ্যে দিয়ে খুব সহজেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা যায়। এর জন্যেই মানুষ এত ছন্দের অনুরাগী। আমি জানি না এটা ভাল কি মন্দ, তবে এটুকু বলতে পারি আমাদের মতো ছন্দ বাদকদের কাছে এটা সৌভাগ্য।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পীদের বেশির ভাগ সময় কাটে বিদেশে। শুধু অনুষ্ঠানের সিজনে তাদেরকে আমরা পাই। এরকম অবস্থা কেন?
কেন? কারণ মিডিয়া এই সিনারিও তৈরি করেছে। যখন কোনও ভারতীয় শিল্পী গ্র্যামি পায় মিডিয়া তাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে। মিডিয়াই তো পশ্চিমকে প্রাধান্য দেয় বেশি। রবিশঙ্করজির কাছে যখন জর্জ হ্যারিসন ছাত্র হিসাবে যান তখন তাই নিয়ে মিডিয়ার কী মাতামাতি। এর আগে তাঁকে কোনওদিনও কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি।
আমাদের দেশে প্রচুর গুণী শিল্পী আছেন। যেহেতু তাঁরা কে বিদেশে যাননি তাই তাদের নিয়ে কেউ লেখেন না। এরকম অবস্থায় শিল্পীরা তো বিদেশে যেতে বাধ্য। কারণ, বিদেশে না গেলে মিডিয়া শিল্পীকে যথাযোগ্য সম্মান দেয় না।
আমাদের দেশে কিছু নামকরা শিল্পীদের ছেলেমেয়েদের নিয়েই খালি লেখালেখি হয়। আমরা কিছু ভাগ্যবান, যাদের পিতা বা গুরু নামকরা শিল্পী ছিলেন। এই জন্য মিডিয়া আমাদের নিয়ে কথা বলে।
আমার মনে হয় মিডিয়া শুড গো আপ অ্যান্ড ফাইন্ড ইয়াং ট্যালেন্টেড গ্রেট আর্টিস্টস। মিডিয়া পাশে দাঁড়াক এইসব প্রতিভাবানদের। একমাত্র তাহলেই নতুন করে অক্সিজেন পাবে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত।
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..