১৯৯৭-এর ৩ ফেব্রুয়ারি। বাবার হাত ধরে বইমেলায় আসা একরত্তি মেয়েটার যাবতীয় খুশি কেড়ে নিয়েছিল আগুনের লেলিহান গ্রাস। সেই ভয়াবহ স্মৃতি আজও তাড়া করে বেড়ায় সেদিনের মেয়েটিকে। ‘রোববার.ইন’-এ ‘বইমেলাধুলো’ সিরিজের লেখা পড়ে সেই অতীত-অভিজ্ঞতাই চিঠিতে তুলে ধরলেন সেদিনের সেই কিশোরী, সুমেধা চট্টোপাধ্যায়।
ছোট থেকে বড় হওয়ার যাত্রাপথে আমার জীবনে বইমেলার অনেক স্মৃতি। বাবার হাত ধরে বইমেলায় প্রথম গিয়েছিলাম– আমি তখন ক্লাস ফোর– আমি তখন আট– বাবার সঙ্গে একটি ছোট মেয়ে ময়দানের পথে মেট্রো ধরত।
আমরা থাকতাম উত্তর শহরতলিতে। নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশন বেলগাছিয়া। জানুয়ারির শেষে দু’টি রবিবারের মেট্রোর ভিড়, ময়দান অভিমুখী হয়৷ কোভিডকালের সময়টুকু বাদ দিলে এখনও সেই রীতি বহাল। আগে শনি-রবির দুপুরে টালিগঞ্জ মেট্রো অভিমুখে ট্রেনে ভিড় মানেই তারা বইমেলা যাবে। ময়দানের ধুলো খেতে খেতে বইমেলায় ঘোরা, এক মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা ছিল।
বইমেলা থেকে বাবার প্রথম কিনে দেওয়া বই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনির বই’। আমার প্রথম পরিচয় ‘রায় পরিবার’-এর সঙ্গে। আমি প্রথমে ফেলুদা পড়িনি, প্রথমে টুনটুনির বই-ই পড়েছিলাম। বাবা দু’টো কি তিনটে বই কিনে দিতেন, খুব আনন্দ করে সারাবছর সেগুলি পড়তাম। অবাক হয়ে যেতাম যেদিনই বইমেলা যাই না কেন, পরিচিত কারও না কারও সঙ্গে দেখা হয়েই যেত। বাবাকে তখন অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘এরা জানত আমরা আজ আসব?’ এভাবে আস্তে আস্তে বইমেলার সঙ্গে বাবার হাত ধরেই আত্মিক পরিচয়।
এইরকমই একদিন, ১৯৯৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বইমেলা গিয়েছিলাম বাবার সঙ্গে। আমি কিশোর বয়স থেকেই সুচিত্রা ভট্টাচার্যর বই পড়তাম। গিয়ে খুঁজতাম, কোন প্রকাশনী থেকে ওঁর নতুন বই প্রকাশিত হল। সেরকমই নতুন বেরোনো দুটি বই নিয়ে একটা কোকের ক্যান হাতে নিয়েছি– লাগিয়েছি দু’-এক চুমুক। হঠাৎ দেখি, বেশ কিছু স্টল ঝপাঝপ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি আর বাবা দুজনেই অবাক হলাম। তখন একজন লোক দৌড়ে পাশ দিয়ে গেল বলতে বলতে, ‘বেরিয়ে যান। বইমেলায় আগুন লেগেছে!’ কয়েক মিনিটের মধ্যে একই কথা মাইকে বলতে লাগল। এক মারাত্মক ব্যস্ততা এবং দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল সমগ্র মেলা জুড়ে। আমরা চটজলদি দুটি স্টলের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে বইমেলার পিছনে ময়দানের ফাঁকা অংশে বেরিয়ে এলাম। ধোঁয়া উঠছে একটা বড় জায়গা থেকে। বেরিয়ে এসে বইমেলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে যে দৃশ্য সেদিন দেখেছিলাম, আজ প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় এসেও তা ভুলতে পারিনি। আমরা দেখলাম দাউ-দাউ করে কিছু স্টল জ্বলছে। আমার সামনে ডানদিক থেকে বাঁ-দিকে আগুন এগোচ্ছে এবং আগুন যেদিকে এগোচ্ছে খানিক দূরের স্টলগুলি থেকে একজন লোক বইগুলি ছুড়ে ছুড়ে আমাদের দিকে মানে নিরাপদ জায়গায় ফেলছে। যতটা বাঁচাতে পারে আর কি! সবে তখন ভৌতবিজ্ঞানে পড়েছি– বই এবং স্টলের সমস্ত উপকরণই প্রকৃতপক্ষে ‘দাহ্য’ বা ‘inflmmable’। আগুন এগোচ্ছে, আর সেই ব্যক্তিটিও বই ছুড়ে দিতে দিতে পিছোচ্ছে। এই দৃশ্য আমাকে এরপরের বেশ কয়েক রাত ঘুমোতে দেয়নি। ছোট ছিলাম– আমার কিশোর বয়সের বইমেলাকে চোখের সামনে এভাবে পুড়ে যেতে দেখে খুব আঘাত লেগেছিল মনে। মনে আছে, বাবা মাঝে মাঝে আমার চোখ চেপে ধরছিলেন হাত দিয়ে। পরে জেনেছিলাম, কয়েক কোটি টাকার বই সেদিন পুড়ে গিয়েছিল। হাতেগোনা কয়েকটি দোকানে নাকি কার্ড পাঞ্চিং মেশিন ছিল। তাও বাঁচেনি আগুনের লেলিহান গ্রাস থেকে। কিছু ছেলেমেয়েরা হাউ-হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমরা যে গলি দিয়ে বেরিয়েছিলাম, সেটি দিয়েই বেরিয়ে এল বইমেলা থেকে। শুনলাম তাদের স্টল থেকে তারা কিছুই প্রায় বাঁচাতে পারেনি। বাবা বাড়ি ফিরে বলেছিলেন যে, সন্তান হারালে এইভাবে কেউ কাঁদে।
সেদিন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরেছিলাম। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবার মেলার ব্যবস্থা করেছিলেন খুব কম সময়ের মধ্যে। কিন্তু আমি তারপরের বেশ কয়েকমাস খুব বিমর্ষ ছিলাম। মা-বাবা রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন, সঙ্গে বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন। বাবাকে অনেক বই বাড়িতে মলাট করতে দেখতাম ট্রান্সপারেন্ট-শিট দিয়ে। তাই এত সাধের সব বই নষ্ট হয়ে গেল দেখে আর নিতে পারিনি। বাড়ি ফিরে নীরবে চোখে জল এসে গিয়েছিল। ‘Memorable Incident’-এর রচনা এলে এই দিনের কথাই লিখতাম।
এরপর যখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে এলাম, তখন দু’-তিনবার ময়দানের বইমেলায় বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছি। একইভাবে ঘুরেছি, যেভাবে বাবার সঙ্গে গেলে ঘুরতাম। কিন্তু সেই লেলিহান বিভীষিকা ফিরে ফিরে আসত মনে। তারপর বেশ কয়েক বছর মেলা ময়দান থেকে সরে গিয়ে বাইপাসের সায়েন্স সিটির কাছে পার্ক সার্কাস কানেক্টারে ‘মিলনমেলা’য় হত। বেশ জ্যামে পড়তে হত সপ্তাহের মাঝের দিনগুলিতে। ময়দান থেকে আস্তে আস্তে বইমেলা স্থায়ীভাবে সরে গেল, সরকার জানাল মাঠের খুব ক্ষতি হচ্ছে তাই বইমেলা বন্ধ হবে। মিলনমেলা প্রাঙ্গণই তখনকার জন্য ঠিক হল। মাঝে আবার একবার সল্টলেক স্টেডিয়ামে হল। আমরা অফিস থেকে দল বেঁধে গিয়েছিলাম। একদম ভালো লাগেনি। দোকানগুলোর বিক্রিবাটাও ভালো হয়নি শুনেছিলাম। আসলে স্টেডিয়ামের মতো বদ্ধ জায়গার বদলে খোলা মাঠেই বইমেলা বরাবর স্বচ্ছন্দ।
গত কয়েক বছর ধরে বইমেলা হয় সল্টলেকের করুণাময়ী মেলা-গ্রাউন্ডে। এটিকে বইমেলা প্রাঙ্গণ নাম দেওয়া হয়েছে। এখন বইমেলায় ক’জন লোক বই কিনতে যান সেই নিয়ে সন্দেহ আছে। ঘুরতে, খেতে বা স্ট্যাটাস আপডেট দিতেই যান হয়ত বেশি। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, ছোটবেলায় বইমেলায় কত ছাড় দেবে তা নিয়ে কখনও আমরা ভাবতাম না। দু’-তিনটি বই কখনও কখনও খানপাঁচেকও বাবা এমনিই কিনে দিতেন। এখন দেখি অনেকেই বলেন, ‘মেলা থেকে কিনব না, ছাড় বেশি দেয় না।’
গত দু’বছর বইমেলায় কিছুটা সময় কাটাই নিজের লেখা খানচারেক বই-এর সঙ্গে। সমরেশ মজুমদার, শংকর, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, নারায়ণ দেবনাথ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সকলকে দেখতাম তাদের বইয়ের স্টলের বাইরে অবিরত সই দিতেন। ইচ্ছা ছিল জীবনে একবার একটি বইতে পাঠককে লিখে দেব। সেই ইচ্ছা গত দু’বছরে পূরণ হয়েছে। অনেক লেখককে উঠতে দেখেছি, আবার অনেককে হারিয়ে যেতেও দেখেছি। সেই বাবার হাত ধরে বইমেলায় যে ছোট্ট পাঠক মেয়েটি যেত, সে আজ হাতে ধরে বয়স্ক মা-বাবাকে নিজের বই দেখাতে নিয়ে যায়। বিবর্তনের ধারা বজায় থাকলেও আনন্দের মাঝে সেই দোকানির বই বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা আর বইপ্রেমীদের হাহাকারের দৃশ্য চোখে ভাসে মাঝে মাঝেই।