বার্ধক্যের কাঁপা কাঁপা হাতে শিল্পী সেই বাঙালির কথা বলে চলেন যার মধ্যে মাছ খাওয়া নিয়ে কোনও হীনম্মন্যতা ছিল না। বাঙালির মাছ খাওয়া নিয়ে উত্তর ভারতীয় বিদ্বেষ সেই যুগে থাকলেও বাঙালি কখনও নদীর ফল থেকে মুখ সরিয়ে নেয়নি। বরং রন্ধনের বৈচিত্রে নিজের মৎস্যরসনার বিলাসকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। বর্তমান সময়ে ‘মটন-মছলি-মঙ্গলসূত্র’ বলে বাঙালির মাছ খাওয়াকে গাল দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নিজের শিল্প সত্তায় বাঙালির মৎস্য বিলাসকে আলোকিত করে রেখেছেন শিশুরানি পাল। তার তৈরি কাঁচামাটি ছাঁচের রঙিন পুতুলের মধ্যেই রয়ে গিয়েছে একটা জাতির জাত্যভিমান।
নদীর ফল মাছকে বহু যুগ আগেই বাঙালি আপন করে নিয়েছে নিজের রন্ধনশৈলীতে। উত্তর ভারতের তীব্র তিরস্কারকে অগ্রাহ্য করে নিজের শিল্প-সাহিত্য ও সমাজ জীবনে বাঙালি তার মাছপ্রীতি বজায় রেখেছে। চ্যাট জিপিটির যুগেও বেহুলা-লখিন্দরের বিয়ের মেনুতে কত রকমের মাছের পদ ছিল, তা জানতে এখনও উত্তাল হয়ে ওঠে তরুণ প্রজন্মের বঙ্গমন। স্বামী বিবেকানন্দ, কাজী নজরুল ইসলামের মাছপ্রীতি হোক বা ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় মৎস্য বিলাস বা বাঙালির মাছ খাওয়াকে অবাক চোখে না দেখার বার্তা দিয়ে যাওয়া নীহাররঞ্জন রায়– প্রতিটি শতাব্দীর বুকে এভাবেই বাঙালি নিজের মাছ খাওয়ার ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আর তারই প্রভাব পড়েছে বাংলার মাটির পুতুল নির্মাণের শৈলীতে।
আনমনে ভাটিয়ালি সুরে দাঁড় বেয়ে চলেছেন মাঝি। নৌকো ভরা রুপোলি ফসল। পদ্মা নদীর বুকের উপর দিয়ে মাছ বোঝাই নৌকোর এমন দৃশ্য দেখে আত্মতৃপ্তি পেত বাঙালি। সেই দৃশ্যই নিজের পুতুল নির্মাণের মাধ্যমে দশকের পর দর্শক ধরে ফুটিয়ে তুলে চলেছেন উত্তর ২৪ পরগনার বেলঘরিয়া আলিপুর নিমতা কুমোরটুলির বরিষ্ঠ মৃৎশিল্পী শিশুরানি পাল। পূর্ববঙ্গের ফেলে আসা পরম্পরাগত বংশানুক্রমিক স্মৃতির ওপর নির্ভর করেই পুতুল তৈরি করেন তিনি। তার পুতুল তৈরিতে মাছের সঙ্গে বাঙালির আত্মিক টানের অকাট্য প্রমাণ বারে বারে প্রস্ফুটিত হয়েছে। মাছের বাজারে বড় বটিতে বিশালাকায় কাতলা মাছ কাটা। দৈনন্দিন বঙ্গ জীবনের অত্যন্ত চেনা এই ছবি নিজের পুতুল নির্মাণে তুলে ধরেছেন। এখানে মাছ বিক্রেতা মাথায় পাগড়ি। পরনে খাটো ধুতি এবং ঊর্ধ্বাঙ্গ আবৃত বোতামহীন ফতুয়ায়। হেঁশেলে বঙ্গ রমণীর এক প্যাঁচ-দেওয়া শাড়ি পরে মাছ কোটার দৃশ্যটি নিজের পুতুল নির্মাণে অঙ্কিত করেছেন। নদীর ঘাট থেকে মাছগুলিকে জেলেদের নৌকো থেকে সংগ্রহ করে হাটে নিয়ে যেতে গরুর গাড়ির প্রয়োজন হতো গ্রামীণ বাংলায়। সেই গরুর গাড়ি বোঝাই মাছ নিয়ে যাওয়ার নাটকীয় অভিব্যক্তির দেখা তার পুতুল নির্মাণে লক্ষণীয়। শিল্পী শিশুরানি পালের তৈরি পুতুলগুলির মধ্যে সপ্তদশ, অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার ছবি দেখা যায়। বুকে পেসমেকার নিয়ে শিল্পী এখনও সেই বাংলার কথা বলে চলে যেখানে পিৎজা বার্গারের অনুপ্রবেশ ছিল না। ঢাকা থেকে কাঁটাতার পেরিয়ে পেট্রাপোল-বেনাপোল হয়ে এপার বাংলা কবে ইলিশের দেখা পাবে সেই উৎকণ্ঠা ছিল না। বার্ধক্যের কাঁপা কাঁপা হাতে শিল্পী সেই বাঙালির কথা বলে চলেন যার মধ্যে মাছ খাওয়া নিয়ে কোনও হীনম্মন্যতা ছিল না। বাঙালির মাছ খাওয়া নিয়ে উত্তর ভারতীয় বিদ্বেষ সেই যুগে থাকলেও বাঙালি কখনও নদীর ফল থেকে মুখ সরিয়ে নেয়নি। বরং রন্ধনের বৈচিত্রে নিজের মৎস্যরসনার বিলাসকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। বর্তমান সময়ে ‘মটন-মছলি-মঙ্গলসূত্র’ বলে বাঙালির মাছ খাওয়াকে গাল দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নিজের শিল্প সত্তায় বাঙালির মৎস্য বিলাসকে আলোকিত করে রেখেছেন শিশুরানি পাল। তার তৈরি কাঁচামাটি ছাঁচের রঙিন পুতুলের মধ্যেই রয়ে গিয়েছে একটা জাতির জাত্যভিমান।
ইন্ডাকশন ওভেন তখনও বাঙালির রান্না ঘরের শোভা বাড়ায়নি। মাটির উনুন মধ্যে দিয়েই এ বাংলার নিজস্ব রন্ধনশৈলী বিকশিত হয়েছিল। মাটির উনুনের উপর কড়াই চাপিয়ে রুই মাছের পেটি দিয়ে বঙ্গ গৃহবধূর মাছের ঝোল রান্নার দৃশ্য শৈল্পিক আঙ্গিকে নিজের পুতুল শৈলীর মধ্যে দিয়ে প্রতি বছর রথ এবং ঝুলন উৎসবের মরশুমে তুলে ধরেন শিশুরানি পালের ছোট জা আরতি পাল। মাছের ঝোল রান্নার পুতুলে এক প্যাঁচ দিয়ে বঙ্গ গৃহবধূর লাল রঙের শাড়ির মধ্যে তুলির টানে সরল কারুকার্য করেছেন শিল্পী আরতি পাল।
বাংলাদেশের ঢাকা-সহ অন্যান্য জনপদে এখনও গোটা মাছ কিনে নেওয়ার রীতি রয়েছে। বেতের ঝুড়িতে গোটা কাতলা, ইলিশ, রুই মাছ বিক্রির পুতুল শিল্পীর হাতে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। পাশাপাশি জেলেদের সংগ্রামময় জীবনকেও গুরুত্ব দিয়েছেন শিল্পী। নদী থেকে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য নিজের পুতুল শৈলীতে তুলে ধরেছেন সুনিপন ছন্দে। তার জেলে পুতুলের গায়ের রঙ কৃষ্ণবর্ণ। গলায় কালো সুতোর মাদুলি। মাথায় পাগড়ি। কপালে চন্দনের ফোঁটা। নির্মেদ শরীর আবৃত খাটো ধুতিতে। আরতি পালের তৈরি মাছ বিক্রেতা এবং মাছ রান্নায় ব্যস্ত গৃহবধূ পুতুলে গায়ের রঙ যেখানে ফরসা সেখানে তার তৈরি জেলে পুতুল কৃষ্ণবর্ণ। সমাজের শ্রেণিবিন্যাসকে এর মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন শিল্পী। তপ্ত রোদে কোমর জলে দাঁড়িয়ে জাল ফেলে মাছ তোলা। এই পরিশ্রম করতে গিয়ে জেলে পুতুলের গায়ের রঙ কৃষ্ণ বর্ণ হয়ে গিয়েছে।
জেলে পুতুলে শ্রমজীবী মানুষের মরিয়া লড়াইকে তুলে ধরেছেন শিল্পী আরতি পাল। অন্যদিকে বিলাসী বাবুদের ছিপ ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য এ বাংলায় এখনও বর্তমান। মাছ নিয়ে বাঙালির বিলাসী ও অবসরের দৃষ্টিকোণকে নিজের পুতুল নির্মাণে অঙ্কিত করেছেন হুগলি জেলার শ্রীরামপুর নগাঁ মাঠপাড়ার সদগোপ পাড়ার শিল্পী সন্টু পাল। ছিপ দিয়ে মাছ তোলা পুতুলের শরীর স্থূল। বসার ভঙ্গিমায় অলস ভাব। কপালে লাল টিকা। এর মাধ্যমে শিল্পী পুতুলটির শাক্ত প্রীতিকে তুলে ধরেছেন। অনাবৃত শরীরে বস্ত্র বলতে শুধু খাটো ধুতি রয়েছে। পুতুলটির মাথার চুলের শৈলী থেকে স্পষ্ট যে শিল্পী মাঝবয়সি বাঙালির মাছ ধরার শিশুসুলভ আনন্দকে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
একই শৈলী দেখা যায় শ্রীরামপুরের রাজ্যধরপুরের শিল্পী আরতি পালের তৈরি ছিপ দিয়ে মাছ তোলা পুতুলে। সন্টু পালের মতো আরতি দেবীর পুতুলটি স্থূল হলেও পরিপাটি করে ধুতি পরে রয়েছে। ছিপ ফেলে মাছ তোলা পুতুলের স্থূলতার ছবি আমরা দেখতে পাই কলকাতার ঐতিহ্যশালী কুমোরটুলি শিল্পী অনিমা ও মায়া পালের তৈরি পুতুলে। যদিও তাদের তৈরি পুতুলের মাথায় পাগড়ি রয়েছে। কুমোরটুলির এই দুই প্রতিভাবান শিল্পী তৈরি পুতুলে মাছের বাজারে বঁটি দিয়ে মাছ কাটার দৃশ্য। বটির মধ্যে থেকে চুঁইয়ে পড়ছে টাটকা রক্ত। মাছের দেহাংশ দু’টুকরো হয়ে পড়ে রয়েছে। মাছের চোখটি টানা টানা। কলকাতার আদিম পটচিত্রের শৈলির ভাব এখানে প্রস্ফুটিত। মাছ বিক্রেতার কপালে রক্ত টিকা। পরনে ফতুয়া এবং ধুতি। মাছ বিক্রেতার শাক্ত ভক্তিকে শিল্পী এই লাল টিকার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
মাথায় করে বিশালাকায় কাতলা ও রুই মাছ নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আঠারো এবং উনিশ শতকে দেখা যেত। এখনও দিঘা মোহনায় বিশালাকায় মাছ এলে যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়, তা বাংলার বংশানুক্রমিক উচ্ছাস। নদীয়ার নিমাই তীর্থ নবদ্বীপের শ্রীবাসঅঙ্গন চড়ার বরিষ্ঠ মৃৎশিল্পী নিমাই পালের তৈরি পুতুলে সেই চঞ্চলতা দেখা যায়। মাথায় করে বিশালাকায় কাতলা মাছ নিয়ে যাচ্ছে এক বাঙালি পুরুষ। তার চুলের শৈলী উনিশ শতকের আমেজ রয়েছে। মুখের অভিব্যক্তিতে আহ্লাদ রয়েছে। গলায় মাদুল। শরীর শ্রমজীবী মানুষের মতো নির্মেদ।
মাছ বাঙালির রূপকথার জগতকেও আলোকিত করে রেখেছে। আর সেই আবেশে মজে মৎস্যকন্যা তৈরি করেন হুগলি জেলার চুঁচুড়ার মৃৎশিল্পী উজ্জ্বল পাল। বিশালাকায় মাছের মুখ থেকে বেরিয়ে রয়েছে এক রমণীর মুখমণ্ডল। তার মাথায় মুকুট। কপালে লাল টিপ। প্রথম দেখাতেই মা গঙ্গা বলে ভুল হতে পারে তবে শিল্পী শুধরে দিয়ে প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন এটি মৎস্যকন্যা পুতুল।
রুই, কাতলা, ইলিশের জগতে নিজের মহিমা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বজায় রেখে চলেছে চিংড়ি মাছ। বাংলার পুতুল শিল্পে চিংড়ি মাছের শৈল্পিকতা অনন্য উচ্চতায় রয়েছে। দেখে মনে হবে জীবন্ত মাছ। কিন্তু সে জীবন্ত নয় নিছক মাটির একটি পুতুল। এই জীবন্ত ভাব তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে শিল্পীর অনবদ্য তুলির ছোঁয়ার প্রতিভাকে আমরা বুঝতে পারি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর মজিলপুরের শিল্পী রবিন দাস এবং উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটির হরিনগর কলোনির শিল্পী নিরঞ্জন পালের হাতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে চিংড়ি।
বাংলার পুতুলে সমাজ চিত্র তুলে ধরার যে প্রয়াস বিভিন্ন জেলার শিল্পীরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে করে গিয়েছে তার নিদর্শন শিল্প সাধনার ইতিহাসে থেকে যাবে। মাছ ছাড়া বাঙালিদের যে একদিনও চলে না, সেই ভাবনায় শিল্পীরা নিজেদের তুলির টানে তুলে ধরেছেন।