দেশীয় ধানের নামেই গর্বিত আউশগ্রাম! গ্রামনামও হয়েছে সে কারণেই। আর সেই জলা, জঙ্গলের আউশগ্রামে একসময় এসেছিলেন ইংরেজ ব্যবসায়ী জন চিপ! মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও এসেছিলেন আউশগ্রামের ডাঙায়। লোককথায় আজও সেই শ্লোকের ছটা ফেরে।
ইতিহাসের আউশগ্রাম! পূর্ব বর্ধমানের শুধু নয়, বাংলার একমাত্র শস্যগোলা। যার একদিকে অজয় নদ, প্রাচীন অজাবতী অন্যদিকে দামোদর নদ। সেই আউশগ্রাম নামের উৎসের ইতিহাসের সঙ্গে সেই সব তথ্য জড়িয়ে! ধূসর ইতিহাসের প্রান্তরে গদ্যের ফুঁপি খোঁজা।
‘আউশ’ শব্দের অর্থ আগাম। ৮০ থেকে ১২০ দিনের ভেতর যে ধান পেকে যায়, হেমন্তের দিনের সেই ধানকেই বলে ‘আউশ’। এই নামেই ডাকা হয় উন্নত ফলনের সেই পুরনো দেশি ধানকে। তাই দ্রুত (আশু) ফসলে উৎপন্ন হওয়ার বিচারে এই দেশীয় ধানের নামকরণ হয়েছিল সেকালে ‘আউশ’। আর এই ধান আউশগ্রাম অঞ্চলে কুনুর, অজয় অববাহিকায় বেশি চাষাবাদ হত বলে এই অঞ্চলের এমন নামকরণ হয়। ধান নামেই গোপভূমের এই প্রাচীন অঞ্চলের নাম ‘আউশগ্রাম’।
তবে সুকুমার সেনের মতে, আবৃষ+গ্রামে > আউশ গা। যেখানে ঠিক মতো বৃষ্টি হত না! তবে আবার ‘আবৃষ’ শব্দটির অর্থ হল ‘সূর্য রশ্মির মতো সুন্দর, ঝলমলে, দীপ্ত’। এটি একটি বিশেষ নামের অংশ, যেখানে ‘আবৃষ’ নামটি সুন্দর আর উজ্জ্বলতার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ধানের গাছ পাকলে আর সেখানে সূর্যরশ্মি পড়লে এমনই রং ধরে। ‘আবৃষ’ শব্দটির অর্থ হতে পারে আবরণ, ঢেকে রাখা, বা আবৃত করাও। এই সব কিছুর ভিতর ধানের সৌন্দর্যময় পরিবেশটি রয়েছে হারিয়ে।
রেনেল সাহেবের ম্যাপেও এই অঞ্চলের প্রাচীনত্বের নাম উল্লেখিত রয়েছে। প্রাচীন কালে এই অঞ্চলে ১২৭ রকমের দেশীয় ধান চাষ হত! যা সত্যিই জেলা নয়, গোটা অখণ্ড বাংলায় সেই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গর্বের সঙ্গে। প্রাচীন আউশগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মঙ্গলকাব্যে-যুগের বৃদ্ধা নদীর যে প্রাচীন গতিপথ আমরা পাই (নরসিংহ বসুর ধর্মমঙ্গল) এবং কুনুর নদীর শাখা নদী হয়ে যাওয়া পাঁচটি নদীর সমন্বয়ের সংযোগস্থল পঞ্চগঙ্গার মধ্যবর্তী তটে, একসময় আউশ ধানের পাশাপাশি পঙ্কজ, রূপশালী, রত্না, জয়া, কল্মা, ঝিঙ্গেশাল, খুদেলাগরা, ডহরলাগরা, মুরগিবালাম, সীতা, ধানের চাষ হত রমরমিয়ে। আর এই সবের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আউশগ্রামের গ্রামনাম।
…………………………………..
সুকুমার সেনের মতে, আবৃষ+গ্রামে > আউশ গা। যেখানে ঠিক মতো বৃষ্টি হত না! তবে আবার ‘আবৃষ’ শব্দটির অর্থ হল ‘সূর্য রশ্মির মতো সুন্দর, ঝলমলে, দীপ্ত’। এটি একটি বিশেষ নামের অংশ, যেখানে ‘আবৃষ’ নামটি সুন্দর আর উজ্জ্বলতার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ধানের গাছ পাকলে আর সেখানে সূর্যরশ্মি পড়লে এমনই রং ধরে। ‘আবৃষ’ শব্দটির অর্থ হতে পারে আবরণ, ঢেকে রাখা, বা আবৃত করাও। এই সব কিছুর ভিতর ধানের সৌন্দর্যময় পরিবেশটি রয়েছে হারিয়ে।
…………………………………..
জেলার উত্তর অংশে কাঁকসা কেতুগ্রাম সমভূমিতে আউশগ্রাম অবস্থিত। পূর্ব বর্ধমান সদর উত্তর মহকুমার উত্তরে অজয় নদীর তীরে অবস্থিত কাঁকসা, কেতুগ্রাম সমভূমি থেকে শুরু করে জেলার কেন্দ্রীয় সমভূমি বর্ধমান সমভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত এই তট, সেখান থেকে দক্ষিণ এবং পূর্বে দামোদর নদী রয়েছে। একসময় এই আউশগ্রামের নিয়ন্ত্রক ছিলেন জন চিপ। তখনও জেলার সীমানা ভাগ হয়নি। এই গোপভূমের আউশগ্রাম ছিল মধ্য-রাঢ়ের অংশ। ১৭৮২ সালে বোলপুরে আসেন ইংরেজ ব্যবসায়ী জন চিপ। যার নামে এখনও বোলপুরের উপকণ্ঠেই রয়েছে সেই ইতিহাসের সুরুল চিপকুঠি। ওই অঞ্চলেই তখন কাছাকাছি দু’টি কুঠিবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল। যার একটিতে থাকতেন চিপ সাহেব আর অন্যটি থেকে ফরাসি ব্যবসায়ী মনলি সিনর ব্যবসা পরিচালনা করতেন। পরবর্তীতে এই মনলির কুঠি বাড়িটিকে বিশ্বভারতী অধিগ্রহণ করে নেয়। এই ব্যবসায়ী জন চিপের হাত ধরেই ক্ষমতাসীন চিপ নিজেকে একসময় প্রতিষ্ঠা করেন। আর চিপকুঠি থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করতে শুরু করেন।
তাঁর উদ্যোগেই ইংরেজদের ক্ষমতা ধরে রাখতে বন্যা কবলিত আউশগ্রামের ডাঙায় তৈরি হয় ‘থানা’।
তখনও ‘থানা’ বলা হত না– ‘কোটালি’ বা ‘দিহি’ বলতেন শাসক চিপ! সেই শুরু! আউশগ্রামের বিস্তীর্ণ বন্যা কবলিত এলাকার শাসনকাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আউশগ্রামের ডাঙার উঁচু স্থানের কোটালিটি।
একসময় আউশগ্রামের এই লাল মাটির টানে, এখানকার গভীর জঙ্গলভূমির প্রান্তরকে নতুন করে জীবন দিতে এসে ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সময়কাল না জানা গেলেও তিনি যে অজয়ের নদীপথে আউশগ্রামের ডাঙায় এসেছিলেন আর তাঁর নেপথ্যে ব্যবসায়ী জন চিপের কোনও ভূমিকা ছিল না, এমনটা বলা কঠিন। কথা ছিল তাঁর সাধনভূমি তিনি আউশগ্রামেই তৈরি করবেন! কিন্তু সেই সময়ের আউশগ্রামের মানুষের ব্যবহারে রুষ্ট হয়ে তিনি ফিরে যান। পরে রায়পুরের সিংহবাড়ির কাছ থেকে নামমাত্র অর্থে জমি কিনে সেই জমিতে ব্রাহ্ম উপাসনার জন্য শান্তিনিকেতন গৃহ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই শুরু করেন সাধনা! আর পিতার তৈরি সেই আশ্রমকেই পূর্ণাঙ্গ অবয়ব প্রদান করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথমে ব্রহ্ম চর্যাশ্রম এবং পরে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করলেন কবি। আর সেখান থেকেই ধীরে ধীরে আজকের চেহারায় বিবর্তিত হতে শুরু করে বোলপুর! পুরনো দিনের আউশগ্রামবাসীদের মনে লৌকিক ইতিহাসের এই ক্ষত আজও দগদগ করে বাজে!
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মুঘল আমল বা তারও আগে থেকেই লোহা ও লাক্ষা শিল্পের জন্য দূরদূরান্ত থেকে অজয় নদী পথ ধরে আউশগ্রামের কালিকাপুর, বুধরা, ছোড়ার নীলডাঙা-সহ আজকের বীরভূমের সুপুর, রায়পুর, চন্দনপুরে আসতেন। সেকালের আউশগ্রাম লাগোয়া নিলামবাজার আজকের ইলামবাজার ছিল লাক্ষার রমরমা বাজার! সেই লাক্ষার পরবর্তীতে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আউশগ্রামের নীল চাষের খ্যাতি।
ভারতবর্ষে বিদেশি শাসকদের অনুপ্রবেশের কিছু পরেই তাদের নজর পড়ে এই এলাকার উপরেও। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স– দুই দেশের শাসকই ব্যবসার প্রয়োজনে এই অজয়, দামোদর নদী-মাতৃিক গ্রামগুলিতে আসতেন নিয়মিত। এক সময় আউশগ্রামের দখলদারি ধরতে শাসক ইংরেজ অজয়ের তীরে ভেদিয়া রেল স্টেশনটি ১৮৬০ সালে তৈরি করেন। এটি সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনের একটি স্টেশন। যা পূর্ব রেলের হাওড়া বিভাগের অধীনে অবস্থিত।
এই ভেদিয়া স্টেশনের কাছে অতীতের নদীপথের একমাত্র বন্দর ছিল বুধরায়। সেখান প্রাচীন বাতিঘরটি দীর্ঘদিন টিকেছিল। বর্তমানে তা জলের তলায় কালের গর্ভে গিয়েছে হারিয়ে। তারও বহু পরে আউশগ্রামের গ্রামনামে যুক্ত হয় আধুনিকতার ইতিহাস। ১৯৫৪ সালে আউশগ্রাম হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, থানার অদূরে। তবে জন চিপের সেই পুরনো থানাটিও বদলে গেছে সময়ের হাত ধরে!
…………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………
শান্তিনিকেতন কবিতা লেখার জায়গাই নয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিশ্বভারতীতে বাংলা বিভাগে পড়াতেন যখন, বলেছিলেন একথা। সে নিয়ে নানা উষ্মাও তৈরি হয়েছিল। এই লেখা অধ্যাপক শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শান্তিনিকেতন পর্ব। কবির মৃত্যুদিনে রোববার.ইন-এর প্রণতি।