এখন তো নতুন শিক্ষানীতি অনুসারে স্নাতক স্তরে চার-বছর সময়। এক বছর বেশি। তাই সাহিত্যের সৃজনশীলতার বিষয়টির ওপর ঝোঁক দেওয়া যেতে পারে। প্রথম বছর ভাষার পাঠ্যসূচিতে পোক্ত হলে তবেই সৃজনশীলতার দিকে যাওয়া সম্ভব। মনে রাখতে হবে, সাহিত্যের সৃজনশীলতা কেবল গল্প-উপন্যাস-কবিতা লেখাতেই প্রতিফলিত হয় না, সাহিত্যের সৃজনশীলতা প্রবন্ধ রচনা, অনুবাদ, গ্রন্থ নির্মাণ, সম্পাদনা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা বিদ্যাচর্চার মধ্যে সৃজনশীলতা শেখানোর আয়োজন করলে গল্প-উপন্যাস-কবিতা লেখা শেখানোর চেয়েও প্রবন্ধ রচনা, অনুবাদ, গ্রন্থ নির্মাণ, সম্পাদনা ইত্যাদি সৃজনশীল বিষয়গুলির উপর ঝোঁক দেওয়া উচিত।
আধুনিক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের বিভাগগুলির পঠন-পাঠনের পদ্ধতি কী হবে, এ প্রশ্নই কেবল মাথা তোলে না, এই বিভাগগুলিকে আদপেই বিদ্যাচর্চার বিষয় হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ আছে কি না, এ-প্রশ্নও মাথা তোলে। ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের বিভাগগুলির মধ্যে ইংরেজি বিভাগ এক অর্থে পড়ে, আবার পড়েও না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত শতকের দ্বিতীয় দশকে যখন আধুনিক ভারতীয় ভাষা সাহিত্যের বিভাগগুলি স্নাতকোত্তর স্তরে বিদ্যাচর্চার মহিমময় বিভাগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, তখন অবশ্য তাদের দলে সংগত কারণেই ইংরেজি ছিল না। ইংরেজি তখন পাশ্চাত্যের উপনিবেশ কর্তাদের ভাষা, উপনিবেশেই ইংরেজি বিদ্যাচর্চার তখন ক্রমসমৃদ্ধি। ইংল্যান্ডে ধ্রুপদী ভাষার সঙ্গে ইংরেজিকে তখন লড়তে হচ্ছে– লড়তে হচ্ছে বিদ্যাবিষয় হিসেবে মর্যাদা লাভের জন্য।
একইভাবে এদেশেও ভারতীয় ভাষাগুলি বিদ্যাবিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশে সচেষ্ট, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাংলা ভাষা-সাহিত্য যদি পড়াতে হয় তাহলে তো মুদির দোকানের কাগজপত্রও পড়ানো চলে– এমন কথা বলছেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের বাঙালি সদস্যদের কেউ কেউ। বঙ্কিমচন্দ্র, আনন্দমোহন বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উনিশ শতকের শেষ দশকে বাংলা ভাষার পক্ষ নিচ্ছেন। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর সর্বোচ্চ স্তরে বিদ্যাবিষয় হিসেবে অন্যান্য কয়েকটি আধুনিক ভারতীয় ভাষার সঙ্গে জায়গা দিতে তৎপর– শেষ পর্যন্ত বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের প্রান্তে আশুতোষের স্বপ্ন সফল হয়েছিল।
তবে আধুনিক ভারতীয় ভাষা কীভাবে পড়ানো হবে, সেই সচল তর্ক পিছু ছাড়েনি। পাঠ্যসূচি নিয়ে সংগত বিতর্ক হয়েছে। সাহিত্যের প্রয়াত অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ পরিকল্পনা করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মহাবিদ্যালয় স্তরে সাহিত্য বিভাগে প্রথম বর্ষে এমন একটি তাত্ত্বিক পাঠ্যসূচি তৈরি করা উচিত যা যেকোনও ভাষার সাহিত্য পড়ুয়াদের অবশ্য পাঠ্য। সেই তত্ত্বপাঠ্যসূচি অধীত করার পর দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তারা নিজেদের নির্দিষ্ট ভাষার সাহিত্য পড়বে। তাঁর এই কাঠামোয় ভারতীয় সাহিত্য বিভাগের দলে ইংরেজিও ছিল। শিশিরকুমার দাশ বাংলা ভাষা সাহিত্যের পড়ুয়া হলেও অন্য সাহিত্যবিভাগের সঙ্গে তাঁর দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক। ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করেছিলেন তিনি, তুলনামূলক ভাষা সাহিত্যের বিভাগে তাঁর অনর্গল যাতায়াত। সংযোগ-সমন্বয়ের এই মডেল ভাষা-সাহিত্যের পড়ুয়াদের উৎসাহিত করতে পারে। নিজের ভাষা ও সাহিত্যের ঘরে আটকে থাকা খুব ভালো কাজ নয়– নিজের ভাষা ও সাহিত্যের জমিতে পা-দু’টি রেখে ঘরের জানলা-দরজাগুলি হাট করে খুলে দেওয়াই রসিকজনের কাজ।
…………………………………………………..
এদেশেও ভারতীয় ভাষাগুলি বিদ্যাবিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশে সচেষ্ট, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাংলা ভাষা-সাহিত্য যদি পড়াতে হয় তাহলে তো মুদির দোকানের কাগজপত্রও পড়ানো চলে– এমন কথা বলছেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের বাঙালি সদস্যদের কেউ কেউ। বঙ্কিমচন্দ্র, আনন্দমোহন বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উনিশ শতকের শেষ দশকে বাংলা ভাষার পক্ষ নিচ্ছেন।
…………………………………………………..
আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে নতুন করে জানলা খোলার সময় এসেছে। প্রযুক্তির আনুকূল্য কাজে লাগিয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যের শিক্ষক ও পড়ুয়ারা নিজেদের নতুন করে তৈরি করলে বেশ হয়। বাংলা ভাষা-সাহিত্য পড়ার ক্ষেত্রে যে গেল-গেল রব উঠেছে, তা থেকে খানিক মুক্তি মিলতে পারে। একেবারে প্রথম বর্ষে যে-পড়ুয়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়তে আসছেন, তাঁকে বাংলা ভাষার ব্যবহারিক প্রযুক্তিগত দিকগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত। আর ভাষার বাক্য-বানান ইত্যাদির ক্ষেত্রে যেন জ্ঞান-গম্যি পোক্ত হয়। কলম দিয়ে লেখা যেমন মুখের ভাষার জগৎকে বদলে দিয়েছিল তেমনই কম্পিউটারের প্রয়োগ অন্যান্য ভাষার মতোই বাংলা ভাষার জগৎকে বদলে দিয়েছে।
এখানে মনে রাখতে হবে, বাংলা ভাষায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়তে আসা পড়ুয়াদের মধ্যে অর্থনৈতিক শ্রেণির বিচারে মোটামুটি দু’টি দল। যাঁরা উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসছেন, তাঁদের কাছে ব্যক্তিগত কম্পিউটার থাকলেও অন্যরা সেই সুবিধার অধিকারী নন। ফলে ভাষা-সাহিত্যের বিভাগগুলিকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে– যন্ত্রে বাংলা লেখার প্রযুক্তি অধিগত হলে তাদের গ্রন্থ-নির্মাণ পদ্ধতির, সম্পাদনার, পাতা সাজানোর বিষয়-আশয় শেখানো যেতে পারে। লেখার বাংলার পাশাপাশি বলার বাংলার ক্ষেত্রেও প্রমিত উচ্চারণ অধিগত করে নিতে হবে। উচ্চারণের আঞ্চলিকতাকে অসম্মান করে নয়, সেই আঞ্চলিকতাকে স্বীকার করেই প্রমিত রূপটি শিখে নেওয়া উচিত। প্রথম বর্ষে বাংলা ভাষার লেখার-বলার প্রমিত রূপ অধিগত হলে পড়ুয়াটিকে পরের তিন বছর সাহিত্য তত্ত্ব ও সাহিত্যের সৃজনশীল পরিসরের সঙ্গে নানা ভাবে পরিচিত করা চলে।
এখন তো নতুন শিক্ষানীতি অনুসারে স্নাতক স্তরে চার-বছর সময়। এক বছর বেশি। তাই সাহিত্যের সৃজনশীলতার বিষয়টির ওপর ঝোঁক দেওয়া যেতে পারে। প্রথম বছর ভাষার পাঠ্যসূচিতে পোক্ত হলে তবেই সৃজনশীলতার দিকে যাওয়া সম্ভব। মনে রাখতে হবে, সাহিত্যের সৃজনশীলতা কেবল গল্প-উপন্যাস-কবিতা লেখাতেই প্রতিফলিত হয় না, সাহিত্যের সৃজনশীলতা প্রবন্ধ রচনা, অনুবাদ, গ্রন্থ নির্মাণ, সম্পাদনা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা বিদ্যাচর্চার মধ্যে সৃজনশীলতা শেখানোর আয়োজন করলে গল্প-উপন্যাস-কবিতা লেখা শেখানোর চেয়েও প্রবন্ধ রচনা, অনুবাদ, গ্রন্থ নির্মাণ, সম্পাদনা ইত্যাদি সৃজনশীল বিষয়গুলির উপর ঝোঁক দেওয়া উচিত।
প্রবন্ধ একরকম নয়, প্রবন্ধ বহুরকম। ‘পরিচয়’, ‘অনুষ্টুপ’ -এর মতো পত্রে জ্ঞানাত্মক প্রবন্ধ যেভাবে লেখা হয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীয় পত্রিকায় অথবা অসম থেকে প্রকাশিত দ্বিভাষিক ‘ঐতিহ্য’-এ সেভাবে প্রবন্ধ লেখা হয় না। জ্ঞানাত্মক প্রবন্ধে বিধি মেনে তথ্য নির্দেশ করতে হয়। অনুবাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ চর্চার বিষয়– ভারতীয় ভাষা বিভাগের পড়ুয়ারা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে দল বাঁধলে এক ভাষার সাহিত্য অপর ভাষায় পৌঁছে যাবে। এমনকী, কম-বয়সি পড়ুয়ারা যাঁরা নিজেরা কবিতা লিখছেন তাঁরা একে-অপরের সঙ্গে সহযোগে নিজেদের লেখা অনুবাদ করতে পারেন।
বিশ্বভারতীর তামিল বিভাগের গবেষক শত্তীশ্বরন জ্ঞানশেখরন শীর্ষা মণ্ডলের সঙ্গে সহযোগিতায় তামিল দলিত কবি সুকীর্তরানীর কবিতা অনুবাদ করেছেন। সুকীর্তরানীর সাক্ষাৎকার অনুবাদে প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘দেখো, নারীবাদের জন্য কখনোই আমরা একটা সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি তৈরি করতে পারব না। আমার নারীবাদ তোমার নারীবাদের থেকে আলাদা। কারো কাছে হয়তো নারীবাদ মানে রাতে দেরি করে বাড়ি ফেরা, কিন্তু আমার কাছে নারীবাদ মানে বাড়ির বাইরে বেরোতে পারার স্বাধীনতা। আবার নারীবাদ অনেকটাই স্থান-কালনির্ভরও বটে।’
সৃজনশীল অনুবাদের মাধ্যমে এক ভাষা কেবল অন্য ভাষার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে না, এক সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতির অবস্থান অনুধাবন করতে পারছে। বাংলা ভাষা পড়তে আসা নানা অঞ্চলের পড়ুয়ারা চাইলে নির্মাণ করতে পারেন তাঁদের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান– প্রকাশ করার দরকার নেই, অন্তর্জালে সুসম্পাদিত আঞ্চলিক শব্দের নথিখানা তৈরি করে ফেলতে পারেন বাংলা বিভাগের একদল পড়ুয়ারা। চাই উৎসাহ দেওয়ার ও পরিকল্পনা করার উদ্যম– পড়ুয়া শিক্ষক সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যে সমস্ত শিক্ষালয়ে ‘ফাইন আর্টস’ পড়ানো হয় সেই সমস্ত শিক্ষালয়ে গ্রন্থ নির্মাণের কাজে ভাষা-সাহিত্যের শিক্ষক ও পড়ুয়ারা একে অপরের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন।
…………………………………………………..
আরও পড়ুন : জিরাফকে ভাষার ভেতর ছেড়ে দিয়েছিলেন ভাস্কর চক্রবর্তী
…………………………………………………..
আর প্রাণপণে পড়া চাই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন রচনা– পাঠ্যতালিকায় যা রইল রইল, তার বাইরে গোগ্রাসে পড়তে হবে। হারিয়ে যাওয়া পুরনো বই চাইলে নতুন করে সম্পাদনাও করতে পারেন কেউ। খুলে দিতে পারেন পড়ার বইয়ের বাইরের বইয়ের জগৎ। কথা হল, সম্ভাবনা আছে– চাই আত্মবিশ্বাস, উদ্যম আর সহায়ক প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষা বিভাগের শিক্ষক-পড়ুয়াদের মধ্যে পারস্পরিক যোগ। ইংরেজি বিভাগও এ-কাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডস তার হাতে গরম উদাহরণ।
আর চাই ভাষা-সাহিত্যের প্রতি আবেগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অলিন্দে বুদ্ধদেব বসু, নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় চলাচল করতেন। বাংলা বিভাগে শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। ভাষাকে ভালোবাসার বিগ্রহ তাঁরা– সেই আবেগ ছাড়া কি সৃজন হয়– আবেগের সঙ্গে মেধার সমন্বয়ে সৃজনশীলতা গড়ে ওঠে।
…………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………..