সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করে কেউ এন্টিলিয়া বানাতে পারেনি। ছেলেমেয়ের বিয়েতে দশজনের বেশি লোক নেমন্তন্ন করতে পারেনি। তাদের বাপের তৈরি ভাঙা টালির ঘর আর বেড়ার দেওয়াল চুইয়ে বর্ষার জল বিছানাপত্র ভিজিয়ে দিত। তাদের কাউকে চাকু, গুলি বা বোমা মারতে দেখেনি। তারা ‘ব্ল্যাকার’। তাই কোনও রাজনৈতিক দলেও তাদের জায়গা হয়নি। সমাজবিরোধীরা তখন ছিল রাজনৈতিক কর্মী। কম বিপ্লবীদের সঙ্গে বেশি বিপ্লবীদের লড়াইটাই ছিল আসলে সশস্ত্র বিপ্লব। ব্ল্যাকাররা সেই দলেও পড়ত না। তারা লুম্পেন প্রলেতারিয়েত। তাদের নাকি রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
তখন হাফ প্যাডেল থেকে ফুল প্যাডেলে সাইকেল চালানোর পাসপোর্ট পেয়ে গিয়েছি, কিন্তু ফুল প্যান্ট পরার ভিসা পাইনি। এদিকে যে মহা বিপদ সামনে, তা তো জানতাম না! সে এক করুণ কাহিনি।
ডিম্পল-ঋষি কাপুরের ‘ববি’ রিলিজ করেছে সদ্য। স্কুলে ব্যাপক উত্তেজনা। কে কবে রাত জেগে হলের সামনে ইট পেতে বসে থাকবে তার রোস্টার তৈরি। প্রবল বৃষ্টির মাস। সকালে ন্যাতা হয়ে ফিরে সবার মুখেই চড়-থাপ্পড়ের লাল দাগ। কাউন্টার খুলতেই নাকি কারা এসে তুমুল কেলিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে ওদের। তাদের নাম ‘ব্ল্যাকার’। সব টিকিট তাদের দখলে। তখন টিকিটের দাম ছিল দু’টাকা ৪৫ পয়সা। সেই টিকিট পাঁচ টাকায় বিক্রি করে তাদের লাভ হয় ১০০ পারসেন্ট। এটাই তাদের ব্যবসা।
বাচ্চু এসে বলে গেল, বাইসাদা নাকি ব্ল্যাকারদের পান্ডা। হেব্বি দাপট! আমার বাবা রিটেয়ার্ড পুলিশ অফিসার ছিল বলে আমাকে ‘ভাই রে ভাই’ বলে ডাকত! বাচ্চুই বুদ্ধি দিল, তুই তোর বাবা-মার নাম করে দুটো টিকিট জোগাড় করে নিয়ে আয় না! কথাটা মন্দ বলেনি! বাচ্চুর বেশ বুদ্ধি হয়েছে তো!
দেখা করলাম বাইসাদার সঙ্গে। বললাম, ‘দাদাভাই, বাবা দুটো টিকিট চেয়েছে, দেবে? বেশি দাম দিতে পারব না কিন্তু!’ বাইসাদা আমার দিকে তাকিয়ে সন্দেহের চোখে বলল, ‘‘কাকাবাবু ‘ববি’ দেখতে যাবে?’’ আমি সোৎসাহে বললাম, ‘‘বাবা তো অনেক সিনেমা দ্যাখে। এই তো পনেরোই আগস্ট ‘বিপ্লবী ক্ষুদিরাম’ দেখিয়ে আনল!’’ বাইসাদা অর্থপূর্ণ চোখে তাকিয়ে একটু ভেবে বলল, ‘ঠিক আছে। আজ স্কুলের পর আসিস। দিয়ে দেব। কাল বারোটার শো। আর কাকাবাবুকে টাকা দিতে হবে না। বলে দিবি, আমি দেখাচ্ছি।’
টিকিট দুটো পাচার হয়ে গেল অঙ্ক বইয়ের পিতা-পুত্রের পাতায়।
স্কুলের সামনেই বাচ্চুর দেখা পেলাম। বললাম, হয়ে গিয়েছে। বারোটার শো। চ, আজ আর স্কুলে ঢুকবই না!
২.
হলের সামনে বিরাট লাইন। জানি কেউ টিকিট পাবে না। সব বাইসাদার জিম্মায় চলে গিয়েছে। বাইসাদার চ্যালারা চিল্লাচ্ছে– পাঁচ টাকা পাঁচ টাকা মাত্র পাঁচ টাকা। ব্যালকনি সাত টাকা সাত টাকা। বাইসাদা এসে কিছুই বলল না, উল্টে একগাল হেসে বলল, ‘আমি আগেই জানতাম তোরা দেখবি, তাই বেস্ট সিট তোদের দিয়েছি। এখন দূরে গিয়ে দাঁড়া। সবাই ঢুকে গেলে তারপর ঢুকবি।’ আমরা হইহই করে প্রতিবাদ করে উঠলাম, ‘ফার্স্ট সিন দেখব না?’ বাইসাদা মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, ‘হাফ প্যান্ট পরে ববি দেখবি! কমলদা তো চুলের মুঠি ধরে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসবে!’ কমলদা গেটম্যান। ইয়া মস্ত চেহারা! বডিবিল্ডার।
বাইসাদার বাহিনী অবিশ্বাস্য দ্রুততায় টিকিট বিক্রি শেষ করে উধাও হয়ে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, ‘হল অন্ধকার হয়ে গেলেই ঢুকে পড়বি।’ আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেই গেটে টিকিট দেখালাম, কমলদা চুলের মুঠি ধরে বলল, ‘দাঁড়া, তোর বাবাকে বলব, এই বয়সেই চিটিংবাজি শিখে গেছিস?’ আমরা হতবাক! কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, ‘বাইসাদাই তো টিকিট দিল।’ কমলদা আরও জোরে চুল টেনে বলল, ‘ঠিকই টিকিট দিয়েছে। তবে এই হলের নয়, তারা টকিজের। যা, শো শুরু হয়ে গেছে।’
জীবনের প্রথম ম্যারাথন দৌড়ে এক কিমি গিয়ে হলের ভিতর ঢুকে শুনতে পেলাম গান, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।’ বাচ্চুকে কানে কানে বললাম, ‘গানটা চেনা চেনা লাগছে না?’ বাচ্চু কেঁদে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, বিপ্লবী ক্ষুদিরামের!’
…………………………………………………………………….
হলের সামনে বিরাট লাইন। জানি কেউ টিকিট পাবে না। সব বাইসাদার জিম্মায় চলে গিয়েছে। বাইসাদার চ্যালারা চিল্লাচ্ছে– পাঁচ টাকা পাঁচ টাকা মাত্র পাঁচ টাকা। ব্যালকনি সাত টাকা সাত টাকা। বাইসাদা এসে কিছুই বলল না, উল্টে একগাল হেসে বলল, ‘আমি আগেই জানতাম তোরা দেখবি, তাই বেস্ট সিট তোদের দিয়েছি। এখন দূরে গিয়ে দাঁড়া। সবাই ঢুকে গেলে তারপর ঢুকবি।’ আমরা হইহই করে প্রতিবাদ করে উঠলাম, ‘ফার্স্ট সিন দেখব না?’ বাইসাদা মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, ‘হাফ প্যান্ট পরে ববি দেখবি! কমলদা তো চুলের মুঠি ধরে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসবে!’
…………………………………………………………………….
৩.
সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করে কেউ এন্টিলিয়া বানাতে পারেনি। ছেলেমেয়ের বিয়েতে দশজনের বেশি লোক নেমন্তন্ন করতে পারেনি। তাদের বাপের তৈরি ভাঙা টালির ঘর আর বেড়ার দেওয়াল চুইয়ে বর্ষার জল বিছানাপত্র ভিজিয়ে দিত। ভাঙা ছাদ দিয়ে চাঁদ দেখে কারও ‘আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’ মনে আসেনি। মনে হয়েছিল পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি! তাদের কাউকে চাকু, গুলি বা বোমা মারতে দেখেনি। তারা ‘ব্ল্যাকার’। তাই কোনও রাজনৈতিক দলেও তাদের জায়গা হয়নি। সমাজবিরোধীরা তখন ছিল রাজনৈতিক কর্মী। খুনখারাপি যা করত, তা পার্টির স্বার্থে। ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়। এমনটাই বোঝানো হত। ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ শক্তিকে বা ‘শ্রেণিশত্রুদের’ খতম করাটাই ছিল দেশের কাজ। কম বিপ্লবীদের সঙ্গে বেশি বিপ্লবীদের লড়াইটাই ছিল আসলে সশস্ত্র বিপ্লব। তাও শহরের বুকে। গ্রামেগঞ্জে নয়। ব্ল্যাকাররা সেই দলেও পড়ত না। তারা লুম্পেন প্রলেতারিয়েত। তাদের নাকি রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
আসলে দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু পরিবারগুলি যখন এদেশে আসে, তাদের ভবিষ্যৎ ছিল অন্ধকার। কী করে ভাত জোটাবে, তার কোনও উপায় তদানীন্তন সরকার দিতে পারেনি। কিন্তু সেইসব উচ্চশিক্ষিত উদ্বাস্তু পরিবারের ছিন্নমূল বাবা-কাকারা চিরুনি বিক্রি করেছে, মাছ নিয়ে ফুটপাথে বসেছে। সবজির দোকান করেছে, কিন্তু টিকিট ব্ল্যাক করেনি তাদের তীব্র মরালিটির জন্য। ‘ব্ল্যাক’ শব্দটা তাদের অভিধানে লেখা ছিল না। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম মানে আমাদের, সেই দাদারা পড়াশুনাও সেভাবে করেনি, চাকরিও পায়নি। বেছে নিয়েছিল সবচেয়ে নিরাপদ রোজগারের পথ। কারও কোনও ক্ষতি না করে একটু বেশি দামে সিনেমার টিকিট হাতে হাতে তুলে দিয়েছে। তারা হয়ে গেল লুম্পেন আর যারা হাতে রক্ত মেখে হত্যালীলা চালিয়েছিল, তারা বিপ্লবের ভ্যানগার্ড পার্টির সদস্য! আড়াই টাকার টিকিট পাঁচ টাকায় বেচে তার থেকে ভাগ দিয়েছে হল মালিককে, কাউন্টার দাদাদের, পুলিশকে আর অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের। তোলা হিসেবে। কত থাকত হাতে? মাত্র কয়েক পয়সা। সেটাই চাল কেনার কুপন। ছয়ের দশক থেকে সাত ও আট দশকের গোড়া পর্যন্ত এই সিনেমা ব্ল্যাকার কারও ক্ষতি না করে দর্শকের হাতে কয়েক টাকা লাভে মনোরঞ্জনের টিকিট তুলে দিয়েছে একটু বেশি দামে। তখন সিনেমাই ছিল একমাত্র বিনোদন। রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, পরে শাহরুখ, সলমন ছিল ওদের ভাগ্যদেবতা।
মধ্য আটের দশক থেকে শুরু হয়ে গেল ল্যান্ড শার্কদের উত্থান। প্রমোটারি। তৈরি হল ‘জমির দালাল’ ক্লাস। টিকিট ব্ল্যাক করে কত আর টাকা? ঠিকমতো ভাত জোগাড় করাই দায়! তুলনায় জমির দালালিতে লক্ষ লক্ষ টাকা। ব্ল্যাকারদের একটা বড় অংশ হয়ে উঠল ‘ব্রোকার’। দালাল বললে তাদের আঁতে ঘা লাগত! সিনেমার বাজার খেয়ে নিতে লাগল টেলিভিশন। সিঙ্গল স্ক্রিন উঠে যেতে শুরু করল। মাল্টিস্ক্রিন দখল করল বাজার। পুরো সিস্টেমটাই হয়ে গেল ‘ব্ল্যাক’৷ ব্ল্যাক বিনোদন। সিনেমার টিকিট আকাশছোঁয়া। ব্ল্যাক। সঙ্গে পপকর্ন, কফি, আইসক্রিম! ব্ল্যাক! ব্ল্যাকার অন্তরালে।
এখন ওটিটি! দুনিয়া মুঠঠি মে। সিনেমা নেই। থাকলেও সূক্ষ্ম শরীরে বিরাজমান। আছে শুধু ভার্চুয়াল, মুখোমুখি বসিবার খাদ্য ও খাদক। বৈতরণির এপার-ওপার। ফলে বাইসাদার রোজগারে টান পড়াতে দেশি মদ খাওয়া শুরু করল। ছোটখাটো চুরিজচ্ছুরি আর ভুয়ো মস্তানি করে দু’চার পয়সা যা ইনকাম হত, তাই দিয়ে সস্তা মদ কিনে বা ধার-বাকিতে জোগাড় করে বিষ খেয়ে একদিন মরেও গেল।
৪.
আমরা তখন ফুল প্যান্ট পরা শুরু করেছি। শুনলাম ‘ব্লো হট ব্লো কোল্ড’ নামে একটা ছবি এসেছে শ্রীরামপুর টকিজে। বাচ্চু বলে গেল, হেব্বি সিন আছে রে! যাবি? যাব তো বটেই। কিন্তু ‘এ’ মার্কা ছবিতে ঢুকতে দেবে তো? তখনও বাইসাদা বেঁচে। বাইসাদার নাম বললে নিশ্চয়ই দেখতে দেবে। মনে মনে ভাবলাম।
কিন্তু মহা মুশকিল। ট্রেন বন্ধ। কারা যেন শ্রীরামপুরে রেল অবরোধ করেছে। তাহলে উপায়? যেতে তো হবেই। আর এমন সুযোগ পাব না। স্কুল ছুটি। কারণ মনে নেই। তাহলে সাইকেলই ভরসা।
ভাঙাচোরা জিটি রোড দিয়ে ছুটল দুই বন্ধুর সাইকেল। বারোটার শো না হলেও তিনটের শো হয়ে যাবে। সাঁই সাঁই সাঁই। তখনও জিটি রোড পাড়ার রাস্তা হয়নি। এত গাড়ি ছিল না। বাস ছিল একটাই। তিন নম্বর। বাতাস ব্লো হট! তাতে কী? সিনেমাটা দেখতেই হবে। জীবনের প্রথম ‘এ’ মার্কা ছবি। আমাদের ‘এ’ হতে আরও দু’-এক বছর বাকি। ঠোঁটের ওপর সদ্য গোঁফ উঠতে শুরু করেছে। বার্থ সার্টিফিকেট আছে কি না, জানা নেই। তবে? একটাই ভরসা, বাইসাদা।
শ্রীরামপুর টকিজের সামনে কিন্তু তেমন ভিড় নেই। তাহলে কি টিকিট লাইনে দাঁড়িয়েই পাব? বুঝলাম ট্রেনের গন্ডগোলের জন্য তেমন কেউ আসেনি। গুটিগুটি লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কাউন্টারে টিকিট চাইতেই চশমার ফাঁক দিয়ে কাকুটা আমাদের জরিপ করে বললেন, ‘বাবা জানে?’ আমি বললাম, ‘বাহ, বাবাই তো বলল, অনেক দিন পর ইংরেজি সিনেমা এসেছে। যা দেখে আয়। ইংরেজিটা শিখবি তাহলে!’
কাকুটা খেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘বাবা কি আইসে?’ আমি বললাম, ‘না, না বাবা তো বিছানায়। উঠতে পারে না।’ লোকটা যেন কুকুর-বেড়াল তাড়ানোর মতো হ্যাট হ্যাট করে আমাদের দূরছাই করে বলে উঠল, ‘বাবা চিঠি লিখতে পারে তো? তাহলে এই কথা কয়টা লিইক্ষা আনো। তবে টিকিট পাইবা! বয়স কত হইল?’ আমি বললাম, ‘বাইশ।’ ‘কলেজ না স্কুল?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে উঠলাম, ‘স্কুল।’ কাকুটা একগাল হেসে বললেন, ‘আগেই বুঝছি। কতবার ডাব্বু খাইসো বাবা? এই সব সিনেমা দেইক্ষা কি আর পরীক্ষায় পাস করা যায়? পড়াশুনা কর। মানুষ হইবা।’
আর কিছু করার নেই। কিন্তু ছবি আমাদের দেখতেই হবে। একমাত্র উপায় ব্ল্যাকার ধরা। আজকাল দেখলেই বুঝে যাই কে ব্ল্যাকার আর কে নয়। ধরলাম একজনকে। বললাম আমাদের সমস্যার কথা। উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোন ক্লাসে পড়?’ লজ্জায় মাথা হেঁট করে বললাম, ‘ক্লাস টেন।’ লোকটা একটু ভেবে বলল, ‘মুশকিলে ফেললা বাবা! এখনও তো আঠারো হয় নাই! এই বয়সে তো এরকম সিনেমা দেখা উচিত নয়!’ আমি বুক ফুলিয়ে বললাম, বাবাই তো বলল, ‘দেখে আয়। ইংরেজি শিখতে পারবি।’ ব্ল্যাকার দাদা মুচকি হেসে বলল, ‘বুঝেছি, মালটি তুমি খাসা! দেখি কী করতে পারি!’ একজনকে ডেকে বলল, ‘প্যালা, ওদের দুটো টিকিট দিয়ে দে। বেশি নিবি না। স্টুডেন্ট কনসেশন দিয়ে দে।’
প্যালা অবাক। মিনমিন করে বলল, ‘স্টুডেন্ট কনসেশন?’ লোকটা উত্তর দিল, ‘ওরা সিনেমা দেখতে আসেনি। ইংরেজি শিখতে এসেছে।’
৫.
আমাদের পাড়ার রাণু প্রেমে পড়ে গেল ধোপা স্বপনের। স্বপনের বাবা ধোপার কাজ করত। মারা যাওয়ার পর স্বপনের দুর্দশা ঘনিয়ে এল। দাদারা সামান্য চাকরি করত। ভাই কিছুই করে না। ধোপাগিরি করা তার না-পসন্দ। দেখতে ভালোই ছিল। পড়াশোনাতেও মন্দ নয়। কিন্তু হায়ার সেকেন্ডারির পর আর পড়াশোনা হল না। দাদারা ডেকে বলল, এবার রোজগারের ধান্দা কর। আমরা খাওয়াতে পারব না। বাধ্য হয়ে বাইসাদার দলে নাম লেখাল স্বপন। ধোপা স্বপনের নাম হয়ে গেল ‘ব্ল্যাকার স্বপন’।
রাণুর বাবার চালের গুদাম। বিরাট বড়লোক। ধুতি আর ফতুয়া পরেই জীবনটা চালিয়ে গেল। এত বড়লোকের মেয়ে প্রেমে পড়েছে ব্ল্যাকারের? এত সাহস? মেয়েকে পিটিয়ে সুখ হল না। না খেতে দিয়ে তিনতলার চিলেকোঠায় তালা মেরে বন্দি করে রাখল। মফস্সলে খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বাপের পক্ষে, কেউ মেয়ের। রোজ ওদের বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ পাওয়া যায়। আমরা শুনি। কিন্তু কাঁহাতক সহ্য করব? গেলাম পাড়ার ডাকসাইটে কমিউনিস্ট নেতা মান্তুদার বাড়ি। মান্তুদা সবই জানত। প্রথমে একটু গাঁইগুঁই করে বলল, ‘তোরা একটা কাজ করতে পারবি?’ আমরা গলা তুলে বললাম, ‘নিশ্চয়ই।’ মান্তুদা চিন্তা করে বলল, ‘স্বপন তো সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করে, নির্দোষ কাজ। আর রাণুর বাবা চাল ব্ল্যাক করত, এখনও করে। কংগ্রেসি মাল শালা! ছেষট্টি সালে খাদ্য আন্দোলনের সময় আমরা ওর গুদাম লুঠ করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম। সেই চাল বিলিয়ে দিয়েছিলাম ঘরে ঘরে। তোরা তখন ছোট। মানুষ এখন ভুলে গেছে। যদি একবার ক্ষমতায় আসি ওর গুদাম শালা সিল করে দেব। পারবি ওর বাবার মুখে মুখে এই কথাগুলি বলতে?’
আমরা বলতে পারিনি। কিন্তু রাতের অন্ধকারে পোস্টারে পোস্টারে আমাদের অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম চাল ব্ল্যাকার রাণুর বাবার কীর্তি-কাহিনি।
……………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………..
৭.
ব্ল্যাকার বললেই সিনেমার টিকিট ব্ল্যাকারদের কথা মাথায় আসে। কিন্তু তারা ছিল নিরীহ প্রাণী। খাদ্য আন্দোলন এখন শুধুই ইতিহাস। আমাদের দেশে কত ব্ল্যাক মানি রোজ জমা হচ্ছে বিদেশের ব্যাঙ্কে তার হিসেব রাখি না আমরা। খোঁজ নিতে দোষ কী? খোঁজ না পাই, চিহ্নিত তো করতে পারি!