মহুয়া কুড়ানিরা তাদের কঠিন পরিশ্রমের মূল্য খুব বেশি পায় না। বাজারে মহুয়া বিক্রির দাম খুবই কম। ফুল ঝরার সময় বাজারে দাম থাকে ২০-২৫ টাকা প্রতি কিলো। ব্যবসাদাররা সেই সময় অল্প দামে মহুয়া কিনে ৩-৪ মাস মজুত রেখে কেজি প্রতি ৫০-৬০ টাকা মূল্যে বিক্রি করে। কুড়ানিরা অনেকেই মহুয়া মজুত রাখতে পারে না। তাদের মহুয়া বিক্রির টাকা দিয়েই বাড়ির নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, নুন, তেল কিনতে হয়। একই অবস্থা হয় মহুয়া ফল বিক্রি করার সময়েও।
ভোর ৫টা। সূর্যের আলো তখনও আকাশের গায়ে লেগে আছে, বনের মাটি ছুঁয়ে উঠতে পারেনি। গ্রামে গ্রামে তখন ‘সিম রাঃ’-এর শব্দ– ভোরের আলোয় প্রথম মোরগের ডাক। ফুলকুড়ানির দল ঝুড়ি, বাঁশের তক্তা আর রান্নার হাঁড়িকুঁড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে জঙ্গল-পাহাড়ের দিকে। না, বনভোজনের জন্য নয়—– তারা পাহাড়ে যায় ‘মাতকম’– মহুয়া সংগ্রহের জন্য। এপ্রিলের গোড়ার দিকে, হোলির ঠিক পরেই মধ্য ভারত এবং ছোটনাগপুর অঞ্চলের আনাচকানাচে দৃশ্যমান এই সুউচ্চ গাছ থেকে টুপটাপ করে ঝরতে শুরু করে অমূল্য সবুজ মহুল। গোটা এলাকা তখন ম-ম করে মউলের সৌরভে। ফুলের গন্ধে, বাহা পরবের গানে গানে কল্লোলিত হয় আরণ্যক নির্জন।
কবি সমর সেনের ‘মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ’– মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চল। এই বিস্তীর্ণ এলাকার বহু মানুষের জীবন মহুয়ানির্ভর। দিনমজুরি না জুটলে মউলিই হয়ে ওঠে তাদের একমাত্র ভরসা। দিন গুজরানের আলো। ভারতের আদিবাসী সমবায় বিপণন উন্নয়ন ফেডারেশন-এর (টিআরআইএফইডি) তথ্য অনুযায়ী– মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের ৭৫ শতাংশেরও বেশি আদিবাসী পরিবার মহুয়া ফুল কুড়িয়ে বছরে ৫,০০০ টাকা উপার্জন করে। জঙ্গলের পথ ধরে হাঁটলেই চোখে পড়ে, ১০০-২০০ মিটারের দূরত্বে একটা করে মহুয়া গাছ। ফুল-ফোটার মরশুমে গাছগুলি চিহ্নিত করা হয় নিচের দিকের ডালে একফালি কাপড় বেঁধে। বহু বছরের প্রথা অনুযায়ী, গ্রাম-সমিতি প্রত্যেকটা পরিবারকে কয়েকটা করে গাছ ধার্য করে দেয়। সেই অনুযায়ী প্রত্যেকটা পরিবারের শুরু হয় জঙ্গলে জঙ্গলে মহুয়া কুড়োনোর কাজ।
মধ্যপ্রদেশের বান্ধবগড় ব্যাঘ্র প্রকল্পের ১,৫৩৭ বর্গ কিলোমিটার পরিসরের সীমানায় বাস করে অসংখ্য ক্ষুদ্র চাষি। মহুয়াই তাদের রুজিরুটির একমাত্র নিশ্চিত উৎস। এরাই অনুমতি পায় জঙ্গলে এই ফুল কুড়োনোর। আঁধার থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়ে তারা। বাঘের আক্রমণ থেকে বাঁচতে, একা নয় সক্কলে যায় দল বেঁধে। বড়দের সঙ্গী হয় বাচ্চারাও। এক মহুয়া কুড়ানির কথায়, ‘যখন ছোট্টো ছিলাম, তবে থেকে মায়ের পায়ে পায়ে জঙ্গলে এসেছি। আজ ঠিক যেভাবে আমার বেটাবিটিরা আমার সঙ্গে আসে।’ বাচ্চাদের চোখের দৃষ্টি অপেক্ষাকৃত তীক্ষ্ণ, ঘাসপাতা-ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঝরে পড়া মহুয়া ফুল দেখলেই তারা দ্রুত ঠাহর করতে পারে। ঝাঁট দিয়ে সাফ করতে থাকে গাছের তলায় তলায় জমা হওয়া শুকনো পাতা। মহুয়া ফুল ভারি, তাই পাতা সরালেও ওগুলো দিব্যি মাটির ওপর পড়ে থাকে। তারপর তাদের ঝুড়ি পূর্ণ হতে থাকে সবুজ মহুলে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হয় এই জীবনচর্যা। জীবনের ধারাপাত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
গোন্ড উপজাতি সমাজের প্রতিটি স্তরেই জড়িয়ে আছে মহুয়া। এদের নতুন বছর শুরু হয় চৈত্র মাস থেকে। চৈত্র মাসে তাদের ঘরে ঘরে চলে মহাপরব, যেখানে মহুয়া ফুল ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল– এই তিনমাস মহুয়া গাছ ফুলে ভরে থাকে। বর্ষাকালে সেই মহুয়া ফুল থেকে সুরা তৈরির আগে পালিত হয় মহুয়া উৎসব। অর্থাৎ একটা গাছে ফুল আসা এবং ফুল ফোটা ধরে তৈরি হয় একটি উপজাতির উৎসব। তাছাড়া এই উপজাতির কাছে মহুয়ার কাণ্ড, ডাল, ফুল, ফল– সবই খুব পবিত্র।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এপ্রিলের প্রথম ২-৩টি সপ্তাহ মহুয়ার মরশুম, এই সময়ে মহুয়া কুড়ানিরা প্রায় ২০০ কেজি ফুল জোগাড় করে। রোদ যত বাড়তে থাকে, ততই বেশি বেশি করে ডাল থেকে খসে পড়ে মহুল ফুল, তাই ভরদুপুর অবধি ফুল কুড়িয়ে বেড়ায় তারা। একসময় বেলা ফুরিয়ে আসে। জঙ্গল থেকে ফিরে আসে মহুয়া কুড়ানির দল। তাদের সঙ্গে ঝুড়ি-ভর্তি মহুয়া আর তাদের কচি-কাঁচা। তারপর রোদে ফুলের রাশি শুকোনোর কাজ। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই দেখা যায় মহুয়া রাখা আছে রোদে শুকোনোর জন্য, কিংবা বস্তায় ঠেসে ভরা হচ্ছে শুকনো মহুয়া। এরপর হাটে শুকনো মহুল বিক্রি।
মহুয়া কুড়ানিরা তাদের কঠিন পরিশ্রমের মূল্য খুব বেশি পায় না। বাজারে মহুয়া বিক্রির দাম খুবই কম। ফুল ঝরার সময় বাজারে দাম থাকে ২০-২৫ টাকা প্রতি কিলো। ব্যবসাদাররা সেই সময় অল্প দামে মহুয়া কিনে ৩-৪ মাস মজুত রেখে কেজি প্রতি ৫০-৬০ টাকা মূল্যে বিক্রি করে। কুড়ানিরা অনেকেই মহুয়া মজুত রাখতে পারে না। তাদের মহুয়া বিক্রির টাকা দিয়েই বাড়ির নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, নুন, তেল কিনতে হয়। একই অবস্থা হয় মহুয়া ফল বিক্রি করার সময়েও। মহুয়া গাছের সঙ্গে আদিবাসী মানুষদের আছে এক আন্তরিক যোগাযোগ। গভীর সম্পর্ক। মহুয়া গাছের পাতার আগুনই ভরা শীতে ওদের ওম দেয়, শীত আড়াল করে। মধ্যপ্রদেশের উমারিয়া জেলার মানুষজন হলফ করে বলে, যে, জঙ্গলের বাদবাকি সব গাছ কেটে ফেললেও মহুয়া গাছ কাটা হবে না কোনও দিনও। এই জেলার আদিবাসী জনজাতির কাছে মহুল পরম পবিত্র, তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এই গাছ যতদিন থাকবে ততদিন অনাহারে মরতে হবে না কাউকে। শুকনো মহুয়া ফুল গাঁজিয়ে শুধু মদ তৈরি হয় না, একে গুঁড়িয়ে আটা বানানো যায় সহজেই। কেবল ‘মাতকম’ নয়, সাঁওতালিতে যাকে ‘কুইডি’ বলে, সেই মহুয়া ফলেরও (যা জুলাইয়ের দিকে পাকে) ব্যবহারিক মূল্য আছে। ভোজ্য তেল তৈরির জন্য এই ফল বাজারে বিক্রি হয়। আর মহুয়া গাছের বাকলের পৌষ্টিক এবং ঔষধিক মূল্যও অপরিসীম। এ গাছ আদিবাসীদের পরম আদরের।
গোন্ড উপজাতি সমাজের প্রতিটি স্তরেই জড়িয়ে আছে মহুয়া। এদের নতুন বছর শুরু হয় চৈত্র মাস থেকে। চৈত্র মাসে তাদের ঘরে ঘরে চলে মহাপরব, যেখানে মহুয়া ফুল ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল– এই তিনমাস মহুয়া গাছ ফুলে ভরে থাকে। বর্ষাকালে সেই মহুয়া ফুল থেকে সুরা তৈরির আগে পালিত হয় মহুয়া উৎসব। অর্থাৎ একটা গাছে ফুল আসা এবং ফুল ফোটা ধরে তৈরি হয় একটি উপজাতির উৎসব। তাছাড়া এই উপজাতির কাছে মহুয়ার কাণ্ড, ডাল, ফুল, ফল– সবই খুব পবিত্র। শুধুমাত্র গোন্ড উপজাতি নয়, এই অঞ্চলের বেশিরভাগ আদিবাসীদের কাছে মহুয়া ভগবানের আশীর্বাদ। শুধুমাত্র সুরা নয়, তারা এই গাছের ফল এবং বিভিন্ন অংশ সিদ্ধ করে, গুঁড়িয়ে বা রস করে স্বাদু খাবার তৈরি করে। শুকিয়ে যাওয়া কাঠ জ্বালানিতে ব্যবহার হয়। কোয়া উপজাতিরা এই গাছের কাঠ দিয়েই তাদের অন্তিমযাত্রার চিতা সাজায়, তাদের বিশ্বাস মহুয়া কাঠের আগুন ছাড়া মানুষের দেহের প্রকৃত পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হয় না।
সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, ওরাওঁ, বাইগা, এবং গোন্ড– মহুয়ার ওপর নির্ভরশীল প্রায় সমস্ত আদিবাসী সম্প্রদায়ের গল্প একই।মহুয়া গাছের গুরুত্ব তাদের জীবনে অপরিসীম। মহুয়া-নির্ভর এক মানুষের কাছ থেকেই শুনেছিলাম, ‘বনজঙ্গল থেকে যা যা সংগ্রহ করি, তার মধ্যে মহুয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভুখমারির সময় মানুষ এটা খেয়ে বেঁচে থাকে। ধরুন, কারও পয়সাকড়ি দরকার, সে তখন খানিক মহুল বেচে দেয়। এমনকী, কারও খুব খারাপ সময় চলছে, তখন যার অতটা খারাপ অবস্থা নয়, সে নিজের গাছগুলোর মধ্যে একখানা তাকে দিতেই পারে।’ আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছেই মহুয়ারা বেঁচে আছে ভালোবাসার সঙ্গে।
গোন্ডদের কাছে মহুয়া মানে জীবন। মহুয়া মানে শাশ্বত চিরন্তন এক দেবতা যে, তাদের বাঁচিয়ে রাখে। গোন্ড উপজাতিদের পুরাণ-গ্রন্থেও মহুয়া গাছের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেখানে এই গাছকে ভীষণ পবিত্র বলে মনে করা হয়, তাই তাদের কাছে মহুয়া ‘জীবন-বৃক্ষ’। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত আয়ুর্বেদ গ্রন্থ ‘চরক-সংহিতা’তেও মহুয়া গাছের উল্লেখ রয়েছে। সেখানে মহুয়ার রসকে ‘মহৌষধ’ বলা হয়েছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সি. পি. খাঁড়ে-ও তাঁর লেখা বইয়ে মহুয়াকে ব্রঙ্কাইটিস এবং সর্দি-কাশির অতি-কার্যকর ঔষধ বলে বর্ণনা করেছেন। মহুয়ার আরও একটি পরিচয়– মেয়েদের প্রসাধনের প্রধান উপকরণ হিসেবে। প্রায় দু’হাজার বছর আগে লেখা সংস্কৃত মহাকবি কালিদাসের ‘কুমার-সম্ভব’ কাব্যে দেখা যায়, সে যুগের মালবিকারা গালে মাখত লোধ্ররেণু, গলায় মধুকের মালা। কালিদাস ‘কুমার-সম্ভব’ কাব্যের সপ্তম সর্গে লিখছেন–
‘ধূপের ধোঁয়ায় শুষ্ক করিয়া কেশ, কুসুম সাজায়ে ঘন চিকুরের মাঝ,
শ্যামলদূর্বা পাণ্ডু মধুক ফুলে মালা গাঁথি নারী বাঁধিল অলক আজ।’
এত সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও মহুয়ার গায়ে কেমন যেন গ্রাম্য, জংলি গন্ধ। জঙ্গলের পথ পেরিয়ে এখনও হয়তো সে এলিটদের রাজপথে উঠতে পারেনি। বছর বছর সবজে মহুল ফুল কুড়োনোর মরশুমে গাছতলায় এসে জড়ো হয় সবাই। জঙ্গলের মাটি থেকে হালকা হলদেটে এই পুষ্পরাজি সংগ্রহ করা– ঠিক যেন কোনও পরব। বহু প্রান্তিক মানুষের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর জীবন সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে এই মহুয়া গাছ। মহুল ফুলে ধরা থাকে নিশ্চিন্ত এক ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি। এখনও সাঁওতাল মেয়েরা মহুয়া ফুলের মালা পরে, খোঁপায় ফুল গোঁজে। মহুয়ার মদিরা পান করে সাঁওতালরা মাতাল হয়ে জ্যোৎস্না রাতে মাদল বাজিয়ে শালবনের মধ্যে উৎসব করে। যদিও উজ্জ্বল, ঝাঁ-চকচকে হুইস্কি বা ওয়াইনের মতো সম্মান পায়নি এই ‘জংলি’ মহুয়া, কিন্তু সে তার সাবলীল ছন্দে, নিজস্ব মদিরতায় আজও বেঁচে আছে এক ‘জীবন-বৃক্ষ’ হয়ে।