অতুলপ্রসাদীয় বিরহের সুরেলা ঝোঁকে আমাদের খেয়াল থাকে না এই দাদুরী কলগীতির পিছনে রয়েছে বর্ষার আহ্বানে পতঙ্গের সংখ্যায় আসা জোয়ার। যত বেশি খাবার, তত বেশি প্রজনন সাফল্যের সম্ভাবনা। উড়ন্ত পতঙ্গের নাগাল না পাক, ভুঁইচর নানা ধরনের খোঁজ এরা রাখে। উড়ুক্কুদের খোঁজও একেবারে নেয় না তা নয়। প্রায় প্রতি বছরই কোনও না কোনও দিন দেখি, গন্ধরাজের তলার নরম মাটির একটা ছিদ্র থেকে অফুরন্ত বেরিয়ে আসছে ডানা-অলা উইপোকা, সামান্য হাজারের হিসেবে আঁটানো যাবে না তাদের। আর গহ্বরটার পাশে বসে কুনোব্যাং আর টিকটিকির দল সেগুলোর সদ্ব্যবহার করছে। পাখিরাও।
বর্ষায় যখন চারিদিকে জীবন ঝমঝম করছে, একটা মরা প্রজাপতি আমাকে টানল। জুলাই মাসের শেষ। অরুণাচলের জিরো-র কাছাকাছি একটা পাহাড়ি জঙ্গল। কাঁচা রাস্তায় এত কাদা আর জল যে, বনবাংলোর দু’কিলোমিটার আগে গাড়ি ছেড়ে পায়ে হেঁটে এগোতে হচ্ছিল। আর সেখানে, জমা কাদাজলের ওপর ভাসছিল সে। হিল জেজেবেল। মৃত্যুতে হয়তো আর সকলের থেকে আলাদা হয়ে উঠেছিল। নইলে তাকে জল থেকে হাতে তুলে নেব কেন! দম নিই কিছুক্ষণ। চেয়ে দেখি তার দিকে। কোথাও স্পন্দন আছে কি না খুঁজি, দেখি তার মুখের সামনের পাকানো শুঁড়ে কোথাও শেষের সাধ লেগে আছে কি না। কিছু নেই। তার বদলে মৃত্যুর নিশ্চলতা উজ্জ্বল হলুদ-কালো শরীরটাকে আরও দর্শনীয় করে তুলেছে।
সেই মুহূর্তে ওই পাহাড় জুড়ে, কেবল যে পথটুকু আমরা পায়ে হেঁটে এসেছি তার দু’ ধারের জলকাদা জুড়ে ছিল উদ্বেল লক্ষাধিক প্রজাপতি! জীবনের উল্লাস! এত প্রজাপতি একসঙ্গে এর আগে আর কোথাও দেখিনি। উত্তরবঙ্গে নদীর পাড়েও নয়। প্রায় প্রতিটাই হিল জেজেবেল। আরও দু’-চার রকম ছিল না তা নয়, কিন্তু ডজনের হিসাবও তাদের পক্ষে বেশি।
কোথা থেকে এল এত প্রজাপতি? আসেনি, জন্মেছে এ জঙ্গলেই। জিরো-র এক প্রজাপতি-উৎসাহী পরে বলেছিলেন, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, এ তো প্রতি বছরেই দেখি!
হবে হয়তো। অনেক সময়ে বিস্ফোরণের মতো এক একটা প্রাণীর সংখ্যার বাড়াবাড়িও দেখা দেয় এক একটা জায়গায়। হয়তো আগের প্রজন্মের প্রাণীগুলো প্রচুর খাবার পেয়েছিল, সঙ্গী বা সঙ্গিনীর অভাব হয়নি কারও, ডিম পেড়েছিল প্রচুর, শাবকগুলোকে হত্যা করতে আসেনি কেউ– পৃথিবী জেনেছিল প্রাণের জোর। তবু সেইদিন, ওই কয়েক লক্ষ প্রজাপতির ভিড়, কাদায় বসে তাদের জলপানের উন্মাদনা, এরকম কিছু কারণেই হয়তো তাদের প্রত্যেককে দলা পাকানো জমাট পিণ্ডের মতো ঠেকেছিল আমার মনে। আলাদা ছিল কেবল ওই একটি– ঘোলাজলে শরীর বিছিয়ে ততোধিক ঘোলাটে একটা আকাশের অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছিল সে চিত হয়ে।
প্রজাপতির ভিড়ের ওপর দিয়ে ছাড়া হেঁটে আসার উপায় ছিল না। উড়ে যাচ্ছিল প্রজাপতিগুলো। লাফিয়ে উঠছিল ফোয়ারার মতো। ঝোড়ো হাওয়ার মুখে একঝাঁক হলুদ পাতা হয়ে আমাদের কাঁধ-পিঠ-গালে এসে পড়ছিল। চিবুকে প্রজাপতির ডানার স্পর্শ, চোখ বুজলেই, এখনও পাই। বোধহয় মরার আগে অবধি তা লেগে থাকবে।
কেন এমন জীবনের মহা সমারোহের ভেতর, ‘মরিবার হল তার সাধ’! আমার হাতের প্রজাপতিটির? আকস্মিক জলে পড়ে যাওয়ার পরিণতিই হয়তো। আরও কয়েক লক্ষের মতো সেও বসেছিল জলে কাদায়, একটু আগেই। তেষ্টা মেটাতে নয়। আসলে এরা চাইছে লবণ, যা জলে গুলে আছে। এরা সকলে পুরুষ প্রজাপতি। সঙ্গিনীর বরমাল্য কেউ পাবে কি পাবে না, তা নির্ভর করছে এরা কে কতটা লবণ ছেঁকে নিতে পেরেছে তার পরিমাণের ওপর। লবণ যার বেশি, বাজারদর বেশি তারই।
বাজার এড়িয়ে বুঝি কোনও দিকেই যাওয়ার উপায় নেই!
বাজারের হিসেবে ভাবলে বলতেই হবে, বর্ষায় জীবনের বাজার বেশ তেজি। একেবারে গোড়ায়, আকাশে মেঘ জমার সময় থেকেই। কেন আকাশে মেঘ ঘনাতেই গাছপালা এমন সতেজ সবুজ হয়ে ওঠে তার কারণ, কোথাও পড়েছিলাম, তারা টের পায় বৃষ্টি আসন্ন। আর তখনই– বৃষ্টি নামার আগেই, জলে ভেজা মাটি থেকে দ্রুত রসদ টেনে নেওয়ার জন্য তৈরি থাকে তার শরীর, তুমুল ব্যস্ততা চলে সেখানে। সালোকসংশ্লেষের জন্য জরুরি ক্লোরোপ্লাস্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রোটিন ইত্যাদি যথেষ্ট পরিমাণে বানিয়ে তোলে। সেটাই ফুটে ওঠে তাদের ঘনিয়ে ওঠা সবুজ রং আর ডাগর স্বাস্থ্যের রূপে। কিন্তু তারা কি মেঘ দেখতে পায়? না, কিন্তু মেঘের গায়ে জড়ানো বিদ্যুৎ মাটিতে তৈরি করে একটা পালটা বিদ্যুৎক্ষেত্র, সেটা ধরতে পারে গাছগাছালি।
আর গাছ থেকেই শুরু সব কিছুর। সূর্যের আলো বন্দি করে তারা যে খাবার বানাবে সেটাই স্তরে স্তরে নেমে আসবে এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীর শরীরে। বর্ষায় সরস মাটি সে কাজটাকে বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ।
বাড়ির চৌহদ্দিতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই দেখা যায় তা। যজ্ঞডুমুরের চারা গজিয়েছে অনেক, এখানে ওখানে। তাদের পাতায় নিশ্চিন্তে দাঁত বসাচ্ছে বহু জাতের মথের শুঁয়োপোকা ও বিটল। পেয়ারা গাছের পাতায় নল বিঁধিয়ে গাছের তরল আহার চুরি করে নিচ্ছে বিভিন্ন ‘বাগ’। কয়েক সপ্তাহ আগেও এদের চোখে পড়েনি তো!
আকন্দ গাছের পাতায় ঘুরছে প্রায় হাফ ডজন উজ্জ্বল নীল রঙের বিটল। পাতায় কামড় বসানোর বিন্দু দিয়ে সাদা কষ গড়াচ্ছে। এটা পরিকল্পিত। কষটা বিষ। যত ঝরে যায় তত মঙ্গল, তাই কয়েকটা মোক্ষম জায়গায় ছিদ্র করে দেওয়া।
গাছের শরীরের কোন অংশটা না খাওয়া যায়!– পাতা, ফুল, ফল, শেকড়, জলে ভিজে নরম হওয়া গাছের ছালের ওপরের অংশ, এমনকী, কচি শাখার ডগা। সমস্ত পতঙ্গকে জুড়ে নিলে অনায়াসে একটা মহাদানব কল্পনা করে নেওয়া যায়, বর্ষা যার ঘুম ভাঙিয়েছে। তার কামড় পড়ছে সর্বত্র। তেমন নির্জনতায় একটা বড় শুঁয়োপোকার পাতা চিবোনোর আওয়াজও কানে বাজবে সত্যিই।
পাতাগুলো রূপান্তরিত হচ্ছে। চোখে দেখছি না, কিন্তু পাতা চিবনোয় মগ্ন শুঁয়োপোকাকে দেখে মনে বুঝছি, ওই যে… ওই যে… পাতাটা ক্রমশ রূপ নিচ্ছে একটা মথের। যে ছিল বোঁটার শাসনে বন্দি, শুঁয়োপোকার গ্রাস তাতে উড়ে বেড়ানোর স্বাধীনতা ভরে দিচ্ছে।
কুয়োর পাড় ঘেঁষে ফনফনিয়ে বেড়ে উঠেছে দোলনচাঁপা। তার ডগার দিকের কোনও কোনও পাতা সরু করে মুড়িয়ে রাখা। ওগুলোর ভেতর রয়েছে গ্রাস ডেমন প্রজাপতির শূককীট। পাতার মোড়কটা একই সঙ্গে তার আশ্রয়, এবং আহার। রাতের বেলায় তার খোঁজ নিতে এসে দেখি একলা গঙ্গাফড়িং পাতা চিবনো থামিয়ে টর্চের আলোর দিকে চেয়ে রয়েছে বেকুবের মতো।
শ্যাওলা আর লাইকেন ভরা কাঁঠাল গাছের গুঁড়িতে, বা পাঁচিলের ওপর মসের মিনিয়েচার জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় শরীরের দু’-পাশ জুড়ে হলুদের টিপ পরা কেন্নো। লাল রঙের কেন্নোও আছে, ঝামেলা বুঝলে ক্যারামের গুটির মতো পাকিয়ে যাওয়া যাদের প্রিয় স্বভাব। কিন্তু কী কারণে জানি না ইদানীং আমাদের পাড়ায় এরা সংখ্যায় কমে গিয়েছে, বেড়েছে হলুদ টিপ-অলা কেন্নোগুলো। ব্যাঙের ছাতা, পচা কাঠের গুঁড়ি, এসবের ওপর তন্ময় হয়ে বসে এরা কী খায় কে জানে।
হলুদ টিপগুলো দেখতে সুন্দর লাগার জন্য নয় সম্ভবত, ভয়ংকর দেখানোর জন্য। এদের শরীরে তৈরি হয় হাইড্রোজেন সায়ানাইড, সেটা রাসায়নিক অস্ত্র। শরীরের কালো-হলুদ উজ্জ্বল রংটা তারই চেতাবনি। বলে রাখা ভালো, কালো-হলুদের উজ্জ্বল বাহার আছে হিল জেজেবেলের শরীরেও, আর তাদেরও আয়ত্তে আছে বিষাক্ত রাসায়নিক কবচ।
বর্ষার প্রসাদ পাওয়া নবশ্যামল গাছের পাতা যাদের সামনে মেলে ধরেছিল অফুরন্ত খাবারের সুযোগ, তারাই কোনও কোনও অভাবিত মুহূর্তে নিমেষে রূপান্তরিত হয় অন্য কারও খাবারে। দুপুরবেলা টেবিলে বসে লিখতে লিখতে চোখের কোণে নড়াচড়া দেখে টের পাই একটা ওয়াস্প, টেবিলের পায়ার কয়েক মিলিমিটার চওড়া ফুটোকে তার ‘বাসা’ বলে নির্বাচন করেছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে গর্তটাকে ঝাড়পোঁছ করে সে হাওয়া হয়ে যায়। মিনিট দশেক বাদে ফেরে যখন, দেখি তার মুখে মরা ইঁদুরের মতো ঝুলছে ইঞ্চিখানেক বড় একটা সবুজ শুঁয়োপোকা। সেটাকে সে টেনে টেনে ঢোকায় গর্তের ভেতর। কে জানে সকালে যাকে যজ্ঞডুমুরের পাতায় দেখেছিলাম, সেটাই কি না। কিছুক্ষণের ভেতর আনে আরও একটা। গোটা চারেক শুঁয়োপোকা অবধি হিসেব রাখতে পেরেছিলাম।
এ ধরনের ওয়াস্পের বাসা আসলে বাসা নয়, সে নিজে এটাতে থাকবে না কখনও। অনেক ওয়াস্প মাটি দিয়ে বাসা তৈরি করে, জাত বুঝে সে সবের নানা গড়ন– কোনওটা অবিকল মাটির হাঁড়ি, গোল করে বাঁকানো কানা সমেত। সংগত কারণেই এরা নাম পেয়েছে ‘কুমোর পোকা’ বা ‘কুমোরে পোকা’। কয়েক দিন আগে টেবিলে রাখা একটা বইয়ের গায়ে মাটির হাঁড়ি পেতে দিয়ে গিয়েছিল এদের একজন।
এই বাসাগুলো ভরে তোলা হয় কখনও শুঁয়োপোকায়, কখনও মাকড়সায়। তারা মৃত নয়, কিন্তু চলচ্ছক্তিহীন। এই ওয়াস্পগুলো সকলেই দক্ষতায় সেরা অ্যানাস্থেসিয়োলজিস্ট। হুল বিঁধিয়ে মাপমতো রসায়ন ঢেলে শিকার করা প্রাণীগুলোকে অবশ করে রাখা হয়েছে কেবল। মরা পোকার ‘শেলফ লাইফ’ প্রায় শূন্য, পচে যাবে অবিলম্বে, তাই জ্যান্তই চাই।
এইসব শিকার মূল ওয়াস্পগুলোর নিজেদের জন্য নয়, এগুলো আসলে তাদের শাবকের খাবার। যথেষ্ট শিকার সংগ্রহ হলে প্রতিটা বাসায় একটা করে ডিম পেড়ে শেষ হবে ওয়াস্প-জননীর কাজ। বাসাটার মুখ ‘সিল’ করে দিয়ে অন্য আর-একটা তৈরির কাজে নামবে সে। দিন দুয়েকের ভেতর জীবন্ত কিন্তু অচল-অবশ প্রাণীগুলো তাদের জীবন সার্থক করবে ডিম ফুটে বেরনো ওয়াস্পের লার্ভার খাবার হিসেবে।
রেডিও নাটকে বর্ষা আসত কিছু বিশেষ শব্দ নিয়ে। রাতের মুহূর্ত বুঝে নিই ঝিঁঝির ডাকে। ব্যাঙের কলতানে। জলধারার শব্দও শুনি। হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ যতটা ঝড় বোঝাত ততটা বাদলা হাওয়া বোঝাত না হয়তো। রেডিও নাটকে মিলবে না কিন্তু বর্ষার অনুষঙ্গে আরও যা মাথায় ঢুকে আছে সেই ছোটবেলা থেকে তার ভেতর রয়েছে একটা বিশেষ ঠক্ শব্দ। শুনলেই বুঝতাম অনেকক্ষণ ধরে ভোঁওওও আওয়াজ তুলে যে বিশাল রাইনোসেরস বিটলটা (এ নামটা এখন জেনেছি, তখন ভুল করেই বলতাম গুবরে পোকা) উড়ে বেড়াচ্ছিল, এইমাত্র ছাদে ধাক্কা লেগে পতন ঘটল তার। মিনিট খানেক বা তারও কম সময় ভূমিশয্যায় উল্টো হয়ে থেকে শূন্যে ‘হাত’-পা ছুড়তে ছুড়তেই সে সোজা হয়ে ওঠে আবার। ফের শুরু হয় ভারী জাহাজের শঙ্খধ্বনির মতো ভোঁওওও শব্দ।
এ দৃশ্যটা কখনও উল্লেখ করার যোগ্য বলে ভেবেছিলাম! এখন ভাবি। শব্দটা এখন ছোটবেলায় শোনা বেতার নাটকের মতোই এক স্মৃতি। এমন বহু কিছুই কেবল স্মৃতি হয়ে উঠছে দিনে দিনে!
বর্ষায় জল-জমা মাঠ অবশ্য আজও ডাক পাঠায়। মাঠটা ঘরের পাশে নয় একেবারে, কিন্তু ডাক ঠিকই শোনা যায়। সে ডাক ফেরাতে নেই। সেদিন গিয়ে দেখা গেল জড়ো হয়েছে প্রায় গোটা ২০ উজ্জ্বল হলুদ সোনাব্যাং। এই দিনটির পরে আবার কবে তারা এ মাঠে আসর বসাবে ঠিক নেই। হয়তো এই বছরের জন্য এটাই একমাত্র দিন। কয়েকটি তখনও ডেকে চলেছে মাঠের যে অংশে একটু হলেও মাটি বা ঘাস জেগে আছে সেখানে বসে। বাকিরা ইতিমধ্যে জোড় বেঁধেছে, জলের ওপর দু’জোড়া চোখ আর ছুঁচলো থুতনি জেগে আছে তাদের, বাকি শরীর জলের তলায়।
অতুলপ্রসাদীয় বিরহের সুরেলা ঝোঁকে আমাদের খেয়াল থাকে না এই দাদুরী কলগীতির পিছনে রয়েছে বর্ষার আহ্বানে পতঙ্গের সংখ্যায় আসা জোয়ার। যত বেশি খাবার, তত বেশি প্রজনন সাফল্যের সম্ভাবনা। উড়ন্ত পতঙ্গের নাগাল না পাক, ভুঁইচর নানা ধরনের খোঁজ এরা রাখে। উড়ুক্কুদের খোঁজও একেবারে নেয় না তা নয়। প্রায় প্রতি বছরই কোনও না কোনও দিন দেখি, গন্ধরাজের তলার নরম মাটির একটা ছিদ্র থেকে অফুরন্ত বেরিয়ে আসছে ডানা-অলা উইপোকা, সামান্য হাজারের হিসেবে আঁটানো যাবে না তাদের। আর গহ্বরটার পাশে বসে কুনোব্যাং আর টিকটিকির দল সেগুলোর সদ্ব্যবহার করছে। পাখিরাও। দোয়েল বিশেষ করে। যে দোয়েলটাকে একটু আগেই দেখেছিলাম উঠোনে একটা মরিয়া কেঁচোকে তার গর্ত থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করতে।
গন্ধরাজ গাছের তলায় সারা বছরই কেঁচোর মাটি জমে থাকে। কেঁচোর দেখা মেলে না সবসময়, কেবল তাদের তৈরি করা ঊর্বর ‘টাওয়ার’টা চোখে পড়ে। যারা বাগান করে কেবল তাদের চোখেই সেই মাটি মহার্ঘ নয়, যে-কুমোরে পোকার কথা আগে বলেছি, তাদের বিল্ডিং মেটিরিয়ালও এই মৃত্তিকা। মুখে করে ছোট ছোট গুলি পাকিয়ে এই মাটি বয়ে আনে ওয়াস্প, মসৃণ করে লেপে বাসা তৈরি করে।
কেউ কেউ সচকিত হয়ে দেখছেন, সর্বত্র পতঙ্গদের প্রাচুর্যে ভাটার টান লেগেছে। বিদেশে মেপেজুপে দেখা চলেছে, এখানে আমরা কেউ কেউ স্মৃতির ঝাঁপি খুলে মেলাচ্ছি। এমন মানুষও মিলবে, যাঁদের স্মৃতিতে পতঙ্গের নামে লেখা কোনও পাতাই নেই। এঁদের সংখ্যাই হয়তো বেশি। ওরা যে আছে, ছিল আরও বেশি প্রাচুর্যে আর বৈচিত্রে, সেটা তাঁদের বোধে দাগ কাটেনি কোনও দিনও।
আমাদের ছোটবেলার সন্ধ্যা কাটত হ্যারিকেন ঘিরে পড়াশোনায়। গরম আর বর্ষার সন্ধ্যায় তার চিমনির কাচে ঠোক্কর খাওয়া উচ্চিংড়ে অঙ্কখাতার ওপর বসে থাকত কিছুক্ষণ বিহ্বলের মতো। গন্ধি পোকা তার উপস্থিতি জানাত তার ‘সিগনেচার পারফিউম’ দিয়ে। কী একটা লম্বাটে ‘ছুঁচলো-লেজা’ পোকা গায়ে এসে পড়ত, আমরা হাত দিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করলে ঘষা লাগা জায়গায় শুরু হত জ্বলুনি, একটা লালচে দাগ থেকে যেত কয়েক ঘণ্টার জন্য, আর আমার নাকে লেগে থাকত কাঁচা আমের মতো একটা গন্ধ। এখন জানি সেগুলোর নাম রোভ বিটল, কিছুদিন আগে হঠাৎ দেখি এরা দুর্ধর্ষ ভিলেন রূপে উঠে এসেছে খবরকাগজের পাতায়, ‘অ্যাসিড পোকা’ নামে। ভাবা যায়! এ তল্লাটে তারা তো ফেরার! আমাদের মতো আরও কেউ হয়তো ছোটবেলার সেই জ্বালা ধরা মুহূর্তক’টাও ‘মিস’ করছে।
প্রাচুর্য ছিল তাদের। অবশ্যই। গরমের দেশে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সঙ্গে ছিল এক ধরনের সাকল্য বোধ, আমাদের বড়দের ভেতর। ছুঁচো, ইঁদুর, আরশোলা, এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জারি রেখেও ধরে নেওয়া হত, এরা তো থাকবেই। তেঁতুলে বিছে বেরত বর্ষাকালে প্রচুর। উঠোনে, ঘরে, কাঁচামাটির রান্নাঘরের মেঝেতে। রান্নাঘরে তাদের অনেক ক’টাকেই হাতের কাছে থাকা কাঠের পিঁড়ির গুঁতোয় শেষ করে দেওয়া হত। কিন্তু আতঙ্ক ছিল না। ঘরের ভেতর আসা মাকড়সা দেখেই দিশাহারা হয়ে নিরাপত্তা বলয় চূর্ণ হয়ে গেছে এমনটা ভাবা হত না আজকের দিনের মতো। কাগজে স্ক্রাব টাইফাস নিয়ে লেখা বেরনো মাত্র ঝোপঝাড় হঠানোর হিড়িক পড়ত না।
জোনাকির কথা এবারে থাক, তার বদলে বলা যাক তাদেরই আত্মীয়, কিন্তু লেজে আলো নিয়ে মাটিতে ঘুরে বেড়ানো কিছু লার্ভার কথা। জোনাকি যেমন, তেমনই এরাও একধরনের বিটল। তেমন বড় মাপেরগুলো লম্বায় ইঞ্চি দুই-তিনও হতে পারে। এদের মিলত বর্ষায় কোনও জঙ্গলে গেলে। যেমন দলমায়। যেমন কুইলাপালে। যেমন শামসিং-এ। হাতে তুলে নিলে একটা মাঝারি এলইডি-র থেকেও বেশি আলো ছড়াত তারা। আলোগুলো চোখ মিটমিট করত না।
ওই দলমা পাহাড়েই করেছিলাম আমার জীবনের একমাত্র সফল ডিসেকশন। প্রায় ৩০ বছর আগের এক জুলাই মাসে আসনবনি থেকে হেঁটে আমরা পৌঁছেছিলাম দলমা মন্দিরের লাগোয়া ঘরটাতে। ঘর না বলে ছাদ-অলা চাতাল বলাই ভালো হয়তো। মন্দিরটা আসলে একটা হেলে থাকা পাথরের তলায় স্থাপিত লিঙ্গ। বিকেল হতে না হতে ঘন মেঘ এসে মন্দির সহ তিন-চারজন সাধু এবং আমাদের চারজনকে নির্বাসন দিয়েছিল গ্যালাক্সির দূরতম কোণে। কোথাও আর কিছু রয়েছে বা ছিল এমনটাও মনে হচ্ছিল না। চাতালটাতে প্লাস্টিক পেতে, শীতল ভিজে ভিজে একটা ঘোলাটে নেবুলার ভেতর বসে আমি কাঁপতে থাকা মোমবাতির আলোয় বোধহয় কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বাইরে তখন ফুলে ফুলে উঠছে বর্ষার গর্জন। বৃষ্টিপাতের শব্দ ততটা নয়। প্রধানত সিকাডা, ঝিঁঝিপোকা, আর বুড়ো আঙুলের নখের মাপের একটা টিক-টক ব্যাং-এর ডাকে কানে কিছু শোনা যাচ্ছিল না।
সিকাডা একটা অতিকায় মাছির মতো দেখতে পোকা, যারা গাছের রস খেয়ে বাড়ে। কাছাকাছি থাকা সমস্ত সিকাডার ডাকের ছন্দ একটা হারমনি তৈরি করছিল। ধুলোর ঘূর্ণি যেমন পাক খেতে খেতে ওপরে উঠে যায় তেমনই এদের সম্মিলিত শব্দ পাকিয়ে পাকিয়ে উত্তুঙ্গ তীব্রতায় পৌঁছেই হঠাৎ একসঙ্গে ঝপ করে যায় থেমে। আধ মিনিট-এক মিনিট, হয়তো দু’-মিনিটের নীরবতা। তারপর আবার একটি সিকাডা দুলে ওঠা ডাক শুরু করে। প্রথমে মৃদুভাবে। এক বিন্দুতে তার সঙ্গে যোগ দেয় দ্বিতীয় একটা, দোলনের ছন্দ মিলিয়ে। অন্য এক বিন্দুতে তৃতীয় একটা… এইভাবে ছন্দের এক একটা মোড়ে বৃন্দবাদনে একে একে মেশে ওই এলাকার ওই প্রজাতির সব ক’টা সিকাডা, ফের তাদের ডাক পৌঁছয় শিখরে, এবং আকস্মিক একটা ভারী পাথরের মতো আছড়ে পড়ে নীরবতা।
সেই সন্ধ্যায় এদেরই ভেতর একটা সিকাডা হঠাৎ চাতালে ঢুকে এসে প্রথমে মোমের আগুনে নিজের ডানা পুড়িয়েছিল, তারপর ডানার সঙ্গে সহমরণে না যেতে পারার দুঃখে প্রাণ বিসর্জন দিল। আর আমি কাঁচির সাহায্যে আবিষ্কার করলাম তার তীব্র শব্দের রহস্য। এদের সেন্টিমিটার দুয়েক লম্বা পেটটা পুরোপুরি ফাঁপা! ঠিক যেন একটা ঢাক। বুকের নিচের দিকে রয়েছে খুব জোরালো দুটো পেশি, মোমবাতির আলোয় দেখে মনে হচ্ছিল একটা রাবার ব্যান্ড থেকে কেটে বসানো দুটো মিলিমিটার তিনেক লম্বা টুকরো। পেশিগুলো দুটো ছোট্ট শক্ত পাতকে টেনে ধরে আবার ছেড়ে শব্দ তৈরি করছে। শব্দটা বহুগুণ বড় হয়ে বাজছে তার ফাঁপা উদরের সৌজন্যে। সেদিনের ওই হঠাৎ-পাওয়া জ্ঞান আমাকে গোটা বর্ষার ভেতরকার রহস্যকেই ফাঁপা প্রমাণ করে মোহমুক্ত করতে পারত হয়তো। কিন্তু ঘটনা তেমন ভাবে এগোয়নি।
বর্ষার জঙ্গল প্রতি বছরের অবশ্যগন্তব্য হয়ে উঠেছে। ক্বচিৎ কোনও বছর বর্ষার জঙ্গলে যেতে না পারলে রেডিওর পাশে বেতার নাটকের শ্রোতার মতো কান খাড়া রাখি। এতটুকু শ্বাস ফেলার শব্দও যেন মিস না হয়।
……………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………………..
যথাসম্ভব নো মেকআপ লুক নিয়ে ফ্লোরে গিয়ে বসলাম আমার নির্দিষ্ট জায়গায়। তরুণ চক্রবর্তী ঢুকল। অন্যান্য দিন কুশল বিনিময় হয়, আজ কেবল স্তব্ধতা। শুরু করলাম অধিবেশন, চিরাচরিত হাসিটি আজ মুখে নেই। তারপরেই তরুণের মুখে উচ্চারিত হল প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার সংবাদ। ঘোষিত হল রাষ্ট্রীয় শোক।
স্রেফ ফেলুদাকে মেয়ে বানিয়ে দিলেই পলিটিকালি কারেক্ট ট্রেন্ডিং নতুন গোয়েন্দা তৈরি হয় না। তাতে ‘দৃষ্টি’-টা তেমন পাল্টায় না। ‘ছোটলোক’-এর সাবিত্রী মণ্ডল নিজে যেমন মফসসলি আটপৌরে, তেমনই সে তার পরিবারকে সমাজের তামসিকতা থেকে আগলে রাখে, এটাই ভিন্ন মাত্রাটা নিয়ে আসে। কিন্তু সাবিত্রী মণ্ডল যে আবার আসবেন, তার আশ্বাসও তো আমরা পাচ্ছি না।