আত্মপ্রচার ও আত্মস্বার্থ সযতনে চরিতার্থ করার একটা বিস্ফোরক-যুগে দাঁড়িয়ে কবি ও অধ্যাপক নরেশ গুহকে মনে হবে দূরতম কোনও নক্ষত্রের আলো-মাখা দেবদূত। শতবর্ষ আগে সাড়ে আট দশকের পরমায়ু নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। আমাদের শেখাতে চেষ্টা করে গিয়েছিলেন মুদ্রিত অক্ষরে নিজের নাম দেখা আর পুরস্কারের শিরোপা সন্ধান করাই সাহিত্য চর্চা নয়। তার পরিসর অনেক বড় এবং মহৎ।
গঙ্গার তীর ঘেঁষে পথ। নম্র পদচারণায় হেঁটে চলেছেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর এক হাত কবি অমিয় চক্রবর্তীর কাঁধে, অন্য হাতটি নিজের কাঁধে নিয়েছেন কবি নরেশ গুহ। তিনি অবশ্য তখন দৈনিক ‘যুগান্তর’-এর সাংবাদিক। পাশাপাশি বিদেশি ‘কোয়েকার’ গোষ্ঠীর হয়ে ত্রাণকার্যের স্বেচ্ছাসেবক। ১৯৪৭-এর ৩০ এপ্রিল। দাঙ্গা বিধ্বস্ত বিহারে ত্রাণ বিষয়ে আলাপ চলছিল পাটনা শহরে এই তিনজনের পদক্ষেপে। গান্ধীজির পরামর্শ মন দিয়ে শুনছেন দুই প্রজন্মের বাংলা কবিতার দুই বিখ্যাত প্রতিনিধি। নরেশ তাঁর ‘দাঙ্গার পরেকার দিনলিপি’-তে লিখেছেন: ‘উঠোনের পথ দিয়ে বেড়াতে-বেড়াতে তিনি কতো কথাই বললেন। আশি বছরের কোনো উদ্ধত রেখাই দেহে নেই। কালকে যেন অতিক্রম ক’রেছেন তিনি তাঁর মন দিয়ে, জীবনের শক্তি দিয়ে।’
ঠিক ৮০ বছর আগে বঙ্গজুড়ে নেমে এসেছিল করাল দুর্ভিক্ষ। ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’। গ্রাম উজাড় করে শহর কলকাতায় এসেছে নিরন্ন মানুষ। ভাত নয়, চাইছে ফ্যান। নগরবাসীর দোরে দোরে কঙ্কালসার সন্তান কোলে নিয়ে ক্ষুধার্ত মা! এদের মুখে অন্ন তুলে দিতে ‘কোয়েকার’ গোষ্ঠীর সদস্য নরেশ দিনরাত্রি পরিশ্রম করেছেন; লঙ্গরখানার স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তাঁর মানবিক ভূমিকার কথা খুব বেশি জানা যায় না।
আত্মপ্রচারের আজকের অসভ্যতা তখন বিরল। নরেশ গুহ এই বিষয়ে নিজের ভূমিকার কথা আড়ালে রেখেছেন সযত্নে। ডায়েরি লিখতেন নিয়মিত। এখনও পর্যন্ত অপ্রকাশিত মোট আটটি ডায়েরির পাতায় খুঁজে পাওয়া যায় এই ভিন্ন মানুষটিকে, যিনি শুধু কবি নন, মানবিক সত্তায় উজ্জ্বল এক পরিশ্রমী দেশসেবক।
‘ক্যামেরা হাতে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াও বুঝি?’– প্রশ্নটা করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সকালেই তিনি শুনেছিলেন কলকাতা থেকে একটি কলেজ-ছাত্র শান্তিনিকেতন আশ্রমে পায়ে হেঁটে এসেছে। তীর্থ ভ্রমণে পুণ্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ পন্থা পদব্রজে গমন– এই ঋষিবাক্য মান্য করে রিপন কলেজের ছাত্র নরেশ গুহ এমন আশ্চর্য কাণ্ডের নায়ক হয়ে উঠেছিলেন সেদিন। সংবাদটি ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। রবীন্দ্রনাথও জানতে পেরেছেন যথা সময়ে। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাস। গুরুদেব তখন বেশ অসুস্থ। দর্শনার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাতে বেশ কড়াকড়ি তখন। কবি নিজেও সেই নিয়ম ভাঙেন না। ১৭ বছরের নরেশ বুঝে গেলেন এই যাত্রায় ঈশ্বর-দর্শন অসম্ভব।
সেদিন বিকেলে ‘উদীচী’ বাড়ির দোতলায় কবি তখন আরামকেদারায় আসীন। বাড়িটি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। নরেশ দেখতে পেলেন তারই এক জায়গায় একটি সুড়ঙ্গের মতো গর্ত। কুকুরদের তৈরি বিশেষ পথ। সেই পথে নরেশ ঢুকে গেলেন। সোজা তাঁর স্বপ্নের মহামানবের কাছে। খুব ইচ্ছে, সদ্য কেনা বেবি ব্রাউনি ক্যামেরায় গুরুদেবের একটি ছবি তোলা। সে কথা জানাতে রবীন্দ্রনাথ ওই প্রশ্নটি করেন। মুখে মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি নিয়ে কবি বললেন: ‘আচ্ছা কালকে এসো। সকালে কলকাতা যাচ্ছি। ট্রেনের সময় জেনে নিয়ে আগেই চলে এসো।’
এর অনেক পরে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে নরেশ গুহ-র অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তাঁর ‘শান্তিনিকেতনে ছুটি’ কবিতাটি পাঠক মহলে আদৃত হয়েছিল:
‘শান্তিনিকেতনে বৃষ্টি: ছুটি শেষ/ ভিজে আলতা-লাল
শূন্য পথ/ ডাকঘরে বিমুখ কাউন্টার চুপ/ কাল
হয়তো রোদ্দুর হবে, শুকোবে খোয়াই, ভিজে ঘাস…’।
কবির ‘দুরন্ত দুপুর’ কাব্যগ্রন্থের উজ্জ্বল কবিতাগুলির অন্যতম এটি। বইটি দিলীপ কুমার গুপ্ত তাঁর সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশ করেছিলেন। সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের করা অনন্য প্রচ্ছদ। সেই কবিতার বইয়ের সব থেকে বিখ্যাত কবিতাটির কিছু পঙ্ক্তি আজকের তরুণ-তরুণীরাও তাদের বিরহ উদযাপনে সযত্নে উচ্চারণ করে: ‘এক বর্ষার বৃষ্টিতে যদি মুছে যায় নাম/ এত পথ হেঁটে এত জল ঘেটে কি তবে পেলাম!’ আর বুদ্ধদেব বসুর কনিষ্ঠা কন্যা দময়ন্তী যখন রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ২০২ নম্বর বাড়ির সকলের আদরের ছোট্ট রুমি, তার গৃহশিক্ষক নরেশদা লিখেছিলেন ‘রুমির ইচ্ছা’ কবিতাটি: ‘হোক আমার এলো চুল,/ তবু আমি হই ফুল লাল/ ভরে দিই ডালিমের ডাল।/ ঘড়িতে দুপুর বাজে; বাবা ডুবে যান কাজে;/ তবু আর ফুরোয় না আমার সকাল।’ বাস্তবের যোগ এই কবিতার ইতিহাসে লগ্ন হয়ে আছে, তারপরও সে সর্বজনীন, চিরায়ত, শিশুর রূপকথার জগতের বর্ণময় এক প্রজাপতি যেন!
এই দেশে তুলনামূলক সাহিত্য চর্চার পথিকৃৎ বুদ্ধদেব বসু। কিন্তু তাঁর সুযোগ্য শিষ্য নরেশ গুহ না থাকলে এই চর্চা অঙ্কুরে বিনষ্টির উদাহরণ হয়ে থাকত না কি? ছয় দশকে মহীরুহ হয়ে ওঠা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগ, যার সংক্ষিপ্ত অতি-আদুরে নাম তু.সা. বিভাগ, তাঁকে লালন করতে গিয়ে বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের উজ্জ্বলতম প্রতিভাবান এই কবির কবিসত্তার অপমৃত্যু ঘটেছে। সারা জীবনে কবিতার বই লিখেছেন মাত্র তিনটি, একটি কবিতা সংগ্রহ, প্রবন্ধের বই দু’টি, আছে দু’টি ইংরেজি বই। সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ও কুমারন আসান পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। এই নিরস তথ্য সমূহ থেকে প্রকটিত হয়ে ওঠে নরেশ গুহ-র আদর্শ শিক্ষকের স্বরূপটি। আত্মপ্রচার ও আত্মস্বার্থ সযতনে চরিতার্থ করার একটা বিস্ফোরক-যুগে দাঁড়িয়ে কবি ও অধ্যাপক নরেশ গুহকে মনে হবে দূরতম কোনও নক্ষত্রের আলো-মাখা দেবদূত। শতবর্ষ আগে সাড়ে আট দশকের পরমায়ু নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি। আমাদের শেখাতে চেষ্টা করে গিয়েছিলেন মুদ্রিত অক্ষরে নিজের নাম দেখা আর পুরস্কারের শিরোপা সন্ধান করাই সাহিত্য চর্চা নয়। তার পরিসর অনেক বড় এবং মহৎ।
নরেশ গুহকে লেখা বুদ্ধদেব বসুর চিঠির সংখ্যা ১৯০, অমিয় চক্রবর্তীর ৮৬, অশোক মিত্রের ৬৩। ‘সংরক্ষণযোগ্যর পত্রাবলি’-র এই তালিকা নিজেই তৈরি করেছিলেন পত্রপ্রাপক নরেশ। এই তালিকায় আরও আছেন যামিনী রায়, শিবরাম চক্রবর্তী, জীবনানন্দ দাশ, সুকান্ত ভট্টাচার্য, আবু সয়ীদ আইয়ুব, পুলিনবিহারী সেন, অম্লান দত্তর মতো শতাধিক ব্যক্তিত্ব। জীবদ্দশাতে সেগুলো প্রকাশের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। নিজে হাতে সেগুলি সযত্নে পুনর্লিখন করেছিলেন। এছাড়া ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথকে লেখা কবি অমিয় চক্রবর্তীর চিঠি, যার নাম ‘কবির চিঠি কবিকে’, প্রমথ চৌধুরীকে লেখা অমিয় চক্রবর্তীর চিঠি ‘সাহিত্য সারথির সমীপে’ গ্রন্থনামে সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। বিপুল শ্রমে সম্পাদিত সেই সমস্ত পত্র-পাণ্ডুলিপি এই সময়ের তরুণ প্রজন্মের গবেষকদের পক্ষে হয়ে উঠতে পারে দর্শনীয়, শিক্ষণীয় উপাদান। নরেশ গুহ-র শতবর্ষে অপ্রকাশিত পত্রাবলি ও ডায়েরির এই আশ্চর্য ভাণ্ডার গ্রন্থাকারে প্রকাশে এগিয়ে আসবেন কেউ?