প্রাচীন কাউনিয়া শ্মশানের অদ্ভুত এক বৈশিষ্ট্য, যা সাধারণত অন্য কোনও শ্মশানে দেখা যায় না। বিশাল জায়গায় মৃতদের উদ্দেশ্য রয়েছে একাধিক সমাধি মন্দির। পুরুষ মহিলা শিশু সবাই চলেছেন সমাধি বেদিতে মোমবাতি বা দীপ জ্বালাতে। এ যেন কলকাতার মতো এক উৎসবের আবহ। গোটা জেলা তো বটেই, গোটা দেশ, এমনকী, বিদেশ থেকেও লোক আসছে পূর্বপুরুষদের স্মৃতির উদ্দেশ্য শ্রদ্ধা জানাতে। মাইকে সমানে বাজছে শ্যামাসংগীত ও বাংলা গান। ঢাকের শব্দ কম। গভীর রাতে হবে শ্মশান কালীপুজো। এখন চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে শুনছি কান্না।
এ শ্মশানে আমি বহুবার গেছি। নয় একরের বেশি জায়গা নিয়ে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড়, আক্ষরিক অর্থেই মহা শ্মশান। বরিশাল শহরের পশ্চিম দিকের, জেলখাল ও লাখুটিয়া খালের সংযোগে কাউনিয়ায় এ শ্মশানে আজ হাজারে হাজারে লোক চলেছেন দীপ উৎসবে। আগামী কাল কালীপুজো। বরিশাল শহরে কালীপুজোর সংখ্যা কম নয়। অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশটি তো হবেই। স্বাভাবিকভাবেই দুর্গোপুজো এবারে হয়েছে, সংখ্যা ধরলে নিশ্চিত দ্বিগুণ।
বাখরগঞ্জ থেকে ১৭৯০,বা ’৯৩ সালে আজকের বরিশাল শহর গড়ে উঠল ধীরে ধীরে, মূলত কীর্তনখোলা নদী বা সদর ঘাটের আশপাশের এলাকায়। পরবর্তীতে আরও তিনটি গ্রাম বা মৌজাকে শহরের সঙ্গে যোগ করা হল। অলকানন্দা বা আলেকান্দা, কাউনিয়া, আমানতগঞ্জ তিনটি গ্রাম এখন ঝলমলে বরিশালের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। কাউনিয়া শ্মশান কিন্তু বহু পুরনো। এ শ্মশানের অদ্ভুত এক বৈশিষ্ট্য, যা সাধারণত অন্য কোনও শ্মশানে দেখা যায় না– বিশাল জায়গায় মৃতদের উদ্দেশ্য রয়েছে একাধিক সমাধি মন্দির। শোনা যায়, এই সমাধি স্থাপত্যে গড়ে উঠেছে একদা বরিশালের ব্রাক্ষ্ম সমাজের প্রভাবে। জীবনানন্দ দাশ বা অনেক বিখ্যাত লোক ছিলেন ব্রাক্ষ্ম। এখন অবশ্য ব্রাক্ষ্ম সমাজের রমরমা নেই। এক-দু’ঘর খুঁজে পেতে ব্রাক্ষ্ম থাকলেও থাকতে পারেন। কিন্তু তাঁদের ঐতিহ্যবাহী উপাসনালয় কোনওরকমে ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়ে গেছে। কিন্তু সমাধি মন্দিরের ঐতিহ্য থেকে গেছে কাউনিয়ার শ্মশানে।
পুরুষ মহিলা শিশু সবাই চলেছেন সমাধি বেদিতে মোমবাতি বা দীপ জ্বালাতে। এ যেন কলকাতার মতো এক উৎসবের আবহ। পুলিশ ‘নো এন্ট্রি’ বোর্ড লাগিয়ে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করছে। পাশে ভলেন্টিয়ার্সে বাহিনী। গোটা জেলা তো বটেই, গোটা দেশ, এমনকী, বিদেশ থেকেও লোক আসছে পূর্বপুরুষদের স্মৃতির উদ্দেশ্য শ্রদ্ধা জানাতে। মাইকে সমানে বাজছে শ্যামাসংগীত ও বাংলা গান। ঢাকের শব্দ কম। গভীর রাতে হবে শ্মশান কালীপুজো। এখন চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে শুনছি কান্না। প্রিয়জনের জন্য মনখারাপের দিন আজ। চলে যাওয়া মা, বাবা, সন্তানের কত সুখস্মৃতি। ভালোবাসার জন যে খাবার ভালোবাসতেন ,তাই তার উত্তরসূরিরা নিয়ে এসেছেন। অনেক মুসলমান লোকজন আসছেন মহাসমারোহে। এখানে কোনও ধর্মের রং নেই। না দেখলে এই আবেগকে বোঝা সম্ভব নয়। বরিশালে হিন্দু জনসংখ্যা খুব কিছু কম নয়। অর্থনৈতিক অবস্থাপন্ন হিন্দু যথেষ্ট। অনেক ব্যবসা আজও হিন্দুদের হাতে। দূর থেকে নানা কাহিনি বাজারে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সংঘাত নয়, সম্প্রীতি আজও বরিশালের মূল মন্ত্র। অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে এই শ্মশান এখন আলোকিত।