নাটাদা বলল, ‘কে, কে করেছে এরকম! দাঁড়া, আমি দেখছি!’ নাটাদার রোয়াবে আমি খানিক ভরসা পেতে শুরু করেছি। নাটাদা গিয়ে সেই নতুন মাস্তানকে বলে, ‘অ্যাই, এ আমার ছেলে, একে সরালি কেন!’ নতুন মাস্তান বলল, ‘তুমি ফোটো নাটাদা, তোমার যুগ শেষ হয়ে গেছে। তুমি চা-ঘুগনি খাচ্ছিলে, খাও। এসবে মাথা গলিও না, এখন আমাদের যুগ।’ নাটাদা খেপে গিয়ে ‘ধরে থাবড়ে দেব’– কিন্তু তা ঘটার আগেই নাটাদাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। নাটাদা এবার কলার ধরল কিন্তু নতুন মাস্তান নাটাদাকে একটা রদ্দা বসিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে নাটাদা ভূপতিত! পড়ে গিয়ে মুখটা একটু মুছে নিল। উঠল, উঠে বলল, ‘ওয়ান বাই ওয়ান এসো। এবার কে আসবে? চলে এসো, নেক্সট!’
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
যে সময়ের কথা এখন বলছি, তখন সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমাহলেরই ছিল রমরমা। ‘সিঙ্গল স্ক্রিন’ বলতে বোঝায়, একটা সিনেমা হল, সেখানে একটাই মাত্র পর্দা। তখন এই কলকাতায় সিনেমার চেন ছিল। যেমন উত্তরা-পূরবী-উজ্জ্বলা, মিনার-বিজলী-ছবিঘর, বসুশ্রী-বীণা-প্রাচী। কিছু হল ছিল, যারা ছিল একাকী। যেমন টাকি শো হাউস, বিধুশ্রী, জহর। শিয়ালদহের সিনেমা হল, এখনও যে বেঁচে আছে– প্রাচী। এসব জায়গায় বহু মারকাটারি বাংলা সিনেমা আসত।
১৯৫৫ সালে যখন ‘পথের পাঁচালী’ রিলিজ করল, কাকারা দেখতে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘একটা সিনেমা এসেছে বটে, কিন্তু চলছে না।’ এটা পথের পাঁচালী রিলিজ করার একেবারে প্রথম দিককার কথা। পরে নানা সময় ‘হারানো সুর’, ‘পথে হল দেরী’, ‘দেয়া-নেয়া’– এইসব ছবির কথা শুনতাম। টকি শো হাউজে ইংরেজি সিনেমা আসত প্রায়শই, সেগুলোর প্রতি বাঙালির একটু ঝোঁক ছিল। সোফিয়া লোরেন, আন্দ্রে হেপবর্ন– এঁদের নিয়ে খুবই উৎসাহ ছিল বাঙালির। আমি হলে গিয়ে প্রথম একটা ইংরেজি সিনেমাই দেখি। তখনও ছোটই। গুরুজনরা নিয়ে গিয়েছিল। ‘টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ (১৯৫৪)। সমুদ্রের তলায় কী আছে– এই ছিল তার বিষয়বস্তু। আর একবার মায়ের কোলে বসে ‘মা ও ছেলে’ নামের একটা সিনেমাও দেখেছিলাম। আমি নিজে বুঝেসুঝে প্রথম কী সিনেমা দেখতে গিয়েছি, আজকে আর মনে নেই। তবে মনে আছে, সিনেমার অ্যাডভান্স টিকিট কাটার কথা। কারণ আমার পিসিরা দুপুরবেলা ম্যাটিনি শো দেখতে যেত। ম্যাটিনি শো দেখা আর অ্যাডভান্স টিকিট কাটা, সেকালের রেওয়াজ ছিল বলা চলে!
আমরা থাকতাম বাগবাজারে, ট্রামডিপোর কাছে, গ্যালিফ স্ট্রিটের এক ভাড়াবাড়িতে। আমার পিসিমারা অনেক দিন আগে থেকেই ওখানে আছে। বলা যায়, গোটা দোতলাটাই ওরা ভাড়া নিয়ে রেখেছিল। সাবটেনান্ট বসিয়েছিল। আমার দাদু যখন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আসে, এই কলকাতায় কোথায় থাকবে জানত না! আমার পিসোমশাই থাকতেন কলকাতাতেই। পেশায় ব্যবসায়ী। এই দোতলা যেহেতু পুরোটাই নেওয়া ছিল, সেখানেই একটা ঘর জুটে গিয়েছিল আমাদের। সেখানে একটাই কল। ‘কল’ বলতে শুধু একটা জলের পাইপের লাইন নয়। ‘কল’ শব্দটা ব্যবহার বদলে গিয়েছে। ‘কল’কে আমরা একসময় বলতে লাগলাম ‘বাথরুম’, বাথরুম থেকে ‘টয়লেট’, টয়লেট থেকে ‘ওয়াশরুম’। কিন্তু কল বলতে তখন যা বোঝাত, তা হল একটা চৌবাচ্চা। সেখানে একটা কলও রয়েছে। যেখান থেকে জল এসে পড়ত চৌবাচ্চায়। সেই চৌবাচ্চা থেকে মগে করে জল নিয়ে আমরা স্নান করতাম। উঠোনের মধ্যে অনেক বাড়িতেই স্নানের এমন ব্যবস্থা ছিল। কোনও কোনও বাড়িতে দরজাও থাকত। তা বন্ধ করে স্নান করা যেত। আমাদের বাড়িতেও ছিল দরজাবন্ধওয়ালা কলঘর। এতজন ভাড়াটে কীভাবে যে একটা কলে ম্যানেজ করতাম, ভেবে পাই না। যেভাবে ভেবে পাই না আমার মায়েরা কীভাবে এত কাজ করতেন! কয়লা ভাঙা, গুল দেওয়া, উনুন ধরানো, আঁচ তৈরি, রান্না তৈরি করা। হয়তো সহায়ক ছিলেন দু’-একজন, তবুও! এসবের মাঝেই আমার পিসিমারা মাঝে মাঝে কুচি দেওয়া শাড়ি পরে ম্যাটিনি শো-তে সিনেমা দেখতে যেত।
আমি যবে একটু চালাক-চতুর হয়েছি, আমাকে পিসিরা বলত, ‘টিকিট কেটে আনবি, এক টাকা চার আনার।’ মনে আছে, একটাকা চার আনার পর টিকিট ছিল দু’টাকার। আর আড়াই টাকা ব্যালকনির। আর লাইন দিয়ে সিনেমা দেখতে লাগত ৬৫ পয়সা। ‘রাধা’ নামের এক সিনেমা হল এয়ার কন্ডিশন ছিল, সেইজন্য ৯০ পয়সার টিকিটে লাইন দিয়ে দেখতে হত। বেশ কিছু সিনেমাহলে, ধরা যাক উত্তমকুমার বা রাজেশ খান্না-ধর্মেন্দ্র, মীনাকুমারী আছেন– সেখানে আগে থেকেই টিকিট ফুল হয়ে যেত। এই ‘হাউসফুল’ ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্ল্যাকারদের জীবন।
কিছু কিছু মাস্তান ছিল– তারাই ব্যাপারগুলো কনট্রোল করত। টকি শো হাউজ এক মাস্তানের দখলে, আবার শ্রী-দর্পণা-মিনার আরেক মাস্তানের দখলে, উত্তরা-রাধা আরেকজনের। এদের মধ্যে বোঝাপড়া ছিল চমৎকার। একবার টকি শো হাউজে ‘ইয়েস্টারডে টুডে টুমরো’ দেখতে গিয়েছি। লাইন মেরেছি। তখন ওখানে একজন মাস্তান ছিলেন– নাটাদা। নাটাদা আমাদেরই পাড়ার, কয়েকটা বাড়ি পরেই থাকত। আগে নাটাদাই টকি শো হাউজ কনট্রোল করত। হঠাৎ সুগার ধরা পড়েছে। গায়ের জোরও কমেছে। ফলে এ লাইনে আর নেই।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, এই জায়গাটাকে ভুলে যায়নি নাটাদা। টকি শো হাউজের সামনে নাটাদা বসে থাকত। চোখের সামনে উঠল নতুন মাস্তান, নতুন টিকিট ব্ল্যাকার। নাটাদা দেখল, কী দ্রুত– ওর শূন্যস্থান পূরণ হয়ে গেল। তো আমি সিনেমাহলে ঢুকেছি যখন ওই মাস্তানদের দু’জন আমাকে বাচ্চা ছেলে ভেবে যাচ্ছেতাই করে তাড়িয়ে দিল। যদিও আমার তখন গোঁফ-টোঁফ দিব্যি গজিয়ে গিয়েছে। আমি জানি, এই আকস্মিক বিপদের পরিত্রাতা তখন একজনই– নাটাদা।
সবিস্তারে বললাম ওকে। নাটাদা বলল, ‘কে, কে করেছে এরকম! দাঁড়া, আমি দেখছি!’ নাটাদার রোয়াবে আমি খানিক ভরসা পেতে শুরু করেছি। নাটাদা গিয়ে সেই নতুন মাস্তানকে বলে, ‘অ্যাই, এ আমার ছেলে, একে সরালি কেন!’ নতুন মাস্তান বলল, ‘তুমি ফোটো নাটাদা, তোমার যুগ শেষ হয়ে গেছে। তুমি চা-ঘুগনি খাচ্ছিলে, খাও। এসবে মাথা গলিও না, এখন আমাদের যুগ।’ নাটাদা খেপে গিয়ে ‘ধরে থাবড়ে দেব’– কিন্তু তা ঘটার আগেই নাটাদাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। নাটাদা এবার কলার ধরল কিন্তু নতুন মাস্তান নাটাদাকে একটা রদ্দা বসিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে নাটাদা ভূপতিত! পড়ে গিয়ে মুখটা একটু মুছে নিল। উঠল, উঠে বলল, ‘ওয়ান বাই ওয়ান এসো। এবার কে আসবে? চলে এসো, নেক্সট!’
নাটাদা বিশ্বাস করেনি সে রাস্তার ধুলো খেয়েছে! মনে করেছে, সে-ই একজনকে ধরাশায়ী করেছে! আবারও নতুন মাস্তানের ঘায়ে নাটাদা পড়ল, উঠে পড়ে নাটাদার সংলাপ ছিল একই।
আমি যে-সময়ের কথা লিখলাম সেসময় বামফ্রন্ট আমলও আসেনি। ছয়ের দশকের শেষ, নকশাল আমলও শুরু হয়নি। টিকিট ব্ল্যাকাররা, অনেকেই ছিল প্রায় গার্জেন গোছের। যদিও কোনও পলিটিক্যাল দলের আশ্রিত ছিল না। ছিল নিজেদের মতো। মেট্রো-এলিট-গ্লোবে হিন্দিভাষী ব্ল্যাকাররা থাকলেও, উত্তর কলকাতায় ছিল বাঙালি ব্ল্যাকাররাই।
একসঙ্গে অনেকগুলো টিকিট কেটে রাখত এরা। ৫০টা কি ৭০-৮০টা। টিকিট কেটে, ‘দো কা চার, দো কা চার’ বলতে থাকত জনগণের মাঝে হেলতে-দুলতে। ওই লব্জের মানে হল, দু’টাকা চার আনারটা চার টাকা। এরা যদিও বাঙালি কিন্তু বলার সময় হিন্দি ব্যবহার করত। পরে দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘তিন কা ছে’ বা ‘তিন কা দস্’। যে কনট্রোল করছে, যে মাথা, এটা তার কাজ না। তার আন্ডারে যে ৪-৫টা ছেলে– তারাই এইসব হাঁক পাড়ত।
সিনেমা হলের ম্যানেজাররা অনেক সময়ই জানত যে, কারা কারা ব্ল্যাকার। তাদেরও তুষ্ট করতে হত বখড়া থেকে কিছু টাকা দিয়ে। নইলে একজনকে ১০-২০টা টিকিট দেবে কেন! এক সময় ব্ল্যাকারদের রোখার জন্য নতুন নিয়ম চালু হল। তা হল, কাউকেই চারটের বেশি টিকিট দেওয়া হবে না। চারের বেশি হলে, দু’জন লোককে টিকিট কাটকে হবে। তখন সদ্য সদ্য বিয়ে করার পর শালীদের নিয়ে সিনেমা দেখানোর একটা রেওয়াজ ছিল। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই দু’জনকে টিকিটের লাইনে দাঁড়াতে হত। ছয় শালী, মামাতো বোন-টোনদের নিয়ে সংখ্যায় অনেকে হয়ে যেত।
হতাশ হতেও দেখেছি ব্ল্যাকারদের। ক’দিন হয়তো ভালো গিয়েছে বিক্রিবাটা। সিনেমায় ‘দম’ আছে। জনপ্রতি ২০টা করে টিকিট তুলে নিয়েছে ব্ল্যাকাররা। এদিকে বৃষ্টি হল বিপুল। ভিড়ই হল না। এদিকে ম্যানেজাররাও আর ফেরত নেবে না টিকিট। কারণ তাদেরকেও তো দেখাতে হত টিকিটের হিসাব-কিতাব, ইন্সপেকশনে আসতেন কেউ কেউ। সিরিয়াল নাম্বার ছিল যেহেতু, ব্যাপারটা ছিল গোলমেলে। তখন ব্ল্যাকারদের বলতে শুনেছি, ‘ঝাড় খেয়ে গেলাম, অ্যাইসান বৃষ্টি হল, লোক এলোই না।’
এখন, এই কলকাতায়, সিঙ্গল স্ক্রিন প্রায় উঠেই গিয়েছে। টিকিটও স্বাভাবিকভাবেই আর ব্ল্যাক হয় না। তবে ব্ল্যাক করা এখনও উঠে যায়নি। টিকিট না হলেও, অন্য কিছু। কী, তা আপনারা, একটু চোখ খোলা রাখলেই টের পাবেন নিশ্চয়ই।
ছোট্ট অপুকে দেখেই রঙিন ছবিতে ভরা টানটান গল্পের বই করার ইচ্ছে জেগেছিল
আটের দশক জুড়ে কার্তিকদার সঙ্গে জুটি বেঁধে আমি প্রচুর ছোটদের বই প্রকাশ করেছি। কার্তিকদা কোনও দিনই দে’জ পাবলিশিংয়ের কর্মী ছিলেন না। কিন্তু আমাদের প্রকাশনার শিশুসাহিত্য বিভাগে তাঁর অবদান ভোলার নয়।