রবীন্দ্রনাথের গান, আমার মাস্টার হতে শুরু করল শান্তিনিকেতনে পাঠভবনে গৃহাধ্যক্ষ হয়ে কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে। আবাসিক জীবনটি সম্পৃক্ত যাপনের সুযোগে গান জড়িয়ে রইল প্রাত্যহিকতায়। দু’জন অগ্রজ সহকর্মীর কথা বলতেই হয়, যাঁরা পাঠভবনের ছাত্রাবস্থায় আমার থেকে কয়েক বছরের বড় ছিলেন– পুলক দত্ত আর শ্রীলেখা চট্টোপাধ্যায়। পাঠভবনে ক্লাসের বাইরের গানের যে জগৎটি, সুপ্রিয়দা-সুপ্রিয়াদির সঙ্গে এঁদের দু’জনের যোগদানে সেটি হয়েছিল সমৃদ্ধতর।
‘গানের মাস্টার’ বলতে ‘ওস্তাদ গাইয়ে’ বোঝা যেতে পারে কি না, না ভেবে, ‘গানের শিক্ষক’ ধরে নিয়েই কিছু কথা বলি। রবীন্দ্রনাথের গান এখন প্রায় জীবনের মাস্টার হয়ে উঠেছে। আর, সেই গান শিখতে থাকার ব্যাপারটা ফুরনোর কোনও সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। শেখার সেই অভিজ্ঞতাটিকে শুরু থেকে ফিরে দেখার চেষ্টা করা যাক।
অস্তাচলের ধার থেকে পূর্বাচলের পানে তাকালে, প্রথম স্মৃতি– রেডিওর গানের সঙ্গে মায়ের গলা মেলানোর। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয় অবশ্য। অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, নজরুলও। পুজোর সময় মাইকের গানে বৈচিত্র আরও বেশি। আলমবাজার অঞ্চলে সারদা মিশন পরিচালিত আমার প্রথম ইশকুলেও গীতা দিদিমণি, স্বপ্না দিদিমণি গান শেখাতেন। নানারকম গান। বাড়িতে গ্রামাফোন এসেছিল ইশকুলে যাওয়া শুরু করার কিছু পরে। মায়ের গান শোনা যেত আগের থেকে বেশি।
মা গান ভালোবাসতেন। মা চাইতেন আমি গান শিখি। সব বাড়িতেই তখন গান শেখার চল ছিল, তবে, ছেলেদের থেকে মেয়েদের জন্যই ‘গানের মাস্টার’রা বোধহয় বেশি আসতেন সব বাড়িতে।
ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় বনহুগলির একটি দোকান থেকে আমার জন্য একটা হারমোনিয়াম কেনা হল। আর শনিবার সন্ধ্যায় আসতে শুরু করলেন ছন্দা মাসি। মায়ের ইশকুলের সহকর্মী। হারমোনিয়ামের বেলোর নাগাল পেতাম না বলে ছন্দামাসির কোলে বসে বাজাতে হত। জর্দার গন্ধ এখনও মনে আছে। অর্থহীন সা-পা-ধা-পা বিরক্তিকর লাগত খুব। হারমোনিয়ামে বাজানোর চেষ্টা করতাম ‘আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে দোলাও’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানটি মায়ের প্রিয় ছিল। সেই হারমোনিয়াম আজও আছে আমার কাছে। সেইটেই আছে শুধু।
কয়েক মাসের মধ্যে হারমোনিয়াম বাড়িতে রেখে শান্তিনিকেতনে হোস্টেলে চলে এলাম। পাঠভবনে গানের ক্লাসে ‘গানের মাস্টার’ পেলাম সিতাংশুদাকে। সদ্যপ্রয়াত শ্রদ্ধেয় সিতাংশু রায়। আমার গান শুনে সিতাংশুদার ভালো লাগল।
সাহিত্যসভায় একা গাওয়ালেন ‘নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল’। তারপর কিছুদিন পথে-ঘাটে উঁচু ক্লাসের দিদিদের গাল টেপার অত্যাচারে বিব্রত হতে হয়েছিল। সাহিত্যসভাগুলিতে অবশ্য সমবেত গানই গাওয়া হত বেশি। বাচ্চুদি, মঞ্জুদি, কুটুদিদের কাছে কখনও কখনও ক্লাস করলেও পাঠভবনে সিতাংশুদার কাছেই গানের ক্লাস করেছি বেশি। ছুটির সময় বাড়ি গিয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে খেলা করতাম কখনও সখনও। নতুন শেখা সব গান মাকে শোনাতে হত। মা খুশি হতেন খুব। ‘কী কঠিন কঠিন গান শেখানো হয় ওখানে’ বলতেন সকলকে। মাধ্যমিকে ১০০ নম্বরের একটা বেছে নেওয়ার বিষয়– মায়ের আগ্রহে নিতে হয়েছিল গান। বন্ধুরা প্রায় প্রত্যেকেই নিল ‘কাঠের কাজ’। আকারমাতৃক স্বরলিপির নিয়মকানুন কিংবা অতুলপ্রসাদ রজনীকান্তের জীবনী পড়তে বিরক্তিকর লাগত। আমার তালজ্ঞান আর অধ্যবসায়ের অভাবে সিতাংশুদাও কম বিরক্ত হতেন না।
দশম শ্রেণির শেষদিকে সিতাংশুদা গেলেন সংগীতভবনে। পাঠভবনে গানের শিক্ষক হয়ে যোগ দিলেন বিজয় সিংহ। বিজয়দাকে তার আগে সংগীতভবনের ছাত্রাবস্থায় চিনতাম। শান্তিদার প্রিয় ছাত্র। হারমোনিয়ামে চাপড় মেরে মেরে কোরাস গানের জোয়ার আনলেন বিজয়দা। মেয়েদের থেকে ছেলেরা কেন কম গান গায়– প্রশ্ন তুলে ‘বিদায়ীসভা’য় আমাদের ‘বিদায়ী’ ক্লাসের চারজন ছেলেকে দিয়ে একা গান গাইয়েছিলেন। সুগায়িকা সহপাঠিনীরা অনেকেই সুযোগের অভাবে দুঃখ পেয়েছিল।
পাঠভবনের জীবনে গানের ক্লাসে যত গান শিখেছি, তার থেকে অনেক বেশি শিখেছি ক্লাসের বাইরে। বিশেষ করে পিকনিক এক্সকারশনে। ক্লাসের বাইরের এই গানের জগতে দু’জন ছিলেন প্রধান। সুপ্রিয়দা, অধ্যক্ষ সুপ্রিয় ঠাকুর, আর সুপ্রিয়াদি, ইংরেজি শিক্ষিকা, শান্তিদার ভ্রাতৃবধূ। রবীন্দ্রনাথের গান কত যে এঁদের জানা ছিল, কথা দেখতে হত না, একের পর এক গেয়ে চলতেন সকলকে নিয়ে। উঁচু ক্লাসের দাদা-দিদিদের সঙ্গে গলা মেলাতে মেলাতে আমরাও শিখে যেতাম কত গান। স্বরলিপি দেখতে আর শেখা হয়নি কখনও। আর অনেক গান শুনতাম বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে, উপাসনাগৃহে। বিশেষ বিশেষ উপাসনায় একা গাইতেন শান্তিদা-মোহরদি-বাচ্চুদিরা। শান্তিদার গলা শুনলে কেমন যেন হাসি পেত, মোহরদি-বাচ্চুদির গানে পেত ঘুম। আজ কৃতজ্ঞ লাগে খুব। অবচেতনে রয়ে গিয়েছে সেই গানেরা। মহর্ষি-স্মরণের উপাসনায় ওস্তাদজি, ওয়াজেলওয়ার, গাইতেন ‘পরিপূর্ণম্ আনন্দম্’। পরে মোহনদা। আরও পরে চন্দন মুন্সী অথবা সন্দীপ সেন। বারে বারে শুনতে শুনতে কখন অজান্তে চেনা চেনা হয়ে গেছে অপরিচিত কঠিন গানটি।
কলকাতায় কলেজে পড়তে গেলাম যখন, মায়ের ইচ্ছে ছিল গান শেখাটা নতুন করে শুরু করি। কিন্তু ততদিনে ‘মানুষ’ হয়ে গেছি। মায়ের সব ইচ্ছেতে সম্মতি জানানোর মতো ছোট নেই। বাড়িতে থাকতামই বা কতটুকু সময়! তবে গণসংগীতের দলে ভিড়ে এদিক-ওদিক চেঁচিয়ে বেরিয়েছি অনেক।
রবীন্দ্রনাথের গান, আমার মাস্টার হতে শুরু করল শান্তিনিকেতনে পাঠভবনে গৃহাধ্যক্ষ হয়ে কাজে যোগ দেওয়ার পর থেকে। আবাসিক জীবনটি সম্পৃক্ত যাপনের সুযোগে গান জড়িয়ে রইল প্রাত্যহিকতায়। দু’জন অগ্রজ সহকর্মীর কথা বলতেই হয়, যাঁরা পাঠভবনের ছাত্রাবস্থায় আমার থেকে কয়েক বছরের বড় ছিলেন– পুলক দত্ত আর শ্রীলেখা চট্টোপাধ্যায়। পাঠভবনে ক্লাসের বাইরের গানের যে জগৎটি, সুপ্রিয়দা-সুপ্রিয়াদির সঙ্গে এঁদের দু’জনের যোগদানে সেটি হয়েছিল সমৃদ্ধতর। আমি আর আমার সহকর্মী গৃহাধ্যক্ষ পার্থ চক্রবর্তী এই দলে জুড়ে গেলাম অনতিবিলম্বে। ‘পিকনিক-আউটিং-এক্সকারশন-রেইনি ডে’ উপলক্ষের অভাব ছিল না। আর একটা বিরাট সৌভাগ্য হল, সব উৎসব-অনুষ্ঠান-নৃত্যনাট্যের মহলাগুলি হত ছাত্রাবাস সংলগ্ন বড় পাঠকক্ষগুলিতে। আমার বাসস্থানটিও ছিল সে প্রাঙ্গণেই। ফলে গানের ঝরনাধারায় অবগাহনের অবকাশ ছিল অফুরান। তার সঙ্গে সাপ্তাহিক উপাসনার গানেরা তো ছিলই। আজ তাই বলতেই পারি, শান্তিনিকেতনই আমার ‘গানের মাস্টার’।
ছাত্রাবাসের ছাত্রদের সঙ্গে গান করতে ভালো লাগত। ওরাও খুশি হত। ওদের সঙ্গে গাইতে গাইতে টের পেতাম চেনা গানেদের নতুন করে চিনছি। কথাগুলো নতুন করে ধরা দিচ্ছে পরিণত মনে। গানেরা নিজেরাই এভাবে ক্রমশ ‘মাস্টার’ হয়ে উঠল।
আজ, অবসর জীবনের অস্তাচলে এসে আর এক সৌভাগ্যের স্পর্শ পাচ্ছি। ছোটদের সঙ্গ পাই নিয়মিত। তাদের সঙ্গে গান করার সুযোগও পাই। অনেকে হয়তো মনে করেন আমি গান শেখাই, মানে ‘গানের মাস্টার’ হয়ে গিয়েছি বুঝি। একেবারেই তা নয়। আমি তো গানের কাছেই গানটা শিখি আর শেখাই শুধু নিজেকেই। শোনাইও শুধু নিজেকেই। মা তো আর কাছে নেই যে, গান শুনতে চেয়ে বিরক্ত করবে। চোখ খুলে গান করতে পারি না কিছুতেই। চোখ বন্ধ না করলে গানের মধ্যে ডুব দেওয়া কঠিন হয়। আমি গাইতে থাকি, ছোটরা আমার সঙ্গে গাইতে থাকে। আবার আমিও তাদের সঙ্গে গাইতে থাকি। গানে স্নান করতে থাকি। তালকানা তো চিরকালই। সুরও কত ভুলভাল হয়। কিন্তু ভালোবাসায় ভরে ওঠে মন। গানে ভরে ওঠে।