সোমেন্দ্রনাথ সেদিন আনন্দ করে সারা বাড়ি চিৎকার করলেন ‘রবি নোবেল প্রাইজ পেয়েছে, রবি নোবেল প্রাইজ পেয়েছে!’ শুধু একটি প্রাণ সে আনন্দে যোগ দেয়নি। সে কবির আত্মজা। প্রথম কন্যা মাধুরীলতা, কবির আদরের বেলা। তাঁর কাছ থেকে আসেনি কোনও শুভেচ্ছাবার্তা, কোনও অভিনন্দন। মেয়ে, জামাই– দু’জনেই ছিলেন আশ্চর্য রকমের নীরব, নিস্পৃহ। কেউ এগিয়ে আসেনি একগোছা রজনীগন্ধা অথবা একটি গোলাপ নিয়ে। কারণ তার আগের বছর থেকেই কবির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছে।
তনুশ্রী ভট্টাচার্য
রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির পর নিকট দূর,আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলের কাছ থেকেই শত শত অভিনন্দন বার্তা শুভেচ্ছা বাণী এসেছে। যেদিন তাঁর হাতে এক সন্ধ্যালগ্নে কলকাতা থেকে তাঁর প্রিয় মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের একটি টেলিগ্রাম এল কবি তখন শান্তিনিকেতনে দিনেন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ ও নেপাল রায়ের সঙ্গে পারুলডাঙায় বেড়াতে বেরচ্ছিলেন। সেদিন ছিল রাসপূর্ণিমা– ১৪ নভেম্বর। কবি পকেটে রেখেই দিচ্ছিলেন টেলিগ্রামটি। অন্যরা দেখতে অনুরোধ করলে সন্ধের আধাঁরে অস্পষ্ট আলোয় তিনি পড়লেন, ‘Nobel Prize conferred on you, our congratulations.’
এরপর শুরু হল শুভেচ্ছার বন্যা। দেশ এবং বিদেশ থেকে। বিদেশ থেকে রোটেনস্টাইন, স্টার্জ ম্যুর, মে সিনক্লেয়ার, রবার্ট ব্রিজেস প্রমুখ সাহিত্যিক চিঠি, টেলিগ্রাম করছেন। এদেশে একটার পর একটা সভায় তাঁকে বরমাল্য পরানো হচ্ছে। কলকাতা, শান্তিনিকেতন– সর্বত্রই আনন্দ। বৃক্ষে সরু-মোটা শাখার আন্দোলন। এমনকী, যাঁরা এতদিন রবীন্দ্রনাথের কঠোর নিন্দা প্রতিকূল সমালোচনা করতেন, বিদ্বেষ পোষণ করতেন– তাঁরাও এলেন কবিকে মালা-চন্দন পরাতে। কবির লেখার সঙ্গে যাঁদের তেমন পরিচয়ই নেই, মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারেন না, তাঁরাও এসেছেন। বস্তুত কবির নোবেল জয়ে বাঙালি যেন নব আনন্দে জেগে উঠল। এমনকী, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে মানসিক স্থিতি-হারানো কবির ঠিক ওপরের দাদা সোমেন্দ্রনাথও সেদিন সচেতনভাবেই আনন্দ করে সারা বাড়ি চিৎকার করেন ‘রবি নোবেল প্রাইজ পেয়েছে, রবি নোবেল প্রাইজ পেয়েছে!’ শুধু একটি প্রাণ সে আনন্দে যোগ দেয়নি। সে কবির আত্মজা। প্রথম কন্যা মাধুরীলতা, কবির আদরের বেলা। তাঁর কাছ থেকে আসেনি কোনও শুভেচ্ছাবার্তা, কোনও অভিনন্দন। মেয়ে, জামাই– দু’জনেই ছিলেন আশ্চর্য রকমের নীরব, নিস্পৃহ। কেউ এগিয়ে আসেনি একগোছা রজনীগন্ধা অথবা একটি গোলাপ নিয়ে। কারণ তার আগের বছর থেকেই কবির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছে। সাংসারিক শীর্ণতা হৃদয়ের দৈন্যের পরিচয় হয়ে রয়ে গেল।
শ্রীকণ্ঠ সিংহের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ এবং সত্যপ্রসাদ
এর সূত্রটা এইরকম। কবি যখন আমেরিকা গেলেন জোড়াসাঁকোর লালবাড়িতে বড় মেয়ে, ছোট মেয়ে আর দুই জামাইকে নিয়ে এসে রাখলেন। লালবাড়ি শুভ লাল ছিল না কবি ও তাঁর মেয়েদের পক্ষে। সেটা যেন আগুনে লাল হয়ে একটা বিচ্ছেদ, মনোমালিন্যের সৃষ্টি করল দুই মেয়ে এবং কবির মধ্যে। ছোট জামাই নগেন্দ্রকে বাড়ি দেখাশোনার ভার দেওয়াতে বড় জামাই ব্যারিস্টার শরৎ চক্রবর্তীর অস্মিতায় লাগল। এদিকে নগেন্দ্র সংসার খরচ বাঁচানোর জন্য বড় জামাইয়ের ইংরেজি খবরের কাগজ বন্ধ করে দিলেন। তাতে বিদ্বেষ বাড়ল। এমনকী, কার ঘরে আগে কাগজ যাবে, সে নিয়েই গোল বাঁধল। হেমলতা দেবীর রচনা থেকে এমনটাই জানা যায়। পরিস্থিতি এতটাই ঘোরালো হল যে অন্তঃসলিলা এই বিরোধ দুই বোনের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ল। এবং সেই সময়েই বিয়ের ১২ বছর পর সন্তানসম্ভবা হলেন বেলা দেবী, সেই অবস্থাতেই ওই লালবাড়ি ছেড়ে তাঁরা চলে যান ডিহি শ্রীরামপুরের ভাড়াবাড়িতে। এতসব খবর আমেরিকায় কবির কাছে অনেকটা দেরিতে পৌঁছেছে। কবির অজান্তেই এই বিচ্ছেদ ঘটে গেল। বড় মেয়ে অভিমানী বেলা প্রবাসী বাবাকে কিচ্ছুটি জানালেন না। এমনকী, রবীন্দ্রনাথ যখন আমেরিকায় বক্তৃতা করছেন, লোকে মুগ্ধ হয়ে শুনছে তখন সে আনন্দ-সংবাদ তিনি বেলাকে চিঠিতে জানাচ্ছেন কিন্তু বেলা তার প্রত্যুত্তর দেননি। বস্তুত বেলা তখন জোড়াসাঁকোর লালবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। বাবার আনন্দের ভাগীদার হননি।
রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর কোলে শিশু বেলা (মাধুরীলতা)
ঠিক যেমন ভাগীদার হননি আরও বড় আনন্দ নোবেল পাওয়ার খবরে। কারণ তখন পিতাপুত্রীর মধ্যে চার বছরের শীতল সম্পর্ক শুরু হয়েছে। ক্ষমা চেয়ে একের পর এক চিঠি লিখে গেছেন কবি– মেয়েকে, জামাইকে, তবু তাঁরা কাছে আসেননি। মেয়ে বাবাকেই দোষী সাব্যস্ত করেছে, জামাই-শ্বশুরের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথ নিজের সহ্যশক্তি দিয়ে তা সহ্য করে গিয়েছেন।
যে রবীন্দ্রনাথ ধনের ক্ষতি অপেক্ষা মনের ক্ষতিকে বেশি ক্ষতিকর মনে করতেন সেই রবীন্দ্রনাথকেও এই ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছিল। বড় মেয়ে একটিবারের জন্যও বাবার কাছে এলেন না। ইতিমধ্যেই স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ও ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ ও ছোট মেয়ে রেণুকার মৃত্যু হয়েছে। সেই দুঃসহ বিচ্ছেদ-বেদনা কবির বুকে শেল বিঁধে আছে। আর বড় মেয়ে নিজের অভিমান নেই দূরেই রয়ে গেলেন সেই আনন্দের দিনে। আসেননি শ্রদ্ধাচন্দনে বাবাকে ভূষিত করতে। আসেননি ছোটবেলার মতো ‘বাবা’ বলে ডাক দিয়ে। যার আদলে কাবুলিওয়ালার ‘মিনি’ চরিত্রটি গড়েছিলেন কবি, সেই বকবক করা বেলা এখন রইলেন কঠিন ভাবে নিশ্চুপ। যে জামাইকে তিনি নিজের খরচে বিলেতে ব্যারিস্টার করিয়ে আনলেন, হাইকোর্ট যাওয়া-আসার সুবিধার জন্য জোড়াসাঁকোর লাল বাড়িতে এনে রাখলেন– সেই জামাই শরৎ চক্রবর্তীর অকারণ বিদ্বেষে কবির সংস্রব ত্যাগ করলেন। ক্ষমাপ্রার্থী বরেণ্য শ্বশুরকে মর্যাদা দেওয়ার কথা মনেও এল না।
মাধুরীলতা (বেলা)
নোবেল প্রাপ্তির সংবাদে আনন্দের পাশে এই বেদনা ও বিষাদ, এই অভিমান ও অত্যাগসহন নিয়েই কবি এই খ্যাতিকে গ্রহণ করেছিলেন। সুখ ছিল না এই যশের গৌরবে।
এই ‘পোস্ট’-মডার্ন যুগেও ‘শুকনো কাঠ’ খারাপ বাংলা আর ‘নীরস তরুবর’ ভালো বাংলা?
তলিয়ে দেখলে এখন বুঝতে পারি, যে সরস্বতীর চেয়ে হাঁসটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়েই যত বিপত্তি। চিন্তার চেয়ে চিন্তার বাহন ভাষাটাকে নিয়ে আমাদের এই বেশি মরি মরি ভাবটাই যত নষ্টের গোড়া।