রবীন্দ্রনাথের জার্মান বন্ধু হেরমান কাইজারলিং। রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি তাঁর সম্পাদিত প্রবন্ধ সংকলন ‘The Book of Marriage’-এর জন্য একটি লেখা চেয়েছিলেন। সেই বইয়ের কথা ভেবেই রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতবর্ষীয় বিবাহ’ প্রবন্ধটি লেখেন। ছাপা হয়েছিল ‘প্রবাসী’ পত্রে। পরে তার ইংরেজি ভাষান্তর ‘The Indian Ideal of Marriage’ রচিত হয়। ‘ভারতবর্ষীয় বিবাহ’ প্রবন্ধে ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটি হিন্দু সমাজের নিয়মনীতির ক্ষেত্রে তিনি প্রয়োগ করেছিলেন।
ফ্যাসিবাদ কি পাশ্চাত্যের বিশেষ রাজনৈতিক দলগুলির ক্রিয়াকর্মের ফলে জেগে ওঠা ব্যবস্থাপনা? আমাদের নিত্য-শুদ্ধ-মুক্ত ভারতে কি পাশ্চাত্যের এই একদলীয় ফ্যাসিবাদের গোড়াপত্তন আদপে সম্ভব? চিন্তাশীলরা বলেন, হয়তো ঠিকই বলেন, এদেশে পাশ্চাত্যের মতো রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ কায়েম করা কঠিন। তাই বলে কি এদেশে ফ্যাসিবাদের কোনও লক্ষণ কিংবা উপসর্গ কখনও ছিল না! আমরা কি তবে নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে সুখনিদ্রায় ডুবে যাব? বহু ভাষার ও বহুদলের এই দেশে আমরা কি তবে নিরাপদ? আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ অসম্ভব! না, অসম্ভব নয়। আমাদের সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের ওপর যে নিষেধনীতি চাপানো হয়েছিল, তা ব্যবহার করেই যে রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ আত্মপ্রকাশ করতে পারে, রবীন্দ্রনাথ তা বুঝতে পেরেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের জার্মান বন্ধু হেরমান কাইজারলিং। রবীন্দ্রনাথের কাছে তিনি তাঁর সম্পাদিত প্রবন্ধ সংকলন ‘The Book of Marriage’-এর জন্য একটি লেখা চেয়েছিলেন। সেই বইয়ের কথা ভেবেই রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতবর্ষীয় বিবাহ’ প্রবন্ধটি লেখেন। ছাপা হয়েছিল ‘প্রবাসী’ পত্রে। পরে তার ইংরেজি ভাষান্তর ‘The Indian Ideal of Marriage’ রচিত হয়। ‘ভারতবর্ষীয় বিবাহ’ প্রবন্ধে ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটি হিন্দু সমাজের নিয়মনীতির ক্ষেত্রে তিনি প্রয়োগ করেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘আজকের দিনে ফ্যাসিজ্ম্ নামে যে-একটি পীড়নশক্তি পাশ্চাত্ত্য মহাদেশে প্রবল হয়ে উঠেছে, সে হচ্ছে আমাদের সমাজপ্রচলিত নিষেধনীতির অবিকল প্রতিরূপ।’
এ-কথার সামনে এসে থমকে দাঁড়াতে হয়। ‘সমাজপ্রচলিত নিষেধনীতির অবিকল প্রতিরূপ’ হল পাশ্চাত্যের ফ্যাসিবাদ। তার মানে ফ্যাসিবাদ কেবল রাজনৈতিক শক্তির ক্রিয়াকলাপের ফলে গড়ে ওঠা ব্যবস্থাপনা নয়; ফ্যাসিবাদ একরকম নিষেধাত্মক, অগণতান্ত্রিক, ইচ্ছার স্বাধীনতাহরণকারী পদ্ধতি, যা এদেশে সামাজিকভাবেও গড়ে তোলা সম্ভব! রবীন্দ্রনাথকে খুবই দূরদর্শী বলে মনে হয়। তাঁর এ-লেখার একটু আগেই প্রকাশিত হয়েছে ‘মুক্তধারা’ আর ‘রক্তকরবী’। দুই নাটকেই রাজনৈতিক শক্তির প্রসঙ্গ রয়েছে– দমবন্ধ করা রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা এ-দুই নাটকে মানুষের স্বাধীনতাকে হরণ করেছে। ‘মুক্তধারা’র থেকে ‘রক্তকরবী’ আরও ভয়ংকর।
তবে রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধে রাজনীতির দিকে নয়, সমাজপ্রচলিত নিষেধনীতির দিকে চোখ ফেরাচ্ছেন। কেন? রবীন্দ্রনাথ জানেন ও মানেন ভারতবর্ষীয় সমাজের সামর্থের কথা। ভারতবর্ষে সমাজের সামূহিক মনই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। ফলে যদি কোনও রাজনৈতিক শক্তিকে নিষেধাত্মক নীতির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে হয়, তাহলে সমাজমনকে জয় করতে হবে। সেই সমাজমনে যুগ-যুগান্তর ধরে যে নিষেধনীতি রয়েছে, সেই নিষেধনীতির পালে যদি একবার হাওয়া দেওয়া যায় তাহলে সেই রাজনৈতিক দলের জয় অনিবার্য। আর সামাজিক নিষেধনীতির সঙ্গে ধর্মীয় নিষেধনীতির যোগ অবিচ্ছেদ্য। ফলে ভারতবর্ষে কোনও রাজনৈতিক দল যদি ফ্যাসিবাদকে কায়েম করতে চায় তাহলে সামাজিক নিষেধনীতির পালে তাদের হাওয়া দিতেই হবে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, ‘মুক্তধারা’ ও ‘রক্তকরবী’ দুই নাটকেই সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধনীতিকে কৌশলে কাজে লাগিয়েছে রাজনৈতিক শক্তি। যন্ত্ররাজ বিভূতির কাজকর্ম কেমন সাংঘাতিক সংস্কৃতায়িত শব্দে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই সংস্কৃতায়িত শব্দগুলিই তো সমাজমনে নিষেধাত্মক ভয় ও সম্ভ্রম জাগিয়ে তুলেছে দীর্ঘদিন ধরে। তাই শাসক রাজনৈতিকভাবে সেই শব্দগুলিকে এবার কাজে লাগাচ্ছেন। যন্ত্ররাজের সৃষ্ট বাঁধের বন্দনামন্ত্র রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শব্দগুলি ভয়ংকর। চক্রমুখরমন্দ্রিত, বজ্রবহ্নিবন্দিত, বস্তুবিশ্ববক্ষোদংশ ধ্বংসবিকট দন্ত। লৌহগলন শৈলদলন অচলচলন মন্ত্র। কাষ্ঠলোষ্ট্রইষ্টকদৃঢ় ঘনপিনদ্ধ কায়া, ভূতলজল-অন্তরীক্ষ-লঙ্ঘন লঘুমায়া, খনিখনিত্রনখবিদীর্ণ ক্ষিতি বিকীর্ণ-অন্ত্র, পঞ্চভূতবন্ধনকর ইন্দ্রজালতন্ত্র।
পড়লে চমকে যেতে হয়! মাথা ঘুরতে থাকে। ভয় জেগে ওঠে। শব্দের সংস্কৃতায়িত মহিমায় ভয়-সম্ভ্রমে সাধারণ জনতার তাক লেগে যায়। সমাজমনকে দীর্ঘদিন ধরে যে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র নিষেধাজ্ঞার ফ্যাসিবাদে আটকে রেখেছিল সেই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের মন্ত্রই রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদের কান্ডারিরা রপ্ত করেছে। তাদের প্রযুক্তিকে সেই শব্দবন্ধে বিশেষিত করছে। একই কাণ্ড ‘রক্তকরবী’ নাটকেও চোখে পড়ে। ফাগুলাল বলে, ‘কাল ওদের মারণচণ্ডীর ব্রত গেছে। আজ ধ্বজাপূজা, সেই সঙ্গে অস্ত্রপূজা।’ চন্দ্রাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘দেখ নি ওদের মদের ভাঁড়ার, অস্ত্রশালা আর মন্দির একেবারে গায়ে গায়ে?’ মন্দির যে সামাজিক ফ্যাসিবাদের জনক রাজনীতি সেই মন্দিরের অস্ত্রকে কাজে লাগাচ্ছে।
জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের বিস্তারে এভাবে সমাজ ও ধর্মকে ব্যবহার করা হয়নি, ভারতে কিন্তু সমাজ ও ধর্মকে ব্যবহার করেই রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যে পীড়নশক্তি এখানে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত সেই পীড়নশক্তির ভাষা ও ভাবকে কাজে লাগানোই বুদ্ধিমানের কাজ। রবীন্দ্রনাথ যে ঠিকই ভেবেছিলেন, তা কি আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে! দেশের নামে এখন প্রযুক্তি, শিক্ষা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যাবতীয় ‘সাফল্যপ্রদায়ী’ ‘নিষেধাত্মক’ ‘উদ্যাপনমূলক’ কাজে সংস্কৃতায়িত নামের কী ঘটা! তাছাড়া হিন্দুত্ববাদের মহিমায় রাষ্ট্রশক্তির কৃপায় যে শুদ্ধাচারী জীবনযাত্রাকে সমাজ থেকে রাজনীতিতে চালান করা হচ্ছে সে-সমস্তই একইরকম গালভরা কাষ্ঠলোষ্ট্রইষ্টকদৃঢ় ঘনপিনদ্ধ নামের কায়ায় মহিমান্বিত। রবীন্দ্রনাথ যে কতকিছু দেখতে পেতেন ও ঠিকই দেখতে পেতেন, তা মর্মে মর্মে টের পাওয়া যাচ্ছে।