টানাপোড়েনের চিহ্ন ‘সূর্যাবর্ত’ সংকলনে সরাসরি দেখা যায়। ‘ছোটো বড়ো নানা মাপের প্রায় পাঁচশোটি কবিতা পাওয়া যাবে সঞ্চয়িতায়, আর এ সংকলনে আছে দুশো বাহাত্তরটি, যার মধ্যে একশো তিরিশটি রচনা সঞ্চয়িতারই অন্তর্গত।’ ফলে, সঞ্চয়িতায় ৩৫০ কবিতা আছে, ‘সূর্যাবর্ত’-এ নেই, আবার ১৪২টি মতো কবিতা পাওয়া যাবে ‘সূর্যাবর্ত’-এ, যার দেখা মিলবে না সঞ্চয়িতায়।
তৃতীয় পর্ব
সম্পাদক তাঁর পাঠকের সঙ্গে কথা বলেন বইয়ের ভূমিকায়। এ কথা লেখা বাহুল্য, সাধারণত ‘ভূমিকা’ আমরা কেউ পড়ি না। দেশি-বিদেশি যেকোনও সাহিত্যবর্গের সংকলনের ক্ষেত্রেই একথা সত্য। সম্পাদনার ক্ষেত্রে মূল লেখককে যেন সম্পাদকের আতশ কাচের মাধ্যমে দেখতে চাই এবং পাই আমরা। আতশ কাচের নিচে কোনও অক্ষর বা অংশ বড় হয়ে দেখা দেয়, কোনও অংশ একেবারে ছোট হয়ে থাকে আড়ালে। কেন সম্পাদক তেমন করেছেন, সেই যুক্তি তিনি বিশদে ব্যাখ্যা করেন ভূমিকা বা সূচনা-কথায়। সুধীর চক্রবর্তী মশাই যার নাম দিয়েছিলেন, ‘আত্মপক্ষ’। চমৎকার নামকরণ। সম্পাদনার এক মুখ্য অক্ষ হল ‘স্ট্র্যাটেজি’। হয়তো বাংলা করা যায় ‘অভিমুখ’ বা ‘প্রকল্পনা’। সম্পাদক ঠিক কোন নকশায় বিন্যস্ত করছেন, তথা নির্বাচন করছেন গ্রন্থভুক্ত রচনাগুলি, তার স্পষ্ট রূপরেখা নানা ইশারায় ধরা পড়ে। মন দিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন, এক-একজন সম্পাদকের এক-এক ধরনের সম্পাদনার চৌহদ্দি। যেমন ধরা যাক, ‘The English Writings of Rabindranath Tagore’ গ্রন্থটি (সাহিত্য অকাদেমি)। তিনটি খণ্ড সম্পাদনা করেন অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ। আবার অন্যদিকে: ‘Modern Indian Literature’ অন্তর্ভুক্ত ‘Surveys and Poems’ (প্রথম খণ্ড) সম্পাদনা করেছিলেন কে. এম. জর্জ। দু’টিই প্রকাশিত হয়েছিল নয়ের দশকের প্রথম পর্বে।
এ দুয়ের সম্পাদনারীতি বেশ ভিন্ন ধরনের। দু’টির ক্ষেত্রেই পাঠককে সহায়তা তথা পথনির্দেশনা করে চলে দীর্ঘ মুখবন্ধ। আবার, অন্যদিকে, আধুনিক ইংরেজি কবিতার সংকলন, ‘A New Anthology Of Modern Poetry’ সম্পাদনা সেলডেন রডম্যান (The Modern Library, New York) দীর্ঘ ভূমিকায় তাঁর নির্বাচন এবং বিন্যাসের নানা কারিগরি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ‘Penguin Modern Poets’ নামক বিখ্যাত সিরিজে আবার কোনও সম্পাদকের উল্লেখ নেই, তিনজন কবির কবিতা বাছাই করার পদ্ধতি নিয়ে কোনও সম্পাদকীয় মন্তব্যও সেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
‘সূর্যাবর্ত’ গ্রন্থে শঙ্খ ঘোষ আত্মপক্ষ স্পষ্ট করতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। আগেই বলেছি, তাঁর এ ক্ষেত্রে ‘সঞ্চয়িতা’ যেমন একটি জটিল সমস্যা, অন্যদিকে কাব্য বাছাইয়ের যুক্তিগ্রাহ্য দৃষ্টিকোণ নির্মাণও প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এসব মুহূর্ত সন্ধি এবং সংঘাতের যুগপৎ পতন-অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা গ্রহণ করে চলা ছাড়া গতি নেই। একই সঙ্গে পূর্বজ, সমকালীন বা অনুজ, অনেক কবির নির্বাচিত কবিতা সংকলনের কাজ তুলনায় হয়তো সহজতর। বুদ্ধদেব বসু বা নবনীতা দেবসেন যথেষ্ট দক্ষতায় সে ধরনের কাজ করেছেন। ‘সূর্যাবর্ত’ অন্যদিকে একজন কবির নির্বচিত কবিতাগুচ্ছ, সেই কবির নাম অতিমানব রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর নিজস্ব সংকলন ‘সঞ্চয়িতা’ জনবৃত্তে যথেষ্ট পরিচিত। ফলে, ভূমিকার প্রথম বাক্যটিই হল– ‘সঞ্চয়িতার কোনো বিকল্প নেই।’
কঠিন কাজটিকে এই বাক্যের মাধ্যমে কঠিনতর করে তুললেন শঙ্খ ঘোষ। কেননা, রবীন্দ্রনাথের নির্বাচনের সম্পূর্ণ বাইরে দাঁড়াচ্ছেন না তিনি। আবার, রবীন্দ্রনাথের সব নির্বাচন তিনি গ্রহণ করছেন না। নতুন নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন রবীন্দ্রনাথকেই। ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসুকে লেখা চিঠি, ‘আধুনিকা’ (প্রহাসিনী) কবিতা বিষয়ে মৈত্রেয়ী দেবীর কাছে করা মন্তব্য ব্যবহার করেছেন সম্পাদক। যদিও তিনি কবুল করেছেন, কোনও সংকলনই গ্রন্থনার পূর্ণচ্ছেদ হতে পারে না। সে কেবল চলে, ব্যক্তিভেদে। এমনকী, একই ব্যক্তি নানা সময়ে, একই সংকলনের বিভিন্ন অবয়ব তৈরি করতে পারেন। ভিন্ন ভিন্ন থিম বা ভাবমূল ভাবলেও সংকলনের চেহারা পাল্টাতে পারে। ‘সূর্যাবত’-এর সম্পাদক জানাচ্ছেন– “আর তখনই মনে হয় আরো এক বা একাধিক সংকলনের সম্ভবনার কথা, ‘সঞ্চয়িতা’র বিকল্প হিসেবে নয়, তার পরিপূরক হিসেবে।”
টানাপোড়েনের চিহ্ন ‘সূর্যাবর্ত’ সংকলনে সরাসরি দেখা যায়। ‘ছোটো বড়ো নানা মাপের প্রায় পাঁচশোটি কবিতা পাওয়া যাবে সঞ্চয়িতায়, আর এ সংকলনে আছে দুশো বাহাত্তরটি, যার মধ্যে একশো তিরিশটি রচনা সঞ্চয়িতারই অন্তর্গত।’ ফলে, সঞ্চয়িতায় ৩৫০ কবিতা আছে, ‘সূর্যাবর্ত’-এ নেই, আবার ১৪২টি মতো কবিতা পাওয়া যাবে ‘সূর্যাবর্ত’-এ, যার দেখা মিলবে না সঞ্চয়িতায়।
অন্যদিকে, গ্রন্থানুক্রম ভেঙে কখনও কখনও ‘সূর্যাবর্ত’-এ মানা হয়েছে কবিতা-রচনার কালক্রম। আবার স্তবক বা বিন্যাসে ‘সঞ্চয়িতা’-র পাঠ না-মেনে মূল কাব্যগ্রন্থের পাঠ গৃহীত হয়েছে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ বা পাঁচমিশালি রবীন্দ্ররচনার সংকলন নয় এটি। ‘দীপিকা’ বা ‘বিচিত্রা’ নয়। কাব্য-পাঠকের ব্যবহারের জন্য এই সংকলন ‘সঞ্চয়িতা’-র মতো বৃহদায়তন নয়, প্রায় তার অর্ধেক। অর্ধেকের সামান্য বেশি। ব্যবহারিক আয়তনে গ্রন্থিত। যে পাঠক আরও একটু গভীরে যেতে আগ্রহী, তার জন্য বিশেষত পরিবেশন করা হয়েছে ‘পাঠপ্রসঙ্গ’ অংশটি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
২.
তাহলে বাইরে থেকে ক্রমশ অভ্যন্তরে প্রবেশ করছি আমরা। সম্পাদক একটা পথে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের কাব্যপরিক্রমায়। প্রথম নির্বাচনের নীতি। তারপর কবিতার অনুক্রমের নীতি। তারপর কবিতার ‘পাঠ’ নির্দিষ্ট করার পদ্ধতি। সমস্ত কাব্যসংকলনের অন্তিম পর্বে আছে ‘পাঠপ্রসঙ্গ’। সেখানে প্রাসঙ্গিক কবিতার স্তবক-পঙক্তি বিন্যাস বা কবিতাটির অনুষঙ্গে মন্তব্য-অভিজ্ঞতা-সমান্তর-গীতিরূপ-বর্জন-সংশোধন-রূপান্তর উপস্থাপিত হয়েছেন। অর্থাৎ, গভীর থেকে গভীরতর স্তরে পাঠককে নিয়ে যাচ্ছেন সম্পাদক। প্রথমে আছে গ্রন্থভুক্ত কবিতার অনুক্রম। তারপর পরিশিষ্ট অংশে প্রথমে শিরোনাম সূচি। বর্ণানুক্রমিক। সেইসঙ্গে গ্রন্থনাম। তারপরে পুরো কবিতাবলি বর্ণনাক্রমে সাজানো আছে।
দু’টি মাত্রায় এই সজ্জা কাজ করে। প্রথমটিকে বলা যায়, রবীন্দ্র কবিতা আস্বাদনকারী সাধারণ পাঠকের চাহিদা পূরণ। শিরোনাম বা প্রথম পঙক্তি অনুযায়ী সহজে কবিতাটি খুঁজে পাওয়া যাবে। ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ বা পাঁচমিশালি রবীন্দ্ররচনার সংকলন নয় এটি। ‘দীপিকা’ বা ‘বিচিত্রা’ নয়। কাব্য-পাঠকের ব্যবহারের জন্য এই সংকলন ‘সঞ্চয়িতা’-র মতো বৃহদায়তন নয়, প্রায় তার অর্ধেক। অর্ধেকের সামান্য বেশি। ব্যবহারিক আয়তনে গ্রন্থিত। যে পাঠক আরও একটু গভীরে যেতে আগ্রহী, তার জন্য বিশেষত পরিবেশন করা হয়েছে ‘পাঠপ্রসঙ্গ’ অংশটি।
এইভাবেই সম্পাদকের হাতে তৈরি হয়েছে বহুস্তরিক একটি রবীন্দ্রকবিতা সংকলন। পাঠক হিসেবে বেশ কিছু কবিতার ক্ষেত্রে আমি ভিন্ন মত পোষণ করি। সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু, শিক্ষণীয় বিষয় হল, পরিকল্পনার অভিমুখগুলি। কীভাবে নির্বাচন করতে হবে, কেমনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে, টীকা-ভাষ্য অনুষঙ্গ কোন নীতিতে পরিবেশিত হবে। ‘সঞ্চয়িতা’য় যে-কবিতা ‘সূর্যাবর্ত’ গ্রন্থে গৃহীত হল, সেখানেও ‘সঞ্চয়িতা’র পাঠান্তর মূল কাব্যগ্রন্থ অনুযায়ী মান্য এবং মুদ্রিত হয়েছে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কবিতার যেন ছায়াশরীর, বিশেষত ‘সঞ্চয়িতা’র সূত্রে, ‘সঞ্চয়িতা’র বিরোধে– নির্মিত হল। পরিপূরক তো বটেই, অন্তর্লোকে প্রতিস্পর্ধীও কখনও কখনও।
৩.
পঞ্চদশ খণ্ড ‘ক’ এবং পঞ্চদশ খণ্ড ‘খ’ নির্মাণকালে চেনা-অচেনার এত জটিল দ্বন্দ্ব ছিল না। সেখানে রবীন্দ্রনাথের বিপুল সংখ্যক ‘অগ্রন্থিত’ রচনা সংকলিত হয়েছে। কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে রচিত গদ্য নিবন্ধও এখানে গৃহীত হয়েছে। এই গ্রন্থের প্রথমাংশে ‘সম্পাদকীয় মন্তব্য’ শেষে পরিশিষ্ট ১ (পথের সঞ্চয়), পরিশিষ্ট ২ (অস্বাক্ষরিত রচনা) এবং দীর্ঘ খুঁটিনাটি তথ্যসমেত ‘গ্রন্থ পরিচয়’ অংশটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সমাজ সাহিত্য শিল্প-সংগীত, আত্মবোধ ইত্যাদি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অজস্র রচনা মূলগ্রন্থ দেহে কালানুযায়ী বিন্যাস করা হয়েছে এবং তার তন্নিষ্ঠ সমান্তর তথ্যাবলি থেকে জরুরি অনুষঙ্গমূলক সূত্র গ্রন্থপরিচয় অংশে সন্নিবেশিত। ষোড়শ খণ্ড ‘গ্রন্থ পরিচয়’ ভাণ্ডারে এই তথ্যাবলি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কেননা, এগুলি অগ্রন্থিত রচনার ‘গ্রন্থপরিচয়’। বেশ কিছু ছোট-বড় কবিতাও এখানে আছে। পঞ্চদশ ‘খ’ খণ্ডটির কাজে আমি যুক্ত ছিলাম। সে সময়ে দেখতাম কত যত্নে এবং অপরিসীম সতর্কতায় অনিঃশেষ তথ্যসম্ভার এবং সমান্তর সঙ্গ-অনুষঙ্গ বিন্যস্ত করছেন সম্পাদক। ‘সাহিত্য’ অংশে রবীন্দ্রকৃত বিভিন্ন গ্রন্থসমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে।
মূলগ্রন্থের লেখকের সময়কাল এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাদি যেমন আছে, মূল গ্রন্থে উল্লিখিত বা মুদ্রিত রবীন্দ্র প্রসঙ্গ কিংবা রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের বিস্তারিত বিবরণ মিলবে। রবীন্দ্রসাহিত্যের একনিষ্ঠ মেধাবী পাঠক হলেই হবে না, জানতে হবে গোটা কালপর্বের তথাকথিত গৌণ বা সম্পূর্ণ বিস্মৃত লেখক-লেখিকার হদিশ। দেখতে হবে, কখনও কখনও মূলগ্রন্থ এবং তার নানা সংস্করণ। আমি দেখেছি, এক একটি এন্ট্রি লিখতে, প্রায় ৩০-৩২টি বই উপর্যুপরি ব্যবহার করতে হচ্ছে স্যরকে, তথ্য আহরণ করে একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করতে; তারপর মূল পান্ডুলিপিতে, অনেক সম্পাদনার পর যুক্ত করতে। ধরা যাক, চন্দননগরে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের উদ্বোধনী ভাষণ (১৩৪৩ বঙ্গাব্দ। ফাল্গুন)। এ-সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ প্রায় আড়াই পাতার তথ্য-প্রসঙ্গ-সমান্তর লিখে রেখেছেন বা লিপিবদ্ধ করছেন। তারপর মূল পাণ্ডুলিপিতে তুললেন হয়তো মাত্র সাড়ে পাঁচ পঙক্তির একটি টীকা! এ এক বিশাল পরিশ্রম, তথ্যসম্ভার বিন্যাসের নৈপুণ্য এবং অপরিমেয় মেধার সম্মিলিত যোজনা। কাছ থেকে দেখলেও পুরো নৈপুণ্য অর্জন করা অসম্ভব।
এরকম চলছিল। হঠাৎ একদিন গম্ভীর গলায় তিনি ফোনে জানালেন, বিকেল সাড়ে তিনটের সময় সাহিত্য-পরিষদে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। জরুরি দরকার। সেদিন ছিল রবিবার। কিন্তু কেন? আমার খাতা নিয়ে একটু কথা আছে শুনে তো আমার আক্কেল গুড়ুম!
(চলবে)
ভাষ্য শব্দের তর্জনী-র দ্বিতীয় পর্ব। তথ্যমূলক তথাকথিত নীরস কাজে শঙ্খ ঘোষের ফুর্তির অন্ত ছিল না
ভাষ্য শব্দের তর্জনী-র প্রথম পর্ব। কত কম বলতে হবে, মুখের কথায়, সভায়, কবিতায় কিংবা ক্রোধে– সে এক সম্পাদনারই ভাষ্য