প্রবন্ধে বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথ ‘Environment’ শব্দটিকে ব্যবহার করেছিলেন। বিদ্যালয়ের ‘বাতাবরণ’ ছিল আমার ভাষান্তর। স্যর বললেন, এই শব্দটা না ব্যবহার করাই ভালো। অন্য শব্দ ভেবে দেখো। আমার খটকা লাগল। কেন? বদলাতে হবে কেন? স্যর তখন বুঝিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি লেখা বাংলায় অনুবাদ করার সময়, রবীন্দ্রনাথের রচনারীতি এবং কথনভঙ্গিটি অনুসরণ করাই সংগত। তার ফলে, মূলের আভাস নির্মাণ করা যায়। এর সঙ্গে এসব ক্ষেত্রে অনুবাদককে মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথের শব্দ ব্যবহারের ধরনটি মোটামুটি কেমন।
অষ্টম পর্ব
আলাদা আলাদা দুই কালপর্বে সম্পাদক শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে কথাবার্তা চালালাম। এই শেষ কিস্তি। মোট আট পর্বের এই অভিযাত্রা ছিল জমজমাট। বহু স্মৃতি যেমন উসকে উঠেছিল, পাশাপাশি লক্ষ করতে পারবেন, সম্পাদক শঙ্খ ঘোষের নানা অবলোকন এবং পদ্ধতি নিয়েও কথা বলেছি। তৎসত্ত্বেও মনে হয়, আরও বহু কথা বলা বাকি রয়ে গেল। গ্রন্থ সম্পাদনা এবং যেকোনও রচনাসম্ভার গ্রন্থনা একদিকে রোমাঞ্চকর, অন্যদিকে শ্রমসাধ্য অভিযাত্রা। তার বাঁকে-বাঁকে লুকিয়ে থাকে নতুন নতুন অভাবনীয় সংকট, নতুন নতুন সম্ভাবনা এবং সমাধান। যখন কোনও অভিজ্ঞ এবং সুদক্ষ সম্পাদকের সঙ্গে কাজ করা যায়, তখন সেই শিক্ষানবিশী পর্ব বহুভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।
মনে আছে, একদিন তাঁর ঘরে গিয়ে দেখলাম তিনি ‘পলাতকা’ কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে কাজ করছেন। সম্পাদনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নানা সূত্রকে কীভাবে একত্রিত করতে হয়, এবং প্রাসঙ্গিক তথ্যরাজি স্পষ্টভাবে পাঠকের গোচরে আনা যায়, তার রূপরেখা সেই কাজ দেখে অনেকটাই হৃদয়ঙ্গম করা যেত। স্যরের নিজস্ব নোটখাতা যেমন ছিল, অন্যদিকে কাজ করার রচনাবলিও আলাদা করে রাখা থাকত। সেই নোটখাতায় প্রভূত তথ্য গ্রন্থ ধরে-ধরে সাজানো ছিল। সেই খাতাপত্রে আমাদের কোনও প্রবেশধিকার ছিল না। দূর থেকে সেগুলি দেখতাম, কখনও কখনও তাঁর কাজের সময় উঁকিঝুঁকি মারতাম। এই তথ্য সংকলন দেখে বোঝা যেত, এগুলি দীর্ঘদিনের নোট। অনুমান করি, প্রয়োজনীয় কোনও প্রসঙ্গ তিনি খুঁজে পেলে এই খাতায় যোগ করে রাখতেন। কখনও কখনও দেখেছি সেখানে প্রশ্নচিহ্নও আছে। রচনাবলির বিভিন্ন খণ্ড বরং আমি অনেকবার হাতে নিয়ে দেখেছি। সেখানে মন্তব্য, সংশোধন এবং সংযোজন ছিল। কোথাও কোথাও পূর্ববর্তী রবীন্দ্ররচনাবলির নানা সংস্করণ বিষয়ে নানা মন্তব্য থাকত। এমনকী, বেশ কয়েকবার গান বা কবিতার শব্দের তলায় অধোরেখ থাকত, তার সঙ্গে বিভিন্ন রবীন্দ্র-কবিতা সংকলন যেমন ‘সঞ্চয়িতা’ বা ‘চয়নিকা’ এবং তার পৃষ্ঠাসংখ্যার উল্লেখও থাকত।
সেদিন ‘পলাতকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘শেষ গান’ কবিতাটির তথ্য সূত্র লিখছিলেন তিনি। ‘ষোড়শ খণ্ড’ গ্রন্থ পরিচয়ে এ বিষয়ে আমরা এখন কী কী দেখতে পাচ্ছি, সেগুলি পাঠকের গোচরে আনতে চাইব। প্রথম তথ্য, কবিতাটি যখন ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন তার নাম ছিল ‘শেষ গান’ নয়, ‘পরমায়ু’। এরপর সম্পাদকীয় মন্তব্য– ‘শেষ গান কবিতাটির একাধিক পাঠান্তর আছে। সবুজ পত্রে প্রকাশ করবার জন্য প্রমথ চৌধুরীকে এই কবিতাটি যখন পাঠাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তখন ( ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৪) তাঁকে লিখেছিলেন:
চলতি কথায় একটা লম্বা ছন্দের কবিতা লিখেচি। এটা কি পড়া যায় কিম্বা বোঝা যায় কিম্বা ছাপানো যেতে পারে? নাম-রূপের মধ্যে রূপটা আমি দিলুম নাম দিতে হয় তুমি দিয়ো।
এরপর সেই কবিতাটি।
‘যারা আমার সাঁঝ সকালের গানের দীপে জ্বালিয়ে দিলে আলো
আপন হিয়ার পরশ দিয়ে,…’
অনশ্বর এই উচ্চারণ, অভূতপূর্ব তার দীর্ঘ চরণের ধ্বনিসুষমা। লক্ষণীয় বিষয়, এই অনবদ্য কবিতা বিষয়ে নোবেল পুরস্কারে ততদিনে ভূষিত রবীন্দ্রনাথের দ্বিধা, সংশয় এবং প্রায় নব্যকাব্যচর্চাকারীর অনিশ্চয়তা। এ বিষয় নিয়ে এখন আলোচনা মুলতবি থাকুক, কেননা, এখন রবীন্দ্রনাথ নন, আমরা ধাওয়া করছি সম্পাদক শঙ্খ ঘোষ-কে। সম্পাদকীয় মন্তব্যে এবার এই কবিতার ছন্দ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিবৃতি। ‘এই জাতের সাধু ছন্দে আঠারো অক্ষরের আসন থাকে– কিন্তু এটাতে কোনো কোনো লাইনে পঁচিশ পর্যন্ত উঠেছে।… কিন্তু যদি এটা ছাপাও তাহলে লাইন ভেঙো না, তাহলে ছন্দ পড়া কঠিন হবে। স্মল পাইকায় মার্জ্জিন কম দিয়ে ছাপলে পঁচিশ অক্ষর ধরতে পারবে।’
মুদ্রণ এবং অবয়ব সচেতন রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি বা নির্দেশ নিয়ে কোনও মন্তব্য এখন করছি না, এটা সেই ক্ষেত্র নয়। ছন্দ বিষয়ক এই বিবৃতি পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র পঞ্চম খণ্ড। এইবার আবার সম্পাদকীয় বক্তব্যের প্রবেশ। “পলাতকা-র (১৯১৮) ঊনশেষ কবিতা ‘শেষ গান’। আশ্চর্যের বিষয় যে, এর অনেক পরবর্তী কাব্য ‘পূরবী’র (১৯২৫) প্রথম কবিতাটিও, নামান্তরে এবং পাঠান্তরে, এইটেই। প্রমথ চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে তথা ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায়, ‘পলাতকা’য়, তারপর ‘পূরবী’তে, তিনবারই এর স্বতন্ত্র নাম (‘পরমায়ু’, ‘শেষ গান’, ‘পূরবী’) কিঞ্চিৎ স্বতন্ত্র পাঠ। চিঠিতে শেষ দুই ছত্রের আগে যে-দু’টি ছত্র দেখা যায়, ‘পলাতকা’য় সে-দু’টি নেই বটে, কিন্তু ‘পূরবী’-তে তা আবার ফিরে এসেছে।…”
তাহলে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ক্ষেত্রে আনুষঙ্গিক তথ্যসূত্র খুঁজতে হয়েছে চিঠিপত্রে, পত্রিকাপাঠে এবং রচনাবলি পাঠে। কবিতা লেখার সময় রবীন্দ্রনাথের কোনও প্রাসঙ্গিক মন্তব্য আছে কি না, তাঁর সর্বজীবনব্যাপী রচনাধারায় কোনও কবিতার সমান্তর বা পাঠান্তর আছে কি না, কতবার সে সব পুনরাবৃত্ত হয়েছে, নাম পাল্টেছে কি না, শব্দ বা যতিচিহ্ন পাল্টেছে কি না, এসবই কিন্তু সম্পাদনার মিলিয়ে-দেখার দায়িত্ব পড়ে।
এই যে শব্দ ধরে ধরে রবীন্দ্ররচনাবলি পাঠ এবং বিশ্লেষণী পরিক্রমা, রূপ-রূপান্তর চিহ্ন-চিহ্নান্তরগুলি হদিশ করা, এসবই শ্রমসাধ্য দীর্ঘ অনুশীলন দাবি করে। এই প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত একটি কাহিনি বলব। আপাত দৃষ্টিতে হয়তো সম্পাদনা বা গ্রন্থনার সঙ্গে সেই অভিনির্দেশের কোনও সরাসরি সম্পর্ক নেই, কিন্তু আমার বারবার মনে হয়েছে রবীন্দ্ররচনার খুঁতখুঁতে সম্পাদক শঙ্খ ঘোষ ছাড়া এই পরামর্শ বা উপদেশ অন্য কেউ দিতে পারতেন না। কথাটা খোলসা করেই বলি।
২০১৫ সাল নাগাদ আমি অনুবাদ করতে শুরু করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ ‘The School Master’। ঠিক প্রবন্ধ নয়, ১৯২৪ সালে জাপানে একটি শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলেন। নানা কারণেই প্রবন্ধটি গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয় পরিকল্পনা এবং আশ্রমের শিক্ষাপদ্ধতি বিষয়ে এই প্রবন্ধে নানা মণিমুক্তো ব্যক্ত হয়েছে। অনুবাদের প্রথম খসড়া নিয়ে স্যরের কাছে হাজির হলাম। মূল ইংরেজি সঙ্গে নিয়ে বসা হল। তারপর চলল নানা কাটাছেঁড়া। বিভিন্ন প্রসঙ্গে অন্যান্য বইপত্র তিনি দেখাতেও লাগলেন। কখনও কখনও অনুবাদ করতে গিয়ে কতটা স্বাধীনতা নেওয়া ঠিক– সে বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা শোনালেন। এই ভাবে, যতদূর মনে পড়ে, মোট আট থেকে ন-দশ দিন কিস্তিতে কিস্তিতে আলোচনা এবং সংশোধন চলেছিল। মোট তিনবার পুরো তরজমাটি আমাকে করতে হয়েছিল। সবটা মিলিয়ে প্রায় তিনমাস লেগেছিল কাজটি সম্পূর্ণ করতে। শেষদিনের আগের দিন, তিনি খুব স্মরণীয় একটা কথা বলেছিলেন। ওই প্রবন্ধে বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথ ‘Environment’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। বিদ্যালয়ের ‘বাতাবরণ’ ছিল আমার ভাষান্তর। স্যর বললেন, এই শব্দটা না ব্যবহার করাই ভালো। অন্য শব্দ ভেবে দেখো। আমার খটকা লাগল। কেন? বদলাতে হবে কেন? স্যর তখন বুঝিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি লেখা বাংলায় অনুবাদ করার সময়, রবীন্দ্রনাথের রচনারীতি এবং কথনভঙ্গিটি অনুসরণ করাই সংগত। তার ফলে, মূলের আভাস নির্মাণ করা যায়। এর সঙ্গে এসব ক্ষেত্রে অনুবাদককে মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথের শব্দ ব্যবহারের ধরনটি মোটামুটি কেমন। যে শব্দ রবীন্দ্র ব্যবহারের পূর্বাপর পঞ্জিতে একেবারে মানানসই নয়, তার থেকে দূরে থাকাই তরজমার পক্ষে সংগত। যেমন, এক্ষেত্রে ‘বাতাবরণ’। এমন কোনও শব্দ প্রয়োগ করা রবীন্দ্রপাঠকের কানে অস্বস্তি জাগিয়ে তুলবে। এবার আমার প্রশ্ন-তাহলে ওখানে কোন শব্দ ঠিক হবে? স্যর বললেন, ভাবো একটু। আমি ছটফট করে উঠে বললাম, এবার প্রেসে দিতে হবে। আমার মাথায় আসছে না। হাতে একদম সময় নেই। পুরো ভাষান্তরে একবারও তো বিকল্প বলে দিলেন না। নিজে-নিজে করতে বললেন। একটা অন্তত বলে দিন। উনি একটু চুপ থেকে বললেন, এক্ষেত্রে ‘পরিমণ্ডল’ করবে কি না, ভাবতে পারো। শব্দ ধরে ধরে রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করলে তবেই এমন আশ্চর্য উপদেশ দেওয়া যায়! পরে আমি অনেক খুঁজেছি। ‘বাতাবরণ’ শব্দ রবীন্দ্ররচনায় কোত্থাও খুঁজে পাইনি।
বিপ্লবী কবি চেরবান্দারাজুর কয়েকটি নির্বাচিত কবিতার বাংলা রূপান্তর ‘ঢেউয়ে ঢেউয়ে তলোয়ার’ প্রকাশিত হয়েছিল বিপ্লবী-লেখক-শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রস্তুতি সম্মেলনের আহ্বায়ক পরিষদ-পরিচালিত সংহতি প্রকাশনী থেকে। গুরুতর অসুস্থ কবি চেরবান্দারাজুর চিকিৎসার্থে এই সংকলনের ‘সমূহ লভ্যাংশ ব্যয় করা হবে’ ছিল নামপত্রে ঘোষণা। এই সংকলন প্রস্তুত করতে বিশেষ সহায়তা করেছিলেন ‘বিরসম্’ সম্পাদক কে.ভি. রমানা রেড্ডি, ভারভারা রাও, মানব মিত্র প্রমুখ। প্রথম প্রকাশ, ‘আশ্বিন ১৩৮৭ (১৯৮১) পরিবেশক কথাশিল্প, মূল্য– তিন টাকা পঞ্চাশ পয়সা’। এই ৩৬ পাতার কৃশ বইটি যতদূর শুনেছি অন্যান্যদের কাছে, সম্পাদনা করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। বইয়ের শেষে নাতিদীর্ঘ একটি আলোচনাও আছে এই কবিকে নিয়ে, যার গদ্যরীতি শঙ্খ ঘোষের বলে আন্দাজ হয়। অনুবাদকদের নামগুলি চমকপ্রদ! কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করছি– সমর সেন, শঙ্খ ঘোষ, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপুল চক্রবর্তী, সব্যসাচী দেব, সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
তেলুগু ভাষার এই শক্তিশালী বিদ্রোহী কবি প্রথমে ‘দিগম্বর’ গোষ্ঠী এবং পরে ‘বিরসম্’ গোষ্ঠীর অন্যতম হিসেবে সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার মাতব্বরির বিরুদ্ধে অগ্নিভ কবিতা লিখেছিলেন ১৯৮২ সালের ২ জুলাই, তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। রাষ্ট্রবিরোধী কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ তিনি বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। ১৯৭১ সালে তিনি প্রথমে অন্ধ্রপ্রদেশ নিবর্তকমূলক আটক আইনে গ্রেপ্তার হন। তারপর ১৯৭৩ সালে মিসায় গ্রেপ্তার হন কবি ভারবারা রাওয়ের সঙ্গে। ‘সেকেন্দ্রাবাদ ষড়যন্ত্র মামলায়’ তিনি অভিযুক্ত হন। জরুরি অবস্থার সময় নকশালপন্থী ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, জেলে নির্যাতন করা হয়।
বইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য নির্ভুল মুদ্রণ। শঙ্খ ঘোষ একাধিকবার আমাকে বলেছিলেন, সম্পাদনার কাজ যাঁরা বা যিনি করবেন, তিনি খুব দক্ষ এক প্রুফ রিডার হলে অনেক সুবিধে। প্রথম বানান সমতারক্ষায় সম্পাদককে অন্য কারও ওপর নির্ভর করতে হয় না। দ্বিতীয়ত, প্রুফ দেখতে দেখতে অনেক সময় গ্রন্থনার অন্যান্য খুঁটিনাটি সম্পর্কে নতুন আইডিয়া আসে, পুরো কাজটির একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ সামগ্রিক ধারণাও স্পষ্ট হয়। আমি বলতে চাইছি, বিশ্বভারতী বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্ররচনাবলির সম্পাদক শঙ্খ ঘোষ, সাহিত্য অকাদেমির জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্থের সম্পাদক শঙ্খ ঘোষ আর রাষ্ট্রবিরোধী, অতিবাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী গ্রেপ্তারের পর গ্রেপ্তার হওয়া লড়াকু কবি চেরবান্দারাজুর কবিতার অনুবাদ সম্পাদনা করেন সেই একই মানুষ। যত্ন এবং অভিনিবেশে কোনও ক্ষেত্রেই কোথাও টলে যায় না। একদিন হঠাৎ বলেছিলেন, এই বইয়ের প্রস্তুতি পর্বের সময়ের কথা। একটি অনুবাদের কয়েকটি শব্দ বদলাতে চেয়ে তিনি অনুবাদক সমর সেনকে ফোন করেছিলেন। সমর সেন খানিকটা আলোচনার পর সানন্দে সম্মতি তো দিয়েছিলেনই, উপরন্তু অনুবাদ বিষয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ করেছিলেন।
‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় কথা ও কবিতা’ বইটির সম্পাদক মণ্ডলীতে ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। তখন দেখেছি, কী অফুরন্ত উদ্যমে এবং উৎসাহে তিনি শত-শত পৃষ্ঠার প্রুফ দেখে চলেছেন। এই ভাবে অনুপুঙ্খ দৃষ্টি অর্জনের ফলেই হয়তো সম্পাদনার কাজে শব্দ টুকতে ভুলচুক নজরে আসতো তাঁর।
এ প্রসঙ্গে ইতি টানার আগে দু’টি তথ্যসূত্রের দিকে ফিরে যাবো, আলোচ্য প্রসঙ্গেরই সম্প্রসারণ হিসেবে। পরিশেষ কাব্যগ্রন্থটি (১৩৩৯) বিষয়ে বিভিন্ন বিস্তারিত সম্পাদকীয় অবলোকনের দু’টি, (ক) ‘অপূর্ণ’ কবিতাটি সম্পর্কে– “বর্তমান রচনাবলীর মুদ্রণে এই কবিতার একটি ছত্রে (রচনাবলি ২, পৃ ৮৯৫, ঊনশেষ ছত্র) একটি মুদ্রণ প্রমাদ লক্ষণীয়। ‘নিখিলেরে’ ছাপা হয়েছে ‘নিখিলের’।”
(খ) ‘চিরন্তন’ কবিতা সম্পর্কে– “এই কবিতার একটি ছত্রে (রচনাবলি ৪, পৃ: ৯২০, ছত্র ১৯) ‘আপনহারা’ শব্দটির শুদ্ধপাঠ ‘আপনহানা’।” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। শুধু পর্যবেক্ষণের তীক্ষ্ণতাটিকে লক্ষ করুন।
সম্পাদক শঙ্খ ঘোষ বিষয়ে এই পাতায় নয়-নয় করে মোট আট কিস্তি লিখলাম। অতৃপ্তি অবশ্য থেকে গেল। হয়তো আরও আট বা ষোলো কিস্তিতেও সন্তুষ্ট হওয়া যেত না। ফলে, এবার ইতি টানাই ভালো। অপটু হাতে যা ধরলাম, তা একটি এলোমেলো রূপরেখা মাত্র। আংশিক। প্রাণপণ চেষ্টা করেছি, যাতে পাঠকের কাছে সামগ্রিকতার একটা নকশা, একটা আভাস স্পষ্ট হয়। এসব আত্মপক্ষ বা জবাবদিহি। দুই দফায় প্রায় চার সাড়ে চার মাস, মাঝখানের নীরবতা-সহ, আমার সংলাপ জারি ছিল। ধন্যবাদ তিতাস রায় বর্মনকে, তার আগ্রহ এবং উৎসাহে কখনো ভাটা পড়েনি। সে ছিল মহার্ঘ পাথেয়। এতদিন ধরে হে পাঠক, হে পাঠিকা, আমি এক হাতে ছুঁয়ে ছিলাম স্মৃতি আর শঙ্খ ঘোষের আঙুল, অন্য হাতে স্পর্শ করে রয়েছি আপনার করতল। এবার সেই বন্ধন স্বাভাবিক কালের প্রথায় ছিন্ন হবে। হাতের উষ্ণতাও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে। দূরে, আরও দূরে সরতে সরতে আমরা কালপারাবারের দিকে যাব। পুনর্দর্শনায় চ। ভালো থাকবেন সবাই।
(সমাপ্ত)
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
…পড়ুন ভাষ্য শব্দের তর্জনী-র অন্যান্য লেখা…
পর্ব ১. কত কম বলতে হবে, মুখের কথায়, সভায়, কবিতায় কিংবা ক্রোধে– সে এক সম্পাদনারই ভাষ্য
পর্ব ২. তথ্যমূলক তথাকথিত নীরস কাজে শঙ্খ ঘোষের ফুর্তির অন্ত ছিল না
পর্ব ৩. কোনও সংকলনই গ্রন্থনার পূর্ণচ্ছেদ হতে পারে না, ভাবতেন শঙ্খ ঘোষ
পর্ব ৪. শঙ্খ ঘোষ বলতেন, অদৃশ্যে কেউ একজন আছেন, যিনি লক্ষ রাখেন এবং মূল্যায়ন করেন প্রতিটি কাজের
পর্ব ৫: অনিশ্চয়তার কারণেই কি রবীন্দ্রনাথের গানে ও পাণ্ডুলিপিতে এত পাঠান্তর?
পর্ব ৬. সহজ পাঠের ‘বংশী সেন’ আসলে ‘বশী সেন’, দেখিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ
পর্ব ৭: অন্যের বই তৈরি করতে তাঁর অদম্য উৎসাহ, নিজের বইয়ের প্রুফ দেখতেন না পারতপক্ষে