সুখ আনন্দ প্রত্যাশা প্রাপ্তি, যাই বলি না কেন, বইমেলা আমাদের দিক থেকে কখনই মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। বরঞ্চ বয়সের আর দূরত্বের দোহাই দিয়ে আমরাই কেউ কেউ বইমেলার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি।
আমার প্রথম বইমেলার স্মৃতি ১৯৭৩-এর। তখন কলেজে পড়ি। বইমেলার খবর দেখেই মফসসল থেকে ছুটে গিয়েছিলাম ‘অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’-এ। হ্যাঁ, ওখানেই হয়েছিল কলকাতার প্রথম পূর্ণাঙ্গ বইমেলা। উদ্যোক্তা ছিল ‘ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট’। অ্যাকাডেমির সবকটা ঘর আর বাগান মিলে স্টলগুলো সাজানো হয়েছিল। যতদূর মনে আছে, সেই মেলায় যোগ দিয়েছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কয়েকজন প্রকাশক। এর আগে মেলায় বইয়ের স্টল দেখেছিলাম ‘বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন’-এ। অন্যান্য নানা পসরার দোকানের সঙ্গে ছিল বইয়ের দোকানও। আর দেখেছিলাম ১৯৭৮-এ বাংলা মুদ্রণের ২০০ বছর নিয়ে যে অসাধারণ প্রদর্শনী হয়েছিল, সেই প্রদর্শনীর চারদিক ঘিরে ছিল বাছাই করা পসরার স্টল। যার একটা দিক ছিল শুধু বইয়ের।
অ্যাকাডেমির সেই মেলার জনপ্রিয়তা দেখে কলেজ স্ট্রিটের কয়েকজন প্রকাশক ঠিক করেন তাঁরা নিজেরাই বইমেলা শুরু করবেন। ১৯৭৫-এ জন্ম হল– ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড’। আর তার পরের বছরেই কলকাতা বইমেলার সূত্রপাত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সেই সময় মেলার গেটগুলোও ছিল অবশ্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে। মনে পড়ে, একবার হল– ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির সেনেট হল। পরের বার– লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস, উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি, ব্রিটিশ মিউজিয়াম আর মস্কোর জাতীয় গ্রন্থাগার, লেলিন স্টেট লাইব্রেরি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। সুকুমার রায়ের শতবার্ষিকীতে মূল গেটের পাশে তৈরি হয়েছিল বিশালাকার ‘আবোল তাবোল’-এর প্রচ্ছদ। সেই বছর, কি পরের বছর, গেট হয়েছিল ‘আনন্দমঠ’ আর ‘নীলদর্পণ’-এর মলাটের ছবি দিয়ে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কত টুকরো-মেদুর স্মৃতি ঘুরে-ফিরে আসে এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে! বইয়ের সন্ধান করতে করতেই নামীদামি সাহিত্যিকদের সামনে থেকে দেখেছি। কাছে যেতে পারিনি ভয়ে। দৌড়ে বই কিনে নিয়ে এলেও, সই নিতে পারিনি। তাঁরা সব এখন স্মৃতিতে। তাঁদের লেখা পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছি। তখনও বইমেলা এমন প্রতিযোগিতার চত্বর হয়ে উঠেনি। প্রকাশকদের মধ্যে বেশ একটা পারস্পরিক সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক ছিল। কোথায় গেল সেই আদরের বইমেলা। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মতো বলতে ইচ্ছা করে, ‘সেই বইমেলার কাছে আমরা চিরঋণী। টাই-ঝোলা মিস্টার কাকাতুয়াদের পেতলের দাঁড়ে বাসি কাবলে ছোলার মতো এই বই মেলা নয়।’
তবুও মেলা হয়, নতুন বাংলা বই, কেশর ফোলানো আরবি-ঘোড়ার মতো সদ্য প্রকাশ লিটল ম্যাগাজিনের নতুন সংখ্যার দিকে হাত বাড়ায় বাঙালি পাঠক। মনে পড়ে, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মিনিবুক আর তার সঙ্গে পোস্টার বিক্রির স্টল, ‘সোনার তরী’। কেউ পত্রিকা বা পোস্টার কিনলে বিল হিসেবে পাওয়া যেত একখণ্ড নুড়ি আর ক্রেতার মঙ্গল কামনা করে বেজে উঠত স্বর্গের ঘণ্টা। হ্যাঁ, স্বর্গের ঘণ্টা! স্টলের সামনে এক দীর্ঘ বাঁশের মাথায় টাঙানো ঘণ্টার দড়ি থাকত স্টলে বাঁধা। সেটাই বাজানো হত। লেখা ছিল– তিরুপতির ঘণ্টা। পরে জেনেছিলাম, ওটা ছিল দমকলের। রাত বাড়লে ওই স্টলের সামনে গান হত– ‘ফিক ফিক ফিক চাঁদের হাসি/ ওই উঠেছে আকাশে!/রসের সাগর রসের নাগর/ রসের ভিয়ান বাতাসে।’
ওই কোরাস গানের সঙ্গে রুমাল উড়িয়ে হাততালি-সহ নাচতে দেখেছি কৃত্তিবাসের লেখকদের। তাদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও থাকতেন। আমরাও তাঁদের ঘিরে ধরে হাততালি দিতাম।সেই সময় বইমেলা হত বিড়লা তারামণ্ডল-এর উল্টোদিকে ছোট মাঠে। বছর দুয়েকের মধ্যেই মেলার জনপ্রিয়তা বাড়ল। গতরেও বাড়ল। মেলা সরে এল রবীন্দ্র সদনের উল্টোদিকের ফাঁকা মাঠে। সেই সময় মেলার গেটগুলোও ছিল অবশ্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে। মনে পড়ে, একবার হল– ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির সেনেট হল। পরেরবার– লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস, উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরি, ব্রিটিশ মিউজিয়াম আর মস্কোর জাতীয় গ্রন্থাগার, লেলিন স্টেট লাইব্রেরি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। সুকুমার রায়ের শতবার্ষিকীতে মূল গেটের পাশে তৈরি হয়েছিল বিশালাকার ‘আবোল তাবোল’-এর প্রচ্ছদ। সেই বছর, কি পরের বছর, গেট হয়েছিল ‘আনন্দমঠ’ আর ‘নীলদর্পণ’-এর মলাটের ছবি দিয়ে।
তখন কারা সব আসতেন আমাদের এই বইমেলায়! না না, উদ্বোধন করতে নয়, স্রেফ দর্শক হিসেবে। মনে আছে, এক দুপুরে স্টল থেকে বেরতেই দেখি ঢুকছেন ‘ওরিয়েন্ট লংম্যান’, সত্যজিৎ রায়। স্টলের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম, বেরনোর সময় আর একবার ভালো করে দেখব বলে। আস্তে আস্তে লোকের সংখ্যা বাড়ল। আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। তিনি বেরোচ্ছেন। তখন মেলায় মাইক্রোফোনে গান শোনা যেত। ভেসে আসছে– ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’। গনগনে দুপুরে জ্যোৎস্না-রাতের গান। উনি বেরনোর সময় গানটা শুনে এমনভাবে আকাশের দিকে তাকালেন, সব্বাই হো হো করে হেসে উঠল। উনি মুচকি হেসে পাশের স্টলের দিকে পা বাড়ালেন। ছোটখাটো রাধাপ্রসাদ গুপ্তকে দেখেছি সুদীর্ঘ রঘুবীর সিং-কে মেলা দেখাতে নিয়ে এসেছেন। একা একা ঘুরতে দেখেছি খুশবন্ত সিং-কে। ‘সুবর্ণরেখা’-র সামনে চেয়ারে বসে গল্প করছেন– অশোক মিত্র, গৌতম ভদ্র আর ইন্দ্রনাথ মজুমদার। ‘আজকাল’ থেকে বেরিয়েছে কুট্টির কার্টুনের বই। স্টলের সামনে চেয়ারে বসে নিজের বইতে এঁকে দিচ্ছেন ক্রেতার মুখের কার্টুন-চিত্র। নিমেষে।
‘এতদিন শুধু শুনেছি আর পড়েছি কলকাতার বইমেলা প্রসঙ্গে। আজ চাক্ষুষ করতে এলাম।’ শেষ দুপুরে রোদ চশমার আড়ালে হঠাৎই আগমন শাবানা আজমির। চিনে ফেলতেই কথাগুলো বলেই এগিয়ে গেলেন। তখন আমরাও বোধহয় একটু ভদ্র ছিলাম। সেলিব্রেটিদের দেখলে হামলে পড়তাম না।
‘প্রতিক্ষণ’-এর স্টলটা ছিল বড়দের আড্ডা মারার স্টল। প্রিয়ব্রত দেব, স্বপ্না দেব তো থাকতেনই, তাঁদের সঙ্গে সোফায় বসে আড্ডা দিতে দেখেছি দেবেশ রায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, সমরেশ বসু, বসন্ত চৌধুরীকে। এই ‘প্রতিক্ষণ’ থেকেই বইমেলার সময় বের হত মেলার জন্য প্রকাশিত– ‘প্রতিক্ষণিকা’। তিন ভাঁজ লম্বাটে ছোট মাপের দৈনিক। গোটা তিন নিবন্ধ, বইমেলার সংবাদ আর পাঠকদের জন্যে ধাঁধা। প্রত্যেক দিন ‘প্রতিক্ষণ’-এর স্টলের সামনে চেয়ারে ডাঁই করে রাখা থাকত। যে যার মতো তুলে নিয়ে যেত। একবার ধাঁধা প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল, বইয়ের জন্যে সবচেয়ে অসম্ভব একটি নাম। আমার বন্ধু শুভাশিস ‘ছোটদের কামশাস্ত্র’ নামকরণের জন্যে সেরার পুরস্কারটি পায়। বছর চারেক বেরিয়েছিল ‘প্রতিক্ষণিকা’। এই ‘প্রতিক্ষণ’-এর স্টল ১৯৯৭ এর আগুনে সবচেয়ে আগে পুড়ে যায়। তাঁদের স্টলের পাশেই ছিল আগুন ধরে যাওয়া খাবারের রেস্তরাঁটি।
‘প্রতিক্ষণিকা’র মতো ‘সান্ধ্য-আজকাল’-এর সূত্রপাতও বইমেলা থেকে। ‘প্রতিদিন’ও বইমেলায় সান্ধ্য-সংস্করণ বের করত। সেগুলো সংগ্রহের জন্য মুখিয়ে থাকতাম। একবার মনে আছে, মূল মঞ্চে ‘যাযাবর অমনিবাস’ প্রকাশ অনুষ্ঠান হচ্ছে। উদ্বোধক আনন্দবাজারের কর্ণধার অশোককুমার সরকার। বই উদ্বোধনের পর বক্তৃতা দেওয়ার সময় ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাক। পাশেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মৃত্যু। আর বছর দুয়েক পরেই ৫০-এ পা দেবে কলকাতা বইমেলা। এই ৫০ বছরের আনন্দ আর বিষাদের স্মৃতি ঘিরে আছে বইমেলাকে কেন্দ্র করে।
এখন আবার বইমেলার সংসার বেড়েছে। সেই সঙ্গে ডানাও গজিয়েছে। সে এখন শুধু হিল্লি-দিল্লি নয়, ঘুরে বেড়ায় এ-জেলা থেকে সে-জেলা, এ-শহর থেকে অন্য শহর। তবুও কলকাতা বইমেলার কোনও তুলনাই নেই। সুখ, আনন্দ, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি– যাই বলি না কেন, বইমেলা আমাদের দিক থেকে কখনই মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। বরঞ্চ বয়সের আর দূরত্বের দোহাই দিয়ে আমরাই কেউ কেউ বইমেলার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। সব শেষে বলতে পারি, কলকাতা বইমেলার বিকল্প হতে পারে একমাত্র ‘কলকাতা পুস্তক মেলা’, আর কেউ নয়।
……..পুরনো মেলার স্মৃতি। বইমেলাধুলো……..
মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়: শক্তিপদ রাজগুরুর বই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে এক পাঠক সই করাবেনই করাবেন!
সৌরীন ভট্টাচার্য: টেবিলের দায়িত্বে থাকা রামু-সমেত কফি হাউস উঠে এসেছিল বইমেলায়
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত: পাঠক বইমেলা সচেতন হলে বইমেলারও তো পাঠক সচেতন হওয়া উচিত
কালীকৃষ্ণ গুহ: বইমেলায় বাজানো হত উচ্চাঙ্গ সংগীতের ক্যাসেট
পবিত্র সরকার: বইমেলার গেটে কবি অরুণ মিত্রকে স্যালিউট করেছিল পুলিশ
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: সদ্য বৃষ্টিভেজা বইমেলায় বিকেলে সুচিত্রা-ঝলক পরম প্রাপ্তি
মৃদুল দাশগুপ্ত: জোড়হস্তে কফি হাউসের টেবিলে টেবিলে বইমেলায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন গিল্ডকর্তারা
সুশোভন অধিকারী: চটের ওপর বসে মন দিয়ে কার্ড এঁকে চলেছেন একমাথা ঝাঁকড়া চুলের পূর্ণেন্দু পত্রী
মিনতি চট্টোপাধ্যায়: স্টলের ভেতরে মহীনের ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে আর স্টলের বাইরে ময়দানের মাটিতে গোল হয়ে বসে চলছে গান
হিরণ মিত্র: এই বইমেলায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় গলায় মিনিবুক ঝুলিয়ে ফেরি করতেন
অনিল আচার্য: অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র-কে লিটল ম্যাগাজিনের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়