এক সপ্তাহ হোক, ১৫ দিন হোক– শুরু হোক একটা পার্বণ। প্রেমেন্দ্র মিত্র হয়তো বইমেলার কথা বলেননি, বইপাড়াতে বই কেনা হবে, এমনই তাঁর মনে ছিল, কিন্তু বইমেলার পরিকল্পনায় ওই ব্যাপারটার কোনও অস্পষ্ট ধাক্কা, নিশ্চয়ই উদ্যোক্তাদের পিঠে লেগে ছিল।
১.
ধুর! এই ৮৭ বছর বয়সে, সব মনে থাকে নাকি? কাজেই, এ লেখায় ভুলভ্রান্তি থাকলে, কিছু মনে করবেন না। অনেক জায়গাতে তাই ‘হয়তো’, ‘বোধ হয়’, ‘সম্ভবত’– এইসব ক্রিয়াবিশেষণ থাকবে (‘অব্যয়’ আমি মানি না)। কলকাতা বইমেলা (যার ভালো নাম ‘কলিকাতা পুস্তক মেলা’) শুরু হয়েছিল ১৯৭৬ সালে, সম্ভবত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পুবদিকের খোলা জায়গাটায়। তখন থেকে প্রতি বছর গিয়েছি, কোনও বছর বাদ পড়েছে বলে মনে হয় না। এ থেকে এই ঘটনা জাহির করতে চাই না যে, আমি খুব বড় একজন পাঠক, যাতে আমি যাওয়ার ফলে, কলকাতা বইমেলা উদ্ধার হয়ে গিয়েছে, বা তার বড় একটা কিছু লাভ হয়েছে। প্রথম প্রথম ভিড়ের একজন হিসেবেই গিয়েছি। তখন অবশ্য অধ্যাপক পরিচয় একটা হয়েছে, কখনও যাদবপুরের বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের একটা দল সঙ্গে নিয়েও গিয়েছি, তারা আবদার করেছে বলে। তবে তখনও লেখক পরিচয় খাড়া হয়নি, যাতে নিজেকে ওই মেলায় যাওয়ার যোগ্যতর দাবিদার হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। সেই সুযোগ হবে, আরও প্রায় ৮ বছর পরে।
কিন্তু ইন্টারনেটে বইমেলার ইতিহাস যা আছে, তা দেখে আমি একটু হতাশ হলাম। তাতে ফ্রাঙ্কফুর্ট, দিল্লি– এইসব বইমেলার কথা আছে, এই বইমেলার প্রেরণা হিসেবে। ওই মেলায় যাওয়া প্রকাশকদের ওসব মেলায় যাওয়ার জ্বলজ্যান্ত স্মৃতি হিসেবে নাকি এই মেলার উদ্যোগের ভাবনাটা উঠে আসে, কফিহাউসে তাঁদের আড্ডায়। পাঠকদের মধ্যে একটা দাবিও বোধ হয় তৈরি হয়েছিল। হতেই পারে। কিন্তু তার একটু আগেই সম্ভবত, ‘দেশ’ পত্রিকার একটা রবীন্দ্রসংখ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘গ্রন্থ পার্বণ’ বলে একটা চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যে প্রবন্ধ পড়ে, আমরা সকলে ‘হায় হায়’ করে উঠেছিলাম এই বলে যে, ‘ইশ্ ! এ কথাটা আমাদের অ্যাদ্দিন মনে হয়নি কেন?’। তাতে তাঁর প্রস্তাব ছিল এই যে, বছরের একটা সময়, হতেই পারে সেটা পঁচিশে বৈশাখকে কেন্দ্র করেই হল, বাঙালি একটা গ্রন্থ পার্বণ শুরু করুক। এই পার্বণের কর্তব্য হবে, বাঙালি লাইন বেঁধে বই কিনবে, আর পরস্পরকে বই উপহার দেবে। এক সপ্তাহ হোক, ১৫ দিন হোক– শুরু হোক একটা পার্বণ। প্রেমেন্দ্র মিত্র হয়তো বইমেলার কথা বলেননি, বইপাড়াতে বই কেনা হবে, এমনই তাঁর মনে ছিল, কিন্তু বইমেলার পরিকল্পনায় ওই ব্যাপারটার কোনও অস্পষ্ট ধাক্কা, নিশ্চয়ই উদ্যোক্তাদের পিঠে লেগেছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কালীকৃষ্ণ গুহর বইমেলাধুলো : বইমেলায় বাজানো হত উচ্চাঙ্গ সংগীতের ক্যাসেট
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
যাই হোক, বইমেলা তো শুরু হয়ে গেল। কালক্রমে তা হয়ে উঠল, বিশ্বের বৃহত্তম বই বেচাকেনার মেলা, যদিও বাংলাদেশের একুশের বইমেলাও এখন বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে হচ্ছে। মোহরকুঞ্জ (তখনও এ নাম হয়নি) ছিল তার আদি ঠিকানা, সম্ভবত ১৯৮৭ পর্যন্ত। তখন থেকেই, সাধুসন্নিসিদের গঙ্গাসাগরের মতো কলকাতার বইমেলাও, পাঠকদের একটা অবশ্য-গন্তব্য হয়ে উঠল। সামান্য একটা দক্ষিণা দিয়ে ঢুকতে হত তখন, তা যতদূর মনে আছে, একটাকা থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত পৌঁছোয়, তারপর ২০১১-তে মিলনমেলায় তা সম্পূর্ণ তুলে দেওয়া হয়। সত্যি লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার একটা ঝামেলা ছিল, যদিও আমরা তখন সিনিয়র সিটিজেনের চৌকাঠে পা রাখতে রাখতে বুঝেছিলাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
১৯৯৪-এ বৃষ্টি, আর ১৯৯৭-এ আগুন। শীতে বৃষ্টি এমনিতে বেশি হয় না, কিন্তু সেবার তুমুল বৃষ্টি হল। এমনিতে সেখানে ধুলো হত খুব, ফলে জল দিতে হত পথে, কিন্তু বৃষ্টি সেই সুবিবেচনা নিয়ে আসেনি, বইপত্রের ক্ষতি হয়েছিল। যাই হোক, তারপর থেকে স্টলগুলোতে বৃষ্টিসুরক্ষার ব্যবস্থা জোরদার হয়। তবে আগুন লাগল ১৯৯৭-এ। জানি না, আগুন বৃষ্টিকে ‘এবার আমার পালা’ বলে নোটিস দিয়ে এসেছিল কি না। কিন্তু সংস্কৃতি-মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সহায়তায়, আবার বইমেলা ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়াল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
২.
বইপাড়ার তুলনায় একটা বইমেলার ‘উপকারিতা-অপকারিতা’র কথা তো সবাই জানে। উপকারিতার কথাগুলোই আগে বলি। বইপাড়ায় পছন্দসই বই কিনতে, দোকানে দোকানে ঘুরতে হয়, দোকানের কর্মচারীর অন্ধকার র্যাকে গিয়ে বই খুঁজে আনতে দেরি হয়, বই দেখে উলটে-পালটে তৎক্ষণাৎ আর তৎস্থানিক পছন্দ করার কোনও অবকাশ মেলে না ইত্যাদি ইত্যাদি। সেইসঙ্গে হাতের কাছেই প্রচুর খাবারের দোকান, আদার চা, লেবুর চা ঘুরে বেড়ায়, মুক্তমঞ্চে কত বুদ্ধিজীবীদের বক্তৃতা হয়, সাহিত্যিক, কবিদের জ্বলজ্যান্ত দেখতে পাওয়া যায়, বইয়ের দোকানে বসে তাঁরা বইয়ে স্বাক্ষরও করে দেন। এ আমরা বইপাড়ায় কোথায় পাব?
আমার মনে আছে, শ্রদ্ধেয় প্রফুল্ল রায়, তাঁর নিজের একটি বই এইভাবে সই করেন, (ক্রেতার নাম দিয়ে) ‘ওমুকেরই বই, আমার শুধু সই’ বলে, তাঁর সুছাঁদ অক্ষরে নিজের নাম নীচে সই করেন। আমি এই কায়দাটা, তাঁর অনুমতির তোয়াক্কা না করে বেমালুম চুরি করে নিয়েছি, আমার বইতেও আমি এই কেতাতেই সই করি, যদি কোনও পাঠক চান। ইংরেজিতে একেই বোধ হয় ‘প্লাগিয়ারিজম’ বলে, বাংলায় ‘রচনাচৌর্য’। ‘অপকারিতা’-র কথা যদি বলতে হয়, তা হলে জোর করে বলতে হবে যে, ১০ শতাংশ কমিশনটা একটু কম, কিন্তু বইপাড়ায় দু’-একটি দোকান ছাড়া, আর বিশেষ পরিচয় ছাড়া, ক’জন লোক কমিশন পায়? আমি নিজে, যে দরেরই হই না কেন, একজন লেখক হয়ে বইমেলার ‘অপকারিতা’ খুঁজে বেড়ালে ধর্মদ্রোহের দায়ে পড়ব।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: পাঠক বইমেলা সচেতন হলে বইমেলারও তো পাঠক সচেতন হওয়া উচিত
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মোহর কুঞ্জের বইমেলার একটা অদ্ভুত ঘটনা আমার স্মৃতিতে বসে আছে।
ঘটনাটা বইয়ের সঙ্গে যুক্ত নয়। একদিন বাংলা আকাদেমিতে, সভাপতি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছি, উঠব-উঠব করছি, এমন সময় প্রয়াত আর শ্রদ্ধেয় কবি অরুণ মিত্র এসে ঢুকলেন ওই ঘরে, কুলকুল হাসিতে তাঁর শরীর কেঁপে যাচ্ছে। তিনি হাসতে হাসতে আমার কনুই ধরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘জানো আজ কি মজা হয়েছে! আমি ট্যাক্সি করে বইমেলার গেটে নেমেছি, ওমনি দু-জন বিশাল পুলিশ এসে আমাক পায়ের জুতোয় জুতো ঠেকিয়ে আমাকে কী বিশাল স্যালিউট! তারপর আমাকে ধরে নিয়ে তাদের স্টলে বসায়, আর চা-টা নিয়ে আপ্যায়নে আপ্যায়নে অস্থির করে দেয়! আমি ভাবি, এ কী কাণ্ড রে বাবা! কবিদের সঙ্গে পুলিশ এরকম ব্যবহার করছে, এ কী স্বর্গে চলে এলাম নাকি? যদিও স্বর্গে কবি দেখলে পুলিশ টুপি খোলে কি না জানি না।’ তারপরে অরুণদা হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আসলে ওদেরই একজন খুব বিনীতভাবে পরে আমাকে জানায়, ওদের বস্, কলকাতার পুলিশ কমিশনার সত্যব্রত বসুর সঙ্গে আমার চেহারার নাকি অদ্ভুত মিল আছে, তাই ওরা ভড়কে গিয়েছিল।’ অরুণদার সেই আপাদমস্তক হাসি, আমি ভুলতে পারিনি।
৩.
পার্ক স্ট্রিট মোড়ে বইমেলা এল ১৯৮৮-তে, তার দু’টি ঘটনা মনে আছে। তাকে বৃষ্টি ও আগুন দুই-ই আক্রমণ করেছিল। ১৯৯৪-এ বৃষ্টি, আর ১৯৯৭-এ আগুন। শীতে বৃষ্টি এমনিতে বেশি হয় না, কিন্তু সেবার তুমুল বৃষ্টি হল। এমনিতে সেখানে ধুলো হত খুব, ফলে জল দিতে হত পথে, কিন্তু বৃষ্টি সেই সুবিবেচনা নিয়ে আসেনি, বইপত্রর ক্ষতি হয়েছিল। যাই হোক, তারপর থেকে স্টলগুলোতে বৃষ্টিসুরক্ষার ব্যবস্থা জোরদার হয়। তবে আগুন লাগল ১৯৯৭-এ। জানি না, আগুন বৃষ্টিকে ‘এবার আমার পালা’ বলে নোটিস দিয়ে এসেছিল কি না। কিন্তু সংস্কৃতি-মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সহায়তায়, আবার বইমেলা ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়াল। যেদিন আবার শুরু হয়, সেদিন একটা অদ্ভুত অনুষ্ঠান হয়েছিল। কেন্দ্রীয় মঞ্চ আবার খাড়া করে, কিছু পোড়ানো বই দেখানো হয়েছিল দর্শকদের, আমরা আগুনের মধ্যে থেকে মাথা তুলেছি বলে, তাতে আমারও একটি নতুন বই তৎক্ষণাৎ কিছুটা পুড়িয়ে এনে দেখানো হয়েছিল।
এখানেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, সম্ভবত সেটা ১৯৯৬ হবে। আমি তখন রবীন্দ্রভারতীতে একটা বড় চাকরি করি। রবিবার সকালে, গিল্ডের একটি সেমিনারে আমন্ত্রিত বক্তা আমি। পার্ক স্ট্রিটের পুব কোনায় গাড়ি ছেড়ে হেঁটে পার্ক স্ট্রিট পেরতে গিয়েছি, আমাকে পুলিশ ধরল বেআইনি কাজ করছি বলে। যতই বলি আমি ওমুক, আমি তসুক, তারা সেসব না শুনে, আমাকে পুলিশ ভ্যানে তুলল। আশপাশের সহযাত্রীদের দেখে মনটা দমে গেল, তাঁদের চেহারা দেখে বুঝলাম, এঁরা অন্ধকার জগতের শ্রদ্ধেয় নাগরিক। পার্ক স্ট্রিট থানায় যাওয়ার পর, মনে পড়াতে ওসি মহাশয়কে আমার কার্ডটা দেখালাম, তিনি মনে মনে জিভ কাটলেন বোধহয়। তারপর, অন্যরা যখন লাইনবেঁধে আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডে দাঁড়িয়েছেন, তিনি আমাকে পাশের একটি দরজা দিয়ে বের করে দিয়ে বললেন, ‘স্যর, কিছু মনে করবেন না।’ যাই হোক, আধ ঘণ্টা দেরিতে হলেও সেমিনারে গিয়ে গুরুগম্ভীর বক্তৃতা দিতে পেরেছিলাম।
এর পরে পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত, ময়দান দূষিত হচ্ছে বলে মামলা করলেন এক শুভক্ষণে, মেলা বোধহয় ২০০৭-এ উঠে গেল বাইপাসের ধারে মিলনমেলায়। সেখান থেকে সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্কের পুব প্রান্তে। স্থানান্তরে, বইমেলার চরিত্র বদলেছে, কিন্তু বই পড়া কমে যাওয়া নিয়ে হইচই হলেও, বইমেলা এখনও মানুষকে দূরদূরান্ত থেকে আমন্ত্রণ করে। দেশের মানুষকে, বিদেশের মানুষকে। কিন্তু আমার গল্প এখানেই ফুরল।