বইমেলায় চমকের অন্ত ছিল না। কোনওবার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মিনিবুক, কোনওবার এক টাকার ‘আনন্দমঠ’, কোনওবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পাণ্ডুলিপি সংস্করণ, কোনওবার আনন্দবাজার পত্রিকার পকেট সাইজ প্রতিলিপি। মমার্তে ছবি আঁকা চলত পুরোদমে। সভাসমিতি তো লেগেই থাকত। মনে পড়ছে মেলায় প্রত্যেক দিন বেরোনো কিছু ট্যাবলেয়েডের কথা। মনে পড়ছে ‘প্রতিক্ষণিকার’ কথা। মনে পড়ছে, সেই ভদ্রলোককে যিনি রণপা’য় চড়ে মেলার মাঠে নিজের লেখা বই বিক্রি করতেন। স্মরণ করি ‘রক্তকরবী’র প্রদীপ ভট্টাচার্যকে, স্টল বন্ধ করে তালা লাগাতে লাগাতে বইমেলার মাঠেই চিরস্তব্ধ হয়ে যান।
প্রথমবার বইমেলার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আচমকা, অর্থাৎ বইমেলার সামনে গিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত জানতামই না শহরে একটা বইমেলা হচ্ছে! আমাদের কাছে ‘বইমেলা’ বলতে কলেজ স্ট্রিট। মেলা বই।
১৯৭৪ সাল। তখন চাকরিতে ঢুকে গেছি। লালবাড়ি মানে রাইটার্স বিল্ডিংস। মাঝে মাঝে বাবার অফিস থেকে বাবা আর আমার অফিস থেকে আমি– দু’জনে আকাদেমিতে নাটক দেখতে যেতাম। এইরকমই একদিন নাটকের শেষে আকাদেমি থেকে বেরনোর সময় হঠাৎ লক্ষ করলাম বই নিয়ে কী একটা হইচই হচ্ছে। আগে বিদেশ থেকে জাহাজ-ভর্তি পুরনো বই এনে আকাদেমিতে বিক্রি হতে দেখেছি। কিন্তু এবার তো সেরকম নয়! এবার মূলত বাংলা বই, বাংলার প্রকাশন, আর উদ্যোক্তা সম্ভবত ‘ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট’, তারাও অনেক বাংলা বইয়ের প্রকাশক। ঘুরে ঘুরে হাতে হাতে নাড়াচাড়া করে বই দেখলাম, কয়েকটি কিনলাম। নাটক দেখতে এসে মনোমতো উপরি পাওনা হল।
তারপর থেকে এই ৪৮ বছর ধরে বইমেলায় প্রায় কখনওই অনুপস্থিত থাকিনি, থাকতে পারিনি। যখন মিন্টো পার্কের কাছের অফিসে এলাম তখন তো প্রতিদিনই বাড়ি ফেরার পথে বইমেলায় চক্কর দেওয়াটাই ছিল দস্তুর! বারবার জায়গা বদল হয়েছে, আমরা তার পিছু ধাওয়া করেছি। ময়দান থেকে পার্ক স্ট্রিট, কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু সল্টলেকে স্থানান্তরিত হওয়ার পর আমি আর নিয়মিত যেতে পারতাম না। আমার ও বইমেলার– দু’জনেরই বয়স বেড়ে গেল। বইমেলা অনেক বিস্তৃত হল, অমূল্য হয়ে যাওয়ার কারণে ভিড় বাড়তে শুরু করল হু হু করে, আর আমি ক্রমশ প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধ হয়ে পড়লাম। তবে কোনওবারই একেবারে দূরে সরে থাকতে পারিনি।
বইমেলার প্রধান আকর্ষণ আমার কাছে– এক, কলেজ স্ট্রিটে নিয়মিত যাতায়াত থাকলেও, সেখানে ছাড়ের হার বেশি হলেও, হাতে নিয়ে বই দেখার সুযোগ প্রায় নেই। উল্টোদিকে বইমেলায় ইচ্ছেমতো বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা যায়। মোদ্দা কথা, বইয়ের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পাওয়া যায়। অনেকেই তাই ছোট নোটবুক নিয়ে মেলায় ঢোকেন। বই পছন্দ করে নোটবুকস্থ করেন পরে কলেজ স্ট্রিট থেকে গস্ত করেন। দুই, আগে লিটল ম্যাগাজিনের আলাদা কোনও মেলার অস্তিত্ব ছিল না, বইমেলার লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নই ছিল আমাদের প্রাণের আরাম, মিলনকেন্দ্র, আড্ডাস্থল। পুরনো বন্ধুরা তো ছিলই, নতুন অনেক বন্ধু আমরা খুঁজে পেয়েছি এই লিটল ম্যাগাজিনের প্যাভিলিয়নে। যাঁরা পোস্টকার্ডে বা ফোনে, লেখার জন্য যোগাযোগ করতেন, তাঁদের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হওয়ার, চাক্ষুষ করার সুযোগ করে দিত এই লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন। ১৯৮৭ সালে এইখানেই আমার প্রথম বই ‘শুভেচ্ছা সফর’ প্রকাশিত হয়। মেলা জুড়ে গোটা ৪০ কপি বই বিক্রি হয়েছিল সেবার। আমাকে বিস্মিত করে কোনও কোনও ক্রেতা আবার আমাকে দিয়ে বইয়ে স্বাক্ষর করিয়েও নেন! ঠিকঠাক অটোগ্রাফ দেওয়ার অভিজ্ঞতা সেবারই প্রথম হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত আমার শেষ বই, ‘অরণি বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা’ও প্রকাশিত হয়েছিল ২০২২-এর বইমেলার শেষ দিনে। তিন, মেলার শেষ দু’দিন বা তিনদিন বেশিররকম ছাড়ে বই দেওয়া হত। নাম ছিল ‘বইবাজার’। ৮০% পর্যন্ত ছাড়ে বই পাওয়া যেত। নামকরা প্রকাশকরাও ‘স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল’ দিতেন বলে অনেক দিন ধরে খোঁজা, পাওয়ার আশা ছেড়ে দেওয়া এমনকী, দুষ্প্রাপ্য বইও পাওয়া যেত এই বইবাজারে। অল্পস্বল্প ছেঁড়া-ফাটা। তবে সেসব গ্রাহ্য করত না কেউই। আমরা একেবারে, যাকে বলে হামলে পড়তাম।
১৯৮৭ সালেই ‘পা’ পত্রিকা পক্ষ থেকে সুশীল সিংহ একটা টেবিল নিয়েছিলেন লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে। সেখানে প্রায় রোজই আসতেন মণীন্দ্র গুপ্ত, রঞ্জিত সিংহ। সুশীল সিংহ তো ছিলেনই। নারায়ণ মুখোপাধ্যায় আসতেন ঘুরে-ফিরে। এঁদের ঘিরে রোজ জমা হত এক দঙ্গল তরুণ কবি ও গল্পকার। টেবিলে থাকত মণীন্দ্রবাবুর আনা ‘পরমা’ পত্রিকা ও ‘পরমা’ প্রকাশিত বইপত্র, সুশীলদার ‘পা’ পত্রিকা ও ‘পা’-এর বই। থাকত তরুণ কবিদের বইপত্র। আমি নিয়ে যেতাম ‘উলুখড়’-এর বই। ‘উলুখড়’-এর বইয়ের মধ্যে ছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘কফিন কিংবা সুটকেশ’, ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘প্রিয় সুব্রত’। এছাড়া আমার, প্রিতমের, অলোকনাথের বই। টেবিলের সামনের খোলা মাঠে শতরঞ্চি পেতে চলত তরুণ কবিদের আড্ডা, কবিতাপাঠ। গানও ধরতেন কেউ কেউ। পিকনিকের আবহাওয়া। বাড়ি থেকে বা বাইরে থেকে খাবার আসত, সেই খাবার সবাই মিলে ভাগ করে খাওয়া হত। বর্ষীয়ানরাও মিশে যেতেন সেই হুল্লোড়ে।
মেলায় খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন তখনও ছিল, তবে এখন যেমন লোকে বইমেলায় ঢোকার আগেই ঠিক করে নেন, কী দিয়ে শুরু করবে নবদ্বীপের লাল দই না ফিস ফ্রাই বা বার্গার তখন এত বাড়াবাড়ি ছিল না। কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউসও এসে উপস্থিত হয়েছিল কয়েকবার। আবার এ-ও দেখেছি ব্যাগভর্তি বই সামনে রেখে রুটি-তরকারি খাচ্ছে পুরো পরিবার।
বইমেলায় চমকের অন্ত ছিল না। কোনওবার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মিনিবুক, কোনওবার এক টাকার ‘আনন্দমঠ’, কোনওবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার পাণ্ডুলিপি সংস্করণ, কোনওবার আনন্দবাজার পত্রিকার পকেট সাইজ প্রতিলিপি। মমার্তে ছবি আঁকা চলত পুরোদমে। সভাসমিতি তো লেগেই থাকত। মনে পড়ছে, মেলায় প্রত্যেক দিন বেরোনো কিছু ট্যাবলেয়েডের কথা। মনে পড়ছে ‘প্রতিক্ষণিকা’র কথা। মনে পড়ছে, সেই ভদ্রলোককে যিনি রণপা’য় চড়ে মেলার মাঠে নিজের লেখা বই বিক্রি করতেন। স্মরণ করি ‘রক্তকরবী’র প্রদীপ ভট্টাচার্যকে, স্টল বন্ধ করে তালা লাগাতে লাগাতে বইমেলার মাঠেই চিরস্তব্ধ হয়ে যান।
আর আগুন লাগার কথা ভুলি কী করে? ১৯৯৭। পার্ক স্ট্রিট সংলগ্ন ময়দানে বইমেলা। থিম ফ্রান্স। সাজানো হয়েছিল ল্যুভর মিউজিয়ামের অনুকল্পে। খাবারের দোকান থেকে আগুন লাগে। সেবারের ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’-এর সভাপতি ছিলেন ভানুবাবু– সবিতেন্দ্রনাথ রায়। তাঁর জবানিতে, ‘মেলা প্রাঙ্গণে দমকল সবসময়ই একটা মজুত থাকত। দুর্ভাগ্য, সেটি যথাসময়ে কাজ করল না। আরও দমকলের জন্য খবর দেওয়া হল। কিন্তু সে দমকল আসতে আসতে মেলার দুই তৃতীয়াংশ পুড়ে ছাই হয়ে গেল! এর এক বছর আগে আমার মা মারা গিয়েছে, সেই পোড়া বইমেলার ভস্মরাশির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল, দ্বিতীয়বার মাকে হারিয়ে শ্মশানে দাঁড়িয়ে আছি। এই অগ্নিকাণ্ডে একজন মারা গিয়েছিলেন। যতীন শীল নামে এক ভদ্রলোক বই কিনতে এসেছিলেন। তিনি হৃদরোগী ছিলেন। অগ্নিকাণ্ডের আতঙ্কেই হার্টফেল করেন। গিল্ড থেকে তাঁর পরিবারকে অর্থসাহায্য করা হয়। নতুন বইমেলায় তাঁর নামে একটি মঞ্চও হয়।’
দমকল, সরকার, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর, অর্থমন্ত্রীর ও আরও অনেকের ঐকান্তিক চেষ্টায় আগুন নেভার পর মাত্র তিনদিনের চেষ্টায় নতুন বইমেলা শুরু হল। কিন্তু পোড়া বইমেলার দগদগে স্মৃতি নিয়ে ভাঙা বুকে আবার বিকিকিনি শুরু হলেও স্বাভাবিকতা ফিরে আসেনি। সুর কেটে গিয়েছিল। মেলা শেষ হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর পর্যন্ত কলকাতার আনাচ-কানাচে, কলেজ স্ট্রিটে আগুনের ক্ষতি-সহ বই বিক্রি হতে দেখে গেছে। আমি নিজে ধর্মতলায় পিয়ারলেস অফিসের সামনে থেকে ভ্যান গগের একটি অসামান্য বই অনেক কম দামে সংগ্রহ করেছিলাম। মলাট নেই, আর বইয়ের ধারে পোড়া বইমেলার কালো স্মৃতি।
আগুন লেগেছিল, আগুন নিভেও গেল। মেলা আবার শুরু হল, কিন্তু একজনের মন একেবারে মরে গেল। তাঁর প্রথম বইয়ের পুরো লট তাঁরই চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল! যাঁকে দেখে সাধারণত মানুষের মন হাস্যরসসিক্ত হয়ে ওঠে। বইমেলার আগুন তাঁকে ভিতর থেকে মর্মান্তিকভাবে দগ্ধ করে দিয়েছিল। রবি ঘোষ তারপর আর বেশিদিন বাঁচেননি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর প্রয়াণ ঘটে।
…….. পড়ুন পুরনো মেলার স্মৃতি। বইমেলাধুলো……..
মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়: শক্তিপদ রাজগুরুর বই শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে এক পাঠক সই করাবেনই করাবেন!
সৌরীন ভট্টাচার্য: টেবিলের দায়িত্বে থাকা রামু-সমেত কফি হাউস উঠে এসেছিল বইমেলায়
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত: পাঠক বইমেলা সচেতন হলে বইমেলারও তো পাঠক সচেতন হওয়া উচিত
কালীকৃষ্ণ গুহ: বইমেলায় বাজানো হত উচ্চাঙ্গ সংগীতের ক্যাসেট
পবিত্র সরকার: বইমেলার গেটে কবি অরুণ মিত্রকে স্যালিউট করেছিল পুলিশ
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: সদ্য বৃষ্টিভেজা বইমেলায় বিকেলে সুচিত্রা-ঝলক পরম প্রাপ্তি
মৃদুল দাশগুপ্ত: জোড়হস্তে কফি হাউসের টেবিলে টেবিলে বইমেলায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন গিল্ডকর্তারা
সুশোভন অধিকারী: চটের ওপর বসে মন দিয়ে কার্ড এঁকে চলেছেন একমাথা ঝাঁকড়া চুলের পূর্ণেন্দু পত্রী
মিনতি চট্টোপাধ্যায়: স্টলের ভেতরে মহীনের ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে আর স্টলের বাইরে ময়দানের মাটিতে গোল হয়ে বসে চলছে গান
হিরণ মিত্র: এই বইমেলায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় গলায় মিনিবুক ঝুলিয়ে ফেরি করতেন
অনিল আচার্য: অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র-কে লিটল ম্যাগাজিনের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
দেবাশিস মুখোপাধ্যায়: দুপুরের বইমেলায় ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে’ শুনে আকাশের দিকে তাকালেন সত্যজিৎ রায়