আর কিছুক্ষণ পরেই একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে একজন অর্থনীতিবিদের, যিনি ছাত্রজীবনে বামপন্থী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়াও আরও যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে তাঁরা প্রায় সকলেই প্রগতিশীল রাজনীতি কিংবা চিন্তাভাবনার সঙ্গে তৎপর ছিলেন।
বাংলাদেশের মানুষ আপাতত হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। গত জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে একটা দমবন্ধ অবস্থা ছিল। এ যেন বিদ্যুৎবিহীন লিফটে আটকা পড়ে থাকা। আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল ছাত্রদের সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। কোটা ব্যবস্থা দেশ স্বাধীনের পরে সংবিধানে রাখা হয়েছিল স্বল্প সময়ের জন্য। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কিংবা তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য কোটা ব্যবস্থা রাখা ছিল। এর বাইরেও নানা ধরনের কোটা বিরাজমান থাকায় মেধাবীদের জন্য পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলোতে দলীয় বিবেচনায় অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের নাম তালিকাভুক্ত করতে সক্ষম হয়। এতে করে ‘কথিত মুক্তিযোদ্ধা’র সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের কোটা তাদের নাতি-পুতিদের (Grand grandson/daughter) জন্যও বিস্তৃত করা হয়। এতে করে মেধাবীদের সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্র আরও অনেক সংকুচিত হয়ে পড়ে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলে। পরবর্তীতে এটি হয়ে ওঠে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
তো ভালোই চলছিল বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নানা কর্মসূচি। সরকারও ২০১৮ সালে ছাত্রদের দাবির সঙ্গে একমত হয়ে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে একটি আবেদন করা হয়। উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সরকারি ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করে এবং কোটা বহাল থাকে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে এবং সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে বলে। সরকার মৌখিকভাবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির সঙ্গে একমত থাকলেও সে কোটার পক্ষের অংশের সঙ্গে যোগসাজশ রাখছিল বলে প্রতীয়মান হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকার আন্দোলনকারীদের আস্থা হারায়। একই সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী এ আন্দোলনের বিপক্ষে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দেয় এবং সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র আন্দোলনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়। তারা আন্দোলনকারীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাদেরকে জোর করে বের করে দেয়। সরকারি পুলিশ বাহিনী সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে মিলে একই ভূমিকা পালন করে।
একই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর চিন সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর সরকারি বাসভবনে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে ইঙ্গিত করেন এবং তাঁদের মর্যাদাবোধে আঘাত করে কটূক্তি করেন বলে মনে করা হয়। জ্বলে ওঠে ছাত্র সমাজ! সংঘর্ষ জোরালো হয় এবং সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করে। বিগত নির্বাচনগুলোতে সাধারণ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারায় এবং সাধারণ মানুষ ও মধ্যবিত্ত; সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে এমনিতেই নাখোশ ছিল। তারা এসে যুক্ত হয় ছাত্রদের পাশে। পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং সরকার সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগে আন্দোলন দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আন্দোলনকারীরা ডাক দেয় অসহযোগ আন্দোলনের এবং সরকার কারফিউ ঘোষণা করে। আজ ছিল আন্দোলনকারীদের অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় দিন। সেনাবাহিনীকে রাস্তায় নামানো হয় তাদের মাধ্যমে প্রতিরোধ করার চেষ্টা চলে আন্দোলনের। বল চলে যায় সেনাবাহিনীর কোর্টে। জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। একই সঙ্গে সাবেক সেনাপ্রধান সহ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তারা সামরিক বাহিনীকে সেনা ছাউনিতে ফিরে যেতে আহ্বান জানান। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধান সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিটিং করেন এবং সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করে দেশের এই পরিস্থিতিতে ভূমিকা রাখার সিদ্ধান্ত নেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের অসহায় পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আজ দুপুরে তার বোন শেখ রেহানা সহ একটি হেলিকপ্টারে করে গোপনে দেশত্যাগ করেন। সেনাপ্রধান জাতির সামনে ভাষণ দিয়ে পরিস্থিতির দায়িত্ব নেন এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন (ইন্টেরিম) সরকার গঠন করার সিদ্ধান্ত জানান। এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের তোড়জোড় চলছে রাষ্ট্রপতির বাসভবনে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই পরিবর্তনে স্বস্তিতে আছেন। তবে স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তি তৈরি হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামি লীগ সরকারের নেতাকর্মীদের মধ্যে। যদিও যেমনটা হয়ে থাকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারি দলের লোকদের উপর হামলা এবং হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে সেটির খুব বেশি সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কারণ আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে কোনও আক্রোশমূলক কর্মকাণ্ড বিগত দিনগুলোতে হয়েছে, এমনটি বলার সুযোগ নেই। তবে দীর্ঘদিন আওয়ামি লীগ ক্ষমতায় থাকার ফলে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
প্রশ্ন হল, এরপর কী? কারা ক্ষমতায় আসবেন? ক্ষমতার পালাবদলে কে হবেন লাভবান? অনেকের মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে যে এর মধ্য দিয়ে কি মৌলবাদী শক্তির উত্থান হতে পারে? বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক।
আওয়ামি লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় সরকারে যাওয়ার জন্য একটা প্রোপাগান্ডাকে কাজে লাগিয়েছে। সেটা হল, আওয়ামি লীগ যদি ক্ষমতায় না থাকতে পারে কিংবা না যেতে পারে তাহলে এদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটবে এবং মৌলবাদী দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। সুতরাং, অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠন করার জন্য শুধুমাত্র আওয়ামি লীগের হাতেই ক্ষমতা থাকা দরকার। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। বিরোধী দলে থাকার সময় আওয়ামি লীগ জামাত ইসলামের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আন্দোলন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলামি পোশাক পরিধান করেছেন এবং তিনি সবচেয়ে অধিক ধর্ম-কর্ম পালন করে থাকেন– এরকম বক্তব্য দিয়েছেন। এরকম একটি বিপরীতমুখী কর্মকাণ্ডের ফলে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক হিসেবে জনগণের মধ্যে আওয়ামি লীগের প্রতি একচেটিয়া বিশ্বাসের জায়গায় আর থাকে নেই। সুতরাং নতুন সরকারে মৌলবাদী কারও স্থান পাওয়ার যেমন সম্ভাবনা নেই, তেমনই পরবর্তী দিনগুলোতে মৌলবাদী শক্তির উত্থানের কোনও সম্ভাবনা তেমন দেখা যাচ্ছে না।
আর কিছুক্ষণ পরেই একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে একজন অর্থনীতিবিদের, যিনি ছাত্রজীবনে বামপন্থী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়াও আরও যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে তাঁরা প্রায় সকলেই প্রগতিশীল রাজনীতি কিংবা চিন্তা ভাবনার সঙ্গে তৎপর ছিলেন। আশা করা যায়, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার দিকে এগোতে পারবে। সমগ্র জাতি এই আশায় বুক বেঁধে আছে।
লেখক: সম্পাদক, সাম্প্রতিক দেশকাল, ঢাকা