‘টিনের তলোয়ার’ প্রযোজনায় সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় আর অভিনয় করছে না। প্রথম দু’টি অভিনয়ের পরই ‘টিনের তলোয়ার’ প্রযোজনায় ওকে আর রাখা হয়নি। আমাদের প্রথম অভিনয়ের দিন ডবল শো ছিল। ২০১৯ সালে নারীনিগ্রহের যে অভিযোগ ওঠে সুদীপ্তকে কেন্দ্র করে, সে ব্যাপারে আমি সেই সময়ে আমার মতামত স্পষ্ট জানিয়েছি। যে অভিযোগ উঠেছিল ওকে ঘিরে, সেই নিগ্রহের কাণ্ডকে আমি একেবারেই সমর্থন করি না, কোনও দিনই করব না। এটা যেন মনে না হয়, কোনও ঔদ্ধত্য থেকে বা পৌরুষের জেদে কিছু মানুষের বেদনাকে আমি অস্বীকার করছি।
এই লেখা কোনও আত্মপক্ষ সমর্থনের বয়ান নয়, একটি খোলামেলা স্বীকারোক্তি। কোনও বানিয়ে তোলা কথা নয়, শুধুই যা ঘটেছে, তাই বলার চেষ্টা করছি। প্রথমেই জানাই, ‘টিনের তলোয়ার’ প্রযোজনায় সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় আর অভিনয় করছে না। প্রথম দু’টি অভিনয়ের পরই ‘টিনের তলোয়ার’ প্রযোজনায় ওকে আর রাখা হয়নি। আমাদের প্রথম অভিনয়ের দিন ডবল শো ছিল। ২০১৯ সালে নারীনিগ্রহের যে অভিযোগ ওঠে সুদীপ্তকে কেন্দ্র করে, সে ব্যাপারে আমি সেই সময়ে আমার মতামত স্পষ্ট জানিয়েছি। যে অভিযোগ উঠেছিল ওকে ঘিরে, সেই নিগ্রহের কাণ্ডকে আমি একেবারেই সমর্থন করি না, কোনও দিনই করব না। গায়ক হিসেবে যোগ্য বলেই এই নাটকে দু’টি গান গাইতে বলেছিলাম; সেটা আমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তাই প্রথম অভিনয়ের পরেই ‘টিনের তলোয়ার’ প্রযোজনা থেকে ওকে সরে যেতে বলি অবিলম্বে। নিশ্চয়ই ওকে সরিয়ে দেওয়ার এই সিদ্ধান্তের পিছনে বহু মানুষের প্রতিবাদ ছিল এবং ছিল তাঁদের বয়ানে লেখা অনেক মানুষের যাপনযন্ত্রণার কথা। কিন্তু তা সত্ত্বেও মূল প্রশ্নটা থেকেই যায়– আমি কেন ওকে ডাকলাম, মঞ্চে স্থান দিলাম?
এর কয়েকটি প্রধান কারণ– প্রথমত, আমার মুহূর্তের অমনোযোগ এবং নির্দেশক হিসেবে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রযোজনার একদম শেষ লগ্নে আমার অস্থিরতা। নির্দেশক হিসেবে তখন নাটকের শেষ দৃশ্যে কয়েকটি গানের জন্য একজন ভালো কণ্ঠশিল্পীর দরকার ছিল। এটা নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ আগে। তখন দিনরাত মহলা চলছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই নাটকের প্রথম অভিনয়। আমি কয়েকজনকে ফোন করে জানতে চাই, তাঁরা খালি আছেন কি না। কিন্তু তাঁদের সময় পাইনি। তখন একটু তাড়াহুড়ো করেই সুদীপ্তকে ডেকে পাঠাই। এর আগে বেশ কিছুদিন ধরে তরুণ প্রজন্মের কিছু নাট্যসহকর্মী আমাকে বলেছিলেন যে, সুদীপ্তকে নিয়ে কিছু কাজ করার কথা। বা আমার আর সুদীপ্তর যৌথ প্রযোজনা ‘ম্যান অফ দ্য হার্ট’ আবার মঞ্চস্থ করা যায় কি না। তাঁরা কিন্তু নাট্যমহলের একেবারে ভেতরের মানুষ এবং সমস্ত ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। তাঁদের এই অনুরোধে বা ইচ্ছার কথা শুনে আমি ভেবে নিয়েছিলাম যে, সুদীপ্তর ব্যাপারটা হয়তো একরকম নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। কিন্তু এমনও বলব না যে, শুধু তাঁদের অনুরোধ রাখতেই আমি সুদীপ্তকে ডেকেছি। ওকে ডাকার সব দায় আমার। আমি ধরে নিয়েছিলাম সুদীপ্তর দীর্ঘ হাজতবাসের পর সেই বিচারের অবসান হয়েছে, এবং অভিযোগকারিণীরা ওকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। কারণ মাঝখানে আরও একটি নাটকে ও বেশ কয়েকটা অভিনয় করেছে, কিছু অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। সেই নাটক বা সেইসব অনুষ্ঠান ঘিরে আমার কোনও প্রতিবাদ চোখে পড়েনি। হয়তো হয়েছে, কিন্তু আমি জানতাম না। অন্তত এরকম প্রবল আকার নেয়নি। তার পরে খবর পেলাম যে, ও একটি চলচ্চিত্র বানিয়েছে এবং নাটকের কর্মশালা করছে। এইসব দেখে বিষয়টি বর্তমানে কী অবস্থায় আছে, তা পুনর্বার খতিয়ে দেখিনি।
সুদীপ্তকে এ নাটকে অভিনয় করতে বলে যদি বহু মানুষকে দুঃখ দিয়ে থাকি, তার জন্য আমি অনুতপ্ত। আমার দীর্ঘ কাজের জীবনে এরকম অবস্থার সম্মুখীন হইনি। আবার এমন প্রশ্ন উঠবে যে, আমি এই লেখা আগে লিখলাম না কেন? তার কারণ ২ মার্চ ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের প্রথম দু’টি অভিনয় ছিল। সেই অভিনয়ের পরই জানতে পারলাম বেশ কিছু মানুষ এখনও সেই ঘটনায় যন্ত্রণাদগ্ধ এবং দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অবসাদে আক্রান্ত। তাই একদিনও দেরি না করে সুদীপ্তকে বাদ দিয়েই চেষ্টা করেছি যাতে বহু মানুষের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পায়, তাঁদের পাশে থাকা যায়। যেন মনে না হয়, কোনও ঔদ্ধত্য থেকে বা পৌরুষের জেদে কিছু মানুষের বেদনাকে আমি অস্বীকার করছি। সুদীপ্তও নাটকের স্বার্থে দলে একটি ব্যক্তিগত চিঠি দিয়ে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর আরও তিনটি অভিনয় হয়। একটি আমন্ত্রিত অভিনয় এবং ৩১ মার্চ অ্যাকাডেমি মঞ্চে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে দু’টি অভিনয়। চরিত্রলিপি থেকে সুদীপ্তর নাম বাদ যায়, এবং নতুন শিল্পীর নাম আসে। তাই ভেবেছিলাম প্রতিবাদীরা এই পরিবর্তন লক্ষ করেছেন এবং আমাদের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু এই বিষয় নিয়ে আলোচনা আবার তুঙ্গে ওঠে কিছুদিন আগে– ৩ এপ্রিল ‘ছোটলোক’ সিরিজ দেখে আমার মুগ্ধতা নিয়ে লেখা একটি আলোচনার পর বেণী বসু যখন কিছু প্রশ্ন তোলে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বেণী বসু এবং ওর সমসাময়িক কিছু নাট্যশিল্পী আমার থেকে অনেক ছোট, বা জুনিয়র বলে ওকে বা ওঁদের উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করব– এমন মনোভাব আমি কোনও দিনই দেখাইনি। বরঞ্চ যাঁদের কাজ দেখে ভালো লেগেছে, উচ্চকণ্ঠে তাঁদের প্রশংসা করেছি, আবার ভালো না লাগলে সে কথা জানিয়েছি। কিন্তু প্রতিবাদীদের একজনও উল্লেখ করলেন না যে সুদীপ্ত আর নাটকে অভিনয় করছে না। আর চুপিচুপি নিভৃতে সরিয়ে দেওয়ার কথাটার মানে বুঝিনি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নিশ্চয়ই কিছু জরুরি প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কিন্তু একটি সুচিন্তিত উত্তর দিতেও তো সময় লাগে। জোর দিয়ে বলতে পারি, এখানে কোনও ‘ইগো’র প্রশ্ন নেই। বেণী বসু এবং ওর সমসাময়িক কিছু নাট্যশিল্পী আমার থেকে অনেক ছোট, বা জুনিয়র বলে ওকে বা ওঁদের উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করব– এমন মনোভাব আমি কোনও দিনই দেখাইনি। বরঞ্চ যাঁদের কাজ দেখে ভালো লেগেছে, উচ্চকণ্ঠে তাঁদের প্রশংসা করেছি, আবার ভালো না লাগলে সে কথা জানিয়েছি। কিন্তু প্রতিবাদীদের একজনও উল্লেখ করলেন না যে সুদীপ্ত আর নাটকে অভিনয় করছে না। আর চুপিচুপি নিভৃতে সরিয়ে দেওয়ার কথাটার মানে বুঝিনি। তাহলে কি লোক ডেকে অভিনয়ের দিনে সুদীপ্তকে জনসমক্ষে হাজির করে ঘোষণা করতে হত যে, ওকে আমরা বহিষ্কার করলাম? যাই হোক, এরপর ‘মুখোমুখি’-র তরফে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে ৬ এপ্রিল নাটকের কলাকুশলীদের তরফে যে, সুদীপ্তকে যুক্ত করাটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তাতেও কিছু এসে যায় না। কী যে ঠিক করতে হবে, এখনও বুঝিনি।
মনে পড়ে গেল একটা ঘটনা– নবারুণদা ওঁর মারুতি ৮০০ ড্রাইভ করছেন, আমি পাশে বসে। গলফ গ্রিনের বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষমাণ বাসযাত্রীদের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার পর নবারুণদা বললেন– ‘জানিস তো ওঁরা এখন কী বলছে, বিজন ভট্টাচার্যের ছেলে মারুতি চালিয়ে চলে গেল, আর উনি সারাজীবন কষ্ট করলেন! ওঁদের আসলে ইচ্ছে, আমি গামছা পরে ওই বাসের লাইনে ভিক্ষে করি।’
আর একটি ব্যাপার– বেণী বসু একটি প্রবন্ধ লেখে পুরো ঘটনাটি কেন্দ্র করে। একটি খুব জরুরি লেখা– শিল্পের পরিধিতে শিল্পীদের নিরাপত্তা নিয়ে এবং অন্যান্য কিছু বিষয় নিয়ে। সেটি প্রকাশিত হয় বাংলার প্রথম সারির একটি পোর্টালে। নিজের কথা ও লিখেছে যুক্তি দিয়ে। প্রকাশ করার আগে, আমাকে সেই পত্রিকা কিন্তু জিজ্ঞেস করেনি বেণীর উত্থাপন করা প্রশ্নগুলি নিয়ে আমার কিছু বলার আছে কি না। সেটা সেই পত্রিকার সিদ্ধান্ত। কিন্তু পরের দিন সেই লেখাটি সরিয়ে দেওয়া হয় কোনও কারণ না দেখিয়ে। সেটা অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক। চিরকালই কোনও কিছু ব্যান করা, সেন্সর করার আমি বিরুদ্ধে। আমাকে আইনজগতের কিছু মানুষ জানালেন, সুদীপ্তর ব্যাপারটা এখনও ‘সাবজুডিস’ বা ‘বিচারাধীন’ বলেই হয়তো সরিয়ে দিয়েছে। আমার কিন্তু পরিষ্কার জানা নেই। যদিও সে লেখা এখনও পাওয়া যাবে, সুস্থ আলোচনা জারি থাকতে পারে। আবার ওই প্রবন্ধে ফেসবুকের আমার একটি উক্তি তুলে বলা হচ্ছে যে, আমি কয়েকজন শিল্পী এবং তাঁদের কাজ নিয়ে কটূক্তি করেছি বা মজা করেছি। এটি সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। আমার ‘এরা নাটকের কি বোঝে’ উক্তিটি ছিল কয়েকটি মানুষকে নিয়ে, যাঁরা ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকটি নিয়ে খুব নিম্নমানের আলোচনা করেছিলেন।
সমালোচনা হতেই পারে, কিন্তু সমালোচনার উদ্দেশ্য আর মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। জীবনে আমার কাজ নিয়ে অনেক কঠিন, গঠনমূলক সমালোচনা পেয়েছি এবং মাথা পেতে নিয়েছি। বা চেষ্টা করেছি একটি যুক্তিযুক্ত উত্তর দিতে। কোনওভাবেই বেণী বা ওর সহযোগীদের উদ্দেশে আমি কোনও বক্রোক্তি করিনি। কারণ যে কয়েকজন প্রতিবাদী অগ্রজন নাট্যশিল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা নাটক নিয়ে কোনও কথা বলেননি। তাঁদের আপত্তির মূল জায়গাটি ছিল সুদীপ্তকে যুক্ত করা নিয়ে। তাই তাঁদের নাট্যশিল্পের দক্ষতা নিয়ে আমার কোনও কথা বলার প্রশ্নই ওঠে না। আর তাছাড়া এঁদের অনেকের কাজ আমি দেখিনি। না দেখে মন্তব্য করার কোনও পূর্ব-ইতিহাস আমার নেই। বেণীর কাজ আমি দেখেছি এবং ও আমার সঙ্গে কাজও করেছে। এবং ওর কাজ সম্বন্ধে আমার কী মূল্যায়ন, সেটা আমি স্পষ্ট লিখেছি ‘ছোটোলোক’ সিরিজ নিয়ে একটি লেখায়। ওই একই প্রবন্ধে আরও কিছু অনুষঙ্গ আছে, যা নিয়ে ক্রমাগত সুস্থ আলোচনা হওয়া দরকার ছিল। আবার অন্য একটা লেখায় এরকম ইঙ্গিত পেয়েছি যে, আমার কথাতেই নাকি সেই পোর্টাল লেখা নামিয়ে নিয়েছে। সত্যি যদি আমার এমন জোর থাকত, তাহলে ওই পোর্টালে কত কিছু করিয়ে নিতে পারতাম! আর সারা জীবন যা নিয়ে লড়ে গেলাম, ভুক্তভোগী হলাম, কোনও দলদাস হলাম না, সেই সেন্সর করার অনুরোধ আমি কাউকে করব? এটা যদি কেউ ভেবে থাকেন, তাহলে এতদিন কাজ করার পর এই সমাজে আমার কোনও শৈল্পিক বা রাজনৈতিক অবদান নেই বলেই মনে হয়। আর এমন কথাও বেণী বলেছে যে, আমি ওর মুখ বন্ধ করার জন্যেই ওর অভিনয়ের প্রশস্তি গেয়েছি। তাহলে বেণী যে শিক্ষা আমার থেকে পেয়েছে বলে দাবি করছে, সেটা আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ ছাড়া কিছুই না। আবার একজন প্রবীণ, পিতৃপ্রতিম মানুষ তো ছড়াও বেঁধে ফেললেন আমাকে নিয়ে। তিনি আমাকে ছোট থেকে চেনেন। ছন্দের তির্যকে আমাকে বিদ্ধ করার আগে তাঁর প্রাজ্ঞতা, অভিজ্ঞতা নিয়ে একবার আমাকে তো ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পারতেন ঘটনাটি কী?
দু’দিন আগে আমার এক থিয়েটারের সহযোগী লিখেছেন যে, সুদীপ্ত এখনও ‘বিচারাধীন’। আমি তাঁর যুক্তিপট বুঝি, মান্য করি। কিন্তু ‘দোষী’, ‘বিচারাধীন’ এবং ‘নির্দোষ’ এই শব্দগুলির পটেই সমস্যা রয়েছে। তাই বহু ক্ষেত্রে এই অস্তিত্বগুলি সম্পর্কে আমাদের দ্বিধা এবং সন্দেহ থেকেই যায়। আবার শেষ পর্যন্ত বিচারের আশায় আমাদের আদালতের কাছেই যেতে হয়। এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই ব্যাপারে আমাদের মুক্তি নেই। জনআদালতেই সব সমস্যার সমাধান হবে, এমনটা ভেবে নেওয়াটা অরাজকতা ছাড়া আর কী? যেখানে কোনও ভাষার বাঁধন নেই, নেই কোনও আচরণবিধি। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ‘বিচারাধীন’ কথাটার প্রতি কোনও মান্যতা দিইনি, কারণ বহু মানুষ সুদীপ্তর কারণে কষ্টে রয়েছেন, যন্ত্রণা পিছু করছে তাঁদের।
আমার আর এক অজ্ঞতা, সেই কারণে জিজ্ঞাস্য– এমন অনেক ঘটনা যা আইন বা আদালতের কাছে না পৌঁছলেও– ঘটেছে। বরঞ্চ সেইসব জানা-অজানা, প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া যৌন উৎপীড়নের সংখ্যাই বেশি। আমার নাট্যসহকর্মীদের কাছ থেকেই শোনা। যাঁরা ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে সুদীপ্তর ব্যাপারে প্রবলভাবে সরব, সেসব কি তাঁদের জানা নেই? তাঁদের লেখার ধারালো যুক্তি, বিশ্লেষণ, উল্লেখিত দৃষ্টান্তের প্রাসঙ্গিকতা পড়েই বোঝা যায়, তাঁরা সবটা ভেতর থেকে জানেন, খবরাখবর রাখেন এবং অবহিত। তাঁরা কী করে সেইসব মানুষকে বা ঘটনাসমূহ মেনে নিয়েছেন, বা মেনে নিচ্ছেন? সেই সব মানুষ তো অনেকেই কাজ করছেন, এমনকী প্রতিবাদও করছেন। নাকি সেখানেও একটা সেন্সরশিপ কাজ করছে? বেণী অভিনীত ‘ছোটোলোক’ সিরিজেও একজন যৌন হেনস্তার অভিযুক্ত জড়িয়ে আছে। সেটার স্বীকারোক্তি বা উল্লেখ মাত্র নেই কেন? কিন্তু এটাও বলে রাখি, আমি কাউকে আজীবনের জন্যে ব্যান করার বিরুদ্ধে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়ুন দামিনী বেণী বসু-র লেখা : তোমার শেখানো পথেই প্রশ্ন করছি, প্রতিবাদ করছি, তোমার তো খুশি হওয়া উচিত লালদা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমাকে কয়েকজন জিজ্ঞেস করেছেন– আমি কেন মেনে নিলাম, কেন মাথা নোয়ালাম? কেন সুদীপ্তকে অপসারণ করলাম? আমি ঘটনাটা একটা জেদাজেদির বা মান-সম্মানের ব্যাপার বলে দেখিনি, যে মেনে নিলাম বলে মাথা নোয়ানো হল। সত্যি কথা বলতে, নাট্যশিল্পীকে প্রতিদিন, প্রতিটা অভিনয়ে মানুষের সামনে সরাসরি দাঁড়াতে হয়। এ তো সিনেমা নয় যে, পর্দায় ছবি চলবে। প্রতিটা হাসি, কাশি, হাততালি, মোবাইল ফোন বেজে ওঠা– সবটা মঞ্চে দাঁড়িয়ে শুনতে হয়। আমার দলের অন্য কলাকুশলী যেন মুখোমুখি অপমানের সামনে না পড়েন, সেটাও ভাবতে হয়েছে।
মাঝখানে শহরে না থাকার ফলে বহু বছর নাটক করিনি। আবার কলকাতায় ফিরে এসে কয়েকটি কাজ করেছি। নাটকের সঙ্গে জড়িত আছি শৈশব থেকে নাট্যপরিবারে জন্মানোর সুবাদে। প্রায় চার দশক হয়ে গেল আমার নাট্যজীবন। কিছু কিছু প্রয়োজনীয় নাটক এবং চলচ্চিত্র হয়তো নির্মাণ করতে পেরেছি। মানুষ সে বিশ্বাস আমাকে দিয়েছে। এর পরেও যদি মনে হয় যে আমি ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছি, তাহলে আমার দুর্ভাগ্য। একজন নাট্যশিল্পীর কাজ সরাসরি মানুষের সঙ্গে। সাধারণ দর্শকই বাঁচিয়ে রাখেন একজন নাট্যশিল্পীকে। আমাকেও তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বাঁচিয়ে রেখেছেন, শিল্পবোধে জাগিয়ে রেখেছেন। তাঁদের সঙ্গে যদি সম্পর্ক নষ্ট হয়, তাঁরা যদি আমাকে ভুল বোঝেন– সেটা বড়ই বেদনার! থিয়েটারের সেট হাতে চুরুলিয়ার মাটির মঞ্চে, গড়বেতার মাচায় নাটক করেছি দশ হাজার দর্শকের সামনে। শহর বা শহরতলির মঞ্চের কথা না হয় বাদ দিলাম। দিনের পর দিন নাটক করেছি ৫০ জন দর্শকের সামনে। মাঠেঘাটে, যেখানে একটা উঁচু জায়গা আছে, দুটো আলো জ্বলে সেখানে থিয়েটার করতে করতে বড় হয়েছি। ৫০-৬০ জন অভিনেত্রী, অভিনেতা, কলাকুশলী, নেপথ্যকর্মী একসঙ্গে দূরদূরান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি। শয়ে শয়ে অভিনয় হয়েছে। মনে পড়ে না কোনও অযাচিত ঘটনা ঘটেছে। সন্তানের পরীক্ষা, বাড়ির অসুস্থতা, এমনকী বাবা-মায়ের মৃত্যু উপেক্ষা করে দেখেছি মানুষকে থিয়েটার করতে। নাটক করতে গিয়ে দিনের পর দিন স্কুলবাড়ির মাটিতে ঢালা বিছানায় সবাই একসঙ্গে ঘুমিয়েছি। কংগ্রেস আমলে থিয়েটার করতে গিয়ে বন্দুকের নল দেখেছি, বামফ্রন্ট আমলেও দেখেছি। শুনেছি রাষ্ট্রীয় হুমকি– প্রচ্ছন্ন এবং প্রকাশ্য। শেক্সপিয়ার, গিরিশ, রবীন্দ্রনাথ, ব্রেশট, দেবেশ রায়, নবারুণ ভট্টাচার্য, উৎপল দত্তকে অবলম্বন করে চেষ্টা করেছি বাংলার দর্শকের সামনে একটা শৈল্পিক বিন্যাস তৈরি করতে। সারা জীবন নিরলস ভাবে কাজ করে যাওয়ার পর কিছু মানুষ যে ভাষায় আক্রমণ করলেন, তা অকল্পনীয়। তাঁরা বোধহয় জানেনও না, দেখেনওনি আমার কোনও কাজ।
ক্রিটিক্যাল সমালোচনা আর নোংরা কটূক্তি, মুখ ভেঙানো এক জিনিস নয়। এমন কথাও কিছু মানুষ বলেছেন যে, এই নাটক বন্ধ করা দেওয়া হোক। শুধু তাঁদের মতকে সমর্থন করছেন বলেই এরকম ভয়ংকর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীদের তরফে কোনও প্রতিবাদ হল না। তাহলে ‘স্বৈরতন্ত্র’ কথাটার মানে কী? নাটক বন্ধ করে দিতে হবে? নানা দ্বিমত সত্ত্বেও যেসব স্বরের একসঙ্গে মিলে প্রবল একটি নির্ঘোষ সৃষ্টি করার দরকার ছিল, তাঁরা নিজেরাই পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করছে, পরস্পরকে ব্যঙ্গ করছে, অপমান করছে। তাই মনে হয়, এমন একটা পরিসর তৈরি হয়েছে যে, এখানে আর সম্মান নিয়ে থাকা যাবে না, শুধুই নোংরা অপবাদ আর কটূক্তি ধেয়ে আসবে। তাহলে এই দীর্ঘ নাট্যজীবনের ইতি টানতে চাই। কলকাতায় আর থিয়েটার করার পরিস্থিতি নেই। আমি যখন নাটক করতে পারছিলাম না অন্য শহরে থাকার কারণে, তখন আমার পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই আমার কাছে অভিযোগ করেছে এই নিয়ে। আমি বলতাম আমার না কলকাতায় থিয়েটার করতে আর ইচ্ছে করে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাটক। ভেতর থেকে অস্থির করে তোলে। আবার কলকাতায় ফিরে এসে শুরু করলাম। ২৫টির বেশি নাটক, ১০টি ছবি নির্মাণ করেছি, কখনও এই সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়নি। এরপরেও আমি যদি এত মানুষের নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়াই, তাহলে সেটা হবে খুবই দুঃখের। তাই ক্রমাগত বুঝছি, এখানে আমার আর থিয়েটার করা বোধহয় মানায় না।