কর্নাটকের ভোটের পর মোদি বিরোধী হাওয়া দেশে প্রবল হয়েছে। মণিপুর ও হরিয়ানার দাঙ্গা শিক্ষিত ভোটারদের আহত করেছে। এঁদের একটা অংশ মোদির সমর্থক ছিলেন। মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বে জর্জরিত গরিব ও সাধারণ মানুষ। শুধু জাতীয়তাবাদের মতো বিমূর্ত বিষয় দিয়ে যে কাজ হবে না, তা বুঝতে পারছেন বলেই মোদি চন্দ্রযানের সাফল্যের হাওয়া ধরে রাখতে দ্রুত রান্নার গ্যাসের দাম কমিয়ে দিলেন। এটা তাঁর সংস্কারী নীতির পরিপন্থী সিদ্ধান্ত। কিন্তু মুম্বইয়ে ইন্ডিয়া জোট বসার আগে নজর ঘোরাতে মরিয়া মোদি।
রাজনীতি যদি জাত ও ধর্মকে ঘিরে আবর্তিত হয়, তাহলে ভোটে জোটের পাটিগণিত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত বিহার ও উত্তরপ্রদেশের একাধিক ভোটে এটা প্রমাণিত। গোবলয়ের রাজনীতিতে জাত-ধর্ম সামনে চলে এলে অন্য সব ইস্যু গৌণ হয়ে যায়। জাতের পাটিগণিত ঠিকঠাক মেলাতে পারলে এমনকী, ধর্মের আবেগও পিছু হঠে। নয়ের দশকে প্রবল রাম মন্দির হাওয়াতে যখন মুলায়মের দল, মায়াবতীর দল ও কংগ্রেস একই সরলরেখায় এসেছে তখন ওই পাটিগণিতের সামনে বিজেপি দাঁড়াতে পারেনি। অন্যদিকে বিহারে যখন বিজেপির হিন্দু উচ্চবর্ণের ভোটের সঙ্গে নীতীশের অতি পিছড়ে বর্গ ও রামবিলাসের দলিত-পাসোয়ান ভোট যোগ হয়েছে তখন লালু তাঁর মুসলিম-যাদব ভোটব্যাঙ্ক দিয়ে দুর্গ সামাল দিতে পারেননি। জাত ও ধর্মের সমীকরণে চলা গোবলয়ের রাজনীতিতে হয়তো সবসময় দুইয়ে দুইয়ে চার হয়, কিন্তু বাকি ভারতের চিত্রটা কতটা এইরকম, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বহু রাজ্যের ক্ষেত্রেই ভোটব্যাঙ্কের পাটিগণিতের চেয়ে জোটের রসায়নটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিরোধী ইন্ডিয়া জোটকে সেটাই মাথায় রাখতে হবে।
আপাতত ইন্ডিয়া জোটে পাটিগণিতটা গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। কোন রাজ্যে কতগুলি দল জোটে শামিল হচ্ছে, সেই অঙ্কে জোর দেওয়া হচ্ছে। দলগুলির মতাদর্শের দিকটি উহ্য থাকছে। সেটি কতটা বিবেচকের মতো কাজ হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। জাত বা ধর্মের ভিত্তিতে পরিচালিত দলগুলি তাদের সমর্থকদের ভোট সহজে জোট সঙ্গীকে ট্রান্সফার করাতে পারে। এটা বিহার ও উত্তরপ্রদেশের অভিজ্ঞতা বলে। কিন্তু মতাদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত দলগুলি বা আঞ্চলিক আশা-আকাঙ্ক্ষার নিরিখে গঠিত দলগুলির সমর্থক ও ভোটারদের ক্ষেত্রে ভোট ট্রান্সফারের রসায়ন জটিল। এটা আমরা নিজেদের রাজ্যেই সবসময় টের পাই। প্রায় এক দশক সিপিএম ও কংগ্রেস রাজ্যে জোট করে থাকলেও তাদের নিজেদের মধ্যে ভোট ট্রান্সফারের রসায়ন এখনও ঠিকঠাক কাজ করে না। ইন্ডিয়া জোটে কংগ্রেস, তৃণমূলের সঙ্গে সিপিএম থাকলেও রাজ্যে একা চলার বার্তাই দিয়ে রেখেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এইরকম পরিস্থিতি দিল্লি, কেরল, পাঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীর, তেলেঙ্গানা-সহ আরও কিছু রাজ্যে রয়েছে। জোটের রসায়নে যদি গোড়া থেকেই এই গন্ডগোল ঘটে যায়, তাহলে কি সেই জোটকে লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির বিকল্প হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে গোটা দেশের ভোটারদের সামনে তুলে ধরা যাবে? জোটের রসায়ন ঠিক করতে গেলে ২৭টি দলকেই বিজেপি ও মোদির বিরুদ্ধে একসুরে কথা বলতে হবে। যেমন সদ্য সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের বিতর্কের সময় হয়েছে। পুরনো শত্রুতাকে ভুলে দলগুলিকে পরস্পরকে আক্রমণও বন্ধ রাখতে হবে। তাতে একটা ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি হবে। ভোটারদের মধ্যেও আস্থা আসবে। যেটা ভোট ট্রান্সফারের সহায়ক হতে পারে। কিন্তু সেটা কি ইন্ডিয়া জোটের দলগুলির পক্ষে বাস্তবে করে দেখানো সম্ভব?
বিজেপি যে কোনও মূল্যে ইন্ডিয়া জোট ভাঙতে তৎপর। তাদের হাতিয়ার মহারাষ্ট্র মডেল। শিবসেনার পর এনসিপিকে তারা ভাঙতে সফল হয়েছে। ইন্ডিয়া জোটে শরদ পাওয়ারের উপস্থিতি এখন নামমাত্র। তিনি ভাইপো অজিত পাওয়ারের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে চলেছেন। বিজেপির নিশানায় আছেন নীতীশ কুমার ও অরবিন্দ কেজরিওয়ালও। গোড়ায় যতটা সক্রিয় ছিলেন এখন জোট নিয়ে অনেকটা উদাসীন নীতীশ। তাঁকে নিজের মুখ্যমন্ত্রিত্বের চেয়ারের কথা ভাবতে হচ্ছে। কারণ জোটের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাহুল গান্ধীর নাম ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিজেপির সঙ্গে থাকলে নীতীশের পাটনার কুর্সি নিরাপদ হতে পারে। কেজরির আপের ভূমিকা সবসময় রহস্যজনক। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তারা কংগ্রেসের বিকল্প হতে চায়। কেজরির পক্ষে কতদূর কংগ্রেসের নেতৃত্ব স্বীকার করা সম্ভব, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। তাই ইন্ডিয়া জোটের সামনে এখনও কাঁটা অনেক। প্রথমত, আগামী ছ’মাস জোটকে অটুট রাখতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, ভোটারদের আস্থা আনার জন্য জোটের রসায়ন তৈরি করতে হবে। রসায়ন তৈরির জন্য যৌথ আন্দোলন ও প্রচার দরকার। যে কাজটা ভিন্ন মতাদর্শের দলগুলির পক্ষে করা সহজ নয়।
মুম্বই বৈঠক থেকে ইন্ডিয়া জোটের ভবিষ্যৎ আরও স্পষ্ট হবে। কর্নাটকের ভোটের পর মোদি বিরোধী হাওয়া দেশে প্রবল হয়েছে। মণিপুর ও হরিয়ানার দাঙ্গা শিক্ষিত ভোটারদের আহত করেছে। এঁদের একটা অংশ মোদির সমর্থক ছিলেন। মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বে জর্জরিত গরিব ও সাধারণ মানুষ। শুধু জাতীয়তাবাদের মতো বিমূর্ত বিষয় দিয়ে যে কাজ হবে না, তা বুঝতে পারছেন বলেই মোদি চন্দ্রযানের সাফল্যের হাওয়া ধরে রাখতে দ্রুত রান্নার গ্যাসের দাম কমিয়ে দিলেন। এটা তাঁর সংস্কারী নীতির পরিপন্থী সিদ্ধান্ত। কিন্তু মুম্বইয়ে ইন্ডিয়া জোট বসার আগে নজর ঘোরাতে মরিয়া মোদি।
আগামি ছ’মাস এই স্নায়ুযুদ্ধ চলতেই থাকবে। মোদি একটার পর একটা তাস খেলবেন। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, দণ্ডনীতির সংস্কার, অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধন, বাজেটে আরও কিছু উপঢৌকন– এইসব হতেই থাকবে। ইন্ডিয়া জোটের চ্যালেঞ্জ কিন্তু এরই মাঝে মোদি বিরোধিতার রসায়নটাকে তৈরির চেষ্টা করে যাওয়া।